ঘুনপোকা

ঘুনপোকা
মাইশা ঘরে দরজা লাগিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। মা এসে দরজা ধাক্কাতে লাগলেন। সে দরজা খুললনা। ওপাশ থেকে বড় চাচীর গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে মাইশার মাও দু চার কথা শুনিয়ে দিচ্ছেন। কানে বালিশ চাপা দিয়ে মাইশা বিছনায় পঠে রইল। সন্ধ্যায় বাইরের বসার ঘরে মিটিং বসল। মাইশার বাবা মাথা নিচু করে বসে আছেন। বড় চাচা গলা খাকারী দিচ্ছেন। মা মাইশার কাঁধে হাত রেখে মেয়েকে একরকম লেপ্টে রেখেছেন নিজের সাথে। বসার ঘরের যে দরজায় মাইশা দাঁড়ানো তার অপর পাশে মাইশার বড় চাচী তার একমাত্র আদরের মেয়ে নিশানী কে পাশে নিয়ে বসে আছেন সিঙ্গেল সিটের সোফাটায়।
কথা শুরু করলেন বড় চাচা, দেখ মাইশার মা মাইশার বয়স কত হবে এগারো পেরিয়ে বারো? নিশানী তেরয় পা দিল বলে। দু বোনের ভাব ভালবাসা যেমন আছে দুশমনীও তার কম কিছু নেই। তো ওদের তো বয়স কম। বুদ্ধিও কম তা তুমি কি মনে করে বোধ বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে নিশানীর মায়ের সাথে ঝগড়া করতে এগিয়ে গেলে? সম্পর্কে সে যে তোমার বড় জা সেটা নিশ্চয়ই তুমি ভুলে যাওনি? মাইশার মা বেশ গলা চড়িয়ে বললেন, বেয়াদবি নিবেন না ভাইজান, বড় বোনকে ছোট বোনের প্রতি উস্কে দেওয়াটাকে আমি মোটেও সমর্থন করতে পারিনি। আহ্ মাইশার মা মুখে মুখে তর্ক করনা। মাইশার বাবা ধমকে উঠলেন।
নিশানীর মা মুখ খুললেন, ও আচ্ছা আমি উস্কে দেই না? আর তুমি যে রাত দিন মেয়েকে কান পড়া দাও যেভাবেই হোক নিশানীর চাইতে ভাল রেসাল্ট করতে হবে,ওর চাইতে সুন্দর জামাটা পরতে হবে, যে ভাবেই হোক আমার মেয়েকে টপকাতে হবে সে কিছুনা? মাইশার মা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল, বেশ করেছি বলেছি। মেয়ের ভালর জন্যই তো বলেছি আপনার মত তো আর মেয়েকে বোনের চাইতে খারাপ রেসাল্ট করার অপরাধে রাতের ভাত বন্ধ করে রাখিনি, মাইশা কেন ভাল করল তুই কেন পারলিনা,তোর বাবা এত বড় চাকুরী করে, তোকে এত দামী দামী কাপড়, খেলনা কিনে দেই তবে ওমন বাউন্ডুলে বাপের মেয়ে কিভাবে তোকে টপকে যায় বলে বলেতো আর মেয়ের মাথা খাইনা।
দেখেছেন নিশানীর বাবা,কেমন বেয়াদবের মত মুখে মুখে তর্ক করছে,আগেই বলেছি আপনাকে চলেন আমাদেরকে নিয়ে চলেন আপনার কাছে,নিজে শহরে থেকে মেয়েটাকে এই মফস্বলের নোংরা পরিবেশে রেখে কি শিক্ষাটাই না দিচ্ছেন ছিঃ ছিঃ ছিঃ নিশানীর বাবা উঠে দাঁড়িয়ে গা ঝাড়া দিলেন,নারে ছোট এ বাড়ীর হাওয়াটা বড্ড বদলে গিয়েছে। উত্তর দক্ষিনের বায়ু একে ওপরকে বিপরীতে ঠেলতে ঠেলতে মাঝ থেকে যে নিজেরাই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে এ কথা কাদেরকে বোঝাব। নিশানীর মা, গুছিয়ে নিও তিনদিন বাদে রওনা দিব। তোমাদেরকে আর এখানে রাখবনা। তোমরা যে যার মত করে দূরে গিয়ে ভাল থেক।
মাইশা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, মা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। মাথার আঁচলটা ফেলে চুলায় চা বসাতে যায়। মাইশা বারান্দার দানবাকৃতির পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আনমনে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ডান বেনীটা পেঁচাতে থাকে।
“কে জানত শেষ পর্যন্ত জল এতদূর গড়াবে। কি থেকে যে কি হল। কেন যে রেজাল্ট টা পেয়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করে নিশানীকে খোঁচাটা দিতে গেলাম। প্রথমে নিশানী চুপচাপই ছিল মুখটা ভার একবারো আমার মনে হলনা ওর মনটা খারাপ কিনা আমার শুধু মনে হচ্ছিল আমি পেরেছি,আমি বৃত্তি পেয়েছি। নিশানীকে যে বড় চাচী এত এত মাস্টার দিয়ে পড়াল কই তাওতো ও পেলনা, চাচীর কাছে তো মা বড় গলায় বলতে পারবে আমার মেয়ে বৃত্তি পেয়েছে। বড় চাচী যে নানান কথায় আমার বাবা কম শিক্ষিত বড় চাচার মত বড় অফিসে চাকিরী করেনা বলে মাকে উঠতে বসতে কথা শোনায় তার তো মা এবার জবাব দিতে পারবে? মা যে এত দিন আমার কাছে শুধু এটাই চেয়েছে। কিন্তু কে জানত এ খবরটা দিতে গিয়েই বিপত্তিটা ঘটবে।
কোন কথা না বলেই নিশানী এত জোরে ধাক্কা দিল তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলাম যতটানা ব্যাথা পেলাম তার চাইতে দ্বিগুন অপমানে আমিও তড়িৎ গতিতে উঠে ওকে জাপটে ধরলাম ও ব্যাথায় এমন চিৎকার করে উঠল অথচ আমি ওকে ব্যাথাই দেইনি। ছেড়ে দিতেই দেখলাম ওর গালে আঙ্গুলের দাগ নিশ্চয় চাচী আমার রেজাল্টের খবর শুনে ওকে আচ্ছা মার দিয়েছে তাই ও পুকুর পাড়ে একলা ওমন ভর দুপুরে বসেছিল। অথচ গতকাল বিকেলেও আমরা একসাথে ইচিং বিচিং খেললাম। কই ওতো খেলায় হেরেও মন খারাপ করলনা। হাত ধরা ধরি করে কেমন দু ‘বোন বাড়িতে এলাম। সন্ধ্যায় এসে নিশানী বড় চাচার আনা দু প্যাকেট বিস্কিট দিয়ে গেল, কালো রঙের ওগুলায় নাকি চকলেট দেওয়া বললাম, দু প্যাকেট কেন দিলি? বলল, কেন ছোটর জন্য। ওনা আমাদের একমাত্র ভাই। আমি হেসে বললাম ওর তো মাত্র দু বছর ওকি এত বড় এক প্যাকেট খেতে পারবে? কথা শেষ না হতেই বড় চাচীর ডাক পেয়েই নিশানী দৌড়ে পালাল।
গেল ঈদে আমার আর নিশানীর জামা কিভাবে যেন মিলে গেল। বড় চাচা কেমন জামা কিনে আনে শহর থেকে যে গ্রাম থেকেও আমরা সে জামা পরতে পারি বলে বড় চাচী জামাটা ছুড়ে ফেলে। ঈদের দিন নিশানী আমাদের ঘরে সেমাই পায়েশ খেতে এল নতুন আরেকটি জামা পরে। বললাম কই সেই জামাটা পরলিনা আমাদের দুজনকে তাহলে একই রকম লাগত। নিশানী কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,ওসব জামা কেন পরব? তুই আর আমি একই জামা পরলে চলে? তোর বাবা আর আমার বাবার টাকা কি সমান? আমার খুব কষ্ট হল,গলার কাছে দলা পাকিয়ে থাকা কান্নাটাকে গিলে ফেললাম,ভয়ে ভয়ে জানালায় উঁকি দিলাম নাহ্ মা শোনেনি এই রক্ষে।”
তিনদিন পর এক কুয়াশা ঢাকা সকালে বড় চাচা গাড়ী ভাড়া করে আনলেন। মাইশা ঘুম জড়ানো চোখ কচলাতে কচলাতে উঠানে গিয়ে দাঁড়াল। সব মালামাল তোলা শেষে নিশানী গাড়ীতে উঠবার আগে এক দৌঁড়ে এসে মাইশার হাতে একটা চিরকুট গুজে দিয়ে গেল। বোকার মত ওদের চলে যাওয়া দেখল মাইশা। পূবের ফাঁকা ঘরটার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এত বড় বাড়ীটায় আজ বড্ড একা লাগছে তার। কি এক নিস্তব্ধ নিঃসঙ্গতা। মাইশার কেমন ঘোর লাগে,” আরে তাইতো এখতো আর তিন বেলা মা চাচীর চিলাচিল্লি নাই, নিশানীর আগে আগে খাওয়া, ঘুম, পড়া রেডি করার তাড়া নেই, মায়েদের বকা খাবার ভয় নেই।
আর নেই আমার সঙ্গী নিশানী,আমার বোন নিশানী। পুকুরে নেমে সাঁতরে ওপারে যাওয়ার প্রতিযোগীতা নেই, আমাদের পুতুল বিয়ের আয়োজন নেই, স্কুল থেকে হেলে দুলে ছড়া গান গাইতে গাইতে ঘরে ফেরার সঙ্গী নেই, টিফিন ভাগা ভাগী করারও আর কোন প্রয়োজন নেই। ” কার সাথে প্রতিযোগীতায় নেমে কাকে হারিয়ে কে জিতে যেতে চায় সে প্রশ্নের ও কোন উত্তর নেই। বছর কুড়ি পরে নিশানী মাইশার বিছানায় গড়াতে গড়াতে বলে, মেয়ে দুটো ঘুমলো কিনা দেখে আয় তো? মাইশা ফোন টিপতে টিপতে বলে, ঘুমবে বলে মনে হয় তোর কতদিন বাদে এলি বলত? রাত তিনটায় গিয়েও দেখবি দু বোনে ফিসফিসিয়ে গল্প করছে। এবয়সে যে কি এত কথা থাকে ওদের কি জানি?
নিশানী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ইস্ আমাদের ছেলেবেলাটাও যদি এমন হত! ভাই বোনের ভালবাসায় পরিপূর্ণ। তুই আমিও যদি পারতাম একে অন্যের সফলতায় লাফিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরতে। একে অন্যের কষ্টে বুকে টেনে নিতে।
মাইশার চোখ লাল হয়ে আসে, সেদিন যদি তুই চিরকুট টা না দিতি তবে কি আমরাও পারতাম আমাদের সন্তানদের এত সুন্দর শৈশব দিতে??? মাইশা সেদিন স্কুলে গিয়ে নিশানীর দেওয়া চিরকুটটা খুলে। অশ্রু সিক্ত সে চিরকুটায় গোটা গোটা অক্ষরে নিশানী লিখেছিল,” আমি চিঠি দিব স্কুলের ঠিকানায় তুই ও আমার নতুন স্কুলের ঠিকানায় চিঠি দিবি, বল দিবি তো? ক্ষমা করে দিস আমাকে বোন, অনেক ভালবাসি তোকে।”
পৃথিবীর এ এক অদ্ভুত মধুরতম সম্পর্ক যার খোঁজ অনেকেই করেনা। একান্নবর্তী পরিবার ছেড়ে একক পরিবারে বেড়ে ওঠা সন্তানেরাও পারে দূরে থেকেও একে অন্যের পাশে থাকতে, তুই এত চিন্তা করছিস কেন আমি আছিতো। এই একটা কথা পারে দূর দেশে থাকা অসহায় কোন ভাই/ বোনের মনটাকেও মুহূর্তে প্রফুল্ল করে দিতে,তার আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে দিতে। পারিবারিক সুশিক্ষাই পারে সন্তানদেরকে একটি সুস্থ সুন্দর কৈশোর দিতে। মাইশা, নিশানীর মায়েরা যেটা পারেনি সেটা পেরে দেখিয়েছে তারা নিজেরা। অসুস্থ প্রতিযোগিতা কি কখনো পারে স্বাভাবিক মানুষ তৈরী করতে, একটা সুস্থ প্রজন্ম উপহার দিতে?
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত