দু’জন মানুষের এক স্বত্তা

দু’জন মানুষের এক স্বত্তা
‘এক্সকিউজ মি! একটু পানি হবে?’ মেয়েটা যখন কেবিনে প্রবেশ করলো তখন আমি তাকে বিশেষ খেয়াল করিনি। কে এলো কে গেল এসব নিয়ে ভাবার সময় আমার খুব একটা নেই৷ আমি মনোযোগ দিয়ে ফেসবুক ব্রাউজ করছিলাম। ঠিক তার কিছু সময় পর মেয়েটা কেমন হাঁপিয়ে আসা স্বরে কথাটা বলল। তখনই আমি মেয়েটাকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম।
চোখ ভরা কাজল নিয়ে মেয়েটার ক্লান্ত চেহারা আমার দিকে ফিরে আছে৷ মেয়েটাকে কী চমৎকার লাগছে! কারো ক্লান্ত চেহারা এতো দারুণ হয়? ঠিক সেই মূহুর্তে আমার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো৷ কেমন শিরশিরে একটা অনুভূতি হলো আমার। আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম বোকার মতো৷ সে আশ্চর্যরকম সুন্দরী এক রমনী৷ এমন সুন্দরী কন্যা এর পূর্বে দেখেছি বলে মনে হয় না। অদ্ভুত! অসাধারণ! আমার এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে মেয়েটা বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কেমন অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকলো। আমি দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলাম। নিজের ব্যাগ থেকে দ্রুত পানির বোতলটা বের করে মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিলাম। বললাম,
-সরি! আসলে মেয়েটা হাসলো। অমায়িক হাসি৷ বলল,
-ইটস ওকে! থ্যাংকস ফর ইউর ওয়াটার!
আমি একটু হাসি। লজ্জাময় হাসি৷ আশ্চর্য! এটা কেমন গাধামি করে ফেললাম? এভাবে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে তাকে বিভ্রান্ত করার কী প্রয়োজন ছিল? মেয়েটা এখন কী ভাববে? কেমন ভাববে? আমাকে আবার খারাপ ছেলে ভাববে না তো৷ মেয়েটা পানি খেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বলল,
-আসলে একদম মুখোমুখি সময়ে চলে এসেছি৷ ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে এমন একটা সময়৷ পানি কেনার সময়টুকু পর্যন্ত পাইনি৷ সে জন্যেই আপনার কাছ থেকে চাইলাম।
-আচ্ছা সমস্যা নেই৷ আপনি বোতলটা রেখে দিন৷
-না না! তার প্রয়োজন নেই৷ আপনি রেখে দিন৷ আপনার পানির প্রয়োজন হলে কী করবেন! আমি হাসলাম। বললাম,
-আমার কাছে একটা এক্সট্রা আছে৷ ইউ ক্যান টেক দিস! মেয়েটা মৃদু হাসল। বলল,
-থ্যাংকিউ সো মাচ! এরপর একটু থেমে আবার বলল,
-থ্যাংক গড যে আপনার মতো একজন রেস্পন্সিবল মানুষ পেয়েছি৷ তা না হলে আমি তো বেশ ভয়েই ছিলাম। কেবিনে কে না কে থাকে! সে মানুষটা আবার কেমন হয়! বুঝেনই তো! এক একটা মেয়ে। আমি বিস্বস্ত হাসি দেই। বলি,
-ইউ ক্যান ট্রাস্ট মি। এটা সত্য যে মেয়েদের জন্যে আসলেই এক ট্রাভেল করাটা ডিফিকাল্ট। তাদের একা বের হওয়াটা ঠিক উচিৎ না৷ কে জানে কখন কী হয়ে যায়!
-এসব বলে বলে মেয়েদের আসলে পিছিয়ে রাখা হয়৷ ভিক্টিম আমরাই হচ্ছি আবার আমরাই নিজেদের গুটিয়ে রাখবো? এটা কেমন কথা? আমাদেরও তো সখ আহ্লাদ আছে। ঘুরাঘুরির ইচ্ছে আছে৷ কী? থাকতে পারে না?
-হ্যাঁ, তা অবশ্যই পারে…
-তাহলে? তাহলে কেন তাদের একা বের হওয়া ঠিক হবে না? বলুন কেন?
-আমি আসলে সেটা মিন করিনি। আমি কেবল বলতে চেয়েছি কেউ একজনকে নিয়ে বের হলে ভালো হতো! ফর সেফটি একচুয়ালি। মেয়েটার মুখটা চট করে শুকিয়ে গেল। বলল,
-কাকে নিয়ে বের হবো বলুন? কে আছে আমার? আমার বুকের ভেতরটা কেমন জানি করে উঠে! মেয়েটা এভাবে বলছে কেন? তার কি কেউই নেই? বলি,
-আপনার কি কেউই নেই?
-আছে। একজম পঙ্গু মা আছে আমার। এছাড়া এই পৃথিবীতে কেউই নেই আমার। আমার মনটা চট করেই খারাপ হয়ে গেল। আহারে! কী অসহায় মেয়েটা! মেয়েটা কিছু সময় মাথা নিচু করে রাখে। কথা বলে না আর। হঠাৎ চটপট করতে থাকা মানুষটা এমন নিস্তেজ হয়ে গেলে খারাপ দেখায়৷ মনের কোণে মায়ার সৃষ্টি হয়৷ আমি কী বলবো ভেবে পেলাম না৷ মেয়েটি চুপচাপ বসে থাকে। ব্যাগ টেনে কাছে নেয়৷ কী জানি খোঁজে৷ আমি কিছু ভেবে না পেয়ে বলি,
-আপনার কী মন খারাপ হয়েছে? মেয়েটা মলিন মুখ হাসে। বলে,
-ব্যাপার না৷ আই ক্যান ম্যানেজ ইট! আমি মৃদু হাসি৷ মেয়েটা ব্যাগ হাতড়ায়৷ আমি বলি,
-নাম কী আপনার? মেয়েটা মাথা তুলে তাকায়। বলে,
-অরিত্রি। অরিত্রি চৌধুরী। সবাই আদর করে অরি ডাকে। আপনার নাম কী?
-অনিম। অনিম হাসান৷ আচ্ছা, আমি কি আপনাকে অত্রি বলে ডাকতে পারি? মেয়েটা মৃদু হাসে। বলে,
-তা পারেন৷ তবে আপনার নামটা সুন্দর। কেমন মায়া লাগে নামটা শুনলে। আমি চট করেই বলে ফেলি,
-আপনি এবং আপনার নাম দুটোই সুন্দর। মায়াবী৷ ঘোর ধরানো৷ আমার খুব পছন্দ হয়েছে৷ মেয়েটা চট করেই লজ্জা পেয়ে গেল। মাথা নিচু করে হাসল। স্বল্প স্বরে বলল,
-থ্যাংকিউ।
আমি হাসি৷ মৃদু লজ্জা পাই। তার দিকে তাকাই৷ লজ্জায় অত্রির গাল কেমন লালছে হয়ে আছে৷ তাকে আরো অসাধারণ লাগছে। কী চমৎকার একটি মেয়ে! এই মেয়েটিকে আমার চাই৷ অবশ্যই চাই৷ একে ছাড়া বাঁচাটা আসলে ইম্পসিবল। অত্রি বেশ লজ্জা পেল। খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। আমি সেটা সামলে নিতে বললাম,
-যাচ্ছেন কোথায়?
-ঢাকায়। আপনি?
-আমিও। পড়াশোনা?
-ঢাকা ইউনোভার্সিটি। ইংরেজি নিয়ে পড়ছি। থার্ড ইয়ার৷ আপনার?
-আমি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে আছি। ফোর্থ…
-আপনি ডাক্তার?
-এখনও সম্পূর্ণ হতে পারিনি। পড়ছি আরকি।
-বেশ তো! আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো। টিএসসিতে আসা হয়?
-হ্যাঁ। প্রায়ই আসি।
-গুড। আমরা একদিন মিট করবো। আপনাকে মোমিন মামার চা খাওয়াবো। অস্থির চা বানান তিনি। আমি হাসি। বলি,
-আচ্ছা।
তারপর চুপ করে থাকি৷ মেয়েটাও চুপ করে থাকে৷ কিছু সময় পর মনে হয় আরেহ, একটা সুযোগ তো ছিল। মেয়েটার নাম্বার নেয়া যেতো৷ কিংবা ফেসবুক আইডি। টিএসসিতে এলে তাকে পাবো কীভাবে? শিট! কী ভুলটা করলাম। মেয়েটাকে কি আবার জিজ্ঞেস করবো? নিজ থেকেই চাইব? কী ভাবে আবার! ইশ কী গাধা আমি! মেয়েটা এতো দারুণ একটা সুযোগ করে দিলো অথচ আমি সেটা হাত ছাড়া করে ফেললাম? ধ্যাত৷ আস্ত একটা বেকুব আমি। নিজের উপর রাগ উঠতে থাকলো। তবে সেটা বিশেষ প্রকাশ করলাম না৷ মেয়েটাকে ডাকলাম,
-অত্রি? অত্রি বই পড়ছে৷ হুমায়ূন আহমেদের ‘অপেক্ষা’। সে মুখের উপর থেকে বু সরিয়ে বলে,
-বই পড়ার সময় আমি একদমই কথা বলি না। প্লীজ ডোন্ট মাইন্ড। এটা আমার অভ্যাস। আমি হাসলাম। বললাম,
-ইটস ওকে। মেয়েটা পড়ায় ডুব দিলো। আর আমি তাকে নিয়ে ভাবনায় ডুব দিলাম। কিছু মানুষ এমন হয়! চট করেই মানুষের সাথে মিশে যায়৷ এমন ভাবে মিশে যায় যে এদের খুব আপন মনে হয়৷ অত্রি মেয়েটাও ঠিক তেমন। আমি পাঁ উঠিয়ে বসলাম। নিজের ম্যাক বুক ল্যাপটপটা বের করে কানে হেড ফোন গুঁজে ‘লাস্ট ট্রেন’ মুভিটা দেখা শুরু করলাম।
সময় গড়িয়ে যায়। ট্রেন আপন মনে চলতে থাকে। রাত হয়। গভীর অন্ধকার চারপাশের শূণ্য আলোটাকেও গিলে খায়৷ নিকষ অন্ধকার কেবল চারপাশে। অত্রি ডিনার সাথে করেই নিয়ে এসেছে৷ আমার কাছে শুকনো নাস্তা ছিল। আমি সেগুলো দিয়ে সেরে ফেললাম। মেয়েটা আমাকে খুব সাধলো। কিন্তু আমি তার খাবার থেকে এক ফোটাও খেলাম না৷ ইচ্ছে হয়নি আসলে। রাতের দিকে অত্রির সাথে গল্প বেশ জমে গেল। তার জীবন, জীবনের উত্থান-পতন নিয়ে বিষদ আলোচনা হলো৷ তার বাবা কিভাবে এক্সিডেন্টে মারা যান, তার আম্মু কিভাবে পঙ্গু হয় এসব বলতে গিয়ে মেয়েটা কেঁদে ফেললো। তার কান্নায় বেশ আবেগী হয়ে পড়ি আমি৷ আমার চোখেও মৃদু জল জমে। ইমোশনাল মূহুর্ত দূর করতে আমি বললাম,
-এই মূহুর্তে এক কাপ চা হলে বেশ হতো! অত্রি উঠে বলল,
-আরেহ! আমার কাছে চা আছে তো! চলেন শেয়ার করি। শোনেন, আমি হচ্ছি চায়ের পোকা৷ একবেলা চা না পেলে আমি পাগল হয়ে যাই। হিহিহি। আমি হাসি। বলি,
-সেইম হেয়ার৷ আপনার সাথে আমার অনেক কিছুই মিলে যায়৷ অত্রি কিছু বলে না৷ হাসে কেবল। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই৷ বেশ অন্ধকার বাইরে৷ অত্রির সাথে আরো কিছুক্ষণ গল্প হয় আমার। কথাবার্তা বলে শুয়ে পড়ি আমি। দ্রুত ঘুমানোর অভ্যাস আমার৷ অত্রিও ঘুমিয়ে গেলো৷ তারও নাকি দ্রুত ঘুমানোর অভ্যাস৷ আমি খুব অবাক হই৷ আশ্চর্য ব্যাপার! একটা মেয়ের সাথে কীভাবে আমার এতো মিলে যেতে পারে? কীভাবে? আচ্ছা, অত্রি কি আমার জন্যেই সৃষ্টি হয়েছে? কেবল আমার জন্যে? মেড ফর ইচ আদার? আমি কি তাকে ভালোবাসি? খুব পছন্দ করি? কে জানে!
খুব সকাল সকাল ঘুম ভাঙ্গে আমার। কোথাও পাখি ভীষণ ডাকছে। কী মন্ত্রমধুর কণ্ঠ! আচ্ছা এই পাখিটি কি অত্রি? তার কণ্ঠে কি সে গান গাচ্ছে? আমি চোখ মেললাম। সকালের তীব্র আলো চোখে পড়ায় চোখ ঠিক মেলতে পারছিলাম না৷ চোখ দুটো খানিকটা কচলে নিয়ে আমি তাকালাম। স্পষ্ট সুন্দর নীল আকাশ৷ দুটো চিল আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে! কী চমৎকার দৃশ্য। আমি কিছু সময় সেদিকে তাকিয়ে থাকলাম। বিছানাটা কেমন শক্ত মনে হলো৷ রাতে তো এমন মনে হয়নি! ভালো করে তাকাতেই দেখলাম আমি মাটির উপর শুয়ে আছি৷ আশ্চর্য! আমি এখানে কেন? এখানে কী করছি? আল্লাহ! ট্রেন এক্সিডেন্ট করলো নাকি? অত্রি? অত্রি কই? মেয়েটা কই গেল? কী জানি হয়েছে ওর? কোথায় ও? আমি পাগলের মতো হয়ে যাই৷ উঠে বসে এদিক সেদিক তাকাই৷ কেউ নেই! কোথাও কেউ নেই। আমি কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারি না৷ মাথা ঘুলিয়ে যায়৷ দূর দূরে কেউ নেই! গাছপালা আর ঝোপঝাড়ে ভরপুর।
ঠিক সেই মূহুর্তে আমার চোখ যায় ডান হাতের উপর। হাতের অনামিকা আঙ্গুলে একটা কাগজ সুতা দিয়ে বাঁধা৷ আমি দ্রুত সেটা খুলি। কাগজে সুন্দর করে ইংরেজি লেখাটা পড়ি, ‘ডোন্ট জাজ এ গার্ল বাই হার ফেস।’ ঠিক সেই মূহুর্তে আমার দৃষ্টি আমার তলপ্রদেশের দিকে যায়৷ আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি আমি সম্পূর্ণ উলঙ্গ! আমার মাথায় বাজ পড়ে। আমি চিৎকার দিয়ে বলি, “ওরে বকুল, ওরে বকুল, তোরে ধরা দিছে। ওই পাক্না মাইয়া তোরে ধরা দিয়া চইলা গেছেরে। তোর সব নিয়া গেছে। স্বল্প দামি জাঙ্গিয়াটাও অন্তত তলদেশে রেখে যায়নি৷ এটা কী হলো রে বকুল। কী হলো? ক্যাম্নে হলো? এই নিষ্পাপের মতো দেখতে মাইয়াটা তোর লগে ক্যাম্নে এরাম খেল খেলতে পারলো। ধোকা! ধোকা দিল মাইয়াটা৷ আমি বকুল মানুষরে ধরা দেই৷ আর এক মাইয়া কি না আমারে ধরা দিয়া গেল!’ আমি কাঁদি৷ শব্দ করে কাঁদি৷ দ্বিগুণ জোরে চিৎকার দিয়ে বলি,
-আল্লাহ? তোমার কাছে বিচার চাই৷ তোমার কাছে বিচার চাই৷ মাইয়াটা আমার সব নিয়ে গেছে। সব! তাতে আমার আফসোস নেই৷ কারণ ওই সব কিছুই আমার না৷ চুরি করে নেয়া৷ কিন্তু মাবুদ, এসবের মাঝে আমার স্বল্পদামি জাঙ্গিয়াটা ছিল। ওইটা কেন নিলো? কেন নিলো গো খোদা। ওটা আমার টাকায় কেনা! তাও গুলিস্তান থেকে নেয়া৷ ওটা কেন নিলো গো মাবুদ। বিচার দিলাম আমি তোমার দরবারে। বিচার দিলাম। এই বকুল তোমার দরবারে বিচার দিলো৷ আমি চিৎকার করি। অথচ সেই চিৎকার কেউ শোনে না। কেউ না।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত