বিয়ে পাগলী

বিয়ে পাগলী
আজ আমার বড় আপুকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসার কথা। আপু ভীষণ খুশি। সেইসাথে আমার পরিবারের লোকগুলোও খুব খুশি। খুশির সাথে সাথে তারা সবাই আবার খুব চিন্তিতও। চিন্তার কারণটা অবশ্য আমি; তাদের আদরের বাদর হয়ে যাওয়া ছোটো মেয়ে। আমি এসএসসি এক্সাম দিয়েছি দুইমাস হলো। এখনো আমার বাবা- মা আমার বিয়ের কথা ভাবছে না দেখে খুবই বিরক্ত আমি। গত তিন চারদিন আমার বিয়ে দিচ্ছে না কেন এই অনেক প্যারা দিচ্ছি পরিবারকে। নানারকম কৌশলে তাদেরকে বিব্রত করাচ্ছি। আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের প্রায় অনেকের বিয়ে ক্লাস টেনে থাকতেই হয়ে গেছে। অথচ, আমার বিয়ের কথা আমার পরিবার দেওয়া তো দূরে থাক ভাবছেও না। সরাসরি নিজের বিয়ের কথা বাবা-মাকে বলতেও কেমন জানি লজ্জা লাগছে।
কৌশল বের করলাম বড় আপুকে দিয়েই বাবার কাছে আমার বিয়ের কথাটা বলাবো। এতে বাবা-মায়ের একটা লাভও হবে। দু’মেয়ের বিয়ে একসাথে দিয়ে দিলে, এক বিয়ের খরচে দু’টো বিয়ে হয়ে যাবে। এসব ভেবেই সকালে ঘুম থেকে উঠেই বড় আপুকে গিয়ে বললাম, আমার বিয়ের কথাটা। আমার মুখে বিয়ের কথা শুনে আপু মনে হলো, কিঞ্চিৎ চমকালো। সেই সাথে ধমক দিয়ে বললো, ‘এসব পাকাপাকা কথা শিখছিস কোত্থেকে? আমি অনার্স শেষ করে ফেললাম তবুও নিজের বিয়ের কথা এখনো মুখে আনি নাই। আর তুই এসএসসি শেষ করেই বিয়ে করবি বলে লাফাচ্ছিস?’
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘দেখছো, তুমি বিয়ের কথা না বলতেই আম্মু-আব্বু কেমন তোমায় বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। আর আমি বলেও কোনো লাভ হচ্ছে না। আপু প্লিজ একটু আম্মুকে বোঝাও না?’ আমার শেষের কথাটা শুনে আপু এবার বেশ রেগে গেলো। বুঝতে পারলাম আমার গালে থাপ্পড় বসাবে তাই দৌঁড়ে আপুর রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম। না কোনো লাভ হলো না। আমি হতাশ হলাম। অন্য কোনো ভাবে সবাইকে আমার বিয়ের কথা বলতে হবে। কিন্তু কীভাবে? হঠাৎ মনে হলো গুগলের কথা। মোবাইল অন করে গুগলে সার্চ দিলাম, বিয়ের জন্য পরিবারকে কীভাবে রাজি করাবো লিখে। এবারও হতাশ হলাম। গুগল আমার কাঙ্ক্ষিত কোনো উত্তর দিতে পারলো না।
মনে মনে হাজারটা গাল মন্দ করলাম গুগলকে। হঠাৎ ফেসবুকের ‘দ্যা স্প্যারোস’ গ্রুপগুলোর কথা মনে হলো। সেখানে আপুরা কতোরকম নিঞ্জা টেকনিক বের করে পোস্ট দেয়। হয়তো বিয়ে নিয়েও কোনো নিঞ্জা টেকনিক পেয়ে যাবো সেই আশায় ঢুঁ পারলাম ফেসবুকে। সার্চ দিতে থাকলাম, বিয়ের জন্য পরিবারকে রাজি করানোর নিঞ্জা টেকনিক! নাহ, এবারও কোনো আশানুরূপ উত্তর পেলাম না। ধীরে ধীরে আমি ডিপ্রেশনে চলে যেতে লাগলাম। হঠাৎ দেখি হোয়াটসঅ্যাপে আমার বান্ধবী নীলা ওর হানিমুনের কিছু ছবি পাঠিয়েছে। মেঘের রাজ্য সাজেকে গিয়েছে হানিমুন করতে। এমনিতেও আমি ডিপ্রেশনে আছি বিয়ে হচ্ছে না বলে। আর ও কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছে। খুব রাগ হলো ওর উপর। দিলাম ব্লক করে। যা এবার চুটিয়ে হানিমুন কর শালী। আমাকে আর দেখাতে পারবি না। এটা ভেবেই একটু হাসলাম।
তারপর আবার টেকনিক বের করতে লাগলাম কীভাবে রাজি করাবো আম্মুকে? হঠাৎ মাথায় আইডিয়া আসলো আম্মুকে রান্নার কাজে সাহায্য করলে হয়তো আম্মু বুঝবে তার ছোট মেয়েটাও বড় হয়ে গেছে। এবার তার বিয়ের কথাও ভাবতে হবে। আইডিয়া মাথায় আসতেই নিজেকে নিজে বাহবা দিলাম। বাহ, আমার কতো বুদ্ধি আহ!
আম্মুর কাছে গেলাম রান্নাঘরে। গিয়েই আম্মুর হাত থেকে বটি কেড়ে নিয়ে পেয়াজ কাঁটতে লাগলাম। আব্বু অবাক হয়ে কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি একটু একটু লজ্জার ভাব করে মিটমিটিয়ে হাসলাম। তারপর আবার পেঁয়াজ কাটায় মন দিলাম। পেঁয়াজের অর্ধেক কাটতেই আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি ঝড়তে লাগলো। তবুও আমি হাল ছাড়লাম না চোখ বন্ধ করেই কাটতে লাগলাম।
এতে একটু কাটতেই পেয়াজের পরিবর্তে কেটে ফেললাম আমার আঙুল। এবার আম্মু ধমক দিয়ে আমাকে বললো, ‘ছোট আছিস ছোটোর মতোই থাক। এসব রান্নাবান্নার কাজ এতো তাড়াতাড়ি করতে হবে না তোকে। এখন পড়াশোনায় মন দে যা।’ আম্মুর কথাগুলো শুনে বুকের ভেতরটা আমার দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো। অসহায় দৃষ্টি নিয়ে আম্মুর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম। নাহ, মায়া হলো না আম্মুর মনে আমার জন্য। সেই আমাকে ‘ছোট’ উপাধিটা নিয়েই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসতে হলো। আমার আর ভালো লাগছে না এই অসহ্য জীবন। কতো স্বপ্ন দেখেছি, বিয়ে হবে। বরকে নিয়ে ঘুরতে যাবো। রোম্যান্স করবো। কিচ্ছু হলো না। নিজের রুমে গিয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে রইলাম।
হুট করে মাথায় আসলো, আপুকে যখন আজ পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে তখন আমি শাড়ি পড়ে সাজুগুজু করে পাত্রপক্ষের সামনে চলে যাবো। শুনেছি পাত্রের ছোটো না-কি একটা ভাই আছে। সেও না-কি পাত্রের মতোই সুদর্শন। যদি আমাকে দেখে পাত্রপক্ষের পছন্দ হয়ে যায়। তাহলে তাদের ছোটো ছেলের সাথে আমার বিয়েটা ঠিক করে ফেলবেন। আহা, আহা! আমার সত্যিই অনেক বুদ্ধি। এসব ভেবেই নিজে নিজেই কিছুক্ষন রুমের ভেতর নাচানাচি করলাম। এখন অপেক্ষা শুধু পাত্রপক্ষ আসার। তারা ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় আমাদের বাসায় আসলেন। এতোক্ষণ আমি নিজের রুমেই শাড়ি পড়ে সাজুগুজু করে রেডি হয়েছি। আপু পাত্রপক্ষের সামনে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আমিও পানের ট্রে হাতে নিয়ে চুপিচুপি ড্রইংরুমে গেলাম। রুমের পর্দা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার মুহুর্তেই ঘটলো বিপত্তি। শাড়ির সাথে পা পেঁচিয়ে উস্টা খেয়ে পড়ে গেলাম পাত্রের বাবার গায়ের উপর। কী লজ্জা! কী লজ্জা! আচমকা এমন ঘটনায় সবাই চমকে গেলো। আপু তাড়াতাড়ি আমাকে ধরে উঠালো।
আমি আড়চোখে একবার সবাইকে পরখ করে নিলাম। ওই তো পাত্রের পাশে সুন্দর হ্যান্ডসাম একটা ছেলে বসে আছে। কিন্তু সে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। লজ্জায় আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। ঠিক ঐ মুহুর্তে ছেলেটা বললো, ‘আহা পিচ্চি বেয়াইন। এখনই এসব শাড়ি টাড়ি পড়ার কী দরকার? নিজেকেই সামলাতে পারেন না। শাড়ি সামলাবেন কী করে? তার চেয়ে বরং বড় হয়ে নিন তখন এসব পড়বেন।’ ছেলেটার কথা শুনে উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। আমার বাবা তো বলে বসলেন, ‘পিচ্চি তো। তাই এখনো পুতুল খেলার অভ্যাসটা যায়নি। পুতুলকে যেমন শাড়ি পড়ায় তেমন নিজেও একটু শাড়ি পড়ার ইচ্ছে করেছে আরকি। হা হা হা!’
আমার স্বপ্নের পাত্রের মুখে এসব কথা শুনে রাগে, দুঃখে আমার বুক ফেটে কান্না আসছিলো। যাও একটা শেষ চান্স ছিলো আমার বিয়ে হওয়ার, সেটাও ভেস্তে গেলো। আমার কপালে বিয়ে নেই বুঝে গেছি। রাতে কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে ফেললাম। আর গান গাইতে লাগলাম, ‘বাবা আমার কি বিয়ে হবে না? বাবা আমার কি বিয়ে হবে না?’ পাশের রুম থেকে হাসাহাসির শব্দ পেলাম। বাবা হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন, ‘হবে মা হবে। আগে একটু বড় হয়ে নে। তারপর ধুমধাম করে তোর বিয়ে দিবো।’ বাবার কথাশুনে নিজেকে সাময়িক সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘বড় হ তাড়াতাড়ি। বিয়ে হবে খুব শীঘ্রই।’
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত