প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া

প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া
রাতে তুচ্ছ কারণে নাবিলাকে খুব মেরেছিলাম৷ তাই ঘুম ভাংতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো৷ এমন তুচ্ছ একটা ব্যাপারে নাবিলার গায়ে হাত তুলা ঠিক হয়নি৷ তার তো কোনো দোষ ছিলো না৷ তবুও মেরেছি৷ কাজ শেষে রাতের দশটায় ফিরে দেখি বিল্ডিং এর লিফট বন্ধ। লিফটে কি একটা সমস্যা হয়েছে৷ অফিসের ঝামেলায় এমনিতেই মেজাজ খারাপ ছিলো। লিফট বন্ধ দেখে মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেলো৷ কিন্তু কিছু করার নেই৷ নয় তলা সিড়ি বেয়ে উঠে মেজাজ খারাপের শেষ সীমায় পৌছে গেলো। গেট নক করলাম। নাবিলা মিনিট পাঁচেক দেরী করে গেট খুললো। ‘গেট খুলতে দেরী হয়েছে কেনো?’ জিজ্ঞাসা করতেই উত্তর দিলো, ‘ঘুমিয়েছিলাম।’ আমি গর্জন করে উঠলাম, ‘নাকি কোনো লাঙ্গের সাথে কথা বলতেসিলি৷’
নাবিলা কোনো উত্তর দিলো না। চুপ করে রইলো৷ আমার মেজাজ আরো খারাপ হতে লাগলো৷ কিন্তু আমি নিজের মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলাম। সফলও হলাম। অফিসের পোশাক খুলে ঘরের পোশাক পরে সোফায় বসে একটা সিগারেট ধরাতেই নাবিলা এসে সিগারেটটা টান দিয়ে নিয়ে ফেলে দিলো, ‘ঘরে বসে সিগারেট খেতে নিষেধ করেছি। ঘরে বাচ্চা আছে।’ আমি মেজাজ আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলাম না, ‘মাগি! আমার ঘরে বসে আমি সিগারেট খাই৷ তোর কি!’ ‘মুখ খারাপ করবে না। বাবু শুনবে।’ নাবিলা আকুতি করলো৷ ‘মাগির বাচ্চায় শুনলে আমার কি!’ নাবিলা তখন কি একটা বলতে যাবে ঠিক তখনি আমি একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বললাম, ‘মুখে মুখে তর্ক করবি না। একদম চুপ।’ কিন্তু নাবিলা চুপ করলো না৷ আমার মুখের উপর উত্তর দিলো। আমি সহ্য করতে না পেরে আবার মারলাম। নাবিলা আবার উত্তর দিলো। আমি আবারো মারলাম। থাপ্পড় থেকে ধীরে ধীরে কিল-ঘুষিতে চলে গেলাম। সময়ের সাথে আমার মাইরের ডোজ বেড়ে গেলো। মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পরলাম।
ঘুম থেকে উঠে রাতের ঘটনায় নিজেকে অপরাধি মনে হতে লাগলো৷ তাই ভাবলাম নাবিলাকে সরি বলি। কিন্তু নাবিলা পাশের রুম, রান্না ঘর কোথাও নেই৷ কিছুটা চিন্তায় পরে গেলাম৷ মেয়েটা গেলো কোথায়? বেশীক্ষণ চিন্তা করতে হলো না৷ বারান্দায় যেতেই নাবিলাকে দেখতে পেলাম৷ গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবলাম পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে সরি বলবো। কিন্তু জড়িয়ে ধরতে গিয়ে বাইরে চোখ যেতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। তিন-চারটা বিল্ডিং পরের একটা বিল্ডিং এ একটা ছেলে এদিক তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ মুচকি মুচকি হাঁসছে। ইশারায় কিছু একটা বলছে। আমি মেজাজ ধরে রাখতে পারলাম না। নাবিলার চুলের মুঠি ধরে টান দিয়ে রুমে নিয়ে চলে গেলাম, ‘খানকি! ঘরে জামাই রাইখা বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাগিগিরি করস!’ বলে হাত চালাতে লাগলাম। হাতের কাছে যা পেলাম তা দিয়েই মারতে লাগলাম। গেটে কেউ নক করেছে। মাইরধর অফ করে গেট খুলতে গেলাম। নেট বিল নিতে এসেছে। লোকটাকে আগামিকাল আসতে বললাম।
নিজে একটা শার্ট পরে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছে না। বাইরে যেতে হবে। বাইরে বের হয়ে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে পার্কে পৌছে গেলাম৷ ভিতরে গিয়ে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলাম। রাগ কিছুতেই কমছে না। মনে হচ্ছে আমি বাসা থেকে বের হতেই নাবিলা তার কোনো প্রেমিকের সাথে কথা বলা শুরু করেছে। আরো একটা সিগারেট ধরালাম। একটু পর একটা লোক এসে আমার পাশে বসলো। লোকটাকে চিনতে পারলাম। কিছুক্ষণ আগে লোকটা বাসায় নেট বিল নিতে গিয়েছিলো। লোকটাকে আমার সন্দেহ হতে লাগলো। এই লোকটাও হয়তো নাবিলার একজন প্রেমিক। আমি কড়া গলায় লোকটা বললাম, ‘আপনাকে না আগামিকাল বিল নিতে আসতে বলেছি।’ ‘বিল নিতে আসিনি৷ আপনাকে বিষন্ন মনে এখানে বসে থাকতে দেখে আপনার সাথে গল্প করতে আসলাম।’ লোকটা উত্তর দিলো। লোকটাকে এমনিতেই সন্দেহ হচ্ছে৷ এখন তার কথা শুনে আরো রাগ উঠে গেলো। ‘আপনি এখন যেতে পারেন৷’ কড়া গলায় বললাম।
কিন্তু লোকটা গেলো না৷ পকেট থেকে গাজা বের করে তালুতে নিয়ে ঘষতে লাগলো। আমি একটু দূরে চেপে বসলাম। লোকটা গাজা বানিয়ে আমার থেকে লাইটার চাইলো। আমি কিছুটা বিরক্ত নিয়ে তার দিকে লাইটার বাড়িয়ে দিলাম৷ লোকটা দুইটা টান দিয়ে আমার দিকে গাজার স্টিকটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এইটা টানেন। দেখবেন ভিতরের সব টেনশন মুহূর্তের মাঝে উধাও হয়ে যাবে৷’ আমি নিতে চাইলাম না৷ লোকটার জোরাজুরিতে নিলাম। গাজার স্টিকে টান দিতেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। আরো একটা টান দিতে সব অবসাদ দূর হয়ে গেলো। নেশা নেশা ভাব হতে লাগলো। ‘স্ত্রীকে এভাবে মারছিলেন কেনো?’ নাবিলার কথা মনে পরতেই রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। এই লোকটাকে এতোক্ষণ সন্দেহ হলেও গাজার প্যানিকে এখন আর হচ্ছে না। লোকটাকে বন্ধু মনে হতে লাগলো, ‘ঐ মাগিকে না মারলে কাকে মারবো। ঘরে জামাই আছে৷ কিন্তু পোলা দেখলে আর তার মাথা ঠিক থাকে না৷ এমনকি হাঁটুর বয়সী ছেলেদেরকেও সে ছাড়ে না।’
‘আপনি কি নিজ চোক্ষে দেখেছেন নাকি শুধু সন্দেহের বসেই বলছেন।’
‘এটা শুধু আমার সন্দেহই না। আমি নিশ্চিত।’
‘একটা গল্প শুনবেন?’ লোকটা বলল।
‘হ্যা বলেন।’
‘আমার বাবা আমার আম্মুকে খুব মারধর করতো। কারণে অকারণে মারতো। আর প্রচুর সন্দেহ করতো৷ কিছু হলেই সন্দেহ করতো৷ বাসার পিছনে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে, কোনো অপরিচিত নাম্বার থেকে আম্মুর মোবাইলে কল আসলে বাবা আম্মুকে সন্দেহ করে মারতো। কিন্তু আমার আম্মু কখনো বাবাকে ছাড়া কোনো পুরুষের দিকে ভালোমতো তাকায়নি। বাবা যে আম্মুকে সন্দেহ করে মারতো, এই ব্যাপারটা আমি একটু বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি৷ যখন বুঝতে পেরেছি তার অনেক আগেই আম্মু গত হয়ে গেছেন৷ আব্বুর এক রাতের মাইরে আম্মু খুব অসুস্থ হয়ে পরেন৷ তার চার-পাঁচ দিন পর আম্মু মারা যান। তখন আমার বয়স মাত্র আট। তারপর বেশ কিছুদিন বাবা ঘরবন্দি হয়েছিলেন। ধীরে ধীরে আমি বড় হই। তখন বাবা আমাকে মারধর করতে শুরু করেন৷ প্রায় প্রতিদিনই আমাকে মারতেন, তার পকেট থেকে টাকা চুরি করেছি সন্দেহে৷ কিন্তু কোনো দিন আমি তার পকেট থেকে টাকা নেইনি৷ একটা টাকাও নেইনি।’ লোকটা একটু থামলো। আরেকটা গাজার স্টিকে আগুন ধরালো। ‘তারপর কি হয়েছে?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম৷ লোকটা বলতে শুরু করলো, ‘আমার বাবার প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া ছিলো। এই রোগের রোগী খুব সন্দেহ প্রবণ হয়। কারণে অকারণে মানুষকে সন্দেহ করে৷ আমার মনে হয় আপনিও এই রোগে ভুগছেন৷’
‘না মিস্টার। আমি এই রোগে ভুগছি না৷ আমার বউ পরকিয়া করে বলেই তাকে সন্দেহ করি৷’
‘আপনি নিজ চোখে দেখেছেন?’
‘হ্যা দেখেছি৷’
‘কবে দেখেছেন? কি দেখেছেন?’
‘আজ কিছুক্ষণ আগেই দেখেছি৷ বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের একটা বিল্ডিংয়ের এক ছেলের সাথে ইশারায় কথা বলছিলো।’
লোকটা কথার প্রসঙ্গ পাল্টে বলতে লাগলো, ‘ধীরে ধীরে আমার বাবার রোগ অনেক বেড়ে গেলো। আমারো সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলো। তখন আমার বয়স বারো-তেরো। তার সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট চুরির সন্দেহে এক সন্ধ্যায় আমাকে খুব মারে৷ সেদিন আমি আর সহ্য করতে পারিনি। সেই রাতে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে আসি।’ লোকটা খুব স্বাভাবিকভাবে কথাগুলো বলল। ‘এসব কথা আমাকে কেনো বলছেন? আমাকে প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়ার রোগি প্রমাণ করতে? কিন্তু পারবেন না৷ আমি সিউর আমার সন্দেহ সঠিক।’ আমি বললাম৷ লোকটা আবার প্রসঙ্গ পাল্টে বলতে লাগলো, ‘আপনি যে আপনার স্ত্রীকে চুলের মুঠি ধরে টেনে ভিতরে নিয়ে গেছেন৷ আমি দেখেছি। সামনের একটা বিল্ডিংয়ের ছাদে দেখা ছেলেটা আমিই।’
‘মানে আমার সন্দেহ সঠিক। দেখেছেন আমি শুধু শুধু আমার বউকে সন্দেহ করে মারি না। সে পরকীয়া করে বলেই মারি৷’ আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম৷ আমার স্ত্রী আমার অনুপস্থিতিতে পরপুরুষের সাথে পরকীয়া করে। স্ত্রীর প্রতি আমার ক্ষোভ বাড়তে লাগলো। মনে মনে ভাবছি, আজ বাসায় গিয়ে তাকে মেরেই ফেলবো। ‘না। আপনার সন্দেহ সঠিক নয়। আপনাদের উপরের ফ্ল্যাটেই আমার প্রেমিকা থাকে৷ আমি ছাদে দাঁড়িয়ে তার সাথেই ইশারায় কথা বলি৷ মাঝে মধ্যে তার বাসায় যাই৷ আমি লিফট ব্যবহার করি না৷ হেঁটে যাই। এতে আমার ব্যায়াম হয়। আপনাদের ফ্ল্যাট ক্রস করার সময় প্রায় খেয়াল করি ভিতর থেকে মারামারি আর ঝগড়ার আওয়াজ আসছে৷ আমি কান পেতে শুনি৷ আপনি আপনার স্ত্রীকে প্রচন্ড সন্দেহ করে মারেন।’ ‘না আপনি মিথ্যা বলছেন। আপনি আমার স্ত্রীর সাথে পরিকীয়া করেন। আর আমি তাকে যে মারধর করি এইটা সেই আপনাকে বলেছে। তাকে বাঁচানোর জন্য আপনি এখন মিথ্যা বলছেন।’ লোকটাকে আমি আবার সন্দেহ করতে লাগলাম। এবার সন্দেহ বলা যায় না৷ আমি নিশ্চিত, এই লোকটাই যে আমার স্ত্রীর প্রেমিক।
‘আমি তাকে বাঁচাতে চাই। এটা ঠিক। কিন্তু আমি আপনাকে কোনো কিছু মিথ্যা বলিনি৷ তবে একটা কথা লুকিয়েছি।’
‘কি কথা?’
‘আমি আমার বাবার বাড়ি থেকে তার পিটুনির জন্য পালাইনি৷
সে রাতে আমি তাকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই। সে মারা যায়। আমি খুব ভিয় পেয়ে যাই৷ তাই সে রাতে আমি পালিয়ে যাই।’ আমি ভয়ে আৎকে উঠি৷ কেউ নিজের বাবাকেও খুন করতে পারে, ‘এসব কথা আমাকে কেনো বলছেন? এমনিতেই আপনি আমার বউয়ের সাথে পরকীয়া করছেন। আবার নিজের বাবাকেও খুন করেছিলেন৷ এখন আমি যদি পুলিশকে সব বলে দেই।’ আমি ভয়ে ভয়ে লোকটাকে থ্রেট দিলাম। ‘বলে দিতে চাইলে বলে দিতে পারেন৷ সমস্যা নেই৷ তবে সে রাতের পর থেকে ধীরে ধীরে আমি সাইকোপ্যাথ হয়ে উঠি। খুন করে মজা পাই। প্রথম প্রথম কাউকে খুন করতে পারলেই আনন্দ পেতাম৷
তবে এখন আর খুব সাধারণভাবে খুন করে আনন্দ পাই না৷ বিভৎসভাবে খুন করে আনন্দ পাই৷ যেমন ধরুন, যাকে খুন করবো তাকে ল্যাংটা করে মারতে মারতে চামড়া ছিড়ে ফেলবো৷ তারপর সেখানে লবণ দিবো। তারপর ছুড়ি দিয়ে টেনে টেনে চামড়া উঠাবো। সেখানে আবার লবণ দিবো৷ তারপর একটু একটু করে তার শরীরের মাংস কাটবো৷ তখনো কিন্তু সে জীবিত আমি লোকটার কথা শোনার ধৈর্য হারিয়ে ফেললাম৷ আমার ভিতর থেকে নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসতে চাইলো। আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম, ‘মানে? আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?’ ‘তেমন কিছুই না৷ তবে আপনি খেয়াল করে দেখুন আপনি গাজার নেশায় আমার সাথে কথা বলতে বলতে আমার আস্তানায় চলে এসেছেন।’
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত