— অবনী, তোর কি মেয়ে হতে ইচ্ছা হয় না? শুভ্র ভাইয়ার এমন প্রশ্ন শুনে হাসবো নাকি রাগ করব বুঝতে পারছি না। সহজভাবে বললাম,
— এগুলো কি ধরনের কথা?
— দেখ, তুই মেয়ে কিন্তু পুরোপুরি না। তুই শুধু মেয়ে কিন্তু একটা পরিপূর্ণ মেয়ে হতে যেসব বৈশিষ্ট্য লাগে সেগুলো তোর মধ্যে আছে বলে মনে হয় না।
— আপনি কি নেশা করেছেন, ভাইয়া? শুভ্র ভাইয়া রেগে বলল,
— বেয়াদবি করবি না। এই যে তুই যেভাবে কথা বলিস মাস্তান লাগে তোকে। মেয়েরা হয় শান্তশিষ্ট কিন্তু তুই…
— আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন? ভাইয়া ব্যঙ্গ করে বলল,
— ওহ শীট! তোর মান-সম্মান আছে? একটা কাজ কর, তোর যে বোনগুলো আছে তাদের সময় দে, দেখবি তোর মধ্যেও একটা মেয়ে মেয়ে ভাব আসবে। সবসময় এমন ভাইদের পিছনে ঘুরিস না, অবনী।
নাহ, এবার বেশি বেশি হচ্ছে। মনে হচ্ছে এর মাথা ফাটিয়ে দিই। সবসময় আমাকে অপমান করে।
— আপনি কিন্তু আমার কথা থামিয়ে দিয়ে শুভ্র ভাইয়া বলল,
— আরে আমি জানি যে আমি ভালো। থ্যাংকস দিতে হবে না। মাঝে মাঝে রান্নাঘরে যেয়ে মশলা গুলোর নাম মুখস্থ করলেও তো পারিস। আবার পরে উপদেশ দেবো, এখন আসি আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শুভ্র ভাইয়া চলে গেল। অসহ্য ছেলেটা। আমি অবনী। আর যার সাথে কথা হলো সে আমার কাজিনের ফ্রেন্ড শুভ্র। ছেলেটার কাজ হলো যখনই আমাদের বাড়িতে আসবে তখনই আমাকে অপমান করবে। আমি ছাড়া বাড়ির সবাই তাকে অনেক পছন্দ করে। কেউ আমাকে অপমান করলে তাকে পছন্দ করা সম্ভব? বাড়ির ছোট মেয়ে আমি যার জন্য সবাই অনেক ভালোবাসে। আর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে আমার ভাইয়েরা। আমার নিজের কোনো ভাই নাই কিন্তু চাচাতো ভাইগুলো সেটা কখনো বুঝতে দেয়নি। ছোট থেকেই সবসময় তাদের সাথে থেকেছি। রান্নার চেয়ে বাইরে ঘোরাঘুরি করা বেশি পছন্দ আমার। ভাইয়ারা যেখানেই যাক আমাকে সঙ্গে নেবে।
আর শুভ্র ভাইয়া, এই ছেলে লেখাপড়ায় অনেক ভালো। আর কেউ লেখাপড়ায় ভালো হলে সহজেই সবার মন জয় করা যায়। আমার সব বোন গুলো এর জন্য পাগল। জানিনা কি দেখে এর মধ্যে। দুই দিন পর, আজ ভাইয়াদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার কথা। মা অনেক বার নিষেধ করেছে কিন্তু কে শোনে কার কথা। বড় ভাইয়ার বাইকে আমি। মাঝ রাস্তায় শুভ্র ভাইয়ার সাথে দেখা। আমাকে দেখে এমন একটা ভাব করছে মনে হচ্ছে যে চোখে আমাকে দেখছে সেই চোখ যদি চেঞ্জ করতে পারতো তাহলে ভালো হতো। ঘোরাঘুরির মধ্যে ভাইয়ার সাথে আমার একটাও কথা হয় নি। হঠাৎ একটা কাজে বড় ভাইয়াকে চলে যেতে হলো। ভাইয়া যাওয়ার সময় শুভ্র ভাইয়াকে বলল যাতে আমাকে বাড়িতে নামিয়ে দেয়। আমার বাকি ভাইগুলো একটু খামখেয়ালী। আর শুভ্র ভাইয়া যেহেতু বড় ভাইয়ার ফ্রেন্ড তাই অনেক বিশ্বাস ও করে। বাইকে বসলেও দূরত্ব বজায় রেখেছি। মাঝ রাস্তায় বাইক থামিয়ে আমাকে নামিয়ে দিতেই আমি বললাম,
— কি হলো?
— হেঁটে যেতে হবে
— কেন???
— ওই এমন ভাবে বলছিস মনে হচ্ছে তোর পা নেই। তেল শেষ গাড়ির।
— আমি হেঁটে যেতে পারব না
— তাহলে এখানে থাক
কথাটা বলেই শুভ্র হাঁটা শুরু করে। রাগে আমার মাথা কাজ করছেনা। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা তো সম্ভব না। আমিও হাঁটা শুরু করলাম।
— আপনার বাইক আপনার মতো। অকেজো..
— বেশি কথা বললে বাইক তুলে মাথায় মারবো। তাড়াতাড়ি চল….
— সবাই বলে আপনি অনেক ভালো ছেলে, কিন্তু সেটা তো সত্যি না। আপনি কেমন সেটা আমি জানি…
— তুই যেমন আমাকে তো তেমনই ভাববি।
— হুহ।
— আমার কিন্তু তোকে নিয়ে টেনশন হয় রে, অবনী। তুই যাকে বিয়ে করবি তার জীবন একদম শেষ। আমি তো সবার ভালো চাই, তাই কারোর জীবন নষ্ট হোক এটা আমি চাইনা। একটা কাজ করতে পারিস
— কি কাজ?
— তুই আমার জীবনটা শেষ করে দে।
— মানে?
— কিছু না। ওই যে তোর বাড়ি, যা…
শুভ্র ভাইয়া আর আসেনা, দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি বাড়ির দিকে এগোতেই ভাইয়া বাইক নিয়ে চলে যাচ্ছে। দৌঁড়ে সামনে গেলাম। রেগে গিয়ে বলল,
— আরেকটু হলেই ওপরে চলে গেছিলি। এভাবে কেউ সামনে আসে?
— আপনি মিথ্যা বললেন কেন? আপনার বাইক তো খারাপ হয়ে গেছে তাইনা? এখন চলছে কিভাবে?
— ওইভাবেই চলছে। সবকিছু তোকে বলতে হবে কেন? সরে যা সামনে থেকে নাহলে উপরে পাঠিয়ে দেবো।
আজকাল শুভ্র ভাইয়ার হাবভাব ঠিক মনে হয় না। আমার ধারণা ঠিক করে দিয়ে উনি বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে দিলেন। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। ফাজলামি নাকি এটা? যাকে আমি সহ্য করতে পারিনা তাকে বিয়ে করা সম্ভব না। বাড়িতে সবাই রাজি। শুভ্রর মতে একটা ছেলের সাথে আমার বিয়ে হবে এটা কেউ আশা করে নি। শুভ্র ভাইয়াকে দেখা করতে বললাম। পার্কে এসেই শুভ্র বলল,
— কিরে কি হয়েছে? আমি রেগে বললাম,
— ফাজলামি করছেন আমার সাথে? আপনার সাথে আমার বিয়ে? শুভ্র নরম সুরে বলল,
— তুই রাজি না?
— অসম্ভব। এটা করার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল।। শুভ্র অসহায় ভাবে বলল,
— আমি তোকে খুব ভালোবাসি। জানিনা কখন, কিভাবে ভালোবাসা হয়ে গেল কিন্তু তোকে ছাড়া থাকা সম্ভব না, অবনী। সেদিন তোর সাথে বেশি সময় কাটানোর জন্য বাইক থাকার পর ও মিথ্যা বলে হেঁটে এসেছি। তোর চোখের দিকে তাকালে আমার সব এলোমেলো হয়ে যায় । আমি তোর সব রাগ সহ্য করে নেবো। আমি কি বলব বুঝতে পারছি না। আমার চুপ থাকা দেখে শুভ্র মাথা নিচু করে চলে গেল। বাড়িতে এসে শুনি শুভ্রর বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য না করে দিয়েছে। সবার মুখের হাসি কোথায় যেন চলে গেল। বাবা আফসোস করতে শুরু করছে। কি জন্য এমন করলো সেটা কেউ জানেনা। এখন আমি কি করবো? আমার তো খুশি হবার কথা। বিয়ে হচ্ছে না, এটাই তো চেয়েছি আমি।
দিন গুলো এভাবেই চলছে। তবে কোথাও একটা শূন্যতা কাজ করে। বাড়ির সবাই বিয়ের কথাটা ভুলেই গেছে। কোথাও একটা বিষণ্নতা কাজ করে। শুভ্র আর আমাদের বাড়িতে আসেনা। আমাদের বাড়িতেও শুভ্রকে নিয়ে আর কোনো কথা হয় না। আমি কি ওর অপমান মিস করছি? আগের সব কথা গুলো মনে পড়লেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে, অথচ আগে কতই না রাগ করতাম। সবকিছু থেকেও আমার কি নেই? এসব ভাবছি হঠাৎ শুভ্রর আওয়াজ পেলাম। নিচে এসে দেখি শুভ্র এসেছে। মায়ের সাথে কথা বলছে। বড় ভাইয়ার সাথে দেখা করতে এসেছে। মা রান্না ঘরে চলে গেল আর শুভ্র ভাইয়ার রুমের দিকে যাচ্ছে হঠাৎ আমি বললাম,
— আপনি এখন আর আসেন না কেন? শুভ্র আমার সামনে এসে বলল,
— আরে অবনী। আসলে কাজের চাপ তো তাই সময় পাইনা। আচ্ছা থাক, আমি আসি। শুভ্র চলে গেল। শুভ্রকে দেখে এতো খুশি লাগছিলো কেন? নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছিলো। এটাই কি আমার অপূর্ণতার কারণ? ভালোবাসি? হ্যাঁ, ভালোবাসি। একবার যখন বুঝতে পেরেছি তখন আর হারাতে পারবনা। রাতে শুভ্রকে কল দিলাম। ও চুপ করে আছে। আমিই বললাম,
— আমি আপনাকে ছাড়া অপূর্ণ। আজ যখন আপনি আসলেন তখন নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হলো। আমি ওতো ঢং করে বলতে পারবনা। সোজাসুজি বলছি, ভালোবাসি আপনাকে।
— একটু মেয়েদের মতো করে বল, অবনী। ভালোবাসার কথা বলতে একটু লজ্জা পেতে হয়। তোর তো লজ্জা ও নেই।
— নেই। তাতে আপনার সমস্যা? আচ্ছা স্যরি। যা বলবেন সেটা শুনবো। শুধু ছেড়ে যেতে পারবেন না।
— বিয়ের ডেট কবে ঠিক করবো?
— আপনার আমার উপর কোনো রাগ নেই?
— বিয়েটা হয়ে যাক সব ফিরিয়ে দেবো। আচ্ছা শোন
— হুম
— তুই আমার পূর্ণতা।
বাড়িতে সবাই আবার খুশি। তারা যেটা চেয়েছে সেটাই হচ্ছে। সবার ধারণা আমার মতো মেয়েকে শুধুমাত্র শুভ্র সামলাতে পারবে। আচ্ছা এটা কি অপমান না? সারাজীবন সবাই অপমান ই করে গেল।
গল্পের বিষয়:
গল্প