কলিং বেলটা অনবরত বেজেই চলেছে।এতো সকাল সকাল কে এলো বুঝতে পারছি না।এদিকে চুলায় রুটি বসিয়েছি।এখান থেকে সরলে রুটি পুরে যাবে।খুন্তি হাতে নিয়ে কিচেনের দরজায় এসে উঁকি দিলাম।তখনই গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে বেডরুম থেকে গুনগুন করতে করতে বেরুলো ঈশান।ওকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠলাম,,
–” এই-যে বাংলাদেশী আইডল,দরজায় কেও দাঁড়িয়ে আছে।দয়া করে দরজাটা খুলে আমায় উদ্ধার করুন।
আমার চেঁচানোতে ঈশানের বিশেষ ভাবান্তর দেখা গেল না।সে একইভাবে গুনগুন করতে করতে দরজার দিকে এগুলো।কিন্তু দরজা খুলেই বেচারার গুনগুন বন্ধ হয়ে গেল।বিস্মিত চোখে জিজ্ঞেস করলো,,
–” আপনি কে ভাই..??
–” স্যার আমি দেশী মুরগী নিয়াইছি।আপায় আনতে কইছিল।
–” এতো সকাল সকাল আপনি মুরগী নিয়ে এসেছেন।এখনও সকালের নাস্তাই করিনি আমরা।
–” দশটা বাজে স্যার।ছুটির দিন দশটারেও অনেক সকাল মনে হয়।আমাগো কি আর ছুটির দিন আছে?
রান্নাঘর থেকে ওদের কথোপকথন স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছিলাম।কিন্তু ঈশানের ডাকে বেরোতেই হল,,
–” তনু এসে দেখো,কোনটা কোনটা কিনবে। ড্রয়িং রুমে মুরগীওয়ালা দুইহাতে মুরগী নিয়ে বসে আছে।বেছে বেছে চারটা মুরগী নিলাম।দুইটা মোরগ আর দুইটা মুরগী।সাইজ মাঝারি,এক-একটা আড়াইশো টাকা করে মোট একহাজার টাকা দিয়ে মুরগীওয়ালাকে বিদায় দিলাম।দরজা বন্ধ করে পেছনে তাকিয়ে দেখি ঈশান হা করে তাকিয়ে আছে।ওর সামনে গিয়ে ওকে ধাক্কা দিলাম।ও নড়াচড়া না করে বলল,,
–” এই পিচ্চি সাইজের মুরগী আড়াইশো টাকা।
–” কেন কি হয়েছে?
–” না কিছু হয়নি।এভাবে চললে তো কিছুদিনের মধ্যে আমাকে ফকির বনে যেতে হবে।
–” এগুলো দেশী মুরগী,দেশী মুরগির দাম সবসময়ই বেশী।এখানে দুটো মোরগও আছে।তা এতোই যখন ফকির হয়ে যাওয়ার ভয় তখন নিজে গিয়ে কিনে আনলেই তো পারো।তাহলে আমাকেও আর কিনতে হয় না।
–” না ইয়ে মানে মানে,,,
–” কি মানে মানে করছো।বাজারে যেতে বললে তো তোমার পা ব্যাথা শুরু হয়ে যায়।আমি বাসা থেকে কিনছি সেটাও তোমার ভালো লাগছে না। ঈশানকে রেখে রান্নাঘরে এসে ভাজিটা গরম করতে বসালাম।ড্রয়িং রুম থেকে ঈশানের গলা শুনতে পাচ্ছি।একা একাই বকবক করে চলেছে,,
–” বুঝতে পেরেছি,আমাকে এবার মুরগীর বিজনেস করেই বড়লোক হতে হবে।সরি মোরগ আর মুরগীর বিজনেস।
মুচকি হেসে নিজের কাজে মন দিলাম।ঈশানটা এমনই।সামান্য ব্যাপারে হা-হুতাশ করবে।ঈশান নিজেও জানে এই মুরগীগুলো বাজারে কিনতে গেলে আরও বেশী দাম দিতে হবে।তারপরও আমার পিছনে লেগে থাকাটা ওর স্বভাব।
সকালের নাস্তা সেরে মুরগীগুলো নিয়ে বসলাম।চার চারটা মুরগী।কেটে ধুয়ে প্যাক করে ফ্রিজে রাখতে ব্যাপক সময় লাগবে।আজ চাচাতো বোনের ছেলের আকীকা অনুষ্ঠান।দুপুরের পর সেখানে যাব বলে রান্নার তাড়া নেই।ঈশান জুম্মার নামাজ পড়ে আসতে আসতে আমি রেডি হয়ে যাব।তাই ধীরে ধীরেই কাজ করছিল।
ঈশান রান্নাঘরে এসে বললো,,
–” দুপুরে কি রান্না করবে তনু?
–” কি রান্না করবো।তোমার মনে নেই আজ তিশা আপুর ওখানে দাওয়াত।পুচকোটার আকীকার অনুষ্ঠান করা হবে।
–” হ্যাঁ মনে আছে।কিন্তু আমি যাবোনা,তোমার যেতে ইচ্ছে হলে যাও।
–” যাবেনা মানে,কেন যাবেনা?দুদিন ধরেই তো তোমাকে বলছি।তাছাড়া ভাইয়া নিজে এসে দাওয়াত দিয়ে গেছেন।না গেলে চলে?
–” সেজন্যই তো বলছি তুমি যাও।আমাকে জোড় করোনা প্লিজ।
–” তাহলে তুমি দুপুরে কি খাবে?
–” ভাত রান্না করে রেখে যাও।আমি ডিম ভেজে খেয়ে নিবো।
–” এটা কোন কথা হলো।সব কাজিনরা বরের সাথে আসবে আর আমি একা একা যাবো?
–” দেখো তনু,তুমি খুব ভালো করে জানো এসব পারিবারিক অনুষ্ঠান ভীড় ভাট্টা আমার ভালো লাগে না।আমার কোন রিলেটিভের বাড়ি আমি বেশি যাইনি।সেখানে বিয়ের একবছরে তোমার সব রিলেটিভের বাড়িতে গিয়েছি।আর আমাকে এর মধ্যে টেনোনা প্লিজ।
ঈশান ওঠে বেডরুমে চলে গেল।ভীষণ কান্না পাচ্ছে।সবাই সবার বরের সাথে মজা করবে আর আমি নাকি দেবদাসী হয়ে ঘুরে বেড়াবো।এটা সত্যি যে ঈশান কোথাও যেতে চায় না।বিয়ের পরদিনই আমার শাশুড়ী বলেছিলে ওর মুখচোরা স্বভাবের কথা।তারপরও আজ খুব কষ্ট হচ্ছে।আপু ভাইয়া বারবার করে বলেছেন।আজ সকালেও ফোন দিয়েছিল। আর কোন কথা না বলে চুপচাপ কাজগুলো শেষ করলাম।ঈশানকে দেখলাম গোসল করে বেরিয়েছে।ও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল আমি এড়িয়ে রান্নাঘরে চলে এসেছি।ওর একটা কথাও এই মূহুর্তে সহ্য হবে না।তার থেকে চুপ করে থাকাই উত্তম। মাংসগুলো ফ্রিজে রেখে ভাত বসিয়ে দিলাম।ঈশান এসে কিচেনের দরজায় দাঁড়িয়েছে।আমি দেখেও না দেখার ভান করে কাজ করছি।ও কয়েকবার কেশে আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে।কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়ে অবশেষে মুখ খুললো,,
–” তনু কি রান্না করছো?
–” বিষ রান্না করছি বিষ।
–” শোনো না,বলছি তিশার আপুর বাড়িতে কি বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে??
–” হলে তোমার কি,তুমিতো আর যাবে না।তুমিতো ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খাবে।একটু অপেক্ষা করো,তোমাকে আমি ডিম ভাজাই খাওয়াবে।ফ্রিজে যত মাছ মাংস আছে সব বিলিয়ে দেব।শুধু ডিম দিয়ে ফ্রিজ ভর্তি করে রাখবো।।
ঈশান একগাল হেসে বললো,,
–” সে কাল দেখা যাবে।এখন চলো আপুর বাসা থেকে ঘুরে আসি।বিরিয়ানিটা মিস করা ঠিক হবে না।
–” তুই যা ছ্যাঁচড়া কোথাকার।এতোক্ষণ বলছি তখন যেতে পারেনি এখন বিরিয়ানি খেতে যাবে।
–” ঠিকআছে তাইলে,আপু একটু আগে ফোন দিয়েছিল।বলেছি আমরা আসছি।এবার ফোন দিয়ে বলে দি যে আপনার বোনের খুব ডিম ভাজা খেতে ইচ্ছে করছে।তাই সে যাবেনা। হাতের খুন্তিটা ছুঁড়ে মারলাম ঈশানের দিকে।কিন্তু ততক্ষণে ও পগার পার।একটু বাদে আবার উঁকি দিয়ে বললো,,
–” পনের মিনিট সময়।এরমধ্যে রেডি হও।নাহলে কিন্তু তোমাকে রেখে আমি একাই চলে যাবো। ঈশানের ওপর চেঁচামেচি করতে করতেই রেডি হলাম।ঈশানের সেসব গায়ে লাগছে না।সে একমনে গায়ে পারফিউম ঢালতে ব্যস্ত।হালকা গোলাপি পাঞ্জাবি পরে ঈশানকে দারুণ লাগছে।একটু এগিয়ে ঈশানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পান্জাবীর কলারটা একটু সমান করে দিয়ে বললাম,,
–” যাবেই যখন তাহলে সকালে মন খারাপ করে দিয়েছিলে কেন?
–” আসলে আমি দেখলাম কতো সামান্য কারনেও আমার বউ কেঁদে ভাসাতে পারে। রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেললাম।ছোটবেলায় কোথাও যাওয়ার সময় মা ডানহাতের কড়ে আঙুলে হালকা কামড় দিয়ে বলতেন,,
–” কারো নজর লাগবে না। বিয়ের পর শাশুড়ী মাও একই কাজ করতেন।আজ আমিও করলাম।ঈশানের ডানহাতটা ধরে আঙুলে জোড়েসোড়ে একটা কামড় দিলাম।ঈশান আতকে উঠে বলল,,
–” এটা কি হলো?
–” কারো নজর লাগবে না।তাই দিলাম,মাকে দেখোনি এভাবে দিত।
–” ওহহ,কিন্তু তুমি কামড় না দিলেও আমার ওপর কেও নজর দিতে পারবে না।
–” কেন?
–” না মানে,তোমার চেঁচামেচি শুনে এমনিই পালাবে।
ঈশান হেসে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।বিয়ের সময় ঈশান নিজের পছন্দে একটা গোলাপী শাড়ি কিনে দিয়েছিল।এতোদিন পরা হয়নি।আজ সেটাই পরলাম।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কুচিগুলো ঠিক করছিলাম তখনই ঈশান পেছন থেকে একটা সাদা রঙের গাজরা খোপার ওপর রাখলো।তারপর আমাকে ঘুরিয়ে কপালে আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,,
–” মাশাআল্লাহ,কারও নজর লাগবে না।ফুলটা লাগিয়ে নাও চুলে। ক্লিপ দিয়ে গাজরাটা খোপায় আটকে নিলাম।সাথে ঈশানকেও ভালোবাসায় বেঁধে রাখলাম সারাজীবনের জন্য।
গল্পের বিষয়:
গল্প