মা

মা
সেদিন শাশুড়ীর রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পেলাম, উনি ইয়াসিরকে বলছেন,
: ইয়াসির, বাবা তুই আরেকটা বিয়ে কর, তুই আমার একমাত্র ছেলে, আমার বংশ রক্ষা হবে কীভাবে? তাছাড়া আমারও নাতি নাতনির মুখ দেখতে ইচ্ছে করে। সাতটা বছর কেটে গেল কিছুই বলিনি, এখন আর চুপ থাকতে পারছি না।
:- কী বলছ এসব মা? যদি আরেকটা বউয়েরও বাচ্চা না হয়? আর যদি সমস্যা আমার মধ্যে হত তখন কী সুমাইয়া আমাকে ছেড়ে চলে যেত? যদিও আমি জানতে চাই না সমস্যা কার মধ্যে? আর মা, আমি আশা করে আছি আল্লাহ আমাকে সন্তান দিবেন যদি সেই সন্তান আমার দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য কল্যাণের হয়। যদি কল্যাণের না হয় তাহলে আমাদের নিঃসন্তান রাখবেন। আমি কখনো আশা ছাড়ব না। আল্লাহ বলেন, একমাত্র কাফির ছাড়া অন্য কেউ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না। [সূরা ইউসুফ : ৮৭]
: এত কথা বলিস না, আমার নাতি নাতনি চাইই চাই। তোর বাবা সেই কবে মারা গেছে, তুই মানে আমার সন্তান না থাকলে আমার দেখাশুনা কে করতো? আমি মরার আগে নিশ্চিত হতে চাই তোরও একটা অবলম্বন আছে।
:- কিন্তু আমাদের গ্রামের বাড়ির প্রতিবেশি রহিম চাচার চারটা ছেলে সন্তান থাকার পরও উনাকে কেন মানুষের টাকা দিয়ে চলতে হয়, বলতে পার? ওরা চারজন সন্তান মিলে চাইলেই কি একজন বাবাকে তিনবেলা খাবার দিতে পারত না?
: এত কথা বুঝি না, আল্লাহর রাসুল (সঃ)ও বলেছেন বন্ধ্যা নারীকে বিবাহ না করতে। তোর কাছে কোন জবাব আছে?
:- হুম হাদিসে আছে সেটা।
কিন্তু তুমি এটা ভাবছ না কেন? হযরত আয়শা (রা:)ও নিসন্তান ছিলেন। এটা এইজন্য বলা হয়েছিল যাতে রাসুল (স:) এর উম্মত বৃদ্ধি পায়। আর আমরা নিঃসন্তান হওয়ার ভার বইতে পারব বলেই আল্লাহ আমাদেরই এই পরীক্ষার ভার বহন করার জন্য পছন্দ করেছেন। জান তো? বন্ধ্যাত্বও আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা এবং নিয়ামত। কারণ কোরানে আছে, আসমানসমূহ ও যমীনের আধিপত্য আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছে তা- ই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছে কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছে পুত্র সন্তান দান করেন।
অথবা তাদেরকে দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছে তাকে করে দেন বন্ধ্যা ; নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাবান। [ সূরা আশ-শুরা, আয়াত ৪৯-৫০ ] দেখ আয়াতে, সন্তানের পাশাপাশি বন্ধ্যা শব্দটাকে রাখা হয়েছে। নেককার সন্তান যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়মত তেমন গুনাহগার সন্তান থাকার চেয়ে নিঃসন্তান থাকাও আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত। কারণ যদি আল্লাহ আমাকে সন্তান নাও দেন, আমি ভেবে নিব সন্তানের মাধ্যমে আমার দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যান হত না তাই আল্লাহ আমাকে নি:সন্তান রাখতেই পছন্দ করেছেন।
: জানি না মেয়েটা তোর উপর কী যাদু করেছে? আমি আর কিছু শুনার মত অবস্থায় ছিলাম না, কোন মতে রুমে এসে বিছানায় ধড়াম করে পরে গেলাম। আমাদের সাত বছরের সংসার জীবন এত তাড়াতাড়ি সব মুছে যাবে? খুব কষ্ট হচ্ছিল। সহ্য করার মত অবস্থায় ছিলাম না। ইয়াসির রুমে আসার আগেই চোখ মুছে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকলাম। ইয়াসিরকে বুঝতে দিতে চাইনি, আমি সব শুনে ফেলেছি। ইয়াসির এসে আমার পাশে কিছুক্ষণ বসে, আলতো করে কপালে চুমু দিয়ে বলল,
: তুমি আমার পাশে আছ আমার আর কাউকে লাগবে না। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমাকেই ভালোবেসেই যেতে চাই। তুমিই আমার পৃথিবী। আমি চীরজীবন তোমার হয়েই থাকব। সুমাইয়ার ইয়াসির হয়ে, আর কিছু চাই না। আর ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকতে পারিনি। উঠে ইয়াসিরকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম, অঝোরে কান্না। আজ আমার সংসার জীবনের ২৪টা বছর পার হয়ে গেল। এর মধ্যে শাশুড়ী ও ইয়াসিরের বোনেরা সবাই মিলে আরো বেশ কয়েকবার ইয়াসিরকে বিয়ে করাতে চেয়েছিল কিন্তু ইয়াসিরকে কোনভাবেই রাজী করাতে পারেনি। আমি সব জানতাম, কখনো ইয়াসিরকে বুঝতে দিইনি। যতই সে আমাকে ভালোবাসুক সারাক্ষণ তাকে হারানোর ভয় তাড়া করতো।
শুধু এই ভরসাটুকু ছিল আল্লাহ যা করেন আমাদের কল্যানের জন্যই করেন। আমি যতই পরিকল্পনা করি না কেন, আল্লাহর পরিকল্পনায় সর্বোত্তম। বাহ্যিকভাবে সন্তান না থাকার জন্য দুনিয়াবি যতই অপদস্থ হই না কেন, আমি জানি এতেই আমার জন্য মঙল হবে। আর আল্লাহ চাইলে যে কোন সময় সন্তান হতে পারে। ইব্রাহিম (আ:) কে আল্লাহ তায়ালা ৮৬ বছর বয়সে সন্তানের বাবা হওয়ার তৌফিক দান করেন। তবে আমি কেন অপেক্ষা করতে পারব না?
বেশ কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন ডাক্তারের কাছ থেকে ট্রিটমেন্ট করছিলাম। অবশেষে সংসার জীবনের ২৪ বছর বয়সে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সন্তানের বাবা মা হওয়ার তৌফিক দান করেন। নামও রেখেছি ইব্রাহিম (আ:) এর সন্তানের নামেই, ইসমাইল। যেদিন ইসমাইলের সংবাদ পেয়েছিলাম, জানি না আমার চোখে এত অশ্রু জমা হয়েছিল। সারাটা দিন অঝরে অশ্রুর বন্যা বয়ে যাচ্ছিল। অথচ অনেকেই বলতো মেয়েটা নিঃসন্তান তাকে দেখে তো মনেই হয় না কোন দুঃখ আছে!! অনেকেই বলতো, হয়তো সন্তানই চায় না!!
হায়! দুনিয়ার মানুষ কত যে জাজমেন্টাল! প্রেগন্যান্সির সাত মাসে এমন কমপ্লিকেশন দেখা দিয়েছিল সিজারে বাচ্চাটা নিয়ে ফেলা ছাড়া উপায় ছিল না। এত সাধনার পর আল্লাহ সন্তানের মুখ দেখালেন, এমন অবস্থা হয়ে গিয়েছিল সেই সন্তানের মুখে মা ডাক শুনতে পাব কি না সেই অনিশ্চয়তার মধ্যেই প্রতিটি মুহুর্ত অতিবাহিত হত। কী অদ্ভুদভাবে ইয়াসির ছিল নির্বিকার! সে সবসময় বলত সন্তানের মুখ দেখেছি ব্যস এতেই চলবে। একে যদি আল্লাহ নিয়ে নেন মনে করব আমরা এক জান্নাতী পুত্রের বাবা মা। আলহামদুলিল্লাহ ইসমাইলের বয়স এখন ১৩ মাস। সুস্থ আছে, একটু একটু দাড়ানোর চেষ্টা করে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত