স্মৃতিছবি

স্মৃতিছবি
দশ মিনিট আগে ভিড় থেকে বের হয়ে পকেটে হাত দিয়ে দেখি মানিব্যাগটা নেই। নির্ঘাত পকেটমার। মানিব্যাগটায় টাকা ছিল কিছু। কিন্তু ব্যাটা পকেটমার আমার মানিব্যাগের সাথে শুধু টাকা না ,জীবনের একটি অংশ নিয়ে গেছে। মানিব্যাগটায় বাবার একটা ছবি ছিল।বেশ আরাম করে চেয়ারে বসে ছবিটা তুলেছিলেন বাবা। দু বছর আগে বৈশাখ মাসে বাবা মারা যাওয়ার ঠিক পরের দিন মা আমাকে ছবিটা দিয়ে বলেছিলেন, “তোর বাবার ছবিটা রাখ।একটাই ছবি আছে। আমার কাছে রাখলে সহ্য করতে পারবোনা। আর অন্য কাউকে দিলে হারিয়ে ফেলবে। যত্ন করে রাখিস।” আমার মার একটা অভ্যাস হচ্ছে যেই জিনিসটা তাকে মানসিকভাবে কষ্ট দিবে সেটা দূরে রাখা। বাধ্য ছেলের মতো ছবিটা আমি মানিব্যাগে রেখে দিয়েছিলাম।
দু বছরে এই একটা ছবি আমি অসংখ্যবার হারিয়েছি। প্রত্যেকবার বাড়িতে যাওয়ার আগেই ঘটনাটা ঘটতো।আবার বাড়ি থেকে আসার পর কিভাবে কিভাবে যেন খুঁজেও পেতাম ছবিটা।প্রথম কয়েকবার হারানোর পর কখনোই আর ফেরত চাইনি ছবিটা আমি। প্রত্যেকবার চেয়েছি হারিয়ে যাক ছবিটা। আমি জানি ,এবারো ছবিটা হারাবেনা। ঠিকই ফেরত আসবে। কিন্তু এই শেষবারের মতো হারাচ্ছে হয়তো ছবিটা। এবার যখন খুঁজে পাবো তখন আর হারাবেনা। সাতপাঁচ না ভেবে হাঁটছি। মাথা প্রচন্ড ব্যথা। বুকের ভেতরে কেমন যেন দম আটকে ছিল। ছবিটা হারানোতে ভাল্লাগছে বোধহয়। এই ভাল্লাগাটা সাময়িক। শেষবার ছবিটা হারিয়েছিলাম ঈদ এ বাড়িতে যাওয়ার সময়। বাড়িতে যাওয়ার পর মা হাসি দিয়ে বললেন, “এবারো হারিয়ে গেছে ছবিটা ?”
আমি বুক পকেটে হাত দিয়ে দেখি সত্যিই ছবিটা নেই। মার দিকে তাকিয়ে একটা ম্লান হাসি দিলাম। বাবা মারা যাওয়ার পর প্রত্যেকবার বাড়িতে গেলে আমার সময় খুব খারাপ কাটতো। বাবা আমাদের গ্রামের স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। গণিত পড়াতেন। গণিতের স্যাররা সাধারণত অনেক রাগি হয়। বাবা ছিলেন তার উল্টো। তিনি ছিলেন ঢাকা থেকে পাস করে আসা টগবগে এক হাসিখুশি যুবক। গ্রামকে খুব ভালোবাসতেন বলেই এখানের প্রাইমারি স্কুলে এসে চাকরি নিয়েছিলেন। বাবা নাকি খুব বেশি হাসিখুশি ছিলেন। মানুষের সাথে খুব তাড়াতাড়ি মিশে যেতেন। পাড়ার টং দোকানে বসে আড্ডা দিতেন,গান গাইতেন, এমনকি নতুন আসার পর স্কুলের ছেলেদের সাথে নাকি একবার ডাবও চুরি করেছিলেন। ২৮ বছর বয়সে মাদ্রাসার ইমামের মেয়েকে বিয়ে করলেন। মা ছিলেন বাবার চেয়েও বেশি হাসিখুশি।
আমার এখনো মনে আছে,ছোট থাকতে বাবার বুকের উপর শুয়ে থাকতাম।মা পাশে বসে তার লম্বা চুল আঁচড়াতেন। বাবা নানারকমের গল্প বলতেন। মা বাবা ছিলেন বন্ধুর মতো। দিনে দিনে আমি যত বড় হয়েছি তাদেরকে আরো কাছে পেয়েছি। সবাই বলতো আমার চেহারাটা নাকি বাবার মত। ভার্সিটিতে এডমিশন হওয়ার পর বাবা বেশ খুশি হয়েছিলেন। ঢাকায় আসার পর বাবাকে দিন রাত কল দিতাম। বাবা বারবার বলতেন, “সাহস রাখ বেটা।” এই হাসিখুশি মানুষটা একদিন টুপ করে ডুব দিলেন মৃত্যুর পথে। সেদিন ভোরবেলা খুব বৃষ্টি ছিল ঢাকায়। হ্যাংলা পাতলা ভেজা শরীরটা নিয়ে বাবার মৃতদেহটাকে বিদায় দেয়ার জন্য বাসে উঠেছিলাম। বাড়িতে যেতে যেতে আমার চুপচুপে ভেজা কাপড় শুকিয়ে ঝরঝরে হয়ে গিয়েছিল। আমার মাকে আমি কখনো ডুকরে কাঁদতে দেখিনি। বাবা মারা যাওয়ার দিনও তিনি শক্ত হয়ে বসে ছিলেন।
সব শোক কাটিয়ে যেদিন ঢাকা চলে আসব সেদিন কেবল বাবার ছবিটা আমার হাতে দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন।
আমি হা করে তাকিয়ে ছিলাম। অথচ সেই মাকে আমি আর ছবিটা দিতে পারিনি। প্রত্যেকবার ছবিটা কোনো না কোনো ভাবে হারিয়ে যেতো। কিন্তু ঢাকা যাওয়ার সাথে সাথে পেতাম। একপর্যায়ে আমি ভয় পাওয়া শুরু করলাম।আমার ভয় পাওয়া দেখে মা হাসতেন। আজকেও বাড়ি যাচ্ছি। মার জানাজা পড়তে। আকাশে মেঘ নেই। কড়া রোদ। গায়ের শার্টটা ভিজে গেছে। ঘামে,বৃষ্টির পানিতে না। এখন বাজে দুপুর দুইটা। বাস স্টেশনে মানিব্যাগ হারিয়েছি। তাই এখন গ্রামের দিকে হাঁটতে হচ্ছে। ঢাকায় থেকে থেকে বদঅভ্যাস হয়ে গেছে। যান্ত্রিক জীবনের যাতাকলে হাঁটাহাঁটির অভ্যাসটা আর নেই। অনেকক্ষন হাঁটার পর গ্রামের স্কুলটা দেখতে পেলাম। স্কুলটার সামনে দাঁড়িয়ে কেন জানি আর পা নড়ছিল না। এই স্কুলে বাবার সাথে সাইকেলে চড়ে কত এসেছি।
বাবা সাইকেল চালাতেন আর আমি দুনিয়ার প্রশ্ন করতাম। বাবা কখনো বিরক্ত হতেন না।ক্লাসের অন্য শিক্ষকরা প্রায়ই বাবাকে বলতেন, “রহমান, তোমার ছেলেটা একটু বেশিই প্রশ্ন করে।” বাবা হাসি দিয়ে বলতেন,”প্রশ্ন না করলে শিখবে কিভাবে?।” স্কুলটার সামনে এসে একঘন্টা হাঁটার পর শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি মানসিক কষ্টটাও বেড়ে গেলো। আমি স্কুলের ভিতরে ঢুকে মাঠের সামনের উঁচু ছাউনিতে বসলাম। উপরে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখি আকাশ কালো করে দূর থেকে মেঘ আসছে। একটু পড়েই সব অন্ধকার হয়ে বৃষ্টি নামলো।আমি আশেপাশে তাকিয়ে মানুষ খুঁজতে লাগলাম। কেউ নেই। এখন কি আর ক্লাস হয়না তাহলে? সবসময় রিকশা গাড়ি যা পাই নিয়ে বাড়িতে চলে যাই।এই স্কুলে শেষ এসেছিলাম বাবার জানাজা পড়তে। বাবার জানাজা স্কুল মাঠেই হয়েছিল। হঠাৎ মনে পড়লো আজকে শুক্রবার। জুম্মার নামাজ পড়া হয়নি। সময়ও চলে গেছে। বাড়িতে কি হচ্ছে কে জানে।
তিনটার মধ্যে পৌঁছানোর কথা।এখানে আসতেই একঘন্টা লেগেছে। আসরের পর মার জানাজা। পড়তে পারব কিনা কে জানে। যদি স্কুল মাঠে জানাজা পড়ে তাহলে সবাই এদিকেই আসবে। আর নয়তো অন্যকোথাও ব্যবস্থা করলে মা তার নিজের জানাজায় একমাত্র ছেলেকে আর পাবেন না। বুকের মধ্যে আটকে থাকা দীর্ঘশ্বাসটা বেরিয়ে এলো। সামনে স্কুল মাঠটার দিকে তাকিয়ে বাবার মৃতদেহটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সাদা কাফনের কাপড়ে ঢাকা শরীরটা একটা খাঁটিয়ায় শোয়ানো। সামনে ইমাম কথা বলতে বলতে কেঁদে দিচ্ছেন।গলার স্বর শুনে বুঝা যাচ্ছে। আর কে কাঁদছিলো সেদিন বুঝা যায়নি। সবার শরীর বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে ছিল।বৃষ্টির পানির সাথে চোখের পানিগুলোও ধুয়ে গিয়েছিল সবার। বৃষ্টির হাওয়ায় এখন ঠান্ডা লাগছে। স্কুলের টিনে বৃষ্টি পড়ার শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। দূর থেকে আসরের আজান শুনা যাচ্ছে। হাঁটা ধরবো কিনা বুঝতে পারছিনা।
মোবাইলটা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।কারো সাথে যোগাযোগ করাও সম্ভব না। এখন বৃষ্টির মধ্যে হাঁটলে কুলাতে পারবনা। কিছু বুঝে উঠার আগেই হঠাৎ বাতাসে মার ঘ্রাণ পেলাম।কলিজাটা কামড়ে ধরলো সাথে সাথে। দাঁড়াতে গিয়েও দাঁড়াতে পারলামনা। আবার বসে গেলাম। হঠাৎ কানের কাছে মৃদু একটা কন্ঠ এলো,”সাহস রাখ ব্যাটা।” শোক ছাপিয়ে ভয় লাগা শুরু করলো কেমন যেন।নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে হেলুসিনেশন। কিন্তু ক্লান্ত শরীরটা আর মানছে না। নির্জন জায়গাটায় বসে গা কাঁপছে। শীতে, ভয়ে আর শোকে যখন কাঁপছি ঠিক তখনি কে যেন বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে স্কুলের ভেতর এলো। একটা অল্প বয়স্ক ছেলে। এসে ধুম করে পাশে বসে পড়লো। একটু সাহস পেলাম। বললাম,”কোত্থেকে আসছো?”
ছেলেটা গায়ের চাদর খুলতে খুলতে বললো, “আর বইলেন না ভাইজান। স্টেশন গেছিলাম। আর আইতে আইতে বৃষ্টি নামলো।আপনেও কি স্টেশন থেকে আইলেন নাকি?” আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। ছেলেটা চাদরটা খুলার পর পকেট থেকে একটা মানিব্যাগ বের করে ভিতরে কি আছে দেখতে লাগলো। দেখলাম তিনটে পাঁচশো টাকার নোট আর দুটো পুরনো কার্ডের সাথে বাবার ছবিটা উকি দিচ্ছে। বুঝতে পারলাম, মাকে কবর দেয়া হয়ে গেছে। মনে মনে কালিমা পড়ে পাশে তাকিয়ে দেখি ছেলেটা চাদর জড়িয়ে উঠে বৃষ্টিতে দৌড় দিয়েছে। মানিব্যাগটা আমার পাশে পড়ে আছে। ভেতরে আছে শুধু বাবার ছবিটা…
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত