হাত পা কাঁপছে। চিঠিটা হাতে নিয়ে মিনুর শরীরটা কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে গেল। হলদেটে খাম। খামের উপর খুব সুন্দর হাতের লেখা, প্রাপক, মেহরিন মিনু। নামটা দেখেই বুকের ভেতর হঠাৎ করে ধুক ধুক শব্দ করে সবকিছু কেমন যেন বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। চুলায় করলা ভাজি। গরম তেলে রসুন একটু রঙ পাল্টাতেই মিনু করলা ঢেলেছিল। নাড়া হয়নি তখনো। কলিং বেল বাজল। মিনু ভাবল, বুয়াটা আসল বুঝি। চুলার উপর হাড়িটা অমন করে রেখে দরজা খুলতে গেল। না, বুয়া আসেনি। আসল ডাকপিয়ন। ভিজে জুবুথুবু। ‘একটা চিঠি আছে ম্যাডাম, মেহরিন মিনু নামে।’
নামটা শুনেই মিনু বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। এতগুলো বছর পর এমন করে নামটা শুনে সবকিছু কেমন যেন উলটপালট লাগছে। গলার ভেতর কিছু আটকে গেল মনে হয়। মিনু কিছু একটা বলতে চাইছে। কী বলবে সেটা মাথায় ঘুরছে কিন্তু কথাটা মুখ দিয়ে বেরুতে চাইছে না। মনে হল গলাটা বোধহয় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দু’বার চেষ্টা করে কথাটা বের হলো না। মিনু মনে মনে নিজেকে একটু শান্ত করে তৃতীয়বার চেষ্টা করে ডাক পিয়নকে বলল,
‘কে পাঠিয়েছে?’ ‘সেটা তো লেখা নেই ম্যাডাম। তবে ঠিকানা এই বাড়ির। এই যে দেখেন, শাপলা মঞ্জিল, ২৬/এ, চকবাজার। এটা তো ২৬/এ, তাই না?’ ‘হুম’ মিনু হুম বলে চিঠির জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিল। একটিবারও বলল না এই নামে তো এখানে কোনো চিঠি আসে না। আগে কখনো আসেনিও। মিনু কিছুই বলেনি। কেমন একটা অসাড় অনুভূতি হাতে চিঠিটা নিয়ে চুপচাপ সোফায় এসে বসল।
সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। তুমুল বৃষ্টি। এই বৃষ্টি নিয়ে ছেলেমেয়ে দুইটা কলেজে গেল। যদিও মিনুর স্বামী আসিফ ঠিক ভোরের দিকে বের হয়েছে। সাতটার ট্রেন। আসিফ যাবে রাজশাহী। অফিসিয়াল ট্যুর। যদিও তখন বৃষ্টি শুরু হয়নি। আসিফ বেরুনোর মিনিট পনের পর থেকে বৃষ্টি শুরু হলো। এখন বৃষ্টি হচ্ছে বেশ শব্দ করে। এই বাড়ির দেয়াল লাগোয়া টিনের ঘরটার চালের উপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে বেশ শব্দ করে। শব্দ শুনে মনে হচ্ছে আর কিছুক্ষণ বৃষ্টি হলে টিন ছিদ্র হয়ে যাবে। ঘরের দক্ষিণ দিকের ব্যালকনির দরজাটা খোলা। ভুলে বন্ধ করা হয়নি। বৃষ্টির পানি এসে ঘরের মেঝে ভিজে যাচ্ছে।
মেঝের পানি আস্তে আস্তে বাড়ছে। গরম তেলে বেগুনী ভাজলে যেমন করে ফুলে উঠে, মেঝের পানি ঠিক তেমন করে ফুলছে। মিনুর এসবে খেয়াল নেই। চিঠি হাতে বসে আছে । ব্যালকনি দিয়ে আসা পানির দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। আজ থেকে তেইশ বছর আগে এমন করে চিঠি আসত মিনুর কাছে। নিজামপুর কলেজে মানবিক বিভাগে পড়া এই মিনুর নামে চিঠি আসত মেহরুন মিনু নামে। যদিও মিনুর আসল নাম মেহরুন আক্তার। বাড়িতে সবাই মিনু নামেই ডাকে। ঠিক সাতদিন পর পর একটা করে চিঠি আসত। চিঠি আসত কলেজে। নিজামপুর কলেজের অফিস পিয়ন মোজাম্মেল কাকা প্রথমদিন চিঠি দিয়ে বলল, এই কলেজে, মানবিক শাখায় মেহরুন বলতে তুমিই আছো। এই তোমারই চিঠি।
মিনু খুব ভয় পায়। ভয়ে পেয়ে বলে, না না, আমার আবার কিসের চিঠি। আমার নাম তো মেহেরুন আক্তার মিনু।
মোজাম্মেল কাকা হাসতে হাসতে বলে, ঐ হলো। মেহরুন মিনু আর মেহরুন আক্তার মিনু একই নাম। এতে ভয়ের কী আছে। চিঠি তো মানুষের নামেই আসে। এসব নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। দরকার না হলে ছিঁড়ে ফেলে দিবে। এই চিঠি আমি অফিসে রেখে কী করব? মোজাম্মেল কাকার কথা শুনে মিনু সাহস পায়। সেই থেকে চিঠি নেওয়া শুরু। প্রথম চিঠিটা না খুলে সাতদিন লুকিয়ে রাখে মিনু। সাতদিন পর যখন আবার দ্বিতীয় চিঠি আসে তখন সাহস করে প্রথম চিঠি খুলে। চিঠি খুলে তো মিনু থ হয়ে গেল। এই মানুষটা তাকে চিঠি দিতে পারে এটা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে। মিনু মনে মনে ভাবে, যেহেতু নামে আক্তার নেই, তবে এই চিঠি কিছুতেই তার হতে পারে না।
দ্বিতীয় চিঠি খুলে তার ভুল ভাঙ্গে। সত্যি সত্যি এই যে মিনুর চিঠি। দিয়েছেন মাহমুদ স্যার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবে পাশ করা এই মাহমুদ স্যার মিনুর ভর্তির মাস দুয়েক আগে এই কলেজে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু পুরো কলেজ এই স্যারকে লাজুক স্যার বলে উপাধি দিয়ে দিয়েছে। তিনি ছাত্রীদের নাকি খুব এড়িয়ে চলেন। এই নিয়ে মেয়েরা খুব হাসাহাসিও করে। তবে দেখতে শুনতে বেশ ভদ্র আর সুদর্শন বলে কলেজের ছাত্রীদের মাঝে ইতোমধ্যে এই স্যার স্বপ্ন পুরুষ হয়ে গিয়েছেন। মাহমুদ স্যার পড়ান ফিজিক্স। মিনু তো সেই মানবিকের ছাত্রী। এই নিয়ে মিনুর কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না এই স্যার তাকে চিনল কী করে? তাছাড়া এই স্যারকে মিনু দেখেছে মাত্র একবার। কলেজের নবীণ বরণ অনুষ্ঠানে। মিনু ভীতু মেয়ে। কলেজে আসলে ভয়ে সব সময় জড়োসড়ো হয়ে থাকে। এই ভীতু মন নিয়ে এসব কিছু ভাববার সাহস তাঁর কোনো দিন হয়ে উঠেনি।
মিনু দ্বিতীয় চিঠি খুলে দেখে লেখা আছে, মেহরুন আক্তার মিনু। খুব সুন্দর করে লেখা ‘মেহরুন আক্তার মিনু’। কেমন একটা বিদঘুটে কালি দিয়ে এই একটা জিনিসই লেখা। মানুষের হাতের লেখা এত সুন্দর হতে পারে তা জানত না মিনু। এমন সুন্দর করে তাঁর নাম লেখা দেখে মনে মনে খুব খুশি হল। কিন্তু ভালো লাগার মাঝে কেমন একটা ভয় মিনুর ভেতর সবকিছু উলটপালট করে দিল। এই ভয়ে মিনু চুপসে থাকে। বিষয়টা কাউকে না জানিয়ে নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখে। মাহমুদ স্যারের সেই চিঠি আসতেই লাগল। একটা মানুষ এত সুন্দর করে চিঠি লিখতে পারে তা মিনুর বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে এই চিঠি পড়ে মিনু লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। কেন কাঁদে সে নিজেও জানে না। একটু না। তারপরও কাঁদে। চিঠি আসত সপ্তাহের ঠিক শেষদিনে। বৃহস্পতিবার। এই দিনটা মিনু কখনো কলেজ কামায় করত না।
এগারোতম চিঠি যেদিন আসবে সেদিন সকাল থেকে মিনুর খুব জ্বর। জ্বর নিয়ে কলেজে আসল। কলেজে এসে জানল চিঠি আসেনি। সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরল। ঐদিন মিনু বুঝলো এই মানুষটাকে সে কতটা ভালোবাসে। মিনুর খুব ইচ্ছে করে মাহমুদ স্যারকে চিঠি লিখতে। কিন্তু স্যার নিজেই লিখে দিয়েছেন, তিনি না বলা পর্যন্ত সে যেন কোনো চিঠিপত্র তাকে না লিখে। মাঝে মাঝে মিনুর খুব রাগ হয়। ইচ্ছে করে স্যারের কথা না শুনে একটা চিঠি লিখে ফেলতে। কিন্তু এই চিঠি কেমন করে পৌঁছাবে মিনু? তার তো স্যারের ঠিকানা জানা নেই। কলেজের ঠিকানায় দিলে অন্য কেউ দেখেলে স্যারের অসম্মান হবে। এসব ভেবে আর লেখা হয়ে উঠে না। লিখতে না পেরে মিনু খুব করে কাঁদে। মাঝে মাঝে মিনুর কাছে মনে হয় এই কান্নায় বোধহয় একটা চিঠি। কেনজানি কাঁদলে চিঠি লিখতে না পারার কষ্টটা কোথায় যেন মিলিয়ে যায়।
মাহমুদ স্যারকে নিয়ে কলেজে মেয়েদের হা-হুতাশ দেখে মিনুর খুব রাগ হয়। একটু অভিমানও। তবে মাঝে মাঝে খুব ভালোও লাগে। যখন সবাই এই স্যারের খুব সুনাম করে, ভদ্র আর লাজুক স্যার বলে এটা সেটা নিয়ে আলোচনা করে তখন খুব ভালো লাগে। মিনু শুধু প্রহর গুনে কখন এই মানুষটার সাথে সামনা-সামনি কথা বলবে। কখন সবাই জানবে এই মাহমুদ স্যার শুধু মেহরুন আক্তার মিনুর। ঐ দিনটির কথা ভাবতে মিনুর খুব ভালো লাগে। স্যার খুব ভালো করে মিনুকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। আর মাত্র কিছুদিন। একটু গুছিয়ে নিয়েই পারিবারিকভাবে প্রস্তাব পাঠানো হবে। মিনু সব মেনে নেয়। কখনো এই মানুষটার সাথে কথা না বলে, সামনা-সামনি দেখা না করে, চিঠি না লিখে এত সহজে সবকিছু বিশ্বাস করতে, মেনে নিতে মিনুর একটুও কষ্ট লাগে না। একটুও না।
বৃষ্টির বেগ আরো বাড়ল। রান্না ঘর থেকে করলাভাজির ঝাঁঝালো পোঁড়া গন্ধ নাকে লাগছে। মিনু এখনো সেই চিঠি হাতে বসে আছে। বাসার কলিংবেল আবার বেজে উঠল। একবার, দুইবার, তিনবার। মিনুর এসব কিছু বোধহয় কানে যাচ্ছে না। চতুর্থবার কলিংবেল বাজতেই সৎবিৎ ফিরে আসল। সৎবিৎ ফিরতেই মিনুর প্রথমেই চুলার পুড়ে যাওয়া করলার ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে লাগল। মিনু দরজা না খুলে চিঠি হাতে দৌড় দিল রান্না ঘরে। চুলা থেকে হাড়িটা নামালো। পুড়ে একাকার। চিঠিটা একটু আড়াল করে দরজা খুললো। বুয়া এসেছে। রান্নাবান্না তেমনই থাকল। এই চিঠি এখন খুলতে ইচ্ছে করছে না। মিনুর খুব ভয় হচ্ছে। এতবছর পর এমন করে একটা চিঠি আসবে তা মিনু কল্পনাও করতে পারছে না। তাছাড়া মিনু তো প্রায় সবকিছু ভুলে গিয়েছে। ইচ্ছে করেই ভুলে গিয়েছে। এমন করে বছরের পর বছর নিজের ভেতর কষ্ট বহন করার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া একটা মৃত মানুষ কেমন করে চিঠি লিখে?
আঠারোতম চিঠি আসবে। শীতের সকাল। মিনু কলেজের উদ্দেশ্যে একটু আগে আগে বাসা থেকে বেরুলো। সকাল হলেও কুয়াশার মাত্রাটা একটুও কমেনি। মনে হয় না আজ সূর্যের আলো দেখা যাবে। এমনটা প্রায় হয়। মিনু এই কুয়াশার মধ্যে সকাল সকাল কলেজে পৌঁছে গেল। কলেজ গেইটে গিয়েই শুনলো মাহমুদ স্যারের দূর্ঘটনার কথা। আগের দিন সন্ধ্যার দিকে কলেজ থেকে ফেরার পথে সীতাকুন্ডে এক্সিডেন্টে মারা গেছেন। খবরটা শুনে মিনু কী করবে বুঝতে পারে না। কোথায় যাবে, কী করবে কিছুই না। নির্বাক, তচ্ছক্তি হারিয়ে প্রায় ঘন্টা খানেক কমনরুমে বসে থাকল। সবাই হা-হুতাশ করছে। বিজ্ঞানের বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের কেউ কেউ কাঁদছেও। সব শুনছে মিনু। তারপরও মিনু নির্বাক। নিজের ভেতর কষ্টগুলো জমে জমে বিশাল পাহাড় হয়ে যাচ্ছে। এই পাহাড় বুকে নিয়ে বাসায় ফেরা খুব কঠিন। মিনু বুঝতে পারে না সত্যি সত্যি সে বাসায় ফিরতে পারবে কি না।
মিনু বাসায় ফিরেছে। কেউ কিছু জানে নি। কেউ বুঝতে পারে নি মিনু নামের একটা মেয়েকে কতটা ভালোবেসে এই মাহমুদ নামের মানুষটা ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। এই ভালোবাসা লেগে আছে সতেরটা চিঠির পরতে পরতে। মিনু যে এই চিঠির ভালোবাসা আর বহন করতে পারে না। লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। রোজদিন লুকিয়ে লুকিয়ে এই চিঠির প্রতিটা শব্দ ছুঁয়ে দেখে মিনু। মিনুর বিশ্বাস ছিল আঠারোতম চিঠিটা সে পাবে। নিশ্চয় মাহমুদ স্যার মারা যাওয়ার আগে এই চিঠি পোষ্ট করেছিল। মিনু রোজদিন কলেজে গিয়ে অপেক্ষা করে। এই বুঝি সেই আঠারোতম চিঠিটা আসল। না, চিঠি আসে না। মিনুকে প্রতিদিন এমন করে অপেক্ষা করতে দেখে কলেজের অফিস পিয়ন মোজাম্মেল কাকা বুঝতে পারে। বুঝতে পারে বলেই একদিন আড়ালে নিয়ে বলে, তুমি আর অপেক্ষা করো না মা। স্যারের আর কোনো চিঠি আমার হাতে নেই। স্যার তো সকালে এসে আমার হাতে চিঠি দিত। আমি জানি তোমার কষ্ট হচ্ছে। খুব পছন্দ করত তোমাকে। স্যার খুব ভালো মানুষ। ভালো মানুষ বেশিদিন পৃথিবীতে থাকে না মা। তুমি এই মানুষটারে ভুলে যাও। মন দিয়ে পড়ালেখা করো। স্যারের মত মানুষ যখন পছন্দ করছে ঠিক তেমন একটা ভালো মানুষের সাথে তোমার বিয়ে হবে।
মোজাম্মেল কাকার কথা শুনে আর এক মুহূর্ত কলেজে থাকেনি মিনু। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছে। এমন একটা কষ্ট নিজের বুকে নিয়ে একা একা বহন করা কত যে কষ্টের তা মিনু বুঝতে পারছে। জীবিত থাকতে এই মানুষটার কথা কাউকে বলেনি। এখন মৃত মানুষটাকে নিয়ে কিছু বলতেও চায় না। নিজের ভেতর পুষে পুষে কেমন যেন শান্ত হয়ে গেল মিনু। সময় গড়াতে গড়াতে মিনু পাল্টেছে ঠিকই কিন্তু নিজের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে। একটা শূণ্যতা নিজের চাওয়া-পাওয়ার সাথে মিশে আছে। কষ্ট আর অভিমান নিয়ে একদিন সেই সতেরটা চিঠি ছিঁড়ে কুচি কুচি করল। এই যেন নিজের বুকের ভেতরটা কেটে ছিন্ন ভিন্ন করা। মিনু এসব এড়িয়ে যেতে চায়। পালাতে চায়। চিঠির অক্ষরে অক্ষরে লেপ্টে থাকা এই ভালোবাসার কষ্টগুলো মিনু এড়িয়ে যেতে চায়। চায় বলেই সব চিঠি কেটে ছিন্ন ভিন্ন করল।
আসিফের সাথে মিনুর বিয়ে হয় আইএ পরীক্ষার ঠিক পর পর। বিয়ের পর কিছুদিন বাড়ি থাকলেও একটা সময় স্বামীর সাথে চলে আসে চট্টগ্রাম শহরে। আসিফ ভীষণ ভালো মানুষ। একুশ বছরের এই সংসার জীবনে মিনু এই মানুষটার উপর খুব করে রাগ করেছে কখন মনে করতে পারে না। আসিফ সব সময় কেমন করে সবকিছু সামলে নেয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই আসিফ কেন এত বেশি ভালোবাসে তাকে? সে-তো আসিফের মত করে ভালোবাসতে পারেনি কখনো।
মিনু চিঠিটা খুলেনি। ইচ্ছে করেই খুলেনি। এতদিন পর একজন মৃত মানুষ এমন করে চিঠি লিখলে সেই চিঠি খোলার সাহস কেউ করতে পারে না। তাছাড়া মিনুর ভয় স্বামী সন্তান। এই বয়সে এসে মিনুর এমন একটা গোপন বিষয় সবাই জানবে এটা ভাবতে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠছে। তারপরও এই চিঠি ছুঁয়ে থাকতে তার খুব ভালো লাগছে। মিনুর মনে হচ্ছে এটা বোধহয় মাহমুদ স্যারের আঠারোতম চিঠি। যে চিঠি এতকাল কোথাও আটকে ছিল। কোনো এক কারণে হয়তো প্রাপকের হাতে পৌঁছাতে পারেনি। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে, তবে এই ঠিকানায় আসে কেমন করে? এসব ভাবতে ভাবতে মিনুর বুকের ভেতরটা কেমন একটা হাহাকার করে উঠে। মিনু তাহাহুড়া করে আলমারির একটা গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখে সেই চিঠি। ছেলেমেয়েরা আসার সময় হয়ে এলো।
চিঠি লুকিয়ে রাখলেও মিনুর ভেতর সব সময় একটা প্রশ্ন ঘুরে ফিরে। মাহমুদ স্যার তো বেঁচে নেই তবে কেমন করে এলো এই চিঠি? কেন এমন করে সবকিছু ওলটপালট করতে এই চিঠি এলো? সবকিছু তো সত্যি সত্যি ভুলে গিয়েছে মিনু। নিজের ভেতর বিশাল একটা ক্ষত ঢেকে রেখে মিনু তো বেশ ভালোই ছিল। তবে কেন এমন করে আবার মনে করিয়ে দিল?
দুইদিন পার হলো। এদিকে রাজশাহী থেকে আসিফ আসার সময় হয়ে এলো। কাল বোধহয় ফিরতে পারে। মিনুর ভেতর অস্তিরতা বাড়ছে। ছেলেমেয়ের কাছ থেকে এই অস্তিরতা লুকাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। মেয়েটা কিছু একটা বুঝতে পারে মায়ের এমন অস্বাভাবিকতা দেখে। বার বার জানতে চায় মায়ের কাছে। মিনুর বেশ ভয় হয়। মেয়ের এসব প্রশ্ন শুনে সেই ভয় বাড়ে। এই চিঠি যে আসিফ আসার আগেই কিছু একটা করতে হবে। না পড়ে ছিঁড়ে ফেলবে? কিন্তু দিনের পর দিন বুকের একটা কোণায় পুষে রাখা সেই মাহমুদ স্যারের ভালোবাসা উপেক্ষা করার সাহস যে মিনুর এত বছর পর এসেও নেই। চিঠির উপর নামটা দেখে মিনুর সবকিছু যেন আবার আগের মত করে জেগে উঠেছে। সেই অতীত, সেই ভালোবাসা, সেই স্বপ্ন। সব, সব, সব জেগে উঠল। এই জেগে উঠা ভালোবাসা মিনু অবহেলা করে কিভাবে?
আসিফ ফোন দিয়েছে। কাল ভোরেই ফিরছে। খবরটা মিনুকে আরো অস্তির করে তুলল। ঠিক মাঝ রাতে আলমারির সেই গোপন জায়গা থেকে চিঠিটা বের করে খুললো। চিঠি খোলা অবদি মিনুর হাত পা কাঁপছিল। খোলার পর মিনু কেমন যেন শান্ত হয়ে গেল। এই চিঠি যে তার স্বামী আসিফই লিখেছে,মিনু, আমি আসিফ। আমি জানি তুমি খুব অবাক হচ্ছো। অবাক হবারই কথা। এই চিঠির খামে আমি কেমন করে ঢুকলাম। ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। তোমার প্রিয় মাহমুদ স্যারের কথা আমি সব জেনেছি। জেনেছি তোমার পুরনো সেই ডায়রি থেকে। যেটা কলেজে থাকতে লিখতে।
প্রথম চিঠি পাওয়া থেকে শুরু করে সেই সতেরোতম চিঠি তুমি কেমন করে হাতে পেয়েছো তার সবটিই তো লিখেছ এই ডায়রিতে। সেই আঠারোতম চিঠির উদগ্রীবতার কথা পড়ে আমার যে কী হয়েছিল আমি তোমাকে বুঝাতে পারব না। একজন ছেলে হয়ে এমন করে কেউ কেঁদেছে শুনলে সবাই হাসবে। কিন্তু আমি সত্যি সত্যি কেঁদেছি মিনু। সত্যি বলছি, আমার একটুও হিংসে হয়নি। একটুও না। আমার কষ্ট হয়েছে। খুব কষ্ট। ইচ্ছে করছিল এই মাহমুদ স্যারের সাথে যদি একটু দেখা করতে পারতাম। ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছিল মানুষটাকে। এই ডায়রিটা হয়তো তুমি ছুঁড়ে ফেলতে পারোনি। মানুষ সবকিছু ছুঁড়ে ফেলতে পারে না। কিছু জিনিস নিজের অজান্তে লুকিয়ে থাকে। আমরা বুঝতেও পারি না এই লুকানো জিনিস কেমন করে নিজের ভেতর কতটা জায়গা নিয়ে জুড়ে থাকে।
মিনু, মাহমুদ স্যারকে তোমার এমন করে লুকিয়ে রাখা বা ভুলে যাওয়া আমি মানতে পারিনি। তোমাকে সামনা-সামনি আমি এই সত্যের মুখোমুখি করতে চাইনি। যদি করতাম তবে মাহমুদ স্যারের প্রতি তোমার ভালোবাসা জেগে উঠার চেয়ে আমাকে নিয়ে ভয় জাগত বেশি। আমি চেয়েছি মাহমুদ স্যারের দেওয়া নামটা চিঠির উপর দেখে তুমি যেন ঠিক আগের দিনগুলো উপলব্ধি করতে পারো। লজ্জা, ভয়, সংশয়ে এই উপলব্ধি, এই বোধকে তুমি এড়িয়ে গিয়েছো দিনের পর দিন।
এড়িয়ে গিয়েছো বলেই একটা সময় এমন করে তোমাকে ভালোবাসা মানুষটাকে কত সহজে তুমি ভুলে যেতে পারলে। এটা অন্যায় মিনু। এটা খুব অন্যায়। একটা মানুষ নিজের ভেতরের সব পবিত্রতা দিয়ে তোমাকে ভালোবাসবে আর তুমি দ্ধিধাহীনভাবে ভুলে যাবে। এটা কখনো হতে পারে না। এই আমি, তোমাকে এতটা ভালোবেসে যাচ্ছি কেন? আমিও কি মেনে নিতে পারব এমন করে আমাকে ভুলে যাওয়া? এই ভালোবাসাটা জেগে উঠা মানে আমার প্রাপ্তিটা বিশাল হওয়া। সব মানুষের কিছু অদৃশ্য পবিত্র ভালোবাসা থাকে। এই ভালোবাসা অবহেলা করা অন্যায়। এই অন্যায় মানুষকে খুব বেশি অসার করে তুলে। আমি চাই না তুমি এমন অসার হয়ে আমাকে ভালোবাসো।
ইতি
আসিফ
চিঠি হাতে নিয়েই মিনু কাঁদছে। এখন মাঝ রাত। ভোর হলেই আসিফ বাসায় ফিরবে। মিনু বুঝতে পারে আসিফ এই শহরেই আছে। রাজশাহী যায় নি। মিনুকে এমন করে একটা চিঠি দিবে বলে এই বাসা ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকছে। একটা মানুষ এতটা ভালোবাসা পুষে কেমন করে সবকিছু আগলে রাখে তা মিনু জানে না।
মিনু আজ রাতে ঘুমাবে না। সারাদির বৃষ্টি হলেও এখন আকাশ বেশ শান্ত। আকাশে অনেক তারা দেখা যাচ্ছে। দুর, অনেক দুর থেকে ঘন্টার শব্দ ভেসে আসছে। কেনজানি মনে হচ্ছে এই শব্দ বুঝি আসিফই দিচ্ছে। জানান দিচ্ছে এই মিনু নামের মেয়েটিকে আগলে রাখার জন্য বহুদুর থেকে ছুটে আসছে আসিফ নামের মানুষটা। হয়তো এই মানুষটার ভেতর জুড়ে আছে মাহমুদ স্যার। কলেজের পিয়ন মোজাম্মেল কাকা বলেছিল, স্যারের মত মানুষ যখন তোমাকে পছন্দ করছে, ভালোবেসেছে, ঠিক তেমন একটা ভালো মানুষের সাথে তোমার বিয়ে হবে। কথাটি মনে পড়তেই মিনু ফুঁপিয়ে উঠে। হাতে থাকা চিঠিটা বুকের সাথে লেপ্টে ধরে মিনু কাঁদছে। মিনুর সত্যি সত্যি মনে হয় এটা সেই আঠারোতম চিঠি।
গল্পের বিষয়:
গল্প