সিদ্ধান্তটা নিতে আমার এক মিনিটও দেরী হয়নি। ঝুমুকে বিয়েটা আমি করছি না। সে আমার আর্থিক অবস্থা সর্ম্পকে সব জানে, জানলেও, কেন এই পাগলামি টা করছে তা কিছুতেই বুঝতে পারছিনা। বাসায় চাল কেনার টাকাটা পর্যন্ত নেই। মা ছোট ভাইকে নিয়ে নানা বাড়ি আছে প্রায় দু’মাস ধরে। আমি কোন রকম একটা টিউশনির টাকা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি।
বাবা অকালে মারা গিয়ে হয়তো ভালোই করেছেন, এমন করুণ দৃশ্য তাকে দেখতে হচ্ছে না। তিনি ওপার থেকে দেখে থাকলেও হয়তো চোখের জল ফেলছেন আর আমায় বলছেন, জোয়ান ছেলে হয়েও মা-ভাইয়ের ভরণপোষণ নিতে পারছিস না, কেমন বেটা হয়েছিস রে তুই? নিজের ঠিক এমন অবস্থায় বিয়ে করাটা নিশ্চয়ই বোকামি। তাই দশ বছরের তিলেতিলে গড়ে উঠা সর্ম্পক টা ভেঙেই দিতে হয়েছে আমার। ঝুমু কে বলে দিয়েছি, না এই মুহুর্তে বিয়ে করা সম্ভব না। এই তো আর পাঁচ দিন পরেই ঝুমুর বিয়ে। কিন্তু সে আমাকে মাত্র দু’দিনের সময় দিয়ে বলেছে, “প্রয়োজনে না থাকবো। তবু একজন কে ভালোবেসে অন্যজনের সাথে ঘুমাতে যাব না। আর যদি যেতেই হয় চিরনিদ্রার ঘুম দেন।” এই বলেই সে ফোন কেটে দেয়, আমাকে আর কোন কথা বলার সুযোগই দেয়নি মেয়েটা। ঠিক, তখন থেকে আমার ভয় হচ্ছে, ঝুমুকে এত বছর ধরে চিনি, সে যা বলেছে তা হয়তো করেই ছাড়বে।
আমি পরিবারের বড় ছেলে, গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট। ছোট ভাইটা ছাত্র হিসাবে খুব ভালো, এবার এইচ.এস.সি দেবে।
ছোট ভাই আদনানের বয়স যখন পাঁচ তখনি বাবা যান। এরপর থেকে ওকেই আমি কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি। সংসারে অভাব অনটন থাকলেও, ওর পড়ালেখার খরচ থেকে শুরু করে কোন চাহিদার কমতি রাখিনি। এবার যখন নানা বাড়ি যাচ্ছিল, আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললো, “ভাইয়া ওখানে আমি যাব না।” ভ্রু কুঁচকে বললাম, “কেন কী হয়েছে?” সে মিনমিন করে বললো, “মানুষ নানার বাড়ি বেড়াতে যায়, আর আমরা সেখানে মাস খানেক পড়ে থাকি। আমার লজ্জা লাগে আমি যাব না।’ সে আমার চোখের দিকে তাকালো। “প্লিজ ভাইয়া আমি না হয় তোমার সাথে থাকি। মা একা যাক, তুমি বরং আমাকে টিউশনির ব্যবস্থা করে দাও। এ কদিন দু’ভাই যা পাই তাই না হয় খাব, প্রয়োজনে পানি খেয়ে থাকব।”
আদনানের কথা শুনে আমার চোখে পানি ঝড়ে। ওকে কীভাবে বুঝাই করোনার জন্য আমার নিজেই চারটা টিউশানি চলে যায়। নিজেই এখন পড়াতে ছাত্র খুঁজে পাচ্ছি না, আর ওকেই কী ব্যবস্থা করে দেব? যাবার সময় ওর পকেটে ১০০ টাকা গুঁজে দিয়ে বললাম, “কষ্ট নিস না ভাই আমার। আমার চাকরিটা হয়ে গেলেই এই কষ্টের দিন আর থাকবে না। ইনশাল্লাহ ভালো সময় একদিন আসবেই।” গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করার পর তিনটি বছর ধরেই তো ভালো সময়ের অপেক্ষায় ছুটছি ভালো সময় আসবে জানি, ঠিক কতটুকু কষ্ট ও ত্যাগের পর আসবে তা জানিনা। কিন্তু বেকার জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট টা মনে হয় এই কথাটা শোনা, “কী করছ এখন তুমি চাকরী-বাকরি কিছু পেলে?” টিউশনির পাশাপাশি চাকরির জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম এ কথা গায়ে তেমন লাগতো না। হাসি মুখে উত্তর দিতাম, এই তো দোয়া করবেন যেন হয়ে যায়। কিন্তু আজকাল কেউ চাকরির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে গায়ে বেশ লাগে। মনে হয় ইচ্ছে করেই যেন এটা বার-বার জিজ্ঞেস করে মজা নিচ্ছে।
একজন বেকার যুবক ঠিক তখনি করুণ অসহায়ত্ব অনুভব করে,যখন সংসারের অভাবটা তার মগজে ঢুকে যায়।
মাসের পর মাস চাকরির জন্য এখানে-ওখানে ছুটছি,কাজের কাজ তো কিছুই হচ্ছে না, বরং চাপা যন্ত্রণা গুলো লুকিয়ে সমাজের সাথে হাসি মুখে চলতে হচ্ছে এদিকে দিন শেষে ঝুমুর চাপতো আছেই। দিনের পর দিন আমার অপেক্ষায় সে ভালো-ভালো বিয়ের প্রপোজাল রিজেক্ট করে যাচ্ছে। প্রত্যেকবার ইন্টার্ভিউ দিতে যাবার সময় সে হাসি মুখে বলতো, “দেখো এবার হয়ে যাবে।” মুখ কালো করে যখন ফিরতাম সে শান্তনা দিত, “এবার হয়নি তো কি হয়েছে? পরের বার তো হবে।” শেষবার যখন ইন্টার্ভিউ দিয়ে ফিরছি পকেটে একটা টাকাও ছিল না। বাস থেকে নামার পর ফোন দিয়ে সে বলল, দেখা করে যেতে। খালি পকেটে ওর সাথে দেখা করতে যাই। এক সময় সে বলে, বাদাম খাবে। ভীষণ লজ্জায় পড়ে যাই। আস্তে করে মানিব্যাগ বের করে দেখি, কোনায় পাঁচ টাকার কয়েন পড়ে আছে। ঝুমু মুখ শুখনো করে বললো, ” কি টাকা নেই?” বিরস একটা হাসি দিয়ে দিলাম, ” ৫ টাকা আছে মাত্র।”
সে আমার মানিব্যাগটা নিলো, “হুম এতেই চলবে,” আমার হাতটা ধরে আবার বললো, “এখন থেকেই না হয় প্রেক্টিস করা শুরু করে দেই, কী বল? তুমি যা খাওয়াবে তাই খাব, না হয় না খেয়ে থাকব। ” সেদিন বাসায় ফিরে এসে দেখি মানিব্যাগে দু’হাজার টাকা। সুযোগ মত কখন রেখে দিয়েছে টেরও পাইনি। এবার ঝুমু কিছু বোঝে উঠার আগেই বিয়েটা হুট করে ঠিক হয়ে যায়। ছেলে যে তাকে দেখতে আসবে তা সে জানতই না। ছেলের মায়ের ঝুমুকে খুব পছন্দ হয়, নিজের হাত থেকে সোনার আংটি খুলে ঝুমুকে পড়িয়ে, বিয়ের কথা পাকা করে যান। ছেলে একটা প্রাইভেট কম্পানি তে চাকরি করে, সেলারি ৫০ হাজার টাকা। সব শুনে ঝুমু কে বললাম, ” আমার তো কিছুই নেই বিয়েটা তুমি করেই ফেল।” ঝুমুর নির্লিপ্ত জবাব, “কিছু থাক আর না থাক, আমার হাতটা ধরে রাখার সাহস তো আছে? তাহলেই চলবে।”
ওর কথা শুনে যন্ত্রনায় চোখ বুঝি। মা আমার পড়ে আছে তার বাপের বাড়ি। ছোটভাই, আমি, আর মা, আমাদের তিন জনের সংসারটাই চালাতে পারছি না; এর মাঝে ঝুমুকে’ই কীভাবে আনবো? আর কেনই বা তাকে এখানে এনে আমার কষ্টের ভাগিদার করব? হ্যাঁ, ঝুমু আমার সব কিছুই জানে, তবু তার এই পাগলামি কে প্রশ্রয় দেয়ার মানে হয় না এসব ভেবে সিদ্ধান্তটা নিতে আমার এক মিনিট ও দেরি হয়নি। চোখ মুখ শক্ত করে বললাম, ” না ঝুমু তোমাকে আমি বিয়ে করতে পারবো না।” “কেন পারবে না?” ঝুমু ফুঁপাতে ফুঁপাতে কাঁদতে লাগলো। আমি ফোনের ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। জানি, ঝুমু এক কথার মেয়ে, আমার সমস্যার কথা গুলো বলে ওকে আটকানো যাবে না। একটু ইমোশনাল হয়ে নরম গলায় বললাম, “আটাশ টা বছর ধরে তোমার বাবা-মা তোমাকে এত কষ্ট করে বড় করে তুলেছে। তুমি তো আমাকে মাত্র দশটা বছর ধরে চিনো। আর এই কয়দিনের সর্ম্পকের জন্য তুমি কী দীর্ঘ আটাশ বছরের রক্তের সেতু বন্ধন ছিন্ন করে দিবে?”
ঝুমু চুপ করে আছে কথার জবাব দিচ্ছিল না। “দেখো, আমি তো সেই সুযোগ টা পাইনি তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব। কদিন বাদেই তোমার বিয়ে, এখন তুমি যদি আমার সাথে চলে আসো, একবার ভেবে দেখেছো তোমার মা-বাবার কতটা অসম্মান হবে?” হঠাৎ কিছু না বলে সে লাইন টা কেটে দিল। আমি চোখ মুছি, ভাবছিলাম, যাক ঝুমু শেষ পর্যন্ত বূঝতে পেরেছে। কিন্তু ঘন্টা খানেক যেতে না যেতেই ঝুমু আবার কল দেয়। তার কান্নার গোঙরানি তে কথা গুলো বুঝতে বেশ কষ্টই হচ্ছিল। শেষে এক প্রকার হুমকি দিয়েই বললো, “আমায় বিয়ে করবে কী করবে না তা ভাবার জন্য দু দিনের সময় দিলাম। মনে রেখো, তোমার সিদ্ধান্তের উপরেই নির্ভর করছে অনেক কিছু।”
আজ ঝুমুর দেয়া শর্তের দুদিন শেষ হয়েছে। সারাটা দিন খুব অস্তিরতা ও আতংকে কাটে আমার। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে এলো তবু ঝুমুর কল আসছে না। সময় যত যাচ্ছে অস্তিরতা ততো বাড়ছে। প্রথমত, সে ফোন দিলে কী জবাব দেব? আর এখনো ফোন দিচ্ছেই না বা কেন? সিদ্ধান্ত পালটে ফেললে আমায় অত্যন্ত জানানোর কথা। নাকী কোন অঘটন ঘটিয়ে বসেছে মেয়েটা বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। হঠাৎ রিংটোনের শব্দে চমকে ওঠি! দ্রুত বালিশের পাশ থেকে ফোন নিয়ে দেখি, নানা ফোন দিয়েছেন। রিসিভ করতেই, নানা বললো, “হ্যালো সিফাত, কেমন আছিস ভাই?” “জ্বী নানা ভালো।” “শোন যে কথার জন্য তোকে ফোন দিয়েছি, চাকরির জন্য খুব ছুটেছিস, কোন লাভ তো হলো না। ব্যবসা করার জন্য তোকে আগেও বলেছিলাম মুখের উপর না করে দিয়েছিস। এবার আর না শুনতে চাই না। যত টাকা লাগে আমি দিবো, তুই নিজে পায়ে দাঁড়াতে শিখ ভাই। “
হঠাৎ আমার চিন্তার মোড় ঘুরে গেল, ভাবতে শুরু করলাম,এত দিন চাকরির পিছনে না ছুটে কোন ব্যবসা শুরু করলেও এত কষ্টের দিন দেখতে হত না আমার। তাছাড়া, ঝুমু কেও “কী হলো কথার জবাব দিচ্ছিস না কেন?” চোখ মুছে বললাম, “নানা আপনি তাই ব্যবস্থা করেন।” “আলহামদুলিল্লাহ। যাক সিদ্ধান্ত টা নিতে দেরি করলেও, দোয়া করি তোর জীবনে যেন ভালো কিছু হয়।” “আচ্ছা, নানা ফোন রাখি, আমার জরুরী একটা কাজ করতে হবে।” নানা কিছু বলার আগেই ফোন কেটে দিলাম। তিন দিন পরেই ঝুমুর বিয়ে। ঝুমুর পরিবার আমাকে মেনে নিবে কীনা জানিনা, তবু তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াব। প্রয়োজনে পায়ে পড়ে তাদের মেয়ে কে ভিক্ষা চাইব। আর ঝুমু তো আমার সাথেই সংসার করতে চায়।
চাপা নিশ্বাস আটকে রেখে দ্রুত ঝুমুর নাম্বারে কল দিলাম। একী! ফোন টা বন্ধ দেখাচ্ছে। কিন্ত তার নাম্বার তো বন্ধ থাকার কথা না, ভয় হচ্ছে সে কী খারাপ কিছু ঘটিয়ে ফেলেছে? ঘড়ির দিকে তাকালাম রাত নয়টা বাজে। দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামলাম। সিএনজি করে ঝুমুর বাসায় যেতে ৩০মিনিট লাগবে মাত্র। আবছা অন্ধকারে গলির মধ্য দিয়ে দৌড়তে লাগলাম, খানিক দূরেই বড়-রাস্তার মোড় , সিএনজি সেখানেই পাওয়া যাবে। সিএনজি দ্রুতবেগে চলছে, এর মাঝেই বেশ ক’বার ফোন দিয়েছি নাম্বারটা এখনো বন্ধ রয়েছে । অস্তিরতা বেড়েই চলছে আমার। এক সময় সিএনজি ঝুমুর বাসার সামনে এসে থামে। দেখি সারা বাড়ি লাল নীল বাতিতে সাজানো হচ্ছে। মুহুর্তেই বুকটা হু হু করে ওঠে আমার।
সিএনজি থেকে নামতেই টুং টুং শব্দে বেজে উঠল ফোন। চেক করে দেখলাম মেসেজ এসেছে। মেসেজ টা ঝুমুর…
ঝুমু লিখেছে__” তুমি সেদিন ঠিকি বলেছিলে, রক্তের সেতু বন্ধনটা আসলেই অনেক দামি। যাদের ভালোবাসা আদরযত্ন ও ছায়ায় বড় হয়েছি, তাদের কে কষ্ট দিয়ে নিজে মত করে চলাটা এক প্রকার রক্তের সাথে বেঈমানি।
যাই হোক, আমার সিদ্ধান্তে তুমি হয়তো খুশিই হবে। কিন্তু, অন্য একজনের ঘর করে কতটুকু সুখী হতে পারব জানি না। তবে বাবা-মায়ের এই হাসি মুখটা দেখে খুব ভালো লাগছে। ভেবে দেখলাম,আমি এখন কোন পরিস্থিতি তৈরী করে কীভাবেই বা তাদের এই হাসি মুখটা কেড়ে নেই? জীবনে সুখদুঃখ যাই আসুক না কেন; হৃদয়ের একটি কোণে তোমার ভালোবাসার স্মৃতি টুকু রেখে জীবনটা নাহয় এভাবেই কাটিয়ে দেব। ভালো থেকো তুমি। ” এক নিশ্বাসে মেসেজটা পড়া শেষ করলাম। বুঝতে পারছি, বড্ড দেরি হয়ে গেছে আমার। এখন কী করেই বা ঝুমুর সামনে গিয়ে দাঁড়াব? ঝুমু যে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটা খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে চিন্তেই নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ঝুমু কী কোনদিনই জানবে, ভালোবাসার টানে আমি ঠিকি ফিরে এসেছিলাম তার কাছে?
নিষুপ্তি জেঁকে বসেছে গোটা শহরে।ফ্যাকাসে অন্ধকারে কেমন যেন এক বিষাদের গন্ধ। আনমনে ছোট ছোট পা ফেলে রাস্তায় হাঁটছি, আর নিঃসঙ্গ ভাবনা গুলো খুবলে খাচ্ছে আমার একাকীত্বকে। ভাবছি, আজ শূনো পকেট বলে ঝুমুর বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারিনি, তবে বুক পকেটে ভর্তি করা কষ্ট গুলো নিয়েই ফিরছি। হ্যাঁ, একটা সিদ্ধান্তেই হয়তো বদলে যায় মানুষের জীবন। বেকার জীবনের কঠিন সময়ে গুলোতে বাস্তবমুখী কোন সিদ্ধান্ত পৌঁছতে পারিনি বলেই তো আজ ভীষণ অপূর্ণতায় ঘিরে ধরেছে আমার চারপাশ …
গল্পের বিষয়:
গল্প