প্রতিদিন একবার হলেও মেয়েটা দরোজার সামনে এসে উঁকি দেয়৷ বিব্রতকর অবস্থা। কেউ দেখে ফেললে আমার মান সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে৷ গুজব রটিয়ে যাবে যে, ‘ছাত্রকে পড়াতে এসে ছাত্রের বোনের সাথে প্রেম!’
সবাই ছি ছি করবে। ‘শিক্ষক হয়ে প্রেম করেন লজ্জা করে না? বিয়ে করে নিলেই তো পারেন৷ এরপর বউয়ের সাথে যত ইচ্ছা প্রেম করবেন।’ উফ! ভয়ে আত্মা কেঁপে ওঠে৷ এতোদিনের অর্জিত মান সম্মান এই একটা মাত্র কারণে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে? ভাবতেই অজানা আতঙ্কে বুক ধুকপুক করে।
অথচ মেয়েটা সবকিছু উপেক্ষা করে দরোজার আড়াল থেকে রোজ উঁকি দিয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে৷
আমি ভুলেও ওদিকে তাকাই না৷ দরজার আড়াল থেকে এক জোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে সেটা দেখেও না দেখার ভান করে থাকি। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রাফিকে পড়াতে থাকি৷ ফাতেমা যে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখে তা যে রাফি জানে সেটা ইতোমধ্যেই বুঝে গেছি। কারণ হলো, সে এই বিষয়ে নীরব ভূমিকায় পালন করছে৷ আর নীরবতা হচ্ছে সম্মতির লক্ষণ। এর মানে বোনের এই কাজের সাথে রাফির গোপন সংযোগ আছে। রাফি চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। ছেলেটা প্রচুর কথা বলে৷ পড়তে চায় না। একটু পড়েই বলে, ‘এতোখানি পড়ে ফেলেছি! আজকে আর পড়বো না স্যার। প্লিজ স্যার। আজকে আর পড়বো না৷ স্যার স্যার প্লিজ স্যার!’ ঘ্যান ঘ্যান করতেই থাকে৷ ভালো লাগে না৷ তবুও জোর করে পড়াতে হয়। আর্থিক অভাবে আছি। নাহলে এইসব টিউশনি ফিউশনি মাইনষে করায়!
যা ভয় পেয়েছিলাম তাই-ই হয়েছে৷ চিঠি এসে পৌঁছে গেছে। চিঠি! আমার তো এখন মাথা খারাপ অবস্থা। চিঠি পৌঁছে দেয়ার গুরু দায়িত্ব পালন করেছে স্বয়ং আমার ছাত্র। পড়ানো প্রায় শেষ। পড়া দিয়ে বাসায় চলে আসবো৷ এমন সময় ফাতেমা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নীচু স্বরে রাফিকে ডাক দিলো, ‘রাফি?’ রাফি ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল৷ কেন জানি আমিও তাকালাম৷ দেখি ফাতেমা দাঁড়িয়ে আছে। সবুজ ওড়না দিয়ে মাথা, চুল, কান সব ঢেকে রেখেছে৷ তবে মুখ খোলা রেখেছে৷ হাতে একটা ট্রে। ট্রেতে নাস্তা৷ আমি সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিলাম। মনে মনে বেশ অবাক হলাম। কারণ প্রতিদিনই সে নিজে রুমের ভিতরে এসে নাস্তা রেখে যায়৷ অথচ আজ ভিতরে না ঢুকে দরোজায় দাঁড়িয়ে আছে। তাছাড়া, এই তিন মাসের মধ্যে সে যে কয়েকবার এসেছে মাথায় কেবল কোনমতে ওড়নাটা রেখে তারপর আসতো৷ কোন কোন দিন ওড়না ছাড়াই আসতো৷ অথচ আজকে মাথা, চুল এমনকি কানও সুন্দর করে ঢেকে তারপর এসেছে। মেয়েটার ভাবভঙ্গি ভালো ঠেকছে না৷
বয়স ষোল, সতের হবে হয়তো৷ এই বয়সটা মারাত্মক। অতি আবেগ কাজ করে এ বয়সে৷ এই বয়স কুমন্ত্রণার বয়স৷ এ বয়সের মেয়েদের মধ্যে উড়ুউড়ু একটা ভাব থাকে, রঙিন রঙিন স্বপ্ন মনের কোণে উঁকি দিয়ে যায়। তাই ভয়ে আছি, কোন দিন কী করে বসে বোঝা মুশকিল। সেই ভয়ের প্রথম ধাপ সুসম্পন্ন হয়ে গেল৷ রাফি নাস্তার ট্রে নিয়ে এসে টেবিলে রেখে মুচকি মুচকি হাসছে৷ হাসিটা ভালো ঠেকলো না৷ অশুভ ইঙ্গিত৷ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি ব্যাপার হাসছো কেন?’ ‘কিছু না স্যার, এমনিই হাসছি।’ ‘কিছু না মানে? কিছু তো আছেই। বলো কেন হাসছো?’ রাফি একটা কাগজ এগিয়ে দিলো। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কী এটা?’ ‘আগে নেন স্যার, তারপরে বলি।’ রাফির মুখে দুষ্টুমির হাসি। আমি বললাম, ‘আগে বলো কি এটা? তারপর নেবো। এছাড়া নেবো না৷’ রাফি ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালো। আমি আড়চোখে দেখার চেষ্টা করলাম। ফাতেমা এখনও দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। রাফি ইশারায় কিছু একটা জিজ্ঞেস করলো৷ আমি অলরেডি বুঝে গেছি কাহিনী কী।
মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম টিউশনিটা ছেড়ে দেবো। নাহলে বিপদে পড়তে হবে৷ মান সম্মানের ব্যাপার স্যাপার৷ এলাকার সবাই আমাকে ভালো জানে। এখন যদি প্রেম বিষয়ক কোন গুজব রটিয়ে যায় তাহলে, শ্যাষ! কিন্তু টিউশনিটা ছেড়ে দিলে হাত খরচ বন্ধ। পকেটে শূন্যতা আর বুকে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে দিন কাটাতে হবে। কতগুলো বইয়ের লিস্ট করে রেখেছি সেগুলো আর কেনা হবে না৷ আর এখন নতুন কোন টিউশনি পাওয়াটাও মুশকিল। শরীরে আঘাত লাগলে সেটা সহ্য করা যায়, মেনে নেয়া যায়, ক্ষত মুছে যায়। কিন্তু মান সম্মানে আঘাত লাগলে তা সহ্য করা যায় না, মেনে নেয়া যায় না, কখনও মুছেও যায় না। টাকা হারিয়ে গেলে, উপার্জন করে তা পূরণ করা যাবে৷ হাজারটা পথ খোলা রয়েছে। কিন্তু হারিয়ে ফেলা মান সম্মান ফের ফিরে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাও আবার স্পর্শকাতর একটা বিষয়ে। স্পষ্ট শুনতে পেলাম ‘বল, আমি দিয়েছি।’ চমকে উঠলাম আমি৷ ফাতেমার কণ্ঠে দৃঢ়তা৷ রাফি আমার দিকে কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘স্যার, আপু দিছে৷’
রাফি আর কিছু বললো না। ওর মুখে এখন আর হাসি নেই। চুপচাপ চিঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কোন প্রতিউত্তর করছি না। কী করবো, কী বলবো বুঝে উঠতে পারছি না। জীবনে প্রথমবার এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন। আমি রাফিকে বাড়ির কাজ ও পড়া দেখিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। রাফি ইতস্তত করে বললো, ‘স্যার, এটা নেন স্যার?’ কিছু বললাম না৷ এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। এরপর চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রাফি এসে হাত ধরলো আমার। ‘নাস্তাটা খেয়ে যান স্যার, প্লিজ স্যার৷ আপু অনেক কষ্ট করে আপনার জন্য পিঠা বানিয়েছে। প্লিজ স্যার!’ রাফির কণ্ঠে কী ছিলো জানিনা৷ না করতে পারলাম না৷ ফাতেমা এখনও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ মেয়েটা চুপচাপ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ কেমন অসহায় লাগছে মেয়েটাকে৷ করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। উপেক্ষা করার শক্তি আমার নেই। নাস্তা খেয়ে চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছি৷ রাফি আবার চিঠিটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘স্যার, নেন প্লিজ!’
এবারও আমি নীরব থাকলাম। চুপচাপ দরোজার দিকে এগুলাম। রাফিও পিছনে পিছনে আসছে৷ ছেলেটার মুখে হাসি নেই৷ মুখটা কালো হয়ে আছে৷ দরোজার সামনে এখনও দাঁড়িয়ে আছে ফাতেমা৷ আমি বের হতে চাইলাম। সে পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে। আমি বিরক্তস্বরে বললাম, ‘যেতে দিন প্লিজ!’ কোন ভাবান্তর নেই৷ অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি মাথা নীচু করে রেখেছি৷ মুখের দিকে তাকালে গুনাহ হবে। বড়সড় গুনাহ। জান্নাতে যেতে না পারি, জাহান্নামের জ্বালানি হবার ইচ্ছে নেই৷ ‘পীঠা ভালো হয়নি? মানে প্রথমবার বানিয়েছি তো এজন্য আরকি..’ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জানতে চাইলো ফাতেমা। আমি ইতস্তত করে সৌজন্যতার সাথে বললাম, ‘না না ভালো হয়েছে৷’ ‘জানেন, আমিও এখন আপনার মতো মিথ্যা বলতে পারি না৷ মিথ্যা শুনতেও পারি না৷’ আমি মাথা নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। হৃৎপিন্ডটা অনবরত ধুকধুক করেই যাচ্ছে। অনুভব করলাম, আমিও কাঁপছি৷ আমার পা কাঁপছে৷
মেয়েদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সৎসাহস আমার কোন কালেই ছিল না। বলতে গেলে, সবসময় পালিয়ে বেড়াতাম মেয়েদের থেকে৷ রাস্তার একপাশ দিয়ে কোন মেয়ে গেলে আমি দ্রুত রাস্তার অপর পাশে চলে যেতাম। আর আজ কিনা একদম সামনে দাঁড়িয়ে!! ‘জানেন, আমি আমার এই নাতিদীর্ঘ জীবনে অনেক ছেলেকে দেখেছি৷ কিন্তু আপনার মতো ছেলে আর কখনো দেখিনি। সম্ভবত দেখবোও না। যদি অনুমতি দেন তবে আপনার কাছে একটা অনুরোধ করবো?’ আমার কণ্ঠে জড়তা৷ কী বলবো বুঝে উঠতে পারছি না৷ একই সাথে ভয় কাজ করছে৷ কেউ এভাবে কথা বলতে দেখলে সর্বনাশ! ফাতেমাদের বাড়িটা রাস্তার সাথে৷ বাড়িটা দোতলা। নীচ তলায় রাফির পড়ার ঘর। সিড়ি দিয়ে কেউ আসলেই দেখে ফেলবে৷ ইতস্তত করে বললাম, ‘জ্বী বলুন।’
রাফির কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললো, ‘প্লিজ চিঠিটা নিন। আপনার সাথে এভাবে কেউ কথা বলতে দেখলে খারাপ ভাববে৷ ভয় নেই। আপনি যা ভাবছেন এটা তা নয়৷ চিঠিটা পড়লেই বুঝবেন৷ হ্যা, আপনাকে আমার ভালো লেগেছে৷ হয়তো বা ভালোও বেসে ফেলেছি৷ কিন্তু আপনাকে কখনও বিয়ে বহির্ভূত অবৈধ সম্পর্কের আহবান করবো না৷ আমি নিজেকে শুধরাতে চাই আর এ শুধরানোর জন্য আপনার সাহায্য খুব দরকার। প্লিজ সাহায্য করবেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, প্লিজ!’ আমার মাথায় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা কী বলতে চাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না৷ নিজেকে শুধরাতে চাইছে শুধরে নেবে৷ আমার সাহায্যের দরকার কেন? ‘বেশিক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত হবে না৷ চিঠিতে আমি বিস্তারিত লিখেছি৷ প্লিজ চিঠিটা নিন। চিঠিটা পড়লেই সব বুঝতে পারবেন৷ প্লিজ নিন!’
আমি কিছু বললাম না। চিঠিটা নিয়ে নীরবে চলে আসলাম৷ নিজের ভেতর কেমন যেন অজানা অচেনা একটা অনুভূতির অস্তিত্ব অনুভব করলাম। জীবনে প্রথম পাওয়া চিঠি! আগ্রহ নিয়ে চিঠিটা খুললাম৷ প্রথম বাক্যটায় চোখ পড়তেই বিষ্ময়ে মুখ হা হয়ে গেল। হে আল্লাহর বান্দা, আসসালামু আলাইকুম। আল্লাহর অশেষ রহমতে ভালো আছেন অবশ্যই। চিঠি লেখার দুঃসাহস দেখানোর জন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি৷ এই মুহূর্তে এছাড়া আর অন্য কোন বিকল্প উপায় ছিল না৷ যেদিন রাফিকে পড়াতে এসেছিলেন সেদিনই প্রথম আপনাকে দেখা৷ আপনার গেটআপ দেখে কেমন ক্ষ্যাত ক্ষ্যাত লাগছিল আপনাকে। তখন আমি আধুনিকতার অন্ধকারে নিমজ্জিত৷ আজকের এই ফাতেমার সাথে তিন মাস আগের ফাতেমার কোন মিল পাবেন না৷ তিন মাস আগের ফাতেমা ইসলাম কী? এটাই জানতো না৷ পর্দা তো দূরে থাক৷ আমি এখন বদলে গেছি৷ আর আমার এই বদলানোর পেছনে যে মানুষটার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন আপনি, আপনি এবং আপনি৷
প্রথম দিন আপনাকে দেখে হেসেছিলাম। আপনার মুখে দাড়ি ছিল বলে৷ আজ আল্লাহর কসম করে বলছি, আপনি যদি দাড়ি না রাখতেন আপনাকে আমি পুরুষ বলেই স্বীকার করতাম না৷ আমি ইসলাম সম্পর্কে প্রয়োজনীয় মোটামুটি যা জানার দরকার তা জেনেছি। আমি ইসলাম সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে চাই৷ কথাটা আপনার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই সত্য যে, জেনেরেল পড়ুয়া হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মেয়ে দ্বীন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। অথচ জেনেরেল পড়ুয়া মেয়েদের জন্য ক্বওমী মহিলা মাদ্রাসা ব্যতীত আর কোন প্লাটফর্ম আমার জানামতে নেই৷ আমার মতে, এ বিষয়ে আমাদের দেশের বড় বড় আলেমদের উচিত জেনেরেল পড়ুয়া মেয়েদের দ্বীন শেখার জন্য আলাদা স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান তৈরির উদ্যেগ নেয়া৷ এতে তারা একই সাথে দ্বীন ও দুনিয়ার প্রয়োজনীয় সকল জ্ঞানই অর্জন ও বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারবে৷ জেনারেল পড়ুয়া মেয়েদের জন্য কোন দ্বীনি প্রতিষ্ঠান খুঁজে না পাওয়ায় আপনার স্মরণাপন্ন হয়েছি৷
আমি ইসলাম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই৷ আমি পরিপূর্ণ ভাবে ইসলামমুখী হতে চাই৷ দ্বীনের সব হুকুম আহকাম মেনে চলতে চাই৷ এখন আমাকে কী করতে হবে? প্লিজ সাহায্য করবেন! আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে৷ ভীষণ পছন্দ৷ অশুদ্ধ করে বললে আপনার প্রেমে পড়ে গেছি। এখন আপনার কাছে একটা প্রশ্ন, আমাকে কে কি আপনার পছন্দ হয়? কিংবা ভালো লাগে? প্লিজ জানাবেন উত্তরটা ভয় পাবেন না৷ আমি আপনাকে অবৈধ সম্পর্কের প্রস্তাব ভুলেও দেবো না৷ অন্য সময় হলে ঠিকই দিতাম৷ এখন এটা অসম্ভব! কারণ, আমি জেনেছি যে, বিয়ে বহির্ভূত প্রেম হারাম। তাই আপনার সাথে হারাম সম্পর্কে জড়াতে চাই না৷ হালালভাবে আপনাকে পেতে চাই৷ আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে এটা বলেছিই৷ আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছে কিনা জানাবেন দয়াকরে৷ উত্তরের অপেক্ষায়।
ইতি,
আল্লাহর বান্দী! ফাতেমা৷ মেয়েটাকে যেমন ভেবেছিলাম মেয়েটা আসলে তেমন না৷ কেমন যেন ভালোলাগা অনুভব করলাম। আমার জন্য মেয়েটা দ্বীনের পথে ফিরে আসছে ভেবে ভালো লাগছে৷ অদ্ভুত ভালোলাগা৷ পরদিন পড়ানো শেষ করে ঘর থেকে বের হতে যাবো তখন দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় ফাতেমা৷ চমকে গেছি ওকে দেখে৷ আজকে মুখও ঢেকে রেখেছে। নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলো,
‘চিঠিটা পড়েছেন?’
‘হ্যা।’
‘প্রশ্নের উত্তরটা?’
‘কোন প্রশ্ন?’ কিছুটা অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বললাম আমি।
‘চিঠিতে যে প্রশ্নটা ছিলো সেটা৷’
‘সেটা কোনটা?’
‘আমাকে কি আপনার পছন্দ হয়?’
আমি প্রতিউত্তরে কী বলবো বুঝে উঠতে পারছি না৷ পছন্দ তো হয়ই৷ না হওয়ার কারণ দেখি না৷ কিন্তু এইটুকুই বা কিভাবে বলবো? আমি নীরব দেখে, ফাতেমা আবার বললো, ‘প্লিজ বলুন! আমাকে কি আপনার পছন্দ হয়?’ আমি কিছু বললাম না৷ চুপচাপ চলে আসি৷ পরের দিন টিউশনিতে যাইনি৷ ইচ্ছে নেই৷ ফোন দিয়ে না করে দেই৷ আমি আর পড়াতে পারবো না। দুদিন পর৷ একটা উপন্যাস পড়ছিলাম৷ রাত তখন আট কি নয়টা হবে৷ হুট করে ফোনে কল আসে৷ রাফির আম্মু ফোন। অবাক হলাম। ভয়ও হলো ভীষণ। অজানা ভয়৷ ফাতেমা কিছু করে বসেনি তো? ফোন রিসিভ করতেই সায়েরা খাতুন বললেন, ‘হ্যালো তানিম?’
‘আসসালামু আলাইকুম। জ্বি আন্টি, বলুন।’
‘তুমি কি ফ্রি আছো?’
‘জ্বি আন্টি ফ্রি আছি। বলুন কী বলবেন?’
‘ফোনে বলা সম্ভব না৷ তুমি এক্ষুণি আমাদের বাড়িতে চলে এসো৷’
‘আচ্ছা আন্টি।’
মনের ভেতর কেমন খুঁত খুঁত করছে৷ হঠাৎ করে জরুরী তলব করলো কেন? ফাতেমা কি বাসায় জানিয়ে দিয়েছে? না, ভালো লাগছে না কিছুই। অসহ্য লাগছে৷ বাসার ভেতর ঢুকেই দেখলাম বেশ কয়েকজন মানুষ বসে আছেন সোফায়৷ অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠলো সর্বাঙ্গ৷ আমার মনে শুধু একটাই প্রশ্ন ফাতেমার কিছু হয়নি তো? আমাকে দেখে রাফি দৌড়ে এলো৷ হাত ধরে ভেতরের একটা রুমে নিয়ে গেল৷ সায়েরা খাতুন বসে আছেন বিছানায়। আমি সালাম দিলাম৷ আন্টি হাত দিয়ে ইশারা করে বিছানার ওপর বসতে বললেন। আমি ভয়ে ভয়ে বসে পড়লাম।
‘জানো তানিম, আমার না খুব ইচ্ছে ছিল আমার মেয়েটাকে বেশ ধুমধাম করে বিয়ে দেবো৷’ আন্টি থামলেন। তার চোখ দিয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে৷ ‘কেন জানো? কারণ আমার মা তার মেয়ের বিয়েটা ধুমধাম করে দিতে পারেননি৷ মা যেদিন মারা গিয়েছিলেন সেদিন বলেছিলেন, হ্যা রে মা,তোর বিয়েটা তো ধুমধাম করে দিতে পারি নাই৷ তুই ফাতেমার বিয়েটা ধুমধাম করে দিস৷ নাতি জামাইকে দেখে যাবার সৌভাগ্য তো আর আমার নাই রে মা৷ সায়েরা খাতুন কাঁদছেন৷ আমি বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছি৷ কী হয়েছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না৷ আমি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে আন্টি? খারাপ কিছু?’ আন্টি চোখের জল মুছলেন৷ এরপর আমার দিকে তাকালেন। করুণ দৃষ্টি৷ আমার বুকের ভেতরটা নড়ে উঠলো। ‘ফাতেমা সুইসাইড’ সায়েরা খাতুন কাঁদছেন। আমি ভীষণ রকম চমকে উঠলাম।
‘ফাতেমা সুইসাইড করেছে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আন্টিকে৷ আন্টি চোখ মুছে বললেন, ‘হুম, সুসাইড করতে চেয়েছিল৷ ভাগ্যিস রাফি এসে বলেছে আমাকে, নাহলে আমার মেয়েটা আজ লাশ হয়ে যেত।’ আন্টি আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ছেন৷ আমার অবস্থাও নাজেহাল। হুট করে কিছু বোঝার আগেই আন্টি আমার সামনে হাঁটুগেড়ে বসে আমার হাত ধরে বললেন, ‘তুমি ফাতেমাকে পছন্দ কর না তানিম?’ প্রশ্ন শুনে ভড়কে গেলাম আমি৷ কী উত্তর দেবো বুঝতে পারছি না৷ সবকিছু গোলমেলে লাগছে৷ ‘পছন্দ করো ফাতেমাকে? বলো তানিম বলো? জানো, ফাতেমা কার জন্য সুইসাইড করতে চেয়েছে জানো তুমি?’
আমি তীব্র পিপাসা অনুভব করলাম।
গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না৷ তানিম জানে কার জন্য ফাতেমা সুইসাইড করতে চেয়েছে৷ ফাতেমা সুইসাইড করতে পারে, এটা ভাবতেও পারছে না তানিম। ‘বলো তানিম, ফাতেমাকে কি তোমার পছন্দ হয়?’ আমি হ্যা সূচক মাথা নাড়ালাম৷ আন্টি মুখে হাসি নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন৷ বিছানার উপর রাখা একটা প্যাকেট হাতে দিয়ে বললেন, ‘নাও বাবা, জলদি এটা পরে নাও। আমি দেখি গিয়ে, ফাতেমার কতটুকু কী হলো? দ্রুত পরে নাও৷’ আন্টি চলে গেলেন৷ আন্টির ভেতর চাপা উচ্ছ্বাস৷ আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম৷ কী হচ্ছে কিছুই বুঝতেছি না৷ রাফি এসে দাঁড়াল আমার পাশে৷ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার তোমাদের বাসার সবাই পাগল হয়ে গেছে? কী হচ্ছে এগুলো?’ রাফি কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো, ‘আপুর বিয়ে স্যার।’
‘বিয়ে? কার সাথে বিয়ে?’
‘কেন স্যার, আপনার সাথে!’
‘আমার সাথে?’
‘হ, আপনার সাথেই তো। আপনাকে ছাড়া আপু আর কাউকেই বিয়ে করবে না৷ জানেন স্যার, আপু ভীষণ জেদী৷ আপনি আর পড়াবেন না, আমাদের বাসায় আসবেন না দেখে আপুর সে কী কান্না !’
.
পাঞ্জাবি পরে ড্রয়িং রুমে যেতেই চমকে ওঠে তানিম৷ তানিমের বাবা মা, বোন বসে আছে সোফায়৷ সবার ভেতর চাপা উত্তেজনা৷ সবার মুখে হাসি৷ রাত এগারোটা তিপ্পান্ন মিনিট৷ পাশাপাশি বসে আছে তানিম ও ফাতেমা৷ রুমটা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে৷ তানিম অবাক হলো, এতো অল্প সময়ে এতো কিছু কীভাবে করলো এরা? তানিম ফাতেমার দিকে তাকালো৷ ফাতেমা ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো, কী কেমন হলো আমাদের বিয়েটা? দা’রুণ না? খানিক আগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে তারা।
গল্পের বিষয়:
গল্প