দীর্ঘ পাঁচ মাস চিকিৎসা শেষে বাসায় আসার পর ড্রেসিং টেবিলটা যখন আমার সামনে থেকে অন্য রুমে সরিয়ে ফেলা হলো তখন আমি খুব শক্ত করে আম্মুকে জড়িয়ে ছিলাম। আমার ফোঁটা ফোঁটা চোখের পানিতে আম্মুর কাঁধের একাংশ ভিজে গেছিলো। আব্বু খাটের এক কোনায় চুপচাপ বসে ছিলেন। বাহিরে মানুষের আনাগোনা টের পাওয়া যাচ্ছিল , ভিতরে কি চলছে তা জানার উদ্দেশ্যে ।
অতি উৎসুক মানুষের বিড়ম্বনা এড়াতে আব্বু তখন দরজা খুলেই সবাইকে বললেন, আমার মেয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়েছে, কাউকে খুন করেনি ! দেখতে হলে যাদের অবহেলায় আমার মেয়ের জীবন নষ্ট হয়েছে তাদের যেয়ে দেখেন। তাদের বিচার কামনা করুন যাতে আমার মেয়ের মতো আপনাদের মেয়েরাও এমন অবহেলায় অগ্নিদগ্ধ না হয়। আব্বুর কথা শুনে কিছু মানুষ চলে গেলো আর কিছু হয়তো থেকে গেলো, আমার এই নষ্ট হয়ে যাওয়া চেহারাটা দেখার উদ্দেশ্যে। এই পাচঁমাসে সবচেয়ে যেটা পরিবর্তন হয়েছে সেটা হলো সুসময়ের মাছি গুলো দূরে সরে গিয়েছি আমার এ দুঃসময়ে। বাবা-মার পরে যেই মানুষটা আমার সবচেয়ে প্রিয়জন ছিলো সেও একবারও খোঁজ নেয়নি আমার, কি অদ্ভুত !
সেদিন মিহিররের সাথে দেখা করার কথা ছিলো। তিন বছর রিলেশনের পর দু পরিবার থেকেই আমাদের এ্যাঙ্গেজমেন্ট হয়েছিলো তার দুদিন আগে। বিয়ের কেনাকাটার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। মিহির আমার জন্য বসুন্ধরায় অপেক্ষা করছিলো আর আমি সিএনজিতে করে তার কাছে যাচ্ছিলাম। সিএনজি কিছুদূর যেতেই বিকট আওয়াজ পেলাম আর চারিদিকে আগুন দেখলাম। তারপর আর কিছুই মনে নাই। যখন জ্ঞান আসলো তখন হসপিটালের বেডে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু সবার কথা বুঝতে পারতাম। বুঝে গেছি একমাস পেরিয়ে গেছে হসপিটালে। ধীরে ধীরে মৃত্যু দুয়ার থেকে ফিরে এলাম। হসপিটালে কত আত্নীয় স্বজন আমাকে দেখতে গেলো কিন্তু সেই প্রিয় মানুষটা আমাকে কখনো দেখতে এলো না।
বাসায় এসে বাবার ফোন দিয়ে তাকে কয়েকবার ফোন দিলাম। কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে ফোন রিসিভ হলো না। বুঝে গেলাম সে আমাকে ইগনোর করছে। আমার তিন বছরের ভালোবাসা আমার অগ্নিদগ্ধ চেহারার কাছে হার মেনেছে ! চিৎকার করতে যেয়েও বারবার নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরেছি যেনো ভিতরের কষ্টটা বাহিরে প্রকাশ না পায়।
সন্ধ্যায় কলিংবেলের আওয়াজে বাবা দরজা খুলেন। মিহিরকে দেখে বাবা অবাক হয়েই তাকে ভিতরে আসতে বলেন। বাবা দরজা থেকেই আমাকে ডাক দিয়ে বলেন, অন্তি দেখ মিহির এসেছে । বাবার গলায় মিহিরের নামটা শুনেই চমকে উঠে তার সামনে আসার জন্য উঠলাম। তখনই মিহিরের গলায় শুনতে পেলাম, “থাক অন্তিকে ডাক দিয়ে লাভ নেই, আমি আংটি ফেরত দিতে এসেছি আর অন্তিকে দেয়া আংটি ফেরত নিতে এসেছি । আমার পরিবার অন্তিকে এখন মেনে নিবে না। আর আমার পক্ষেও অন্তিকে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। “
পর্দার আড়াল থেকে সব শুনছিলাম আর নিজের প্রতিই ঘৃনা হচ্ছিল, এমন একটা মানুষকে তিন বছর ধরে ভালোবাসছিলাম ! যে কিনা আমার বিপদে আমাকে একা ছেড়ে চলে গেলো ? আল্লাহ যা করেন তা নাকি বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন। হয়তো এই বিপদ দিয়েই একজন মুখোশধারীকে চেনালেন। যে কিনা সত্যি আমাকে ভালোবাসেনি শুধু ভালোবাসায় অভিনয় করেছে মাত্র ! নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম এমন স্বার্থপর ব্যক্তি যেনো কখনো এমন দূর্ঘটনার শিকার না হয়। নিজে অগ্নিদগ্ধ হয়ে বুঝতে পারি কতটা যন্ত্রনা সহ্য করতে হয় পোড়া রোগীদের। স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে পাঁচবছর থেকে এই বার্ন ইউনিটে কাজ করছি। কতশত পোড়া রোগীদের দেখি, কত রোগী লাশ হয়ে যায় যন্ত্রনায় কুড়ে কুড়ে।
রাতে বার্ন ওয়ার্ডে একটা মেয়ে ভর্তি হলো। গরম পানি পড়ে মেয়েটার শরীরের অর্ধেকর বেশি পুড়ে গেছে। মেয়টার কান্না দেখে আমার চোখের পানিও গড়িয়ে পড়ছিলো। তিন বছরের একটা ছোট্ট বাচ্চামেয়ে এই অসহ্য যন্ত্রনা কিভাবে সহ্য করবে তা ভেবে। মেয়েটার মা কান্না করছে আরো কতো আত্নীয় স্বজন। একটু পরে একজনকে দেখে চেনা চেনা লাগলো। কাছে যেতেই দেখি মিহির। মেয়েটাকে ধরে সে কি কান্না তার। বাচ্চা মেয়েটার থেকেও বেশি কাঁদছে সে। আমার বুকের ভিতরটা কেমন জানি করে উঠলো। আমি তো আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম মানুষটা যেনো কখনো এমন বিপদে না পড়ে তাহলে ! মিহির আমার পোড়া চেহারা কখনো দেখেনি তাই কাছে যেয়েই শান্ত সুরে বললাম, আপনি চুপ করুন। বাচ্চা মেয়েটা ভয় পেয়েছে সাথে তার যন্ত্রনাও হচ্ছে। প্লিজ আপনারা চুপ থাকুন। আল্লাহর কাছে দোয়া করুন সে যেনো সুস্থ হয়ে ওঠে দ্রুত। মেয়েটা সুস্থ হলে তাকে আবার ছেড়ে যাবেন না তো,,,?
আমার এই কথাতেই মিহির চমকে উঠলো। আমি সরে গেলাম। ডাক্তাররা মেয়েটার চিকিৎসা করছে আর আমি তাদের সাহায্য করছি। মনে মনে ভাবছি আল্লাহ, এ কেমন খেলা, যেই কারনে মিহির আমাকে ছেড়ে গেলো, সেই একই কারনে কি তার মেয়েকে ছেড়ে যেতে পারবে ? উত্তরটা হয়তো আমারও জানা, না কখনোই সে তার মেয়েকে ছেড়ে দিতে পারবে না কারন সে বাবা।আর যাকে সে ছেড়ে গিয়েছিলো সে তার আপন কেউ ছিলো না। একজন বাবার কাছে তার কুৎসিত মেয়েও সুন্দর, কিন্তু প্রেমিকের কাছে না। বাচ্চাটা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে বাবা- মার কোলে ফিরে যাক সেটাই একমাত্র চাওয়া। যখন কেউ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় আপনজনদের কাছে তখনই মনটা সুখে ভরে যায়। কারো প্রস্থান জীবনকে থমকে দিলেও সময় হলে আবার নতুন করে নতুন ভাবে বাঁচার প্রেরণা দেয়।
গল্পের বিষয়:
গল্প