রাশির হাতের পোড়া জায়গায় ফুঁ দিয়ে মলম লাগাচ্ছে ওর শ্বাশুড়ি শাহনাজ বেগম। মলম লাগানোর মাঝে ছেলে বৃত্তর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে আর রাগে ফুঁসছে। বৃত্ত কাচুমাচু হয়ে বসে আছে। শাহনাজ বেগম নিজের রাগ দমন করতে না পেরে বলে ওঠে, ‘আজ দুপুরে তোর খাবার বন্ধ। রাশি তোকেও বলে দিচ্ছি এই অকর্মার জন্য খাবার সাজাস তাহলে আমি তোর সাথে কথা বলব না।’
‘মা তোমার ছেলে খুধা সহ্য করতে পারে না।’
‘এহহ, খুধা সহ্য করতে পারে না।
এ সব ন্যাকামি বাদ দে। এই বজ্জাতকে আমি জন্ম দিয়েছি হারে হারে চিনি। হ্যাঁ রে বৃত্ত তোকে কে বলেছিল পিছন থেকে ওকে ভয় দেখাতে? ভালো করে চেয়ে দেখ মেয়েটার হাত কতটা পুরে গেছে। এর আগেও বহুবার তুই এমন বাজে মজা করেছিস।’
‘মা তুমি ওকে এভাবে বল না। আমার আরো খেয়াল করা উচিত ছিল। ‘
‘তুই চুপ কর রাশি। আর কত বাঁচাবি একে। একটা অপদার্থ অকর্মা।’
‘কি দিন এলো বাবা, নিজের বাড়িতে নিজেরই কোনো সম্মান নেই।’
‘বৃত্ত, তোর কোনো দিন কোনো সম্মান ছিল?’
‘ রাশি এ কি করলে তুমি?’
‘একদম রাশিকে টেনে নিজের দোষ ঢাকার চেষ্টা করবি না।’
‘মা এবারের মতো ছেড়ে দাও ওকে। এমনটা আর কখনো করবে না।’
‘দেখ দেখ কিছু শেখ। রাশির কথাতে এবারের মতো তোকে ছেড়ে দিচ্ছে।
রাশি এটাই কিন্তু শেষ বার। আমি যাই, গিয়ে রান্নাটা শেষ করি।’ শাহনাজ বেগম যেতেই বৃত্ত রাশির পাশে গিয়ে বসে। পোড়া জায়গায় ফুঁ দিতে থাকে। মুখটা এতটুকু করে আছে বৃত্ত। রাশি মুখ টিপে হাসছে। আস্তে করে বৃত্তের মাথাটা উঁচু করে রাশি। চোখে পানি টলমল করছে।
‘কি হয়েছে, চোখে পানি কেন?’
‘কিছু না।’
‘আমার থেকে লুকাবে?’
‘সত্যি বলছি, কিছু হয় নি।’
‘আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল।’ বৃত্ত রাশির চোখের দিকে তাকায়।
‘সরি রাশি, আমার দুষ্টুমির জন্য তোমার হাত পুরে গেছে, কষ্ট হচ্ছে। আমি আর কখনো এমন করব না।’
‘ধুর, পাগল ছেলে। আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না। ‘
‘হ্যাঁ তাতো দেখতেই পাচ্ছি।’
‘হুম, খুব দেখছ তুমি। অনেক দেখা হয়েছে এবার গিয়ে গোসল সেরে নাও। নামাজের সময় হয়ে গেছে। ‘
‘আমার খাবারের কি হবে? ‘
‘খাবার বন্ধ। হাহা’
‘নিজের বাড়িতে নিজেকে ঘর জামাই মনে হচ্ছে। ‘
‘অনেক কথা হয়েছে, এবার তুমি যাবে নাকি আমি মাকে ডাকব।’
‘হুহ, মায়ের বৌমা।’
বৃত্ত বাথরুমে গেলে রাশি বিছানার উপর পাঞ্জাবি, পাজামা আর টুপি রেখে রান্নাঘরের দিকে যায়। স্বামী আর শ্বাশুড়িকে নিয়ে রাশির সংসার। ওর শ্বশুর মারা যায় যখন বৃত্ত ১২ বছরের। সৎ মায়ের সংসারে ভালোভাবে খেয়ে পরে থেকেও মায়ের ভালোবাসা পায়নি রাশি। বিয়ের আগে বাংলা ছবি আর অন্যদের কথা শুনে ভেবেছে ওর শ্বাশুড়িও মনে হয় দজ্জাল হবে। কিন্তু ওর ভাগ্যে ছিল অন্য কিছু। বৃত্তের জন্মের পর শাহনাজ বেগম এর খুব ইচ্ছে ছিল মেয়ের। কিন্তু কোনো কারনে তার সে ইচ্ছে পূরন হয় নি। তাই সে ঠিক করে রেখেছিল, ছেলের বউকে মেয়ের মতো ভালবাসবে, স্নেহ করবে। রাশির ভাবনা মিথ্যা করতে আর শাহনাজ বেগমের ইচ্ছে পূরণ করতে উপরওয়ালা তাদের দেখা করিয়েছে। প্রথম দেখাতেই রাশিকে পছন্দ হয় শাহনাজ বেগমের। সেদিনই পাকা কথা সেরে আসে। বিয়ের পর রাশির ধরাণা ভুল প্রমানিত হয়। শ্বাশুড়ি-বৌমার সম্পর্ক যে এমন বন্ধুত্বপূর্ণ হতে পারে তা কেউই ভাবেনি। রান্না প্রায় শেষের পথে, রাশিকে দেখে মুচকি হাঁসে শাহনাজ বেগম।
‘কিরে অপদার্থটা গোছলে গেছে? ‘
‘হুম। মা তুমি ওকে এমন করে বল কেন?’
‘হাহাহা’
‘হাসছ কেন বল না?’
‘ওকে এমন করে বলতে আমার ভালো লাগে। তাছাড়া বৃত্ত কথা শেষ করার আগেই বাথরুম থেকে বৃত্তের ডাক।
‘ও মা, পানি ঠান্ডা কেন? গিজার টা অন কর।’
‘আমি গিজারটা অন করে দিয়ে আসি।’
রাশি যেতেই নিজ মনে হাসে শাহনাজ বেগম। ‘দুটোই পাগল। আল্লাহ যেন দুটোকেই এমন একসাথে রাখে।’ রাশি যতক্ষণ না নিজ হাতে বৃত্তের পাঞ্জাবিতে আতর লাগিয়ে দিচ্ছে ততক্ষণ বৃত্ত বসে থাকে, সে নামাজে যাবে না। রেডি হয়ে রাশির কপালে চুমু দিয়ে মায়ের কাছে যায়। মা বৃত্তের কপালে চুমু দিলে বৃত্ত বাড়ি থেকে বের হয়।
‘একি আমার খাবার কই?’
‘নেই.’
‘নেই মানে কি? আমার ক্ষুধা লাগছে মা।’
‘তো?’
‘রাশি তুমি কিছু বল?’
‘ রাশি কিছু বলবে না। রাশি তুই কেন বসে আছিস, হা কর। খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ‘
বৃত্ত বসে আছে আর ওর মা রাশিকে খায়িয়ে দিচ্ছে। বৃত্ত দেখছে আর ফুলছে। শাহনাজ বেগম রাশির মুখে খাবার দিতে নিলে বৃত্ত তা কেড়ে খেয়ে নেয়। রাশি আর ওর মা একে অপরের দিকে চেয়ে হেসে দেয়, একে বৃত্ত অস্বস্তিতে পরে। শাহনাজ বেগম পরে দুজনকেই খায়িয়ে দেয়। লেপের নিচে বৃত্তের বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে রাশি। এ রুমের এটাই নিয়ম, রাশিকে বৃত্তের বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে হবে। অবশ্য পরে এটা রাশির অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। এখন বৃত্তের বুকে মাথা না রাখলে রাশির ঘুম হয় না। কিন্তু আজ কেন যেন রাশির ঘুম আসছে না। রাশি যখন বুঝতে পেরেছে বৃত্ত ঘুমিয়ে পরেছে তখন আস্তে করে উঠে যায়। চাদর নিয়ে বারান্দায় রাখে বেতের সোফায় বসে পরে। উত্তরের বাতাস কাটা দিচ্ছে ওর শরীরে। উঠে গিয়ে কফি বানিয়ে আবার ফিরে আসে।
রাশি কোনোদিন ভাবে নি ওর জীবনে এত সুখ এতো ভালোবাসা আসবে, ও কখনো প্রথম হবে। ‘প্রথম হবে’- কথাটা শুনে অবাক লাগছে তাইতো! বুঝিয়ে দিচ্ছি। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান রাশি, বড় ভাই আর ছোট বোন আছে ওর। স্কুল থেকে শুরু করে ভার্সিটি পর্যন্ত ওর রেজাল্টের অবস্থান দ্বিতীয় ছিল। এ নিয়ে বেচারির খুবই হতাশা । কেন সব সময় দ্বিতীয় হবে, আরে প্রথম হতে না পারলেও তৃতীয়, চর্তুথ বা অন্য কিছু তো হতে পারত। ওর ভাই আর ছোট বোন এ ব্যাপারটা নিয়ে ওকে ক্ষেপাত। রাশি ওর সমস্ত কথা একটা ডায়রিতে লিখত। বৃত্ত আর ওর মা যেদিন রাশিকে আংটি পরাতে যায় সেদিন রাশির রুমে সেই ডায়রিটা পায় বৃত্ত। অন্যের ব্যক্তিগত জিনিস অনুমতি না নিয়া পরাটা বেশ খারাপ দেখায়, কিন্তু রাশির ছোট বোন রিধি বৃত্তকে পরতে বল, আর বলে ‘আপুর ব্যাপারে এই ডায়রি থেকে অনেক কিছু জানতে পারবে।’
ইচ্ছে আর হাতে অনেকটা সময় থাকার কারনে বৃত্ত পরতে রাজি হয়। রাশির পছন্দ অপছন্দ সব কিছু এমনকি দ্বিতীয় নিয়ে ওর হতাশার কথাও জানতে পারে। বৃত্ত নিজের মাথার দুষ্টু বুদ্ধির গাছে পানি দিতে থাকে। বিয়ের আগে রাশি আর বৃত্তের তেমন কোনো কথা হয় নি। বৃত্ত ইচ্ছে করেই তেমন কোনো সুযোগ করে নি। বৃত্তের মায়ের কথায় রাশি বুঝতে পেরেছিল বৃত্তের জীবনে রাশিই প্রথম মেয়ে। এ ব্যাপারে রাশি খুবই খুশি ছিল। স্বামীর জীবনে প্রথম নারী হবার অন্যরকম সুখ, অন্যরকম ভালোলাগা। বিয়ের রাতে থমথমে মুখ নিয়ে ঘরে ঢুকে বৃত্ত। কোনো কথা না বলেই বারান্দায় চলে যায়। অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন বৃত্ত রুমে আসছিল না তখন রাশি বারান্দায় যায়। শুনকে পায় বৃত্তের নিচু গলায় বলা কিছু কথা। রাশির উপস্থিতি বুঝতে পেরে উঠে দাড়ায়।
‘তোমার সাথে আমার কিন্তু কথা আছে রাশি, অনেক আগেই বলতে চেয়েছি কিন্তু পারি নি।’
‘কি কথা?’
‘বাধ্য হয়ে আমি তোমাকে বিয়ে করেছি।
আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। মা তোমাকে পছন্দ করেছে বলে তোমাকে বিয়ে করতে না করতে পারিনি।’ রাশি যেন পাথর হয়ে গেছে, কিছু বলার শক্তি নেই ওর। যাকে নিয়ে এতো স্বপ্ন দেখল আজ যে অন্য কথা বলছে। একটি নববিবাহিতা যখন তার বিয়ের ১ম রাতে স্বামীর মুখ থেকে এমন কথা শুনে তখন তার কি করা উচিৎ? ‘আমি জানি কথাগুলো তোমার কাছে ভালো লাগছে না। কিন্তু আমি তোমার থেকে এ কথা আড়ালে রাখতে পারব না। আমার মা তোমাকে পছন্দ করে এ বাড়িতে আমার বউ করে এনেছে। আমি তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে মাকে কষ্ট দিতে পারব না আবার তোমার সাথে থাকতেও পারব না।’
‘চিন্তা করবেন না। আপনার সাথে আপনার ভালোবাসার মানুষের মিল হবে। মা কিছু জানতে পারবে না। তিনি নিজে আপনার ভালোবাসার মানুষকে আপনার কাছে নিয়ে আসবে। তাকে ভাবতে বারন করবেন, কারন আমি আপনার থেকে আমার অধিকার চাইব না।’ রাশি ব্যাগ থেকে একটা শাড়ি বের করে ওয়াশরুমে চলে যায়। বৃত্ত রুমের মধ্যে মুখ চেপে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। রাশি বের হবার আগে বৃত্ত বিছানার একপাশে সুয়ে পরে। রাশি পরে এসে বালিশ নিয়ে বারান্দায় চলে যায়, সোফায় শুয়ে পরে। বৃত্ত কিছু না বলে শুয়ে পরে। পরেরদিন রাশির কথা আর ব্যবহার দেখে বোঝার উপায় নেই রাতে কি হয়েছে। বৃত্ত আবারও মুগ্ধ হয় রাশিতে। এভাবে চলতে যায় আরো কয়েকটা দিন। এবার কিছুটা বৃত্তের মায়ের চোখে বৃত্ত আর রাশির ব্যাপারটা কিছুটা ধরা পরে। তিনি দুজনকেই ডাকে।
‘কি হয়েছে রে তোদের মধ্যে? ‘
‘কিছু হয়নি মা।’
‘রাশি তুই বল কি হয়েছে? ‘
‘মা তোমাকে একটা কথা বলব, আগে বল রাগ করবে না।’
‘আচ্ছা রাগ করব না। এবার বল।’
‘তোমার ছেলে অন্য কাউকে ভালোবাসে। তুমি প্লিজ ওদের চার হাত এক করে দাও।’
‘এবার সবটা আমায় ঢুকল। বৃত্ত আজ তোর হচ্ছে, ফাজিল বউয়ের সাথে এমন দুষ্টুমি কেউ করে?’
‘মানে?’
‘আমি তোকে সবটা বলছি রাশি।
এই ফাজিলটা তোর ডায়রি পরে জেনেছে তুই সব সময় দ্বিতীয় হয়েছিস বলে তোর মন খারাপ। আর ও এটা নিয়ে মজা করেছে তোর সাথে। ও শুধু তোকে ভালোবাসে, আর কাউকে না। বৃত্ত তো নিজে তোকে পছন্দ করেছে।’ রাশি বৃত্তের দিকে তাকালে ও হেসে দেয় আর রাশিও। ‘কি ম্যাডাম আবার পুরোনো কথা ভাবছেন?’ বৃত্তের কথায় ঘোর কাটে রাশির। বৃত্তকে দেখে হেসে দেয় রাশি। দুই মগ কফি নিয়ে দাড়িয়ে আছে বৃত্ত। টেবিলে মগ দুটো রেখে রাশির চাদরে ঢুকে যায়। ‘তুমি আর যে ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় হও না কেন, আমার জীবন আর মনে তুমিই প্রথম। ভালোবাসার প্রথম কিরণ তুমি।’
গল্পের বিষয়:
গল্প