একটু বিরহ চাষ

একটু বিরহ চাষ
আমার কাছের বন্ধুটা প্রায়ই বলে, “যে মানুষটা তোকে ঠকিয়েছে, তার জন্য দুঃখ করিস না। সে কখনো সুখী হবে না।”আমি তখন বলি, “নারে, আল্লাহ যেন তাকে ক্ষমা করে দেয়। আমিও ক্ষমা করে দিয়েছি। দোয়া করি সে সুখী হোক।” বন্ধুটা তখন বলে, “আমি তোর মতো এত মহৎ না। যে ঠকিয়েছে, প্রতারণা করেছে। তার জন্য কখনো দোয়া আসবে না। অভিশাপ আসবে।”
আমি তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবতে থাকি, যাকে ভালোবাসা যায়, তাকে কখনো অভিশাপ দেয়া যায়? মধ্য রাতে দুই চোখে যখন ঢুলু ঢুলু ভাব, তখনো চাঁদটা দেখা করতে আসেনি। মেঘের আড়ালে অভিমান করে লুকিয়েছে। আমার মতো বড্ড অভিমানী চাঁদটা। অপেক্ষার সময় যখন পেরুচ্ছিলো না, আমি ফেক আইডি দিয়ে তাঁর ফেসবুক আইডিতে প্রবেশ করলাম। কী আশ্চর্য, এখনো (তাঁর) লেখার সময় সম্মান দিয়ে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করেছি। আমার বন্ধুটা দেখলে এক চোট বকা দিবে আমি নিশ্চিত। ভাবছিলাম, আমাকে ঠকিয়ে হয়তো সে অনুতপ্ত। আমার মতো তাঁরও নিশ্চয় রাতগুলো নির্ঘুম কাটে। হয়তো বিরহী পোস্ট লিখে দুঃখের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে। কিন্তু যা দেখলাম, তাতে করে দুটি চোখ বড্ড অপরাধী হলো। কেন যে চোখ দুটো দেখল, সেই অনুতাপে জ্বলছি। সে তাঁর পোস্টে বিভিন্ন মানুষের কমেন্টে “আমি ঠকিনি, ঠকাইছি” লিখে কয়েকটা হাসির ইমুজি দিচ্ছে। অর্থ্যাৎ আমাকে ঠকিয়ে সে বড় খুশি। আমার বন্ধুটা নিশ্চয় বলবে, “কী ব্যাপার? তুই না তাঁর জন্য দোয়া করেছিলি?”
বর্ষার পানি যখন থৈ থৈ। তখন এক বকের ভারী কষ্টের দিন। কারণ বক বেশি পানিতে মাছ শিকার করতে পারে না। বকের দরকার অল্প পানি। যেখান থেকে ঠোকর দিয়ে মাছ খেতে পারবে। সেই কষ্টের দিনগুলোতে বকটা অনাহারে থাকে। বক গেল পানকৌড়ির কাছে। পানকৌড়ি আবার বেশি পানিতেই মাছ শিকার করে। বক পানকৌড়িকে বলল, ” ভাই আমার এই কষ্টের দিনে তুমি আমার বন্ধু হবে? এখন তুমি আমাকে মাছ ধরে খাওয়াও, পানি কমে গেলে তখন আমি মাছ শিকার করে তোমাকে খাওয়াবো।” পানকৌড়ি বন্ধুত্ব করলো বকের সাথে। পুরো বর্ষা মৌসুম মাছ শিকার করে নিজেও খেল, সাথে বককে খাওয়ালো। কিন্তু পানি কমে যাবার পর বককে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। কারণ সে তো তখন নিজেই শিকার করতে পারে। যে মানুষটা আমার সাথে প্রতারণা করেছে, সে ভাবছে আমি পানকৌড়ির মতো বড্ড বোকা। কিন্তু আমি বোকা ছিলাম না। আমি শুধু বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু সেই মানুষটা কখনো বিশ্বাসের যোগ্য ছিল না। চিনি আর লবন একই রকম দেখতে হলেও, স্বাদ ভিন্ন। প্রতারকদের চেহারা মানুষের মতো হলেও তারা কি আদৌ মানুষ।
চাঁদটা উঁকি দিয়ে আবার চলে গেল। আজকের দুঃখ বিলাসটা ঠিক জমছে না। হাতে জ্বলন্ত সিগারেটের ধোঁয়া মৃদু বাতাসে চোখ দ্বয়ে এসে জ্বালাতন করছে। কানে হেডফোন গুঁজে দিয়েছিলাম বিরহের গান শুনবো বলে। একটু পর পর বিজ্ঞাপনের যন্ত্রনায় ইচ্ছে করছে নিজেই ইউটিউবকে গান শোনাই। এরই মধ্যে চাঁদের অভিমান করা আমার রাগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আকাশ যদি হয় আদালত। আকাশের উপরে বসে আছেন বিচারপতি। আদালতে আমি মেঘের বিরুদ্ধে অভিযোগ দ্বায়ের করবো। কেন সে চাঁদকে পশ্রয় দিয়ে তাকে আড়াল করে রাখে? আকাশের উপর বিচারপতির কাছে আরেকটা নালিশ আমার। পৃথিবীর প্রতারকগুলোর গায়ে কেন “প্রতারক” শব্দটি লিখে দিলে না? কত অগনিত মানুষ বেঁচে যেত প্রতারণা থেকে। তারা তো রাস্তায় বড় ছুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। কেউ হেঁটে গেলে পেটে বড় ছুড়িটা ঢুকিয়ে দিবে। প্রতারণা করে তিলে তিলে মারার চেয়ে একেবারে শেষ করে দে। সিগারেটটা মনে হচ্ছে চড়া হয়ে গেছে। কেমন আবোল তাবোল বকছি। চাঁদটা আবার আসবে, এমন বিশ্বাস নিয়ে বসে থাকলে আবারো প্রতারিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাহির থেকে এসে শুয়ে আছি। অন্ধকার রুম, পাখাটার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। পাশের রুমে কারো নাক ডাকার শব্দ ভেসে আসছে কানে। আমি অন্ধকার দেয়ালে হাতের আঙ্গুলে লেখার চেষ্টা করলাম, “প্রতারক।” অন্ধকারেই মনে হচ্ছিলো, অক্ষরগুলো ঠিকঠাক লেখা হচ্ছে না। মোবাইলে টাইপিং করার উছিলায় লেখার বেলায় যে শূণ্য পাবো তা বেশ স্পষ্ট। জানালাটি অল্প খোলা। গাঢ়ো অন্ধকার রাত নেমে এসেছে চারিদিকে। আমারই কেবল দুই চোখে রাত নামেনি, নেমেছে বর্ষা। থৈ থৈ বর্ষার পানি কখনো উপচে পড়ে গাল বেয়ে নেমে আসছে। চোখ দুটো আবারো অপরাধী হলো। প্রতারকের জন্য পানি ফেললে অবশ্যই চোখ দুটো দোষী। জগত সংসারে একটা নিয়ম জারি করা আছে। পুরুষ মানুষের কাঁদতে হয় না। কান্না করা মেয়েদের অভিধানে লিখা। আর কোনো মেয়ে ঠকিয়েছে এই কথাটিও যেন কাউকে জানানো যাবে না। তাহলে হাসির পাত্র হতে পাবে। এই ধরা বাঁধা নিয়মগুলো মাঝে মধ্যেই ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে খোলা আকাশের নিচে চিৎকার করে কেঁদে নিজেকে হালকা করে ফেলি। তারপর আবারো বেশ কিছুদিন স্বাভাবিকভাবে চলতে পারবো। যতদিন না কান্নাগুলো বুকের ভিতর জমা হয়।
চোখ জোড়াতে এবার সত্যিই ঘুম এসে যাচ্ছে। তাঁর আগে ক্ষমা করে দিতে চাই পৃথিবীর সকল মানুষকে। বিশেষ করে যারা আমার কষ্টের কারণ হয়েছে। তারা ক্ষমা পেয়ে যাক। ভালো থাকুক তারা। তাদের যেন কখনো চোখের জল ফেলতে না হয়। পৃথিবীটা অনেক সুন্দর। বেঁচে থাকাটাও পরম পাওয়া। সেখানে কে কখন ঠকিয়েছে সেসব মনে না আনাটাই উত্তম। শুধু আমার রাতগুলো যেন ভালো কাটে। নয়তো মিথ্যে হাসির আড়ালে দুঃখ হাতড়ে পেয়ে রাতের গভীরতাও বুক চাপড়ে কাঁদবে। সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে নতুন এক আমি’র জন্ম। কাজ, মানুষের সাথে অট্টহাসিতে মেতে থাকা। পেট ভরে ভোজন আরো কত কী। “আসলেই জীবন অনেক সুন্দর, যদি তুমি দিন শেষে একা না হও।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত