বাবু খাইছো

বাবু খাইছো
বাসরঘরে এক হাতে লেহেঙ্গা ধরে আরেকহাতে ঝাড়ু নিয়ে রুম ঝাড়ু মারছি।আমিই বোধহয় প্রথম মেয়ে যে কি না বাসরঘরে ঘর পরিষ্কার করছি।চারিদিকে ছরানো- ছিটানো গোলাপ,গাঁদা ফুলের পাপড়ি ঘরটাকে পুরো বস্তি করে রেখেছে।যা কি না আমার একদম পছন্দ না। বড় বড় করে নাক টেনে কাঁদছি আর আমার স্বামীর চৌদ্দ গুষ্ঠীকে বিরবির করে বকে উদ্ধার করছি।শালা,বুইরা জানি কোথাকার? বুড়া বয়সে বিয়া করনের সখ জাগছে।তাও আমার মতো একটা ১৯ বছরের মেয়েকে।
শেষ পর্যন্ত তিন বাচ্চার বুইরা বাপ কে বিয়ে করলাম আমি।রুমের এই অবস্থা আমার স্বামীর আগের পক্ষের বাচ্চা গুলো করেছে।কিছুখন আগে যখন আমাকে আমার ননদ বাসর ঘরে বসিয়ে দিয়ে গেল। ঠিক তার পরপরি তিনটা পুঁচকে ইঁদুর এসে সারা ঘর টর্নেডোর মতো তছনছ করে ফেলেছে।একটা ফুলও বোধহয় আস্ত নেই।আমার উনির দুইটা মেয়ে একটা ছেলে। ছেলেটার বয়স ৪ বছর। একটা মেয়ের বয়স হবে ৫ বছর।আরেকটার ৭ বছর।বাপরে কি দুষ্টু।ওদের মা নাকি মারা গেছে। বেচারী মরে গিয়ে বেঁচেছে।বেচে থাকলে এদের জ্বালায় আবার মরার চেষ্টা করতো।আর আমি ফাইসা গেছি মাইনকা চিপায়।
নিজেকে এখন নিজেই বকছি।দিন তোর সত্যিই খারাপ নোভা।এটা তোর শান্ত শিষ্ট, ভদ্র বিশিষ্ট বয়ফ্রেন্ড তাজের সাথে ব্রেকআপ করার অভিশাপ।কেন করতে গেলি ব্রেকআপ।তাহলে কি আর এরকম ৩৫ বছরের বুড়োর ঘর করতে হয়।তাজ আই মিস ইউ। কই তুমি? তোমার সাথে রাগ করে এই বুড়াটাকে বিয়ে করা একদম ঠিক হয়নি।অবশ্য আমি আমার স্বামীকে এখনো দেখিনি।তাজের সাথে এতই রেগে ছিলাম যে কাকে বিয়ে করছি তাও জানি না।আমার বয়ফ্রেন্ডটা খুব ভালো ছিলো।ওর সাথে ২বছর ৩ মাস ১৪ দিন রিলেশন ছিলো।তাজের কোন বেড হেবিট ছিলো না।পড়াশোনা শেষ করে চাকরী খুঁজছে।একদিন ফোনে কার সাথে কথা বলছিলো।তখন আমি ওকে বলতে শুনেছি কাকে যেন বলছে বাবু খাইছো? ব্যাস ওর কোন কথা না শুনে সেদিন তুমুল ঝগড়া করে ব্রেকআপ করে ফিরে এসেছি। আসার সময় সাফ সাফ জানিয়ে এসেছিলাম আমি ১ মাসের মধ্যে বিয়ে করে ওকে দেখিয়ে দিবো।তাই করেছি।
বাবাকে বিয়ের কথা বলতেই বাবা আর দেরি করেনি।পাত্র খোঁজা শুরু করে দিয়েছিলো।আমি বাবা-মা কে এতোদিন বিয়ের জন্য মানা করেছিলাম। বাবা আমার মুখে বিয়ের কথাটা শুনে আর দেরি করে নি।তারা তো ঈদের চাঁদ হাতে পেয়েছে। এতোদিন এই কথার অপেক্ষায় ছিলো।তাজের কথা বাসার কেউ জানে না।তাজ সবসময় বলতো চাকরি পেলে একেবারে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমাদের বাড়িতে যাবে।তাই আমিও চুপচাপ বিয়ের জন্য মানা করে দিয়েছি।এই ১ মাস আমার সাথে তাজের কোন যোগাযোগ হয়নি।ঐ তিন বাচ্চার বুড়ো বাপকে আমি দেখিও নি,জানি ও না কেমন? নামটা পর্যন্ত আমার অজানা।বিয়ের সময় আমরা আলাদা আলাদা রুমে ছিলাম।এক গাড়িতেও আসেনি।ব্যাপারটা আমার কেমন সন্দেহজনক লেগেছে।বুড়োর ব্যাপারে শুধু জানতে পেরেছি বয়স ৩৫, তিনটা বাচ্চা আছে,আগের স্ত্রী মারা গেছে। আমাকে যেদিন দেখতে গিয়েছিল সেদিন আমার স্বামী যায়নি।তার দুই বোন দেখে আংটি পরিয়ে দিয়ে আসে।
হাতে আর মাত্র কয়েকদিন বাকি ছিলো ১ মাস হওয়ার তাই আমিও স্বইচ্ছায় রাজী হয়ে যাই।দেখতে আসার দুইদিনের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল।ছেলে পক্ষের এতো তারা কিসের কে জানে? আমার তখন এরকম একটা মনোভাব ছিলো যে করে হোক বিয়ে আমার করতেই হবে।হোক সে ৮০ বছরের বুড়ো।আর ২৫ বছরের যুবক।তাজ যদি আমায় ছেরে অন্য কাউকে বলতে পারে বাবু খাইছো? তাহলে আমি কেন পারবো না অন্য কাউকে বিয়ে করতে। ঝাড়ু দেওয়া প্রায় শেষ পর্যায় এমন সময় ছোট ছেলেটা কোথা থেকে এক গাদা ময়লা, সবজির খোসা এনে মেঝেতে ঢেলে দৌড়ে পালালো।আমার মেজাজ চরম খারাপ হয়ে গেলো।
আমি চেচিয়ে বললাম দাঁড়া বলছি বিচ্ছু ছেলে।তোকে একা পেলে পিঠের ছাল তুলে ফেলবো।এর আগে তিনজন এসে সব ফুল ছিঁড়ে রুমের বারোটা বাজিয়েছিস।এখন আবার ময়লা ফেলে পালালি।আল্লাহ তুমি কোথায়? আমি এই বিচ্ছুগুলোকে কিভাবে পালবো? তুমি আমার মতো একটা ভোলাভালা,মাসুম,ইনসেন্ট বাচ্চার সাথে এমন করতে পারো না।আমি তো বাচ্চা এমনিতে পছন্দ করি না।তাই বলে আমাকে বিয়ের সাথে সাথে ৩ বাচ্চার মা বানিয়ে দিলা।আমি এখন কোথায় যাবো গো? আমায় বাঁচাও গো।ও তাজ তুমি কোন হানে? আমি আর তোমার সাথে একটুও ঝগড়া করবো না।আমায় এখান থেকে নিয়ে যাও।বিয়ের রাতেই বাচ্চা তিনটা আমায় পাগল করে ফেলেছে।বাকি জীবন পরেই আছে। আমি মেঝেতে হাত- পা ছরিয়ে অনেকটা জোরে জোরে বিলাপ করেতে লাগলাম।তখনি কেউ পেছন থেকে বললো–
— বাবু খাইছো? আমি পেছন দিকে ঘুরে হা করে তাকিয়ে রইলাম। দরজার সাথে হেলান দিয়ে তাজ দাঁড়িয়ে আছে। মুখে তার মেকি হাসি।পরনে শেরওয়ানি পায়জামা। তাজ আবারও বললো– বাবু খাইছো? আমি মুখ বন্ধ করে রেগে জিজ্ঞেস করলাম — তুমি এখানে কি করছো? বিয়ের শেরওয়ানি গায়ে কেন তোমার? তাজ সামনে এগিয়ে এসে বললো
—-আমার বাড়ি,আমার রুম আমি এখানে কি করি মানে?
— তোমার বাড়ি মানে? এটাতো আমার শ্বশুর বাড়ি।
— হুম। তোমার শ্বশুর বাড়ি।
— তুমি রুমে ঢুকলে কেন? যাও বেরিয়ে যাও।এ বাসার কেউ দেখলে ব্যাপারটা জটিল হয়ে যাবে।তুমি বিয়ে করে নিয়েছো? ( কাঁদো কাঁদো কন্ঠে)
— হুম। আজকেই করেছি।তোমাকে চেয়েছিলাম দাওয়াত দিতে কিন্তু তুমিই তো আমাকে তোমার বিয়ের দাওয়াত দেও নি। তাই আমিও রেগে দাওয়াত দেইনি।
— তুমি এমনটা করতে পারলে তাজ।
— তুমি করতে পারলে আমি কেন পারবো না।সর তো আমাকে ঘুমাতে দেও এমনি সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে। (ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে) আমাকে পাশ কাটিয়ে তাজ ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পরলো।
— এই তুমি আমার রুমে শুলে কেন? চলে যাও এখান থেকে। বেরোও বলছি এই রুম থেকে।
— আমার রুম থেকে আমায় তাড়িয়ে দিচ্ছো।
— কখন থেকে আমার রুম আমার রুম করছো।এটা আমার স্বামীর রুম।ভাগো এখান থেকে।
— রুমটা যদি আমার হয় তাহলে তোমার স্বামীটা কে হবে?
— মা–নে মা– নে তুমি আমার স্বামী। কি যা তা বলেছো? আমার শোকে কি পাগল হয়ে গেলে নাকি? আমার স্বামীর বয়স ৩৫ বছর। তার ৩ টা বাচ্চা আছে।
— আল্লাহ কি বলো এসব? তুমি দেখি রেডিমেড স্বামী পেয়েছো।
— কথা না বলে ভাগো তো এখান থেকে।
তাজ বিছানা ছেড়ে উঠে আমার কাঁধে হাত রেখে বললো– সত্যি আমি তোমার হাজবেন্ড।বিয়েটা আমার সাথে হয়েছে।
— কিভাবে কি? তাহলে যে সবাই বললো আমি ২য় স্ত্রী। তিনটা বাচ্চা কার?
— এগুলো আমিই বলতে বলেছি।তোমাকে সারপ্রাইজ দিবো বলে।আর ঐ বাচ্চা তিনটা আমার বড় দুই বোনের।তোমার বাবা-মা, আমার পরিবারের সবাই মিলে এই প্ল্যান করেছি। আমি রেগে একটা বালিশ নিয়ে তাজকে বারি মারতে লাগলাম। ফাজলামির একটা সীমা আছে। সবাই আমার কাছ থেকে এতবড় কথা লুকালো।আর আমি এদিকে তাজের শোকে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।তাজ বললো—
— আরে করছোটা কি? ব্যাথা পাচ্ছি তো।
— তোমাকে আমি আজ মেরেই ফেলবো।কেন বিয়ে করেছো আমায়? যাও তুমি তোমার বাবুর কাছে? আমার এখানে এসেছো কেন?
— আমার ছোট বোনের ঐ ৪ বছরের ছেলেটার নাম বাবু।আর আমি সেদিন ওর সাথে কথা বলছিলাম।ওকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম বাবু খাইছো?
— আবার বাবু খাইছো? তুমি জানো না এই শব্দ দুটো আমি পছন্দ করি না।ফের বলেছো তুমি এই শব্দ টা।
— যাক বাবা। আমি আবার কি করলাম?
আমি একটানা বালিশ দিয়ে তাজকে মেরে চলছি।কেন জানি এই বাবু খাইছো শব্দটা আমার অনেক অসহ্য লাগে।তাজ তো আমায় আজ ভয় দেখিয়ে ফেলেছিলো।আমি তো ভেবেছি আমার জীবন বুড়োর সাথে কাটাতে হবে।বালিশ ছিঁড়ে তুলা সারা ঘর ছেয়ে গেছে। তাতে আমার থামার নাম নেই। আরেকটা বালিশ নিয়ে মারতে নিলে তাজ ঘর থেকে পালালো।দৌড়ে রুম থেকে বের হতে হতে বললো– আমি পালাই।আমার বউ যা রেগে আছে তাতে আমাকে কিমা করে দিবে।এখন ভাগি পরে পাগলীটার রাগ কমলে আসা যাবে।আমার বাসর ঘরের তেরটা বাজিয়ে দিলো।ভাগ তাজ বেঁচে থাকলে জীবনে একদিন বাসর করে নিবি।আমি আর জীবনে মুখ দিয়ে “বাবু খাইছো”শব্দ উচ্চারণ করবো না।যত নষ্টের গোড়া এই শব্দ দুটো।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত