হয়তো এমনটা

হয়তো এমনটা
বিয়ের পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে দেরি করে উঠার জন্য শ্বাশুরি মা যখন সবার সামনে ঠান্ডা পানি ছুড়ে মেরেছিলেন তীব্র শীতের মধ্য তখন ঢুকরে কেদে আমার স্বামীর দিকে তাকিয়ে ছিলাম কিছু যদি প্রতিবাদ করে এই আশায়।কিন্তু সেও বাকি সবার মতো হাসিতে তাল মিলাচ্ছিলো।নতুন আসা বউয়ের সাথে এমন আচরণ করার
কারণ জিজ্ঞেস করায় আমার স্বামী উওরে বলেছিলেন,
–মানিয়ে নিতে শিখো! বাবা-মাকে ফোন করে বলার পর তারা বলেছিলো,
–বিয়ের পর তুমি তাদের সম্পওি তারা মেরে ফেললেও মানিয়ে নিতে থাকো একসময় সুখ আসবেই।
দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় মানুষ তখন আমার আমাকে মনে হচ্ছিলো।মেয়েদের জীবনটা বুঝি মানিয়ে নেওয়ার?পাশের বাড়ির রহিমা যখন কয়েকদিন পর পর এসে কান্না করতো আর তার অসহায়ত্বর কথা বলতো তখন কিছুই আমলে নিতাম না ।আজ বুঝি আমিও সেই অসহায় রহিমার কাতারের মানুষ?বাপের বাসার একদিনের চেয়ে দুদিন থাকতে দিবে না তারা।তাহলে বউ নাকি পালিয়ে যাবে । বাবা-মা ভাই গুলাও মুখ ফিরিয়ে থাকতো যদি তাদের ঘাড়ে উঠে পড়ি এইভেবে । যাওয়ার আর জায়গা রইলো না যে !তাই তো হাজার কষ্টের মাঝেও এই নরকে থাকি ।দুপুরে খাবার পরিবেশন করায় একটু দেরি হওয়ার আমার ননদ যখন ভাতের প্লেট আমার উপর ছুড়ে দিয়েছিলো তখন আমার আর্তনাদ দেখার কেও ছিলো না।তারা ব্যস্ত ছিলো তাদের মেয়ে বোন দুপুরে না খেয়ে উঠে গেছে এই কারণে।সেদিন যখন আমার ননদ মিতুকে দেখতে এলো চায়ের কাপটা হাত থেকে ভুলবশত ছেলের পায়ের উপর পড়ে যেতেই মিরাজ সবার সামনে ঠাস করে গালের মাঝে থাপ্পড় মেরে বলেছিলো,
–চোখ কি সাথে থাকে না?ফকিন্নিদের মতো কাজ করতে আসো কেন!জীবনেও ফকিন্নির জাত শুধরায় না তোমার মতো।যেখানে যাবে আকাম করবে।
চোখে টলটলে পানি নিয়ে হাসি মুখে নাস্তা গুলো দিয়ে দৌড়ে চলে এসেছিলাম । চাইলে প্রতিবাদ করতে পারতাম কিন্তু ওইযে ‘মাথার উপর ছায়া না থাকলে তুমি তীখর রৌদ্রে পুড়ে যাবে যে।’চুপচাপ মেনে নিচ্ছিলাম সব।শ্বাশুরির কটু কথা আর সবার সামনে অপমান গুলোর জন্য মরে যেতে ইচ্ছা হতো কিন্তু আমার ছেলেটার জন্য বেচে ছিলাম।আমার স্বামী মিরাজও তার মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমায় নানা কথা শুনাতো।প্রত্যেকটা ছোট জিনিসের জন্য দায়ী হতাম আমি ।সংসার জীবনটা বুঝি এমনই হয়? সব দোষ তুমি নামক মেয়ের?জীবন নামক খাতাটা পাল্টানোর চেষ্টায় আমার অর্ধেক জীবনটা কালো খাদে হারিয়ে গেছে।মানিয়ে নিতে আর মেনে নিতে নিতে নিতে আমার জীবনের সুখের গোণা কয়েকটা পাতা আছে ।আজ ছাব্বিশ বছর পর আমার ছেলে সাফিনের বউয়ের সামনে এক বালতি পানি নিয়ে দাড়িয়ে আছি আমি।আমার ননদ মুখ ছোট করে তাকিয়ে আছে।যদি তার মায়ের মতো আমিও নতুন বউ দেরি করে উঠার জন্য তার মেয়ের দিকে পানি ছুড়ে মারি এই ভয়ে।
আমি মুচকি হেসে গরম পানির বালতিটা বউয়ের দিকে এগিয়ে দিলাম।গিজারটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে এই তীব্র ঠান্ডার মধ্যে মেয়েটা ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করতে পারবে না যে ।মিতুর চোখে ভয়ের রেশ দেখতে পেয়ে আমার সেই দিনের কষ্টের কথা মনে পড়ে গেলো। সত্যি!মানুষ নিজেরটার বেলায় প্রচুর ভয় পায় আর অন্যেরটার বেলায় হেসে মজা নেয়। রান্না দেরি হওয়ার জন্য আমার মেয়েটা কিন্তু ভাতের প্লেট মৌয়ের(সাফিনের বউ)দিকে ছুড়ে মারে নি।সে উল্টে হাতে হাতে সাহায্যর জন্য এগিয়ে গেছে।কারণ সে কষ্টে মোড়ানো মায়ের জীবন কাহিনীর সাক্ষী।আমার দশ হাজার টাকার ডিনার সেটের প্লেট ভেংগে ফেলার জন্য সবার সামনে আমার ছেলে সাফিন কিন্তু তার বউকে মারে নি সে উল্টে বলেছে,
–পুরনোটা না ভাংলে নতুনটা ঘরে আসবে কি করে! আমি কিন্তু তাকে কথায় কথায় অপদস্ত করি না বরং আমরা হাসিমুখে নিজেদের মা-মেয়ে বলে পরিচয় দেই।আমাদের সুখের এখন কমতি নেই শুধু কমতি কিছু নিম্ন মানুষিকতার মানুষের।আমার জীবনটাও কিন্তু মৌয়ের মতো এমনটা হতে পারতো।অবহেলার পর যখন সুখ পেয়েছি তখন কাওকে অবহেলিত করতে পারবো না।আমাদের সমাজের দুটো রুপ আছে আর তার মধ্যে আমার মতো অবহেলিত দের সংখ্যা আজ বড্ড বেশি। কবে শেষ হবে এই অবহেলিতদের অবহেলা?হয়তো এমনটা সবার জীবনের পাতা হতে পারতো তবে আমার মতো সবাই যে কষ্টের কারাগারে বন্ধী থাকে এবং থাকছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত