তৃতীয়বারের মত প্রেমে ধোঁকা খেয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম এ জীবন আর রাখবো না। ম্যাচের কাউকে না বলে সোজা বেরিয়ে গিয়ে একটা ফুটওভার ব্রীজের উপর এসে দাঁড়ালাম। ব্রীজের উপর থেকে দিব্যি পড়ন্ত বিকেলের সূর্যটা তখনো দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমাকাশের শেষ অংশে গিয়ে তার প্রখরতা ছাড়িয়ে নমনীয়তা ধারন করে,ডিমের কুসুমের মত হয়ে গিয়েছে। স্নিগ্ধ রোদ সামান্য গায়ে এসে পড়ছে,আবার গাছের পাতার ফাঁকে বিলিন হয়ে যাচ্ছে ক্ষনিকের জন্য।
ব্যস্ত আর কোলাহল পূর্ণ শহরটা যেন ঝড়ের গতিতে ছুটে চলেছে এই মূহুর্তে।প্রতিটা মানুষ আর যান্ত্রিক বাহন গুলোর শব্দে কানকে প্রতিনিয়ত বিদ্ধ করে তুলছে। একটু পরেই মাগরিবের আযান পড়বে,তারপর ধিরে ধিরে এই শহরটা তার প্রকৃতির আলোকে ছেড়ে নতুন এক রং-এ সেঁজে উঠবে নিয়ন বাতির কৃত্রিম আলোতে। আমিও অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছি,সেই সময়টার। যখন এই ওভারব্রীজ টাতে একটু ভিড় কমবে,আর লাফ দিয়ে নিজের জীবনটাকে শেষ করে দিবো।কিন্তু আমার ধারণা হয়তো ভুল,এখানকার চারপাশের যে জমজমাট অবস্থা,রাত গভির হওয়ার সাথে সাথে মানুষ কমার পরিবর্তে আরও বেড়ে যাচ্ছে। এক প্রকার বিরক্ত হয়ে,নিচে নেমে আসতে যাবো।ঠিক তখনি একটা মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকের সাথে ধাক্কা খেলাম। ধাক্কা লাগার কারণে লোকটার হাতে থাকা একটা ছোট্ট ব্যাগ নিচে পড়ে গিয়ে লাল রং এ রাঙিয়ে দিলো পুরোটা জায়গা জুড়ে।
লোকটা বাচ্চাদের মত ঢুকরে কেঁদে উঠে বললো,”বাজান এইডা তুমি কি করলা?অনেক কষ্টে সারাদিন এর ওর কাছে ঘুরে ঘুরে এক ব্যাগ রক্ত ম্যানেজ করেছিলাম।সেইডাও ফেইলা দিলা। হায় আল্লাহ,আমার পুলাডা কি আর বাঁচবো না? লোকটার কান্না আমার হৃদয়টাকে ব্যাথিত করে তুললো।নিজেকে কেমন যানি অপরাধি মনে হলো।লোকটাকে তুলে দাঁড় করিয়ে বললাম,”চাচা আমি আসলে দেখতে পাই নি।আমি খুবই দুঃখিত। ভদ্রলোক তার চোখে-মুখে অসহায়ত্বের ছাপ ফুটিয়ে বললো,”এখন আর এইসব বইলা কি হবে?পুলাডা আর মনে হয় বাঁচবো না। ভদ্রলোকের ঘামজড়িত সাদা টি-শার্ট টা দেখে কেন যানি মায়া হলো।ভদ্রলোকের পিছন পিছন গিয়ে বললাম,”চাচা আপনার ছেলের রক্তের গ্রুপ কি? ভদ্রলোক কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো,”O(-) এই রক্ত নাকি পাওন যায় না।অনেক কষ্টে একজনের কাছ থেইক্যা পনেরো হাজার টাকা দিয়া আনতেছিলাম।
কিন্তু কপাল খারাপ আমার।
-চাচা আপনার ছেলেকে আমি রক্ত দিবো।আমারো সেইম রক্ত।চলুন হাসপাতালে চলুন। ভদ্রলোকের মুখে আশার আলো প্রস্ফুটিত হয়ে উঠলো,অন্ধ্যকারের মাঝে। একটা রিক্সা দেখে দ্রুত জেনারেল হাসপাতালে এসে থামলাম।
ভদ্রলোক আমাকে সাথে নিয়ে,তার ছেলের কাছে গিয়ে একটা নার্সকে বললো,”ইনার রক্ত নাকি আমার পুলার লগে মিলে। তারপর বাকিটা আমি কথা বলে নিয়ে ঠিক করে নিলাম।দ্রুততার সাথে আমার শরীর থেকে রক্ত বার করে ছেলেটার শরীরের দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো।ভদ্রলোকের ছেলে দুপুরে এক্সিডেন্ট করে তার মাথাতে আঘাত পাওয়াতে,প্রচুর রক্ত খরন হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এক ব্যাগ রক্ত হাসপাতাল থেকে পাওয়া গেলেও দ্বিতীয় ব্যাগটার জোগান তারা দিতে পারে নি। রক্ত দেওয়া শেষ হলে,আমি উঠে দাঁড়ালাম।হাতঘড়িটাতে তখন রাত দশটা বেজে পঁচিশ মিনিট।হাত চেপে ধরে বেড ছেড়ে উঠে ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে দেখলাম,লোকটা তার ছেলের বেডের পাশে বসে আছে। রোগি এখনো অবচেতন অবস্থাতেই আছে।ভদ্রলোকের মুখে ভারাক্রান্তের ছাপ ফুটে উঠেছে,সেই সাথে ক্ষুধার্থ ভাবটাও বেশ দৃশ্যমান।আমাকে দেখে ভদ্রলোক ছুটে এসে হাতটা ধরে বললো,”বাজান তোমার এই ঋণ কোনদিনও শোধ করতে পারুম না।তুমি না থাকলে হয়তো পুলাডা আমার মইরায় যাইতো।
-এইসব বলতে হয় না চাচা,উপরে একজন আছেন না,তিনি সব ঠিক করে দিবেন। ভদ্রলোক আমার কথাই বেশ আস্বস্ত হলেন। “চাচা আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে,আপনি সারাদিনে কিছু খান নি।চলুন রাস্তার ঐ পাশে হোটেলে ঢুকে কিছু খেয়ে নিবেন।টেনশনের কিছু নেই,আপনার ছেলে এখন সুস্থ্য। ভদ্রলোকের শুকনো ঠোটে হাসি ফুটে উঠলো।তারপর না খাওয়ার কথা বললে,আমি একপ্রকার জোর করে নিয়ে গেলাম। মানিব্যাগে পাঁচশত টাকার একটা নোট ছিলো,ভেবেছিলাম নীলার জন্মদিনে খরচ করবো।কিন্তু তা তো আর হলো না।আর একটু পরেই যখন মরে যাবো,তখন এই টাকাটা আর কোনো কাজেও আসবে না আমার। দু’জনে পেট পুরে রুই মাছ দিয়ে চার প্লেট ভাত খেলাম।খাওয়ার এক পর্যায়ে লোকটা হাত তুলে মনে মনে কিছু একটা বললো,তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,” তোমার বাবা,খুব ভাগ্যবান,যে তোমার মত একখান সুনার টুকরা পুলার জন্ম দিছে।জীবনে অনেক বড় হও বাজান।বাজান আমি তাহলে যাই,পুলাডা একা একা আছে। “চাচা আপনি আপনার ছেলেকে খুব ভালোবাসেন তাই না?
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,” এই জগৎসংসারে আমার আপন বলতে ঐ পুলাডা ছাড়া আর কেউ নাই।
আর বাবার ভালোবাসা কখনো বইল্যা কওন বুঝানো যায় না বাজান।যেদিন একটা পুলার বাপ হবা,সেদিন বুঝবা বাপের কাছে তার সন্তানরা কি জিনিস। কথাগুলো বলে লোকটা আমার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।নিজেকে আবার আগের জায়গাতে এসে রাখলাম। এই বেঈমান দুনিয়াতে বেঁচে থেকেই বা কি হবে?যাকেই বিশ্বাস করে বাঁচার স্বপ্ন দেখি সেই ধোঁকা দিয়ে দূরে সরে যায়। মরে গেলে তো আর কেউ ধোঁকা দিতে পারবে না। হ্যা মরে যাওয়াটাই শ্রেয়। ফুটপথ ধরে আবারে হাঁটা শুরু করলাম।বেঁচে থাকতে তো সুখ পেলামই না,অন্তত মরার আগে একটা নিরিবিল জায়গা খুঁজে শান্তিতে মরবো। কথাগুলো ভাবছি আর হাঁটছি।ব্যস্ত শহর,কেউ কারো দিকে ঘুরে তাকানোর সময় নেই।এমন সময় পকেটে থাকা ফোনটা বেঁজে উঠলো। বার করে দেখলাম,মা ফোন দিয়েছে। থমকে দাঁড়িয়ে রিসিভ করলাম।
-হ্যা,মা বলো।
-খোকা কেমন আছিস?
-এইতো ভালো,তোমরা কেমন আছো?
-তোকে ছাড়া কি আর ভালো থাকতে পারি।তা তুই কি ব্যস্ত নাকি খোকা,তাহলে পরে কথা বলি?
-না মা ব্যস্ত নেই। কথার মাঝে একটা খাবার দোকানে চোখ পড়তেই লোভ জাগানো বিরিয়ানির ঘ্রান নাকে এসে বিধলো।
-কিরে খোকা,ওভাবে নিঃস্বাস নিচ্ছিস কেন?তোর কি কিছু হয়েছে বাবা?
-নাহ্ মা,কিছু হয় নি।আসলে অনেকদিন ধরে বিরিয়ানি খাই না তো,একটা হোটেল থেকে বিরিয়ানির ঘ্রান এসে নাকে বিধলো,তাই।
-বাজান বিরিয়ানি তোর খুব পছন্দের খাবার ছিলো,তাই আমিও আর বিরিয়ানি রান্না করি না।রান্না করলেই তোর কথা মনে পড়ে যায়।তখন আর মুখ পর্যন্ত উঠে না রে।তোকে কতদিন দেখি না রে,খোকা।তোর বাবাও তোকে খুব দেখার জন্য বলে। আমি কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থাকার পর বললাম,”মা আমি বাসায় আসছি।তুমি বিরিয়ানি রান্না করো,গিয়ে তুমি আমি আর বাবা একসাথে খাবো। মা খুশি হয়ে বললো,”সত্যি বাবা আসবি!
-হ্যা মা,আমি আজকে রাতেই বাসায় রওনা দিবো।তোমাদেরকে খুব মিস করছি।
-চলে আয় বাবা,কিছুদিন মায়ের বুকটাতে একটু শান্তির বাতাস দিয়ে যা।আমার কিচ্ছু লাগবে না,শুধু তুই থাকলেই হবে।
কলটা কেটে দিয়ে এক বন্ধুর থেকে বিকাশে টাকা নিয়ে সোজা বাসে উঠে পড়লাম।একটু আগেও যেই আমি মৃত্যুর জন্য ছটফট করছিলাম,সেই আমি এখন মায়ের মমতাময়ী মুখটাকে সামনে থেকে দেখার জন্য ছটফট করছি,ছটফট করছি বাবার শাসনের আড়ালে থাতা ভালোবাসাটাকে খুব কাছ থেকে পাওয়ার জন্য। ঠুনকো ভুল বুঝাবুঝি বা সামান্য অযুহাতের দোহায় দিয়ে যে সরে যায়,সেই আর যায় হোক কখনো ভালোবাসে নি।আর এমন একটা মানুষের জন্য নাকি আমি মরতে যাচ্ছিলাম।বড্ড বোকামির মত কাজ করছিলাম।ভালোবাসার আসল ছাঁয়া তো সেইটা,যেখানে দু দন্ড বসলে নিলৃপ্ততার পরশ মিলে।
গল্পের বিষয়:
গল্প