“আমি চলে যাচ্ছি তোমার লাইফ থেকে। বাবা যাকে পছন্দ করেন তাকেই বিয়ে করো। একটা অনুরোধ, আমাকে ডিভোর্স দিও না। আমি কখনও তোমার সামনে আসবো না। স্ত্রীর অধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত কোরো না প্লিজ। আমি শুধু এ জীবনে নয়, পরকালেও তোমার স্ত্রী হয়ে থাকতে চাই। আমি স্বেচ্ছায় তোমাকে দ্বিতীয় বিয়ে করার অনুমতি দিয়ে যাচ্ছি। তোমার স্ত্রী হিসেবে মনের জায়গাতে বসিয়ে রেখো আমাকে” মেসেজটা দিয়ে ফেসবুক ডিএকটিভ করলাম। লাস্ট একটা কল করতে হবে। নিশাদ আমার খুব কাছের বন্ধু। ও ছাড়া এখন আমার যাওয়ার কোনও জায়গা নেই।
– হ্যালো।
– নিশাদ….
– কি খবর তোর? কয়েকদিন ধরে তোর সাথে কন্টাক্ট করার চেষ্টা করছি কিন্তু তুই কল পিক করিস না।
– দেখা করতে হবে, এক্ষুণি।
– ইমার্জেন্সি?
– ইমার্জেন্সি না হলে “এক্ষুণি” বলতাম না।
– আচ্ছা কোথায় আসতে হবে বল।
– তুই আয়। আমি আগেই পৌঁছে যাবো।
বাসে উঠলাম। যেতে প্রায় আধাঘন্টা সময় লাগবে। নিলয়কে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে। সিমটা খুলে ব্যাগে রাখলাম। ফোনের গ্যালারিতে নিলয় আর আমার শত শত ছবি। একটার পর একটা ছবি জুম করে নিলয়কে দেখতে থাকলাম। চোখ থেকে অনবরত পানি ঝরছে। পাশে বসা ভদ্রলোক ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। তিনি জানতে চাইলেন কোনো সমস্যা হয়েছে কি না। আমি হাতের ইশারায় ওনাকে চুপ থাকতে বললাম। ওনার সাথে কথা বলার মতো অবস্থায় আমি নেই। স্বর বের হবে না। তাছাড়া ওনাকে বলেই বা কি লাভ। উনিও হয়তো ব্যাপারটা বুঝলেন। তাই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে উনি আর কিছু বললেন না। বাস থেকে নেমে দেখলাম নিশাদ দাঁড়িয়ে আছে। ওর কাছে গেলাম।
– কি হয়েছে নিসা? কাঁদছিস কেন? তোর হাতে ব্যাগ কেন? কোথাও যাবি? না কি কোথাও থেকে এসেছিস?
– তোর হেল্প লাগবে।
– আগে চল কোথাও বসি। এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদলে লোকে খারাপ বলবে।
একটা রেস্টুরেন্টে বসলাম। সকাল থেকে কিছু খাই নি। মনে শান্তি না থাকলে ক্ষুধা অনুভূতি থাকে না। খেতে ইচ্ছে করছে না। তবুও নিশাদ দুজনের জন্যই খাবার অর্ডার করলো। অল্প খেয়ে পানি খেলাম।
– এবার বল কি হয়েছে?
– আমার একটা জব লাগবে। সাথে একটা থাকার জায়গা। জব খুঁজে না পেলে টিউশন হলেও চলবে।
– তুই তো টিউশন করিস। এখন আরও টিউশন লাগবে? টাকার প্রবলেম হচ্ছে? আর থাকার জায়গা লাগবে কেন? তোর মেসে কি হয়েছে?
– লাগবে বলছি ব্যাস লাগবে।
– আচ্ছা ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু কেন? নিলয় ভাইয়ের সাথে কিছু হয়েছে?
– ওখানে আর থাকবো না। নতুন কোথাও চলে যাবো। মেসের সিট ছেড়ে দিয়েছি।
– বলিস কি? নিলয় ভাই জানে?
– না, জানেনা। জানাতে চাইও না। আমি কোথায় থাকবো কি করবো ও কিছুই জানবে না।
– প্রবলেম হলে সামনাসামনি বসে সলভ কর। এভাবে দূরে থেকে কি হবে?
– তোকে যা বলছি তুই কি করতে পারবি? না পারলে অন্য কারো হেল্প নেব।
– আরে বাবা হেল্প করবো না তা তো বলি নি। জব বা টিউশন খুঁজে পেতে তো একটু টাইম লাগবে।
– আমার আপাতত একটা থাকার জায়গা দরকার।
– আমাদের বাসায় তো তোকে নিয়ে যেতে পারবো না। মা অনেক প্রশ্ন করবেন। আমার বান্ধবির বাসায় তোকে আপাতত রাখা যায় নাকি দেখছি। তারপর তুই আমি দুজন মিলে মেসে সিট খুঁজবো। তোর কোনও আপত্তি আছে?
– না, নেই। তবে সেখানেই চল।
নিশাদের বান্ধবি সীমার বাসায় এসেছি। ওর শশুর-শ্বাশুড়ি গ্রামে গেছেন কয়েকদিনের জন্য। ওনাদের রুমে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিলো। ওরা স্বামী-স্ত্রী দুজন এখন বাসায় আছে। আপাতত আমাকে এখানে থাকতে হবে। ওনারা ফিরে আসার আগেই অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। কাল থেকে নিশাদ আর আমি মেস খুঁজবো। হাতে যা টাকা আছে মাসখানেক চলতে পারবো। তার মধ্যেই জব বা টিউশন খুঁজে পেতে হবে। নাহলে সমস্যায় পড়ে যাবো।
নিলয় আমার হাজব্যান্ড, ওর সাথে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় পরিচয় হয়। একই ডিপার্টমেন্ট এ পড়তাম আমরা।
কখন যে আমি ওর এতটা কাছে চলে এলাম বুঝতে পারিনি। বছরখানেক আগে নিলয় ওর বাসায় আমার কথা জানায়। কিন্তু ওর বাবা, মানে আমার শশুর আমাকে মানতে রাজি নন। কারণ আমি এতিম। পৃথিবীতে আমার আপন কেউ নেই, থাকলেও আমি জানি না। আমার মা আমাকে রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। উনি বন্ধ্যা ছিলেন যার কারণে ওনার স্বামী ওনাকে ডিভোর্স দেন। বাবার বাড়িতে ফিরে এসে মা আর কখনও বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর একদিন সাত বছরের আমাকে যখন রাস্তায় কুড়িয়ে পান, জানতে পারেন আমার কেউ নেই। মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত তখন আরও জোরালো হয়। মা হাতের কাজ জানতেন। যেমন জামাকাপড় সেলাই, নকশী কাঁথা সেলাই, সোয়েটার বোনা, এমন আরও অনেক কাজ।
মায়ের কাছ থেকে আমিও টুকটাক শিখেছিলাম, মাকে সাহায্য করতাম। মামার পরিবারে আমি আর মা থাকতাম। মায়ের আয় দিয়েই আমার পড়াশোনার খরচ চলতো। যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম মায়ের আয়ে পড়াশোনার সব খরচ চলতো না। মামাও সাহায্য করতেন। তিন বছর আগে মা মারা যান। মা মারা যাওয়ার পর মামার পরিবারে আমার যাতায়াত কমে গেল। বুঝতে পারছিলাম ওখানে সবাই আমাকে মেনে নিতে পারছে না। যার জন্য ওই পরিবারের সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো তিনি না থাকার কারণে, অথবা মায়ের অবর্তমানে আমার ভরণ পোষণের দায় এড়ানোর জন্য তারা আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকেন। বিষয়টা উপলব্দি করার পর আমি ওনাদের বিরক্ত করা কমিয়ে দেই। মামার বাসায় এখন যাইনা। শুধু মাঝে মাঝে ফোনে খোঁজ নেই। যাই হোক না কেন, আমার মায়ের আত্মীয় তো ওনারা।
আমার সম্পর্কে ভার্সিটির বন্ধু-বান্ধবিরা অনেকেই জানতো। নিলয়ও জানতো। হয়তো আমার একাকীত্বটাই ওকে বেশি আকৃষ্ট করেছিলো। অনেকবার উপেক্ষা করার পরও ও যখন আমার পিছু ছাড়ছিলো না, কখন যে আমি ওর মায়ায় জড়িয়ে গেলাম জানিনা। নিলয় আমার পড়াশোনার খরচ দিতে চাইতো। কিন্তু আমি নিতাম না। প্রেমিকের কাছ থেকে কিছু নেওয়াটা আমার কাছে লজ্জার ছিলো। তারপর একদিন নিলয়ের জিদের কাছে হার মেনে ওকে বিয়ে করতে রাজি হই। বিয়ের পরও আমি মেসেই থাকি। ওদের বাসার কেউ বিয়ের কথা জানে না। এমনকি কেউই জানেনা। নিলয়ের বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো। ও নিজেও তখন থেকেই জব করে। আমার পড়াশোনার খরচ অনেকটাই নিলয় দিতো। আমি নিজেও টিউশন করি। এভাবেই চলতে থাকলাম। পড়াশোনা শেষ হওয়ার পরও আমি টিউশন চালিয়ে যাই। আর জবের জন্য পড়াশোনা করতে থাকি।
আমার শশুর যখন নিলয়কে বিয়ের কথা বললেন, ও আমার কথা জানালো। কিন্তু আমার পরিচয় জানার পর বাবা সোজা মানা করে দিলেন। পরিচয়হীন একটা মেয়েকে তিনি পুত্রবধূ হিসেবে মানবেন না। নিলয় অনেকবার বোঝানোর পরও বাবা রাজি হন নি। এতদিনে ওনার সম্পর্কে আমি যতটুকু জেনেছি, এক কথার মানুষ উনি। যা বলেন তাই করেন। যা করবেন না বলেন তা কোনোভাবেই করবেন না। গতকাল নিলয়ের বন্ধুর কাছে শুনলাম বাবা নিলয়ের জন্য পাত্রী ঠিক করেছেন। শর্ত দিয়েছেন এই পাত্রীকেই বিয়ে করতে হবে। না করলে তিনি নিলয়কে সারাজীবনের জন্য ত্যাজ্য করে দিবেন। আমি তো এতিম। আমি জানি বাবা-মা না থাকা, বা তাদের থেকে দূরে থাকার যন্ত্রণা কতটা গভীর। আমার জন্য নিলয় ওর বাবা-মায়ের থেকে দূরে থাক আমি চাই না। এক জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় তো পার করেই ফেলেছি। বাকিটা সময় নাহয় আমার গর্ভে আসা নিলয়ের অনাগত সন্তানকে নিয়েই কাটাবো। আমার মা যদি আমাকে নিয়ে তার জীবনটা কাটাতে পারেন, আমি কেন পারবো না? আমিও যে মা হবো! কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারি নি। সীমার ডাকে ঘুম ভাঙলো। সকাল হয়েছে।
– খাবে না?
– আমার ক্ষুধা নেই।
– যাকে ছাড়া ক্ষুধাও লাগে না তার থেকে দূরে এসেছো কেন?
– তুমি বুঝবে না।
– কেঁদে কেঁদে চেহারার কি অবস্থা করেছো দেখেছো?
– হাজব্যান্ড এর জন্য কষ্ট হচ্ছে?
– হুম(মাথা নীচু করে)
– তাকে এখন সামনে পেলে কি করতে?
– ওর বুকে মাথাটা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতাম।
– এহেম এহেম!! ভাইয়া ভেতরে আসুন।
– কে আসবে? কাকে ডাকছো তুমি সীমা?
– আসলেই বুঝবে। আমি নাস্তার ব্যবস্থা করছি।
– আরে আরে, কথা তো শুনো! সীমা চলে গেলো। ও রুম থেকে বের হতেই রুমে একজন পুরুষ ঢুকলো। সেই চিরচেনা চেহারা, নিলয়!
– তু তুমি? এখানে আসলে কিভাবে?
– (ঠাস গালে চড়) কি ভেবেছিলে? তোমাকে খুঁজে বের করতে পারবো না?
– তোমাকে কে বললো যে আমি এখানে?
– নিশাদ বলেছে।
– কিন্তু তুমি তো নিশাদকে চিনতে না।
– তুমি কাল সারাদিন আমাকে কত নাকানিচুবানি খাইয়েছো জানো? তোমাকে খুঁজতে থানায় জিডি করেছি। পুলিশ তোমার সিমের লাস্ট কল চেক করে নিশাদের নাম্বার পেয়েছে। নিশাদের সাথে কথা বলে এখানে এসেছি। বাইরে পুলিশের দুজন কর্মকর্তা বসে আছেন। ভেবেছো কি তুমি? এভাবে চলে আসবে আর আমি চুপচাপ বসে থাকবো?
– কিন্তু বাবা-মা….
– ওনাদের আমি সামলাবো। তোমার জন্য যেমন বাবা-মাকে ছাড়বো না, তেমনি ওনাদের জন্য আমি তোমাকেও ছাড়বো না। তুমি আমার বিয়ে করা বউ। তোমার হাত ছেড়ে দেবো তুমি ভাবলে কিভাবে নিসা?
– বাবা আমাকে মানবেন না।
– সেটা আমি বুঝবো। তুমি শুধু আমাকে কথা দাও, আর কখনও ভুলক্রমেও এমন পাগলামি করবে না। বলো?
– নিলয় একটা কথা ছিলো….
– বলো?
– তুমি বাবা হতে চলেছো।
– কি?? সত্যি বলছো?
– হ্যাঁ, সত্যি।
– আর এই শরীর নিয়ে তুমি এত মানসিক চাপ নিয়েছো? আবার এভাবে পালিয়ে এসেছো? যদি বেবির কিছু হয়ে যেত? কে সামলাতো তোমাকে? তোমার কিছু হয়ে গেলে কে দেখতো? বলো? (দুহাতে কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে) এতটা কেয়ারলেস কেউ হয় নিসা?
– সরি।
– সরি? এত কান্ড ঘটিয়ে সরি?
– আর হবেনা তো।
– আর আমি তোমাকে সুযোগ দিলে তো? এবার সোজা তোমাকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাবো। ভালোবাসি তোমাকে। ছেড়ে দেওয়ার জন্য তোমার হাত ধরি নি।
– তাহলে বুকে মাথা রাখতে দাও। কতদিন তোমার বুকে মাথা রাখিনি!!
– এসো, সারাজীবন এভাবেই আমার বুকে থাকবে।
গল্পের বিষয়:
গল্প