অতঃপর এক পাহাড়ি সুরের সাথে দেখা

অতঃপর এক পাহাড়ি সুরের সাথে দেখা

পাহাড় থেকে আসা ঠান্ডা বাতাসের সাথে অজানা কোনো বনফুলের মাদক ঘ্রাণে শরীর মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। হিম হিম কুয়াশার আবরনী ঘিরে ধরছে চারদিক থেকে। বিষন্ন আওয়াজটা তাই প্রথমেই ধরতে পারিনি। যখন খেয়াল হলো, অবাক হয়ে দেখলাম আমার দুই হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে এক লোক। গায়ে গেরুয়া চাদর, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল। পাহাড়ের প্রেমে এতই ডুবে ছিলাম যে তার উপস্থিতি টেরও পাইনি। জিজ্ঞেস করলাম, “দুঃখিত, কী বলছিলেন?”
লোকটা নির্লজ্জের মতো হেসে বলল, “আমি ভাবছিলাম আপনি ছেলে।

তাই লাইটার চাইছিলাম। সিগারেট ধরাব।” আমি খেয়াল করলাম আমার পরনের পোশাক কিছুটা ছেলেদের মতোই। জিন্স, জ্যাকেট আর আট করে বাঁধা চুলের বাইরেটা মাফলার দিয়ে পেঁচানো। পকেট থেকে লাইটার বের করে দিলাম। লোকটা অবাক হয়ে হাতে নিল। নিজের সিগারেট ধরিয়ে হে হে করে বলে উঠল, “আপনিও সিগারেট খান নাকি?” গলার স্বরটা ভীষন গভীর। যেন অন্তর থেকে অন্তরে গিয়ে স্পর্শ করে। কথার সুরে খানিকটা কৌতুক থাকলেও সেটা যেন কন্ঠের গাম্ভীর্যের ফাঁক দিয়ে পিছলে পড়ে যায়। এই অদ্ভূত লোকটা কে? আমি তার প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। নিঃশ্বাসের সাথে টেনে নিলাম শীতল বাতাস। মনে হচ্ছে বাতাসের সাথে বরফকুচি মেশানো। লোকটা আমার লাইটার ফেরত দিয়ে বলল, “আপনি কি একাই এসেছেন?”

আমি মুখে কিছু বললাম না। মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলাম। লোকটা ফিক করে হেসে ফেলল। এই হাসিটাও কী মারাত্মক! আমি নিজের স্মৃতির রেকর্ডারে প্রাণপণে সেই হাসির শব্দটুকু জমা করে রাখার চেষ্টা করতে লাগলাম। সে বলল, “আমিও আপনার মতোই। কেউ একশোটা প্রশ্ন করলে একটা জবাব দেই। আজকে আমি প্রশ্ন করছি আর কেউ জবাব দিচ্ছে না দেখে মজা পাচ্ছি। আপনি প্রথমে কিছু বললে কথা বাড়ত না। যাহোক, আপনার নিশ্চয়ই আমার কথা শুনে বিরক্ত লাগেনি? আমার কন্ঠ খুব সুন্দর। ঠিক না?” আমার হাসি আসলেও হাসলাম না। কোনো উত্তরও দিলাম না। সে “আলবিদা” বলে চলে গেল পাশ থেকে। ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল কুয়াশার আড়ালে। চিকন সিগারেটের ধোয়া মিশে যেতে থাকল কুয়াশার সাথে। আমি ততক্ষণ চেয়ে রইলাম যতক্ষণ তাকে দেখা যায়।

চায়ের কাপ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে লোকটা বলল, “আমার নাম আদনান। আপনার নাম জানতে পারি?”
আমি কাপটা হাতে নিলাম। নিচু স্বরে বললাম, “লুনা।” গতকালকের পর আজ ভোরবেলায় লোকটার সাথে আবার দেখা। কলেজের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে আমার রুটিন হয়ে গেছে ভোরে ওঠা। উঠে নিজের প্রাত্যাহিক কাজকর্ম শেষ করে কলেজে যাই, ফিরি বিকেলে। বাকিটা সময় কাটে বই পড়ে। আজও অভ্যাসমতো ভোরে ঘুম ভেঙেছে। হোটেল থেকে বের হয়েই এই লোকের সাথে দেখা। নিজে থেকেই আমাকে চা খাওয়ার দাওয়াত দিল। “লুনা, আপনি আমার চেয়ে বয়সে ছোট হবেন। তুমি করে বলতে পারি?” “আপনার বয়স কত?” আদনান হাসল। দাড়িগোঁফের ভেতর থেকে বের হয়ে এল সারিবাঁধা ঝকঝকে সাদা দাঁত। আজন্ম আমার এমন দাঁতের ওপর দুর্বলতা। উফ! এই লোকটার সাথে আমার কেন দেখা হলো? আদনান বলল, “আমার বয়স আটত্রিশ।” “খুব বেশি বড় নন। আপনি করে বললেই খুশি হব।” আদনান আবার হাসল। বলল, “জানেন, এই পাহাড়টার সবচেয়ে সুন্দর বৈশিষ্ট্য কী? ও মানুষের বিষন্নতাগুলে শুষে নিতে পারে। প্রাণহীন মানুষে প্রাণসঞ্চার করতে পারে। যত বার আমি পাহাড়ে আসি, আমার মন ভালো হয়ে যায়।”

“ভালো।”
“আপনি প্রথমবার এসেছেন তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“সাথে কেউ আসেনি কেন?”

গতকালও আদনান প্রশ্ন করেছিল আমি একা এসেছি কি না। এই লোকের এত কৌতুহল কেন? তাকে কি বলব আমার কথা? বলে কী লাভ? গতদিনের মতো আজ কুয়াশা নেই। পাহাড়ের মাথায় রোদ পড়েছে। সোনালী রঙা রোদ্দুরে সবুজাভ পাহাড়ের মাথা ঝিলমিল করছে। নিচে এখনো শীত। চায়ের কাপ আঁকড়ে ধরে হাত গরম করার চেষ্টা করলাম। চা ঠান্ডা হচ্ছে দ্রুত। একটা চুমুক দিয়ে চা পান করে নিলাম শরবতের মতো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “চলুন হাঁটি।”

আদনান উঠে এলো। সামনে সরু পথ এঁকেবেঁকে গেছে। এদিকটাতে একটা মানুষও নেই। উৎরাই বেয়ে নামার সময় পদক্ষেপ আপনা থেকেই দ্রুত হয়ে যাচ্ছে। বলতে থাকলাম, “আমি মানুষটাই একা। মা বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ভাইবোন নেই। বিয়েও হয়নি। এমন কেউ নেই আমার যে সাথে আসবে।” “বিয়ে করেননি কেন?” “তেমন কাউকে পাইনি। একটা সম্পর্ক ছিল, যেটা আমাকে শিখিয়েছে কখনো মানুষের বাইরেটা দেখে বিশ্বাস করতে নেই। যেহেতু কারো ভেতরটা আগে থেকে দেখার সুযোগ থাকে না, তাই ভরসা করে বিয়ে করার সাহস হয়নি। আর সত্যি বলতে আমার অত আবেগও নেই। জীবনটা একভাবে কাটাতে পারলেই হলো।” ভেবেছিলাম আদনান হাসবে। কিন্তু সে হাসল না। কেমন বিষন্ন হয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ নিরবতার পর সে তার গভীর কন্ঠটাকে আরও গভীরতর করে বলল, “আপনি নিজেকে চেনেন না।”

বলেই দ্রুত হেঁটে ফিরে গেল ওপরের দিকে। আমি বেশ অবাক হলাম। কী হলো এটা? লোকটার মাথায় ছিট নেই তো? সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। অজানা কারনে আমার পুরো সত্তা আচ্ছন্ন করে রইল একটা বাক্য- “আপনি নিজেকে চেনেন না।” আজও আদনান যেচে পড়ে এসেছে কথা বলতে। একটা দোলনায় বসেছি দুজন৷ এখান থেকে পাহাড় ভালো দেখা যায় না। সামনে আগাছার ঝোপ। তাতে বেগুনী-গোলাপী মিশেল ছোট ছোট ফুল ফুটে আছে। বাতাসে বুনোলতার ঘ্রাণ। কাছেই একটা চিকন ঝর্ণাধারা থেকে ছলছল পানি পড়ার আওয়াজ আসছে। আদনান বলল, “সেদিন অমন করে চলে গেছিলাম বলে দুঃখিত। “কেন চলে গিয়েছিলেন?” আদনান প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, “জানেন, আমি একটা রেডিওর আরজে ছিলাম।”

“স্বাভাবিক। আপনার গলা সুন্দর। কিন্তু নাম বললে আমি হয়তো চিনতে পারব না। রেডিও শোনা হয় না।”
“কেন?”
“ওইযে বলেছিলাম, আমার আবেগ নেই।”

আদনান শব্দ করে হেসে বলল, “আমার অবশ্য অনেক আছে। জীবনে অনেক প্রেম করলেও আবেগের কাছে শেষবার ধরা খেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু যার কাছে ধরা পড়েছিলাম সেই ছেড়ে চলে গিয়েছিল।” আমি চোখমুখ শক্ত করে বললাম, “মানুষের কাজই ধোঁকা দেয়া।” “আমার গল্পটা ঠিক আপনার মতো নয়। আমার স্ত্রীর ক্যান্সার হয়েছিল। সে মারা গেছে।” আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। বেশ একটা গাঢ় কষ্ট আদনানের ভেতর থেকে বের হয়ে এসে আমাকে ভেদ করে গেল। আমি প্রথমবারের মতো তার দিকে সরাসরি তাকালাম। সেও দেখি আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি সাহসা চোখ সরিয়ে ফেললাম না। অপলক চেয়ে রইলাম অনেকটা সময় নিয়ে।

তারপর হঠাৎ সে ঘোর ভেঙে বলল, “যা বলছিলাম, যখন রেডিওতে কাজ করতাম, হাজার হাজার প্রেমের প্রস্তাব পেতাম। মেয়েরা আমার গলার আওয়াজেই পাগল হয়ে প্রেমপত্র দিতে থাকত, এমনকি আমাকে বিয়ে করার জন্যও কেউ কেউ অস্থির হয়ে উঠেছিল।” বলেই হা হা করে হাসল আদনান। আমার বিরক্ত লাগল। একটা মানুষের একটু গুণ আছে দেখেই সেটা বড়াই করে বলতে হবে! তার ওপর তার জন্য কত মেয়ে পাগল ছিল সেসব জেনে আমার কী হবে? বাঙালির হুজুগে স্বভবটা আর গেল না! আদনানকে অন্যরকম মানুষ ভেবেছিলাম, ভাবনাটা কেমন মিথ্যে লাগতে লাগল, মনটা খারাপ হয়ে গেল।  আমার উদাসীন ভাব দেখে আদনান চোখ টিপে হেসে বলল, “গল্প শেষ হয়নি ম্যাডাম!”

“বলতে থাকুন।” “একবার এক মেয়ের সাথে সিরিয়াসলি জড়িয়ে গেলাম। তখন আমার বয়স ছিল অল্প। বাইশ-তেইশ হবে। এত মিষ্টি করে কথা বলত যে পাগল হয়ে শুনতাম। আর এত্তো কেয়ারিং ছিল! আলাপ হয়েছিল ফোনে। তাকে সামনাসামনি দেখিনি তখনো। তাও আকাশ পাতাল কত কী ভেবে নিয়েছিলাম তাকে নিয়ে। ফাইনালি আমরা দেখা করলাম। তার সাথে দেখা হওয়ার দিনটা আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরনীয় দিন হয়ে থাকবে। দেখলাম আমার প্রেমিকাটির বয়স মাত্র আটান্ন। তিন ছেলেমেয়ের মা। মাথার চুল পাতলা হয়ে গেছে, চামড়া একটু ঢিল হয়ে গেছে, তবুও সাজগোজের অন্ত নেই। কড়া লিপস্টিক, ভারি গহনার সাথে জমকালো সিল্কের শাড়ি! আমাকে ভ্যাবাচ্যাকা খেতে দেখে সে খুব মজা পেল। এমন ভাব করল যেন আমাদের জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক। এটাও বলল যে আমার জন্য নাকি সে তার স্বামী সন্তান ছেড়ে আসবে।”

আমার মুখ হা হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর?” আদনান বিরস মুখে বলল, “কথা ছিল খাওয়াব। সে চাইনিজ খাবার থেকে শুরু করে পেস্ট্রি, ফালুদা, আইসক্রিম সব খেয়ে নিল। খাওয়ার বহর দেখে আমার চোখ উল্টে যাওয়ার জোগাড়! সব খাওয়া শেষে আমার দুই হাত টেনে নিয়ে হাতে চুমুও খেয়ে ফেলল কয়েকটা! তারপর ভ্যানিটি ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বলল, যাই, আবার নেক্সট উইকে দেখা হবে প্রিয়।” “তারপর?” “তার আর পর! আমি বাড়ি ফেরার পথে নতুন সিম কিনে নিয়ে গেলাম৷ পুরাতনটা ফেলে দিলাম ডাস্টবিনে। সেও বোধহয় বুঝেছিল আমি তাকে আর পাত্তা দেব না, তাই অন্য কোনোভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেনি। একদিনেই খাওয়া পুষিয়ে নিয়েছে!”

আমি খিলখিল করে হেসে উঠলাম৷ আদনানের গল্প আর বলার ধরণটা এত চমৎকার ছিল! হাসি সহজে থামল না, চোখে পানি চলে এল। চোখ মুছে দেখি সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। একটু কঠিন হওয়ার চেষ্টা করে বললাম, “কী হয়েছে?” “আপনাকে হাসলে সুন্দর লাগে লুনা।” আমার বিব্রত বোধ হলো। প্রসঙ্গ এড়াতে বললাম, “হঠাৎ এই গল্পটা আমাকে বলার কারন?” “আপনার হাসিমুখ দেখতে, যেটা এই পর্যন্ত একবারও দেখিনি।”

আমার আবারও অস্বস্তি হলো। উঠে পড়লাম সেখান থেকে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। আমরা পাহাড়ি রাস্তা ধরে হেঁটে চললাম চুপচাপ। আমি বা আদনান কেউ কারো সাথে কথা বললাম না। শুধু মনের কোণে নিজের অজান্তেই সুর ভেসে বেড়ালো- “এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো আবিরের রঙ ছড়িয়ে সূর্য অস্ত গেল। গোধুলীর নিস্তেজ আলোয় কী মনে করে আদনানের দিকে তাকালম। তার দাড়িগোঁফে ভর্তি মুখটা মনে হলো অতলান্ত কোনো সমূদ্র। সেই সমূদ্রে ডুবে মরতে ভীষণ সাধ জাগল। নিজেকে অবশ্য সামলে নিলাম পরক্ষণেই। আদনান আমাকে হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দিল। পরদিন আমার ফেরার দিন। আদনান আরও কিছুদিন থাকবে। দুপুরের বাস আমার। সকালে তার সাথে দেখা হলো। আগেই বলেছিল সকালে আমাকে খাওয়াবে। পাহাড়ি খাবার খেলাম দুজন। সে তার একটা কার্ড দিল। তাতে তার বিষয়ে সবকিছুই লেখা আছে।

বাসের সময় হলে আমাকে এগিয়ে দিতে এল সে। নির্জন একটা পথ পড়ল মাঝে। সেখানে এসেই বলতে শুরু করল, “লুনা জানো, আমার জীবনে অনেক মেয়ে এসেছে। একেকজন একেক রকম৷ কিন্তু আমার মন ঠিক যেমন চাইত, শান্ত, গভীর অথচ স্বচ্ছ একটা মন, সেরকম কোথাও পাইনি। আমার স্ত্রী অনেকটা তেমন হলেও পুরোপুরি সেরকম ছিল না। তোমাকে দেখে প্রথম মনে হয়েছিল আজীবন যা খুঁজেছি তা পেয়েছি। কিন্তু এই তোমার সামনেই কিসের এক সংকোচে মনের কথাটা অকপটে বলে উঠতে পারিনি। আজও সোজাসুজি বলতে কেমন বাঁধছে। তুমি বুঝে নাও। কার্ডে আমার ফোন নাম্বার আছে। ইচ্ছে হলে ফোন করো।” আমি কিচ্ছু বললাম না। এগিয়ে চললাম ছোট ছোট পায়ে। মনে হতে লাগল পৃথিবীটা দুলছে। কখন যেন পা ফসকে পড়ে যাব গভীর খাদে। যদিও কিছু হলো না। সুস্থভাবেই পৌঁছুলাম৷ আদনান বাকিটা রাস্তা শুধু রবীন্দ্রনাথের গানের কয়েকটা লাইন গেয়ে গেল।

বাসের জানালা দিয়ে গেরুয়া চাদর পরা উদাস মুখটা আরও বেশি মেঘাচ্ছন্ন মনে হলো৷ দুটো চোখ ভর্তি তৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার জানালার দিকে। তার গাওয়া গানটা কানে বাজছে “আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন তোমাতে করিব বাস দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বয়স মাস ঠোঁট চেপে আসন্ন কান্নাটা আটকে দিলাম। চলতে চলতে প্রাথমিক আবেগের ধাক্কাটা কেটে গেল পথেই। বাড়ি ফিরে মনে হতে লাগল সব মিথ্যে। মানুষের ছলনার শেষ নেই! এটাও একটা ছলনা! অতীতের কথা খুব বেশি করে মনে পড়তে লাগল৷ মনে হলো একটা প্রায় অচেনা ছেলের ফাঁদে পড়ে গেছি আমি। এর থেকে বের হতেই হবে। আমি আদনানের কার্ডটা নিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিলাম ময়লার ঝুড়িতে।

বেশ কয়েক মাস কেটে গেল। আমার অস্থিরতা একটুও কমেনি। বরং দিন দিন বেড়েছে। গলার কাছে একটা বিষাক্ত কাঁটা আটকে আছে যেন৷ কার্ডটা ছিঁড়ে ফেলার জন্য নিজেই নিজেকে কতশত বার ধিক্কার দিয়ে ফেলেছি! আদনানের ব্যাপারে বলতে গেলে কিছুই জানি না। কার্ডের লেখাতে ঠিক করে চোখ বোলালেও কিছু মনে থাকত।
আমার খুব খারাপ অসুখের মতো হলো। কিছুই ভালো লাগে না। কোনো কাজে মন বসাতে পারি না। ছাত্রদের ঠিক করে পড়াতে পারি না। মাথায় শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীতের লাইনগুলো বেজে চলে। শুধু একটা মানুষ কয়েকটা দিনে জীবন এত এলোমেলো করে দিয়ে যেতে পারে বিশ্বাসই হয় না। আমি তো টিনএজার মেয়ে নই! এতকিছু দেখে ফেলেছি জীবনে, তবুও বাচ্চাদের মতো কেন করছি? সেই উত্তর অনেক খুঁজেও পেলাম না। তীব্র সংকট থেকে বাঁচতে ডাক্তার দেখাব বলেও ঠিক করলাম।  যেদিন ডাক্তারের কাছে যাব, সেদিন সকালে একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এলো। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে মানুষটা বলে উঠল, “কেমন আছ লুনা?” আমি কেঁদে ফেললাম। আদনান! সেই কণ্ঠ! কাঁদতে কাঁদতেই বললাম, “আমি তোমার নাম্বার হারিয়ে ফেলেছিলাম!” আদনান হাসল। “বাচ্চা মেয়ে নাকি তুমি? কাঁদছ কেন?”

“জানি না।” “বলেছিলাম না, তুমি নিজেকে চেনো না। তোমার কোনো আবেগ নেই- কথাটা মিথ্যে!” আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম। আদনান একটু কড়া সুরে বলল, “কত কষ্ট করে তোমার নাম্বার জোগাড় করেছি কান্না শুনতে? এখন একটু নিচে এসো তো। আমি তোমার বাড়ির সামনে।” আমি ঝট করে উঠে পড়লাম৷ মনে হলো একটু সেজে যাই। কতকাল সাজি না! আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের উজ্জ্বল চোখদুটো দেখে মনে হলো এত খুশি আমি এই জীবনে কোনোদিন হয়তো ছিলাম না!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত