অন্তঃসত্ত্বা

অন্তঃসত্ত্বা
বাসর রাতে আমার নববধূ যখন জানালো যে সে তিন মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা, আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। প্রচন্ড মন খারাপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, বিয়ের আগে কেন ব্যাপারটা বলোনি কিংবা তোমার পরিবারই বা কেন ব্যপারটা গোপন করলো?
জয়া বললো, চার-পাচঁ মাস আগের কথা। আমি খালার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। খালা খালু মার্কেটে গেলে আমার আপন খালাতো ভাই যে কিনা দুবাই প্রবাসী, যাকে আমি আপন মায়ের পেটের ভাইয়ের মতন ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি, সে আমাকে ধর্ষণ করে। এরপর থেকে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে থাকি, আত্নহত্যা করার কথাও যে ভাবিনি তা নয়, আসলে ঘটনার আকস্মিকতায় আমি দিশেহারা হয়ে যাই, বুঝিনি যে তার বীজ আমার শরীরের গেঁথে গিয়েছে। আমার বাবা-মা এর কিছুই জানেন না। আমি বহুবার ব্যপারটা আপনাকে জানাতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি। অমন পরিস্থিতিতে কি করে শান্ত থাকা যায় আমি সেটাই ভাবছিলাম। তারপরও খুব যন্ত্রণা হচ্ছিলো, মন-মগজে। এত বড় প্রতারণা, তাও আবার আমার সাথেই? মনে হচ্ছিলো, বাসর রাত থেকে বেরিয়ে এখনই সবাইকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিই আর তালাকের কথা বলি। কিন্তু না, সবরকমের চেষ্টা করে নিজেকে শান্ত করে রাখলাম, ওর কথা গুলো আগে শুনি, তারপর একটা সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।
– তারপর? তুমি তোমার খালাতো ভাইয়ের মুখোশ উন্মোচন করলে না কেন?
– ভয়ে! – কিসের ভয়?
– একদিকে নিজের মান-সম্মান তো আছেই,
অন্যদিকে আমাকে রেইপ করার পরে আমার খালাতো ভাই আমাকে হুমকি দিয়েছিল, এই ঘটনা যদি আমি কাউকে জানিয়ে দিই, তবে নাকি সে আমার ছোটবোনের ওপর দিয়ে শোধ তুলবে। নিজের বোনের কথা ভেবে আমি চুপ হয়ে যাই, কিন্তু তলে তলে যে আমার এত বড় সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে তা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন কিন্তু প্লিজ ব্যাপারটা গোপন রাখুন। জয়ার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। অবিরত কেঁদেই চলেছে সে। কি করবো আমি এখন? আমি কি সবাইকে জানাবো, তালাক দেবো নাকি গোপন রেখে অন্য কোনো ভাবে ব্যাপারটার সমাধান করবো? কঠিন একটা সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। বিশ্বস্ত বন্ধু শ্যামলের সাথে আলাপ করলে সে আমাকে একটা উপায় বাতলে দেয়, যদিও উপায়টা খুব সহজ কিছু নয় তারপরেও চেষ্টা করলে মন্দ কি?
আমি আর শ্যামল মিলে বুদ্ধি করলাম, জয়ার খালাকে ডেকে এনে তাকে সবকিছু খুলে বলা, তার ছেলের কীর্তিকলাপ সম্পর্কে আরকি; তারপর তাকে দিয়ে বলানো, “বাবা, তুই চলে আই দেশে, আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে, জানিনা, তোকে শেষ দেখা দেখতে পারবো কিনা” – এই টাইপের কথা বার্তা আরকি যাতে করে জয়ার খালাতো ভাই সূর্য ব্যাটাটা এক ফোন পেয়েই চলে আসে দুবাই থেকে। আর যদি সহজ কথায় চিড়ে না ভেজে, তবে ভয়-ভীতি দেখিয়েই জয়ার মায়ের মুখ দিয়ে এমন কথা বলাতে হবে, এছাড়া আর কোনো ভালো উপায় দেখা যাচ্ছেনা। পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি জয়ার খালাকে ফোন করে বলি, খালা আমার বন্ধু শ্যামল গাড়ি নিয়ে আপনার বাড়িতে যাচ্ছে, আপনাকে আনতে, জয়া ভুনা খিচুঁড়ি রান্না করেছে, আপনার তো খুব প্রিয়, চলে আসেন প্লিজ! শ্যামল গাড়িতে করে খালাকে নিয়ে এলে আমিও গাড়িতে খালার সাথে বসে পড়ি।
– কি বাবা, আমরা কি নামবো না? কোথায় আচ্ছি আমরা?
খালাকে পুরো আস্ত একটা খিচুঁড়ির বাটি ধরিয়ে দিয়ে বলি, খালা আপনার প্রিয় ভুনা খিচুঁড়ি, আমি রান্না করেছি, না, আমরা আজ বাড়িতে যাচ্ছিনা, একটু ঘুরবো আর আপনার সাথে আলাপ করবো খালা। উনি প্রথমে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেও পরে অবশ্য স্বাভাবিক হতে থাকেন এই সেই কথা বলার পরে, ধীরে ধীরে মূল কথায় আসি, পুরোটা বলা হয়ে গেলে তিনি বলেন,
– কি? এমনটা হতে পারেনা, আমার সুর্য এমন ছেলেই না, সে এমনটা কখনোই করতে পারেনা, বাবা, কোথাও হয়তো ভুল হচ্ছে, তবে তোমাদের যেহেতু সন্দেহ, আচ্ছা, আমি আমার ছেলেকে দেশে নিয়ে আসবো, তবে মিথ্যে বলে নয়। আমার ছেলেকে বললে, আজ রাতের ফ্লাইটে দেশে চলে আসবে। বললাম, খালা, সে যদি আপনার এক কথায় চলে আসে, তবে আমরাও চাইবোনা যে আপনি মিথ্যে কথা বলেন। একটা কথা বলে রাখা উচিত, আর সেটা হলো, এসব কিছু আমি জয়াকে না জানিয়েই করছিলাম। জয়াকে ওর বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।
পরদিন ভোরবেলা। আমি আর শ্যামল জয়ার খালার বাড়িতে। অপেক্ষায় আছি ঠিক কখন সূর্য বাড়িতে ঢোকে, অবশেষে ভোর পাচঁটার দিকে সে হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ঢোকে। আমাদের দেখে সে স্বাভাবিক ভাবেই অবাক হয়। খালাকে আগেই বলেছি, তার ছেলেকে একটু হলেও আমরা জেরা করবো। সুতরাং তিনি যেন ঘাবড়ে না যান।
সূর্য আমাকে দেখেই আমতা আমতা করে বলে, আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে, আপনি কি জয়ার হাজব্যান্ড না? মানে ছবিতে দেখেছি আরকি! লাগেজ এক কোণায় রাখতে রাখতে সে বললো, আচ্ছা, এত সকালে, জয়া কি আমাদের এখানে? মা, কোনো সমস্যা না তো? – বলে আমাদের দিকে একবার তাকালে শ্যামল ওর কোমরে থাকা পিস্তলটাকে এক নজর দেখায়। আমি পর মুহূর্তেই বলি, সূর্য, আপনার সাথে আমরা একটু কথা বলতে চাই, আশা করি আপনার কোনো আপত্তি নাই?
– না না, কিসের আপত্তি, বসুন? সূর্য্যের কাঁপা কন্ঠ! মা, একটু যাও তো চা করে নিয়ে এসো।
– না খালা আপনি বসুন, আগে আমরা কথা বলে নিই, তারপর নাহয় চা-নাস্তা সারা যাবে।
এরপর সব কিছু আমি সূর্যকে খুলে বলি, সূর্য শুনতে থাকে আর ওর চোখ থেকেও পানি ঝরতে থাকে। সেটা দেখে মনে মনে বলি, কি রে বাবা, এরা দেখি কথায় কথায় কাদঁতে জানে? আজব ব্যাপার সেপার!
– আপনার তো সবকিছু বলা হয়েছে তাইনা? সূর্যের প্রশ্ন! – জ্বি হ্যাঁ, এবার আপনি বলতে পারেন।
– আপনারা যা ভাবার ভাবেন, কোনো সমস্যা নেই,
কিন্তু এই যে দেখেন আমি আমার মায়ের মাথা ছুঁয়ে বলছি, আমি এসবের কিছুই করিনি, অসম্ভব ব্যাপার। আর যেদিনের কথা সে আপনাকে বলেছে, সেদিন তার উল্টোটা হয়েছিল, আমার বাবা যে অন্য শহরে থাকেন সেটা তো জানেন, চাকরীর আর কয়দিন বাকি আছে, বাবা এলেই বাবা-মা একসাথে ঘুরতে বের হন। তো সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাসায় বেড়াতে এসেছিল জয়া। তো বাবা মা বের হয়ে গেলে হঠাৎ জয়া আমার ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়, বন্ধ করে আমার সাথে যাচ্ছেতাই কাজ করে, তা বলে বোঝানোর মতন না।
– যাচ্ছেতাই কাজ করে বলতে? – শ্যামল পাশ থেকে জিজ্ঞেস করে।
– সেটাও কি খুলে বলতে হবে মায়ের সামনে? কোমরে পিস্তল নিয়ে বসে আছেন, আর এটুকু বোঝেন না?
– না মানে, আসলে আপনাদের মধ্যে কি শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল কোনোভাবে?
– আসলে জয়া করতে চেয়েছিল, অনেক চেষ্টাও করেছিল, কিন্তু হয়ে ওঠেনি, কারণ, আমার তো আগ্রহ ছিলনা।
আর আগ্রহ না থাকলে কিভাবে সম্ভব? বিশ্বাস করুন, আমি ওকে আমার আপন বোনের মতন ভালোবাসি। সূর্য্যের মা বললেন, কি বলেছিলাম না? আমার ছেলে এমন নয়? আর জয়া এই কথা কি করে বললো, আমার তো সেই রাত থেকেই এই সব শোনার পরে মরে যেতে ইচ্ছে করছে, ওকে কোলে পিঠে করে বড় করলাম, আর জয়া কিনা আমারই ছেলের বিরুদ্ধে এত বড় অপবাদ দেয়? এ কি মেনে নেওয়া যায়? সূর্য তার মাকে শান্তনা দিয়ে বলছিল, “মা, আমরা যাকে সবচাইতে বেশি বিশ্বাস করি, তারাই সবচাইতে বেশি অবিশ্বাসের কাজ করে” – শুনে সূর্যের মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন! সেই দীর্ঘশ্বাসটাকে ব্যাখ্যা করার মতন ভাষা বিধাতা আমাকে দেননি! আমি পড়ে গেলাম এক বিশাল গোলকধাধাঁর মধ্যে, আমি বলছিনা যে আমার বৌ দুধে ধোঁয়া তুলসী পাতা, আবার এটাও বলছিনা যে সূর্য সত্যটাই বলছে। ওদের সত্য-মিথ্যের মারপ্যাঁচে পড়ে নিজেকে খুব দিশেহারা মনে হচ্ছিলো! আমার ব্যাপারটা সূর্য আর তার মা বুঝতে পেরে বললো, তারা আমাকে সত্য উদঘাটনে যথার্থভাবেই সাহায্য করবেন। আর যতদিনে না সত্য উদঘাটিত হবে, ততদিনে সূর্য দেশেই থাকবেন। সূর্যের এমন সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ তার প্রতি কোনো সহানুভূতি তৈরী করতে পারেনি যদিও।
– সূর্য আপনার সাথে আমরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখবো। অনুরোধ রইলো, আপনি কোনোভাবেই আমার বা আপনার খালার পরিবারের কারো সাথে আপাতত যোগাযোগ রাখবেন না।
বের হতে হতে শ্যামল বললো, বন্ধু কাউকেই আপাতত বিশ্বাস করা উচিত হবেনা, খুব ধৈর্য ধরতে হবে এক নাম্বার কথা, আর হাল ছাড়া যাবেনা। আর হ্যাঁ, আমি আমার দুটোকে চ্যালাকে সারাদিন এখানে লাগিয়ে রাখবো। এদের ওপর নজর রাখতে। বাড়িতে ফিরে গেলাম। শ্যামল ওর বাড়িতে চলে গেল। বাড়িতে গিয়েই দেখি জয়া এরই মধ্যে বাবার বাড়ি থেকে ফেরত এসেছে। জয়ার সাথে সম্পর্কটা এখনো খুব বেশি মধুর হয়নি, জয়া সেটা আন্দাজ করতে পারে, তারপরেও সে কাছে আসে, আমার খবরাখবর জানতে চায়, রাতে একসাথে থাকলেও একটা দুটো কথা – এর বেশি কোনো আলাপ হয়না। বাবা-মায়ের সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করি। সেদিন বাড়ি ফিরে ওকে দেখতে পেয়ে ঘরে ডেকে বললাম, আচ্ছা জয়া, তুমি মোট কয়বার প্রেগন্যান্সি টেষ্ট করিয়েছিলে যেন?
– কেন? একবার করেছিলাম, পজেটিভ এসেছিল। আর দিনে দিনে আমার পেট বেড়ে যাচ্ছে!
– কখনো তো ডাক্তারের কাছে যাওনি তাইনা?
– সে সাহস তো হয়নি কখনো।
– আচ্ছা, আজ আমরা ডাক্তারের কাছে যাবো।
হাসপাতাল থেকে ফিরছি। আমি আর জয়া। কথায় আছে, আমরা মরার আগেই ভূত হয়ে যাই, আর মরার আগে ভূত হয়ে গেলে জীবনের আনন্দ উপভোগ করা যায়না, অহেতুক চাপে পড়ে দিশেহারা হয়ে যাই, নববধূর মুখ থেকে প্রেগন্যান্সির কথা শুনে অমনটাই হয়েছিল। মূল টার্গেট হয়ে গিয়েছিল সূর্য। তাই যে মেডিকেল টেষ্ট প্রথমেই করানো উচিত ছিল। সেটা বেশ দেরীতেই হয়ে গেল। জয়া বললো,
– না, এই টেষ্ট সঠিক নয়। এটা হতে পারেনা, আমার মধ্যে প্রেগন্যান্সির সব ধরণের লক্ষণ আছে।
– আচ্ছা, আগামীকাল আমরা অন্য কোথাও আবার নাহয় টেস্ট করে আসবো?
তোমার যদি এতই সন্দেহ থাকে! শ্যামলকে ব্যাপারটা জানালে ও বললো, বন্ধু চিন্তা করিস না, আমার ফুপাতো বোনের সাথে আমি কথা বলে দেখছি, কেমন? শ্যামলের ফুপাতো বোন ডাক্তার। পরদিন সকাল সকাল চলে গেলাম সেখানে। সেখান থেকেও একই ফলাফল এলো, জয়া অন্তঃস্বত্ত্বা নয়। শ্যামলের ফুপাতো বোনের সাথে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করলাম। আমি আর শ্যামল দুজনই। তাকেও ব্যাপারটা খুলে বললাম।
– দেখুন, শ্যামলের কাছ থেকে সবকিছুই জেনেছিলাম, তো আজ আসলে প্রেগন্যান্সি টেস্টের সাথে মেডিকেল টেস্টটাও করিয়ে নিয়েছি যে ওকে আসলেই সূর্য সাহেব রেইপ কিংবা জোর পূর্বক শারীরিক সম্পর্ক করেছিল কিনা। কিন্তু সত্য বলতে, মেডিকেল টেস্টে রেইপের কোনো প্রমাণই পাওয়া যায়নি! প্রচন্ড অবিশ্বাসের দোলাচলে ভুগতে লাগলাম, মানুষের মন হলো এই দুনিয়ার সবচাইতে দ্রুতগতির যান। মাথার মধ্যে মুহূর্তের মধ্যে কি না এলো সেকেন্ডের মধ্যে, কল্পনা করে ফেললাম, শ্যামল আর শ্যামলের ফুপাতো বোনকে টাকা দিয়ে হাত করেছে সূর্য! তার ফলাফল এইসব কথা বার্তা – ধূর কিসব ভাবছি আমি? মাথার মধ্যে তখনো বাজছে, সূর্যের সেই কথাটা, “মা, আমরা যাকে সবচাইতে বেশি বিশ্বাস করি, তারাই সবচাইতে বেশি অবিশ্বাসের কাজ করে” – অল্প সময়ের মধ্যে এত রংবদল আমাকেই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে তুললো।
শ্যামলের সেই ডাক্তার বোন আরো বললো, দেখুন, ডাক্তারী জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা থেকে যেটা বুঝতে পারছি, সেটা হলো আপনার বৌ-এর হয়তো মানসিক কোনো সমস্যা রয়েছে, আর সেই সমস্যার কারণেই এমনটা হচ্ছে, তার অবচেতন কোনো কারণে হয়তো তৈরী করে নিয়েছে যে তার আপন খালাতো ভাই তাকে রেইপ করেছে, এবং সেই থেকে সে নিজেকে প্রেগন্যান্ট ভাবতে শুরু করেছে। তার সাথে কথা বলে তাকে মানসিকভাবে সুস্থ মনে হয়নি আমার, যা ভাবছি, আমার বিশ্বাস সে ফলস প্রেগন্যান্সির আওতায় রয়েছে, এটা অনেক সময় মায়ের কারণেও হতে পারে, মানে মায়ের থেকে আসতে পারে।
– কিভাবে? প্রশ্ন করলাম তাকে।
– সে বললো, জয়ার জন্মের আগে তার মা যদি প্রেগন্যান্ট হয়ে থাকে,
এবং কোনোকারণে তার বাচ্চা যদি নষ্ট হয়ে যায়, মা তখন স্বাভাবিকভাবেই বিষন্নতায় ভুগতে থাকে, আর সেই বিষন্নতা থেকেই দিনে দিনে তার মধ্যে একটা বাচ্চার জন্য গভীর আকাঙ্খা তৈরী হতে থাকে। যদিও আবার বাচ্চা-কাচ্চা জন্ম দিলে একসময় এটি মিলিয়ে যায় কিন্তু ভেতরে ভেতরে এই আকাঙ্খা ঠিকই মা তার ব্রেইনের কোথাও না কোথাও পুষে রাখে, যা কিনা পরবর্তীতে অনেক সময় সেটি নতুন জন্ম দেয়া বাচ্চার ওপর প্রভাব ফেলে। আপনি কি জানেন এমন কিছু যে জয়ার মা জয়ার জন্মের আগে এমন কিছুর মুখোমুখি হয়েছিল কিনা?
-জ্বী হ্যাঁ, আসলেই তাই! ওর জন্মের আগে ওর মায়ের একটা সন্তান পেটে আসে, কিন্তু বাচ্চাটা নির্দিষ্ট সময়ের আগে দুনিয়াতে আসায় মরে যায়।
– দেখলেন তো তাহলে, এখন যেটা হয়েছে, ওর বয়স বাড়ার সাথে সাথে ওর মধ্যে ওর মায়ের মধ্যে থাকা সেই আকাঙ্খা দিনে দিনে প্রবল হয়েছে, ও প্রেগন্যান্ট না হলেও ওর কাছে মনে হচ্ছে যে ও প্রেগন্যান্ট, মেডিকেলের ভাষায় আমরা এটিকে সিউডোসিওসিস বলে থাকি।
– সেটা নাহয় বুঝলাম রে রাত্রি, কিন্তু তাই বলে ও কেন ওর খালাতো ভাইকে এভাবে দোষারোপ করবে, মানে তাই বলে রেইপের কথা কেন বলতে যাবে? শ্যামল প্রশ্ন করলো!
– আসলে এই ব্যাপারটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারিনা, আমার যতদূর মনে হয়, এটা ওর অবচেতন মনের কল্পনা! কিংবা এমনটাও হতে পারে যে সূর্য সাহেব আসলেই তার সাথে এমন কিছু করেছে যার প্রেক্ষিতে তার মনে হয়েছে যে সূর্য তাকে রেইপ করেছে। আমার মতে সূর্য সাহেবকে আরেকটু ভালো করে ভয় দেখিয়ে জিজ্ঞেস করা উচিত! রাত্রি ম্যাডামের চেম্বার থেকে আমরা বের হলাম। বের হতে না হতেই মায়ের ফোন, জয়া নাকি আত্নহত্যা করেছে। দ্রুত বাড়িতে পৌছে দেখি জয়ার ক্ষতবিক্ষত শরীর ঘরের মধ্যে পড়ে আছে, রক্তে পুরো ঘর ভেসে গিয়েছে। তলপেটের ওপর থেকে কাটা। আঁকা-বাঁকা, যেভাবে পেরেছে সেভাবেই কেটেছে! ওর হাতে একটা ছুরি, যেভাবে পড়ে আছে, দেখে বুঝতে বাকি রইলো না যে এই ছুড়ি নিয়ে নিজের পেট কেটে কুটে দেখার চেষ্টা করেছে আসলেই ওর মধ্যে কোনো স্বত্ত্বার বসবাস আছে কিনা!
আমি ওকে এভাবে দেখে চেয়ারের ওপর ধপ করে বসে পড়লাম, কান্না আসতে চাইছিল কিন্তু কাদঁতে পারলাম না, পাগলীটাকে বুঝে ওঠার আগেই, ওর সমস্যাটা ধরতে পারার আগেই ও এভাবে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবে আমি ভাবতেও পারিনি। ও হয়তো প্রেগন্যান্সির রিপোর্টটাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি! আরেকটা ফোন, শ্যামলের কাছে। ওর সোর্স খবর দিয়েছে যে সূর্য নাকি লাগেজ নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। শ্যামল বললো, ওকে আটকা তোরা, আমি আসছি এখুনি। আমার মা কে ও জিজ্ঞেস করলো, কাকীমা, এই খবর কি আপনি আপনার বোনকে জানিয়েছেন? মা কাদঁতে কাদঁতে বললো, হ্যাঁ, বাবা জানিয়েছি তো! শ্যামল চলে গেল, আমি তখনো তাকিয়ে আছি পাগলীটার মুখের দিকে, সেদিনই কেবল বুঝতে পারলাম, জয়াকে আমি দিনে দিনে কতখানি ভালোবেসে ফেলেছিলাম!
সূর্যকে আটকানোর পরে ওকে মৃত্যুর ভয় দেখানো হলে ও স্বীকার করে সবকিছু, ওর কথা হলো, ও আসলে ওর মায়ের সামনে নিজেকে ছোট করতে চায়নি, তবে সে জয়াকে রেইপও করেনি, তবে করতে চেয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ করে ওর বাবা-মা মার্কেট থেকে ফিরে এলে জয়া রক্ষা পায়, জয়াকে ভয় দেখিয়ে সূর্য বলেছিল, তুই যদি এই কথা কাউকে বলে দিস, তাহলে তোর ছোট বোনকে মেরে ফেলবো! জয়া মিথ্যে বলেনি, ডাক্তার রাত্রির কথা অনুযায়ী জয়া আসলেই কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল! জয়ার মা-বাবাও ব্যাপারটা নাকি কখনো বুঝে উঠতে পারেনি যে তাদের মেয়ে ভেতরে ভেতরে এমন সমস্যা নিয়ে বড় হয়েছে! সূর্যকে পুলিশে দেয়া হয়, ও এখনো জেলে! আমার মা আবার আমার জন্য পাত্রী খুজঁছেন, আমি জানি আমি মায়ের কথায় না করতে পারবো না, কিন্তু এটাও সত্য, আমি এই জনমে জয়াকে কখনোই ভুলতে পারবো না!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত