খোয়াবনামা

খোয়াবনামা
লোকটির চেহারা গোলগাল। আমার চেহারা লম্বাটে। এবং এইমুহূর্তে খানিক চ্যাপ্টাও হয়ে আছে। চ্যাপ্টা মুখে জমে আছে বিরক্তি। কপালে ভাঁজ হওয়া তিনটে রেখা, কুচকানো ভ্রুঁ, ছোট হয়ে আসা দু’টো চোখ আমায় ভেতর থেকে ক্ষনিক পর পর জানান দিচ্ছে, ‘তুমি বিরক্ত। রাগান্বিতও বটে।’ গোলগাল চেহারার লোকটিকে আমি চিনিনা। চেনার কথাও না। অপরিচিত শহর থেকে শুরু হওয়া দুরপাল্লার বাস ভ্রমনে পাশের সিটে চেনা কেউ একজনকে পাব, আশা করাও বোকামো। সবার জন্য নয়, আমার জন্য বোকামো। আমার কেউ নেই। আমি হচ্ছি দড়ি খুঁটিহীন চূড়ান্ত নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। ‘আমি ঘুমাইনা বুঝলেন? উহু, একদম না। এই দেখেন, হাত। তেঁরছা তেঁরছা কাটা দাগ। হে হে। আমিই কেটেছি ব্লেড দিয়ে। ক্যাঁচ, ক্যাঁচ। ব্যাথায় সারা রাত ছটফট করেছি। ঘুম পালিয়ে গেছে তারপর। মানুষ ঘুমায় কী করে? ঘুমাতে হবেই বা কেন? সবাই ঘুমালে হয়? ঘুম আর মরণ সমান। ঠিক কিনা বলেন। বলেন।’ আমার বিরক্তি বাড়ছে।
লোকটি হড়বড় করে কথা বলছে প্রায় দশ মিনিট ধরে। আমার ডান কান অবশ হয়ে আসছে। চিনচিনে ব্যাথা টের পাচ্ছি। বিরামহীন কথা বলা যাকে বলে। অনবরত। কতক্ষণ কানে সয়! তিনঘন্টার মুভি একটানা দেখতে বসলেও মাঝখানে দশ পনের মিনিট বিরতি পাওয়া যায়। আমি মুভি দেখছি, বিরতিহীন। মনোযোগ জানালার বাইরের চট করে পেছনে চলে যাওয়া সবুজ বৃক্ষগুলো, দোকানপাট আর কিছু অচেনা মানুষের মধ্যে গেঁথে রেখেছি জোর করে আপাতত। এটা এজন্য করা যাতে লোকটি বুঝতে পারে আমি তার কথা শুনছিনা, আমার মনোযোগ নেই। আমার একফোঁটা আগ্রহ নেই। তাও বলছে! হড়বড়। বড়হড়। কি সর্বনাশ! ইচ্ছে করছে গোলগাল মানুষটাকে চিপসের প্যাকেটের মতোন কচলে নিয়ে দলা মুচড়া করে বাসের ছোট্ট জানালা দিয়ে টুপ করে ফেলে দিই।
‘বাসে উঠলে সবাই ঘুমায় বুঝলেন? অপদার্থ মানুষ। দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি চুরি ডাকাতি হয় বাস ট্রেনে। আমি একদম ঘুমাইনা। আমার একটা বন্ধু ঘুমিয়েছিল, তের হাজার টাকা ছিল ব্যাগে, পকেটে দামি সেট। অফো না ফফো, কি একটা সেট জানি। চোর হারামজাদা পকেট কেটে অফো নিয়ে ব্যাগের মধ্যে রেখে তের হাজার টাকা নিয়ে পালিয়েছে। গাধা! চাইলে অফোও নিয়ে যেতে পারত, কেন নেয়নি কে জানে? তাজ্জব মানুষ। আমার বন্ধুটা ওইদিনই ট্রেনের সামনে লাফ দেয়। তের হাজার টাকার শোকে। সেও তাজ্জব মানুষ। আমি লাশের সামনে গিয়ে কাঁদিনি, থু থু দিয়েছি। আত্মহত্যা মহাপাপ। তোর জীবনের দাম মাত্র তের হাজার টাকা না। কোন কথা থেকে কোন কথায় আসলাম। যা বলছিলাম, ঘুম… আমার ওই ছাগল বন্ধু মাত্র দশ মিনিটের ঘুমের শোকে সারা জীবনের মতো ঘুমিয়ে গেছে। মানুষের ঘুমানোই উচিৎ না।
পৃথিবী একটা পরীক্ষা ক্ষেত্র। এইখানে হয় ভালো কাজ কর, নাহয় খারাপ কাজ। ঘুমাবানা। ঘুম মানেই মৃত্যু। দ্বিতীয় ফিতিয় কোনো কথা না। কি? ঠিক কিনা? বলেন। বলেন।’ আমার ডান কান লাল হয়ে আসলো। বেসামাল রাগ সংবরণ করে হাতজোড় করলাম। বললাম, ‘ভাই, মাফ চাই। আমি ঘুমাচ্ছিনা। জীবনেও ঘুমাবোনা। আপনি দয়া করে কথা বইলেন না আর। কানে ব্যথা করছে ভীষণ। প্লিজ।’ লোকটি মন খারাপ করল না। ডানপাশে তাকালো। বাসের অধিকাংশ যাত্রী ঘুমাচ্ছে। মানুষটি থামল বোধহয় এইবার। মনে হলো বাসের ভেতর মাত্রই কোনো এক কালবৈশাখী লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসলো। অপরুপ নির্জন! আমি একটা লম্বা শ্বাস নিলাম। আহ। বাঁচলাম। আড়চোখে তাকিয়ে যা শ্বাস নিলাম, ফোঁস করে বের হয়ে গেল। লোকটির মুখ বন্ধ, শরীরের বাকি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এখনও কথা বলছে।
অকারণেই হাত দু’টো নড়ছে। চোখের দৃষ্টি একজায়গায় স্থির নেই। একবার সিট থেকে উঠে বাসের পেছন পর্যন্ত হেঁটে আসলো। সিটে বসে কিছুক্ষণ ডানপাশ বামপাশে মাথা নাড়িয়ে হেলান দিলো। কয়েকমিনিট পর নিজের ডান হাত মুখের কাছে এনে কব্জি বরাবর কামড় দিয়ে ‘উহ’ বলে শব্দও করলো। পুনরায় শুরু হলো হড়বড়, বড়হড়!
আমি টের পেলাম মানুষটি অসুস্থ। মানসিকভাবে। আমি কেন, যে কেউ টের পাবে। এইমুহূর্তে মিথ্যে বলব না, আমি ভয় পাচ্ছি তাকে। শারীরিক ভাবে অসুস্থ একজনকে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। মানসিকভাবে অসুস্থ একজন ভয় না পাওয়ারও কারণ নেই। অসুস্থ মানুষটি লম্বায় আমার সমান। বয়সে আমার থেকে চার অথবা পাঁচ বৎসরের বড়। এটা আমি অনুমান করলাম। গায়ের রঙ শ্যামলা, মাথাভর্তি ঘন কালো চুল, লাল হয়ে আসা চোখের নিচে কালি, অস্থির দৃষ্টি, চূড়ান্ত অশান্ত একজন।
আরও একটি জিনিস টের পেলাম। এই মানুষটির প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। জোর করে জেগে থাকতে চাচ্ছে। হাই তুলতে দেখেছি অনেকবার। যতদূর আমার ধারণা, কয়েকরাত ইচ্ছে করেই জেগে ছিলো লোকটি, ঘুমোয়নি। যে অনিচ্ছায় রাত জাগে, আর যে ইচ্ছাকৃত রাত জাগে, একটা পার্থক্য থাকে বৈকি। পার্থক্যটা সহজেই ধরা যায়। আর কেউ না পারলেও আমি ধরতে পারি। অনিচ্ছায় রাত জাগি আমিও। ঘুমোতে চেষ্টা করি। ঘুম ঈদের চাঁদ। রাতে দেখা মেলেনা একদম। দিনের আধবেলা পর্যন্ত ঘুমোই। সারা রাত জেগে থাকি। তুলিকে ভাবি। তুলি! আমার রঙতুলির বাক্স। তুলির সাথে দেখা হয়েছিল আমার কলেজে। মনজুর স্যারের ক্লাসে, উনি ফিলোসোফি পড়ান। এইতো, এক দেড় বৎসর আগের কথা।
ক্লাসে কি একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করার এক পর্যায়ে স্যার প্রশ্ন করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে কে চাও সারাক্ষণ একা থাকতে? কেউ ডিস্টার্ব করবেনা তাদের। সারাক্ষণ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। জগত সংসার সমাজ, সবার থেকে বিচ্ছিন্ন।’ পুরো ক্লাসভর্তি সবাই হাত তুলল। এই প্রজন্ম এত্ত একাকিত্ব চায়। সমস্যাটা কোথায়! পুরো ক্লাসে দু’জন হাত তুলেনি। একজন আমি। অন্যজন তুলি। আমি একা থাকতে চাইনা। ছোটবেলা থেকেই একা আছি। পঁচিশটা বৎসর আপনজন ছাড়া একা কাটিয়েছি। পরিবার নেই। বুঝতে শেখার পর থেকে একটা অনাথ আশ্রমের ক্ষয়ে যাওয়া ইটের দেয়াল আর জানালার বাইরের খানিক দূর জাঁকিয়ে বসা বিশাল একটা আমগাছ ছাড়া দেখার কিছুই ছিল না। আমি কেন একা থাকব?
আমার দরকার ভীড়। প্রচুর ভীড়। ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসের লম্বা বসার জায়গাটায় তুলি এসে বসল পাশে। এই একটা মুহুর্ত, কোনোরকম লজিক ছাড়া, কোনোরকম কারণ ছাড়াই হুট করে মনে হলো আমি আর একা নই। আমার সাথে কেউ একজন আছে। পরিচিত, অল্প পরিচিত কিংবা অচেনা! কত মানুষই তো এই কয় বৎসর পাশে এসে বসেছে। কখনও মনে হয়নি কেন এমন? এই জায়গায়ও অনেকবার বসেছি অনেকের সাথে। কখনো মনে হয়নি সামনের নাম না জানা গাছগুলোর মাথা এত উপরে কেন? মেঘ ফুঁড়ে উঠে গিয়েছে কখন। কবে! আকাশ ছোঁবে নাকি? তুলি পাশে বসল বটে। আমার চোখে জমলো স্বপ্ন। কেউ আমার কানে ফিসফিস করে বলে গেল না, খুব তাড়াতাড়ি স্বপ্ন দেখা অপরাধ। তুলির গলার স্বর শুনতে পেলাম আমি। এত মধুর, এত মধুর সে স্বর। আমার কান্না পেল।
‘পাঁচটা সিগারেট নিয়েছিলাম, গোল্ডলিপ। মজা পাইনা। এটা থেকে ম্যারেজ ভালো। হে হে… না না, বিবাহ না। সিগারেট। খান তো, নাকি? দু’টোই কটকটে, বুকে গিয়ে লাগে। একটা দামি, একটা সস্তা। তবুও মানুষ ম্যারেজ না খেয়ে, গোল্ডলিপ খায়। মানুষ আসলে দাম খায়। ভদ্রসমাজে ম্যারেজ টানা যায়না, সন্মানহানী হয়। দুই আঙ্গুলের আগায় গোল্ডলিপ তো মাথার আগায় সন্মান। সন্মান, ভীষণ সন্মানের জিনিস। ম্যারেজের ধোঁয়া লাগলে মান কমে যায়। দুর, কই থেকে কই আসলাম। যা বলছিলাম, আমি এখন একটা সিগারেট খাব। আমায় জানালার পাশে বসতে দেন। জানালা খোলা থাকবে, হাতের আঙ্গুলে সিগারেট থাকবে। হাতও বাইরে থাকবে।শুধু মজা থাকবে ভেতরে।’
আমি জলদি সিট ছেড়ে দিলাম, বসুক। মুখে সিগারেট ঢুকাক, বকবক বন্ধ থাকবে বরং। এটাই অনেক। লোকটি জানালার পাশে বসে সিগারেট ধরালো। বাসের মধ্যে সিগারেট ধরানো নিষেধ। লোকটির ভাব ভঙ্গী দেখে মনে হলোনা কোনোরকম নিষেধাজ্ঞা পাত্তা দেয়ার করার অভ্যাস আদৌ আছে তার। দিব্যি ধোঁয়া উড়ানো আরম্ভ করলো।
টের পেলাম, হাতে সিগারেট নেয়ার পর লোকটির কন্ঠস্বর একটু পাল্টেছে। কথা বলার ভঙ্গীও। জানালার ওপাশে তাকিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক নরম শান্ত স্বরে বলল, ‘ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করছি ভাই। হাস্যকর চেষ্টা। কেউ থাকলেও কথা বলি, কেউ না থাকলে কথা বলি। আমি দুঃখিত ভাই, ডিস্টার্ব করছি খুব। ক্ষমা করার প্রয়োজন নেই, কেননা পুরো রাস্তা এমন ডিস্টার্ব করে যাব আমি।’ আমি এবার হেসে ফেললাম। হাসি শুনে জানালার ওপাশ থেকে আমার দিকে তাকালো লোকটি, ভ্রুঁ কুঁচকে। হয়তো এই সময়ে আমার মুখে হাসি আশা করেনি। চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘আমি নয়ন। চোখ। চোখ নামে একটি মেয়ে ডাকতো আমায়। আদর করে চোখ ডাকতো, রেগে গেলে ডাকতো চক্ষু। বেশী রাগলে খক্ষু। খক্ষুর কোনো মানে নেই। মেয়েটির নাম শুনলে আপনি খানিক চমকাবেন। আঁখি। মেয়েটির নাম আঁখি। আমরা দুইজন মিলে একজোড়া চোখ। হা হা।’
নয়ন অথবা চোখ নামের লোকটি সিগারেটে পর পর টান দিয়ে লালচে চোখের দৃষ্টি আপাতত জানালার ওপাশে রেখে বলল, ‘আমি লিখতাম কবিতা। একটা ছোটখাটো পত্রিকায়। এই পত্রিকার সাহিত্য পাতার নিয়মিত পাঠক ছিলো আঁখি। আমি লিখতাম সমুদ্র ছদ্মনামে। আঁখি কবিতা পছন্দ করে ভীষণ। সমুদ্রকে পছন্দ করে। আমি মজা পাই। আমার কলেজ লাইফের সবচেয়ে ভালো বন্ধুটি আমারই কবিতা ভালোবাসে। আমায় ভালোবাসে নিজের অজান্তেই। আপনি বুঝতে পারছেন বিষয়টায় কতটা সৌন্দর্য! আমি কখনও বলিনি আঁখিকে, সমুদ্র মূলত আমি। আঁখি আমায় যেচে এসে গলা জড়িয়ে ধরে ভীষণ আবেগ নিয়ে আমারই কবিতা শোনায় আমাকে। আমি ওর গলার স্বরে নিজের ছন্দ, শব্দগুচ্ছ শুনি। মুগ্ধ হই। ভাবি এই চমৎকার মেয়েটি কি কখনো আমায় ভালোবাসবে, সমুদ্র কে জানার পরও? ভাবি আমি। একটা কনফিউশন কাজ করে। সমুদ্র সম্পুর্ণ আলাদা কেউ একজন ওর জন্য। আর আমি অন্য একজন। দু’টো আলাদা মানুষের জন্যে ওর অনুভূতি আলাদা। আমি ভয় পাই, দু’টো আলাদা মানুষ মূলত এক জানার পর ওর অনুভুতিও এক করতে পারবে কিনা! যদি না পারে, আমি মরে যাব।’ আমি অস্বস্তি অনুভব করলাম।
গল্প বোরিং নয়, লোকটির মতোই যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং। তবুও আমার ভালো লাগছেনা। তেতো লাগছে বাসটা। এই সিট। এই আবহাওয়া। সিগারেট। কিংবা একটা আস্ত জীবন। লোকটি থামলো। আমি এখন ডায়েরী পড়ব। এটা আমায় জাগিয়ে রাখে। আমার আদৌ জেগে থাকার দরকার খুব? আমি জানিনা। ডায়েরী খুললাম। “আগস্ট। রাত। ও রাত, আমায় শুনতে পাচ্ছো তুমি? সুপ্ত ঘুমোচ্ছে। সুপ্ত ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে। আমি পাশে বসে আছি, আমার কোলে ডায়েরী। আমি লিখছি। আমার খুব দমবন্ধ লাগছে। বায়ান্ন দিন পার হলো আজ। সুপ্ত কথা বলছেনা। সবার সঙ্গে বলছে। বারান্দা, আলনা, বন্ধু, দেয়াল, বৃক্ষ, কাপড় শুকোনোর জন্য বাঁধা দড়িতে এসে বসা কাক… সবার সঙ্গে কথা বলছে সুপ্ত। শুধু আমার সঙ্গে কথা বলছেনা।
আমি গোপন করেছি কিছু একটা তার কাছে। আমি সত্যিই গোপন করেছি। গোপন করেছি প্রথম প্রেম। গত হয়ে যাওয়া একটা মানুষ। পৃথিবীর ভেতরের একটুকরো পৃথিবী ছিল একদা। বাইরের জটিল কাঠখোট্টা পৃথিবী ছেড়ে ওই ছোট্ট পৃথিবীতে বাস করতে শুরু করেছি যখন। কিছু একটা হয়ে গেল। চুরমার হয়ে গেল সব। ঘুমোতে ভুলে গেলাম। দিনরাত বসে বসে অপ্রকৃতস্থ’র মতো কান্নাকাটি ছাড়া করার কিছুই ছিল না। মা বোঝায়, বাবা বোঝাতে এসে চুপ করে দুরে দাঁড়িয়ে চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর কাঁদে। আমার একা থাকতে ইচ্ছে করেনা। আমার খুব দরকার হয় একটা একা মানুষ। একা থাকতে থাকতে যে ভীষণ ক্লান্ত। না চাইতেও পাওয়া একাকিত্বজনিত অসহ্য কষ্টের প্রতিটা ফোঁটা যে আলাদা করে ছোঁয়ার ক্ষমতা রাখে। আমার একটা ছোট্ট পৃথিবী প্রয়োজন ছিল, যেখানে মাথা রেখে আমি তীব্র কষ্টের অসহ্য একটা অতীত চিরতরে ভুলতে পারব। চিরতরে ধুয়ে মুছে দূরে ছুঁড়ে ফেলতে পারব, অনেকটা সময় আগে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো এক তীব্র ঝড়ে একটা ছোট্ট পৃথিবীর ভেঙ্গে যাওয়া চুর্ণ বিচুর্ণ টুকরোগুলো।
সুপ্তকে পাই আমি। আমার সুপ্ত। সাদাসিধে একজন মানুষ। আমি অসহায়ের মতোন আঁকড়ে ধরি তাকে। আমি একটা অতীত ভুলতে চাই। এই মানুষটি আমার অতীত ভুলিয়ে দেয় ভীষণ ভালোবাসে। এক বৎসরের সুখী বিবাহিত জীবন আমাদের জানো? এক বৎসর। আমি আবারো একটা ছোট্ট পৃথিবী পাই। আর বাস করতে শুরু করি। আর দ্বিতীয়বার ঝড় আসে বায়ান্ন দিন আগে। ওইদিন দুপুরে কাজ থেকে ফিরে আসে সুপ্ত, ঘর্মাক্ত গায়ে। লম্বাটে চেহারায় ওর ঝলসানো লাল আভা। ভীষণ রাগ ওর। আমি ভয়ে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। আমায় জিজ্ঞেস করল সে, ‘পরশ কে?’ আমি আঁতকে উঠি। কেউ যেন পুরনো একটা ক্ষতে নতুন করে আঁচড় কাটলো গো। অসহ্য! অনেক অনেকদিন পর আমার চোখে জল জমলো। সুপ্ত আমার ছলছলে চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘গোপন করেছিলে কেন? এতটুকুন বিশ্বাসও ছিল না?’
আমি কাঁদোমুখে কিছু একটা বলতে যেয়েও বলতে পারলাম না কিংবা সুপ্ত বলতে দিলোনা। সুপ্তের চোখে নিদারুণ কষ্ট জমা হয়ে থাকতে দেখেছি আমি। আমার হু হু করে কাঁদতে ইচ্ছা করল। কেন আমি বলিনি গো! এত কষ্ট আমার!
সুপ্ত যেভাবে এসেছিল হুড়মুড় করে, সেভাবে বের হয়ে যায় বাসা থেকে। ব্যাস! এখনও ফিরেনি। আজ বায়ান্ন দিন। সুপ্ত ফিরেছে বৈকি, ওর শরীরখানা। আমার সুপ্ত যে নেই তাতে। একফোঁটা কথা বলেনা। আজকাল বড্ড বেশি ঘুমোয়। যে সময়টা আমার সাথে কাটাতো, আমার সাথে কথা বলে, চিমটি কেটে, এক্কা দোক্কা খেলে, সামনাসামনি বসে, বারান্দায় কিংবা ছাদে… এখন সে ওই সময়গুলোতে নাকডেকে ঘুমোয়। কতরাত কাছে পাইনি আমি আমার সুপ্তকে। ও রাত, আমায় একটু শান্তি দাও গো। কতরাত হলো, বুকে মাথা গুজিয়েছি ওর। কতটাসময় কেটে গেল। সুপ্ত ঘুমোয় একপাশ ফিরে, আমি জেগে থাকি। ওইদিন কাঁদোমুখে গায়ে হাত দিতেই সরিয়ে দিলো ঝটকা মেরে। বলল, ঘুমোচ্ছি। ডিস্টার্ব যেন না করি। আমি করিনি। এখনও না।
আজ লিখতে ভীষণ ইচ্ছে হলো। ও রাত, সুপ্তকে বলে দিও তুমি। তীব্র ভালোবাসার মানুষটির কাছে কিছু অতীত গোপন রাখতে হয়। অসহ্য অতীত। এটা অপরাধ নয় গো। আমি তাকে চেয়েছি, একটা অসহ্য অতীত ভুলেছি। কখনো যেন সম্পর্কের মাঝখানে না এসে দাঁড়ায়, কবর দিয়ে এসেছি ওটা তাই। মৃত অতীত নিয়ে এমন করতে নেই, ও রাত। তুমি সুপ্তের কানে গিয়ে বলে দিও। আমি ভীষণ একা হয়ে পড়েছি। আমায় একটু জড়িয়ে ধরতে বোলো ওকে।” ‘সুপ্ত…’ চমকে উঠলাম আমি। কানের কাছে যেন কেউ খুব কোমল স্বরে ডাকলো। ডায়েরী বন্ধ করে ব্যাগের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখলাম। নয়ন কিংবা চক্ষু নামের লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মানুষ নিজেকে নিজে হিংসে করে কখন জানেন? আমি চুপ করে রইলাম। নয়ন অথবা চক্ষু বলল, ‘গল্পটা শেষ করি?’
আমি এইবার আগ্রহী হলাম খুব। গল্পের শেষ জরুরি। কোনো গল্পই অর্ধেক থাকতে নেই। গল্পের মাঝখানে আটকে থাকা বড্ড কষ্ট। যন্ত্রণাদায়ক। “দুই বৎসর কেটে গেল আমার। আমি পড়লাম আনন্দময় ঝামেলায়। মেয়েরা তো এসব টের পায়। তাই আমার ধারণা, আঁখি জানে, ভালো করেই জানে ওকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু ওর সকাল বিকাল সমুদ্র সমুদ্র করেই কাটে। ওটাও আমি। তারপরও কোনো এক অদ্ভুত কারণে আস্তে আস্তে আমার নিজের উপর নিজেরই হিংসে হতে শুরু করলো। আঁখির বাসায় সপ্তাহে দু’দিন পর পর বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে ততদিনে। আমি ঘাবড়ে যাই। যদিও আঁখি কঠিন মেয়ে, বাবা মাকে জানিয়ে দিয়েছে, পছন্দ আছে ওর। বাবা মা জিজ্ঞেস করে, কোন ছেলে? আঁখি কিছু বলেনা। শুধু বলে, সময় হোক। আমি এখনো প্রস্তুত নই।
আমায় এসে আঁখি এসব বলে। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কোন ছেলে? সমুদ্র?’ আঁখি হাসে। সর্বনাশ! হাসি দেখে স্পষ্ট হয়। আমার ধারণা সত্যি। বললাম, ‘তুই জানিস ছেলেটা দেখতে কেমন? বিবাহিত নাকি অবিবাহিত? কিছুই না জেনে ভালোবাসতে গেলি কেন?’ আঁখি হেসে বলে, ‘বিবাহিত হলে ডিভোর্স করিয়ে নেব, ডিভোর্স করাতে না পারলেও বিয়ে করবো। বুঝাব ওকে, ইসলাম ধর্মে চার বিয়ে পর্যন্ত জায়েজ আছে। হি হি। আমি লক্ষী বউ। আমার সতীন নিয়ে কোনো অভিযোগ, অনুরোধ, আগ্রহ কিছুই নাই। সমুদ্র হলেই হলো।’ আমি ঢোক গিলি আঁখির কথা শুনে। জিজ্ঞেস করি, ‘সমুদ্র কে কই পাবি? কেমনে পাবি?’ আঁখি চোখ বড় করে বলে, ‘তুই আছিস না, খুঁজে বের কর। কাল থেকে তোর কাজ হচ্ছে সমুদ্র খোঁজা।’ দুইদিন পরই দাঁত বের করে বললাম, ‘আমি সমুদ্র।’
প্রমাণের দরকার ছিল না। আঁখির কয়েক সেকেন্ড লাগল আমার কথা বুঝতে। তারপর সেটাই হলো, যেটা ভেবে ভেবে এতোদিন স্বীকার করিনি ব্যাপারটা। আঁখির চোখে রাগ। রাগের সাথে জল। চেহারা লাল হয়ে উঠল। আমি হাত ধরে রাখলাম ওর। ঝট করে হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললো, ‘একটা মেয়ের ইমোশন নিয়ে খেললি? তুই মানুষ? তুই জানতিনা সমুদ্র সমুদ্র করে আমি পাগল। দুইটা বৎসর পাগলামো দেখেছিস আমার, একবারও বলিসনি। বলবি কেন? বললে তো তোর সার্কাস দেখা বন্ধ হয়ে যাবে। তুই কী করে পারলি? একটা মেয়ের প্রেম, আবেগ, ভালোবাসা, ইমোশন নিয়ে দুই বৎসর ধরে মজা করলি! তুই সমুদ্র না, কখনো ছিলিও না। যদি হোসও, আমি মানবোনা। তোর কাজ কবিতার ছন্দ নিয়ে খেলা, কারোর হাত পেতে নেওয়া ইমোশন নিয়ে নয়।’ আঁখি ফুটপাত পার্শ্ববর্তী দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে মাথা নিচু করে দু’হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কাঁদতে লাগল। আমি সামনে যেয়ে বললাম, ‘আমি বলার চেষ্টা করেছি তো অনেকবার, তারপর ‘তুই যা আমার সামনে থেকে। চোখের সামনে পড়বিনা।’ আঁখি আমায় যেতে বলে নিজেই উল্টো দিকে হাঁটা দিলো। ব্যাস। শেষ। আমার ঘুম ভেঙে গেল।”
‘আপনি কি ফাইজলামি করেন?’ আমি গলা চড়ালাম। স্বপ্নকাহিনী বর্ণনা করছে বদমাইশটা এতক্ষণ। আমি ভেবেছি সত্য। সাজিয়ে গুছিয়ে একটা গল্প। স্বপ্নে পাওয়া গল্প। আমি জীবনেও খোয়াবনামা পড়িনি। স্বপ্নে কী দেখিলে কী হয়! লোকটার কেন আমাকে আস্ত খোয়াবনামা মনে হলো ভেবেই রাগ মাথায় চড়ল। আমার কাছে স্বপ্ন বর্ণনা করার কোনো মানে হয়! সম্ভবত খানিকটা যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম ইমোশনের সঙ্গে। এজন্য রাগ বাড়ছে। অনর্থক অবাস্তব গল্প। ‘ফাজলামো করছিনা। আমি ঘুমে ছিলাম। এই যে এখন জেগে আছি, অন্য কোথাও ঘুমে আছি।’ আমার কপালের ভাঁজ হওয়া পুরনো তিনটে রেখা ফেরত এলো। নয়ন কিংবা চক্ষুর দুইটা নয়ন খাবলা মেরে নিয়ে নিতে পারলে বিরক্তি কমতো বোধহয়। ‘আচ্ছা আমি বুঝিয়ে বলছি নয়ন কিংবা খক্ষু এখন আমায় বুঝাবেন। খোয়াবনামা বুঝাবেন। আমি কান পাতলাম। ‘রিয়েলিটি বলতে কিছু নেই ভাই। সব ভ্রম। সবগুলো স্তর ভ্রম। আপনাকে একটা বেছে নিতে হয়। আমি না জেনে বলছিনা, এইখানে অসংখ্য জগত। সব স্বপ্ন জগত। এক জগত থেকে আরেক জগতে যাওয়ার উপায়, ঘুম। আমি কেন ঘুমোচ্ছিনা আপনি বুঝতে পারছেন?
একবার ঘুমোলে এই স্বপ্নটা ভেঙ্গে যাবে আমার। এই স্বপ্ন আমি ভাঙ্গতে চাইনা। এই স্বপ্নজগতে আসতে অনেক সময় লেগেছে আমার। প্রচুর অপেক্ষা। স্তরে স্তরে প্রচুর ঘুম। আঁখি ওইদিন চলে যাওয়ার পর আমি সারারাত ঘুমাইনি। সকাল সকাল লালচে চোখ নিয়ে কলেজেও গিয়েছি। আঁখি কলেজে আসেনি। ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল এক সপ্তাহের মধ্যেই। আমি পাগলের মতো হয়ে যাই তারপর। সারারাত ঘুমোইনা। জেগে থাকি। সিগারেট গিলি। সারাদিন ঘুমোই। এক সন্ধ্যেয় ঘুম থেকে উঠে খেয়াল হলো, আমি ঠিক আগের জায়গাতে নেই। নতুন কোথাও চলে এসেছি ঘুমের ঘোরে। দেখি… এটা আমার পুরনো বাসা। বাসা পাল্টিয়েছি পাঁচ মাস আগে। আসহাবে কাহাফের ঘটনা জানেন তো? ওরা এক ঘুমে অনেক বৎসর সামনে চলে গিয়েছিল। আমি এক ঘুমেই পাঁচ মাস আগে চলে এসেছি, বুঝতে আমার পুরো একদিন সময় লাগল। আঁখির সাথে কথা হলো। আঁখি আমার অবস্থা দেখে অবাক হলো। জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে, কী হয়েছে তোর? এইরকম লাগছে কেন তোকে? জানিস, আজ সমুদ্র একটা ভীষণ সুন্দর কবিতা লিখেছে। শুনবি?’
আমি অবাক হয়ে আঁখির দিকে তাকাই। তারপরের রাতে ঘুমিয়ে সকালে উঠে টের পাই, এটা অন্য আরেকটা সময়। দশ পনেরো বৎসর পরবর্তী কোনো এক সময়। খোঁজ নিয়ে জানলাম আঁখির বিয়ে হয়ে গিয়েছে, বাচ্চাও আছে দু’টা। বাচ্চা একটা ক্লাস টুতে পড়ে। আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি এটা বুঝতে আমার সময় লেগেছে অনেক। তারপর আমি বারবার ঘুমিয়েছি। অনেক অনেকটা সময় পেছনের কোনো একটা স্বপ্নে যাওয়ার চেষ্টায়। এক বৎসর পাঁচ মাস পর তিন দিন হলো এই স্বপ্নটায় এসেছি। বাস করছি। এই স্বপ্নে এখনো আমি কবিতা লিখতে আরম্ভ করিনি সমুদ্র ছদ্মনামে। আঁখি আমার জন্য অপেক্ষা করছে সামনের স্টপেজে। আমায় ওর খুব কাছে থাকতে হবে। তারপর ভালোবাসি বলতে হবে। এই স্বপ্নটা ভাঙ্গা যাবেনা, এইজন্যই ঘুমোচ্ছিনা আমি। ঘুমোলে সব শেষ।’
আমি ঢোক গিললাম। এত সিরিয়াস মুখ নিয়ে মানুষ আজগুবি কথা বলতে পারে, জানা ছিল না। নয়ন কিংবা চোখ সাহেব মিথ্যে বলছেন না, এটা তার চোখজোড়া বলছে। কিন্তু এও সম্ভব! অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললাম, ‘আমি বিশ্বাস করলাম না আপনার স্বপ্ন, স্তর, সময়। তবে একটা ভয়ংকর তথ্য দিচ্ছি। একটা মানুষ না খেয়ে দু’সপ্তাহ পর্যন্ত বাঁচতে পারে৷ কিন্তু না ঘুমিয়ে এগার দিনের বেশি বাঁচতে পারেনা। আপনি তিন দিন টানা জেগে আছেন, আর মাত্র আটদিন বেঁচে থাকবেন, যদি চব্বিশঘন্টা এইরকম জোর করে জেগে থাকেন। ওই রিয়েলিটি কেন, যেটার স্থায়িত্ব মাত্র এগার দিন?’ নয়ন হাসলো। এই প্রথমবার মনে হলো লোকটির চোখদুটো অসম্ভব সুন্দর। মায়ায় টলটল! ওখানে সামান্য ছলছল করতে থাকা জল নিয়ে বলল, ‘এগারদিন আমার কাছে থাকবে আঁখি। এগার জনম আমার প্রয়োজন নেই।’
বাস থামলো। নয়ন নেমে গেল। আমি অনুভব করলাম পুরে বাসভর্তি শূন্যতা। বহু বৎসর এমন পাগল করা একা লাগেনি আমার। নয়নের ধারণা, মৃত মানুষের শুধুমাত্র স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায়, আর সব ঠিক থাকে। অন্য কোনো এক স্বপ্নে। ঘুম হচ্ছে দ্বিতীয় মৃত্যু। ঘুমন্ত মানুষ অন্য স্বপ্নে বিচরণ করে। চাইলে ওই স্বপ্নে বাসও করতে পারে। কেউ চায়না। কিংবা চাইতেই জানেনা। আমি কি চাই? শেষ যে বার তুলিকে দেখেছি, তুলির ঠোঁটে রক্ত ছিলো! আমি দেখতে চাইব না ওটা আর। অথচ চোখে ভাসছে আমার। গলায় ফাঁস দেওয়া শাড়িটা আমারই উপহার দেওয়া। ওর জন্মদিনে, বিয়ের তিন মাস পর। দোষটা আমারই ছিল। তুলি একা থাকতে ভয় পেত, আমিও পেতাম। একটা ভয়ানক বিচ্ছিরি সময়ে আমার সঙ্গী ছিলো ঘুম, আর ওর ছিলো নির্ঘুম রাত।
নয়নের গল্পটা বড্ড বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল আমার। সন্ধ্যে নামছে জানালার বাইরে। শোঁ শোঁ করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে। চোখ বুজলাম আমি। আহ! কতদিন পর দুই চোখের পাতা একে অপরকে আলিঙ্গন করল যেন পরম আবেগে। টুংটাং শব্দ শুনতে পেলাম আমি, চোখ খুললাম। কোথায় শব্দ? কোথায়! কোথায়! পাশে তুলি। আমার চোখে জল জমলো। ওর হাতের চুড়ির আওয়াজ। ঠিক তো! চুড়িই। আমি বিছানায় শুয়ে আছি একপাশ ফিরে। তুলি ওপাশে। পাশ ফিরলাম আমি। তুলি চোখ মুছছে কিছুক্ষণ পরপর। আহা তুলি! কাঁদছে আমার তুলি! চুড়ির টুংটাং আওয়াজ হচ্ছে এখনও। বালিশে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদা তুলির গায়ে হাত রাখলাম, চমকে উঠল তুলি। চটজলদি এই পাশ ফিরে আমার বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়লো, ওর চোখ ভর্তি জল। কি ভীষণ কান্না তার। গাল ভিজে জবুথবু। আমি কাঁপতে কাঁপতে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কয়দিন হয়েছে আমার বউটির সাথে কথা বলিনি আমি?’
‘একান্ন দিন।’ বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আস্তে আস্তে ফেললাম। অনেক বেশি দেরি হয়ে যায়নি। আহা! কাল একটা মেয়ে ভীষণ অভিমানে কেঁদে কেঁদে আর ডায়েরী লিখবেনা। কাল থেকে মেয়েটি একফোঁটা কষ্টও পাবেনা। আমি তুলির ঠোঁটে আঙ্গুল ছোঁয়ালাম। কাল এই মেয়েটির ঠোঁটের কোনায় রক্ত জমবে না। ঠোঁট জোড়া সামনে এগিয়ে গলায় চুমু এঁকে দিলাম আলতো। এই গলায় কাল একটি শাড়ির আঁচল শক্ত হয়ে বসবে না, দাগ হবেনা কালচে। আমি এই মানবীকে ভীষণ ভালোবাসব। এগার জনম না পাই, তাতে কী! এগারদিন বাসব। শিরায় শিরায় বয়ে যাব তুমুল, কথা দিচ্ছি.. এগারজন্মের সমস্ত ভালোবাসা একত্র করে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত