আমার বিবাহিত জীবনের তিন বছর পেরিয়ে গেল । যদিও আমরা বিয়ের প্রথম বছর ছিলাম সাবলেট বাসায়। দ্বিতীয় বছর আমরা সাবলেট ভাড়া দিয়েছি । আর তৃতীয় বছর আমরা নিজেদের মতো করে ছোট্ট একটা বাসায় উঠেছি।
আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই মধ্যবিত্ত পরিবারের খুব সাধারণ মানুষ । আমি ভাইবোন সকলের ছোট আর আমার স্বামী ভাইবোন সকলের বড়। বিয়ের পর আমাদের আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী সকলের মাঝে আমাদেরকে নিয়ে এমন সমালোচনার ঝড় উঠলো মনে হলো আমরা দুজন সেলিব্রিটি ।
কেউ বলছে মেয়েটাকে দেখেশুনে আরেকটু ভালো বিয়ে দিতে পারত । আবার কেউ বলছে ছেলেটার চেহারা ভালো কিন্তু একদম ছোট চাকরি করে। কিন্তু নিশি এমন ভাব করে মনে হয় ওর স্বামী বিশাল কিছু । আমরা দুজন ভালোই আছি। সাবলেট বাসায় দিন চলে যাচ্ছে । সামনে আমাদের প্রথম ম্যারেজ ডে, আমার স্বামী সুজনের সামান্য বেতন আবার ম্যারেজ ডেটাও পড়েছে মাসের শেষে । এদিকে মাসের শেষে থাকে হাতটান অবস্থা । কিন্তু আমি যেমনই থাকি না কেন, বাবার বাড়ির লোকজন কে দেখাতে হবে আমি খুব ভালো আছি। আজ আমার প্রথম ম্যারেজ ডে । বিয়ের পরই আমরা দুজন পরিকল্পনা করেছিলাম একটু অন্যরকম ম্যারেজ ডে পালন করব । আমাদেরকে ম্যারেজ ডে উপলক্ষে যারা উইশ করবে তাদের জন্য খুব ছোট ছোট হলেও উপহার দেব এবং আমাদের সামর্থ অনুযায়ী । আর অন্ততঃ একজনকে হলেও খুশি করব, তাই তো রাস্তার ধারে শুয়ে থাকা ফকিরটাকে বললাম আপনি এখন এই টাকার মধ্যে আমাদের কাছে কী চান ?সে ইশারায় বললো খাবার এবং আমরা দুজন সেটাই দিলাম ।
কিন্তু ঐ যে, পরিবারকে দেখাতে হবে । তাই খুব ছোট্ট একটা গোল কেক কিনে দোকানদার কে বললাম কেটে দুভাগ করে দিতে । আর হাফ লিটার মিনারেল ওয়াটার । দুজন আনন্দ করে খেয়ে নিলাম, কেকটা কিন্তু মজার ছিলো । এটাই ছিলো আমার প্রথম ম্যারেজ ডে । আমি আর আমার স্বামী সুজন , দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম সাবলেটে বাসায় অনেক বিড়ম্বনা এখন থেকে আমরা বাসা নিয়ে সাবলেট দেব । ঠিক তাই হলো । আমরা বাসা নিলাম এবং এক বয়স্ক ভদ্রলোককে সাবলেট দিলাম । ওনার বউ চাকুরি করে অন্য জায়গায়, তাই উনি থাকা খাওয়া বাবদ আমাদের টাকা দেয় আর আমাদের সঙ্গে থাকে । ভদ্রলোক ভীষণ ভালো, আমাকে খুব স্নেহ করেন । আমার দ্বিতীয় ম্যারেজ ডে ।
এ বছরও যারা উইশ করেছে তার জন্য উপহার কিনেছি । এবারও ঐ একই সিদ্ধান্ত অন্ততঃ একজন মানুষকে হলেও খুশি করব । দুজন রিক্সায় উঠলাম এবং রিক্সাওয়ালাকে বললাম আপনার কয়টা বাচ্চা ? উনি বললেন – একটা মেয়ে, এ বছর স্কুলে দিয়েছি । যাক পেয়ে গেছি , সামনেই মার্কেট । দুজন রিক্সা দাঁড় করিয়ে মার্কেটে ঢুকলাম এবং একটা ছোট্ট স্কুলব্যাগ কিনে রিক্সাওয়ালার হাতে দিয়ে বললাম – এটা আপনার মেয়ের জন্য । এমন আত্মতৃপ্তি আর নির্মল হাসি আমি কখনো দেখিনি । আবার মাসের শেষ হাতটান অবস্থা । আবার সেই লোকলজ্জার ভয় - অন্ততঃ একটা কেক তো চাই । অনেক দোকান ঘুরছি কিন্তু টাকা আর কেক ঠিক মেলানো গেল না । দু’জন দু’পিস পেস্ট্রি কেক কিনে খেলাম আর দুটো ছোট কোক। এখানেই আমার দ্বিতীয় ম্যারেজ ডে শেষ । আমার স্বামী সুজনের বেতন একটু বেড়েছে আমরা নিজেদের মতো একটা বাসা নিয়েছি । একটু একটু করে জিনিসপত্র কেনা হচ্ছে। একটু ফুল কিনে ঘর সাজানো, একটা ভালো পোস্টার দেয়ালে ঝুলানো, ছোট্ট একটা আয়না পেরেক দিয়ে দেয়ালে আটকানো – সবই হচ্ছে ।
এর মধ্যে আমাদের তৃতীয় ম্যারেজ ডে এটাতেও আমরা আর একটা নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছি – ছোট্ট একটা কেক কিনে কমলাপুর স্টেশনের কয়েকটা পথশিশুকে নিয়ে কেক কাটব এবং ওদের সাথে সময় কাটাব । আর আমি ফুটপাতের মার্কেট থেকে একখানা হাওয়াই মিঠাই কালারের গোল্ডেন পাড়ওয়ালা শাড়ি কিনে ফেলেছি । আর সুজনের তো লালের ওপর গোল্ডেন কাজের পাঞ্জাবি আছেই । আমরা দুজন যেখানেই যাই একটু ম্যাচিং করে ড্রেস করি । তাতেও কিন্তু সমালোচনার ঢল নেমেছে । আমরা কিন্তু সমালোচনাকে খুব ইতিবাচক ভাবেই গ্রহণ করছি। সবাই যখন সমালোচনা করে আমরা দুজন নিজেদেরকে সেলিব্রিটি মনে করি খুব ভালো লাগে । তৃতীয় ম্যারেজ ডে তে খুব সাধ হয়েছে আমরা দুজন একসঙ্গে একখানা ছবি তুলব এবং ছবিখানা স্টুডিও তে গিয়ে তুলব এবং বড় করে বাঁধাই করব । সেই ছবিখানাই থাকবে সামনের রুমের দেয়ালে ।
আমাদের ছোট্ট দুটো রুম । আসবাবপত্র বলতে কিছুই নেই এইজন্য বাসাটা খুব বড় মনে হয় । পাশের বাসার এক ভদ্রমহিলা এসে বললো কিছুই তো নেই বাসা ভাড়া দিতে পারবেন ? আমি হেসে দিয়ে বললাম ভাড়া না দিতে পারলে বাড়িওয়ালা আমাদের কে তাড়িয়ে দেবে । আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন ভদ্রমহিলা মুখ বাঁকা করে চলে গেল । আমার খারাপ লাগেনি কারণ আমি আছি তৃতীয় ম্যারেজ ডে নিয়ে । আজ আমার তৃতীয় ম্যারেজ ডে আমি সেই শাড়িটা পরেছি, খোঁপায় বেলিফুলের মালা জড়ানো, আর হাতভর্তি লাল কাঁচের চুড়ি । সুজনকে বললাম একটু আয়নাটা দাও তো কাছ থেকে নিজেকে দেখি । সুজন বললো, ধুর আয়না দিয়ে কী হবে ? আমার চোখ ই তো তোমার আয়না । ঠিক তাই তো তোমার চোখে আমার দেখা । আমরা যাচ্ছি ছবি তুলতে একটা কালার ল্যাব স্টুডিওতে । যেতে পথেই ডানপাশে ফটোভিশন কালার ল্যাব স্টুডিও । ওহ্ কী আনন্দ ! দুজন রিক্সা থেকে নেমে হাত ধরাধরি করে স্টুডিও তে ঢুকলাম । কী সুন্দর স্টুডিও সেন্ট্রাল এসি ! ওহ্ কী ঠান্ডা ! আমার সেকি আনন্দ ।
যে ছেলেটা ছবি তুলবে সে ভেতরে নিয়ে বসিয়ে আমাদেরকে তৈরি হতে বললো কিন্তু টাকার সাথে বনিবনা হলো না । তাতে কি আমরা দুজন সিদ্ধান্ত নিলাম আগামী বছর ছবি তুলবো । আবার হাত ধরাধরি করে রিক্সায় উঠছি হঠাৎ ফটোভিশনের ঐ ছেলেটা পেছন থেকে ডাকছে ভাইয়া আমার স্যার আপনাদের ডেকে পাঠিয়েছে । এবং আমরা গিয়ে ভদ্রলোককে বললাম আজ আমাদের তৃতীয় ম্যারেজ ডে তাই দুজন একখানা ছবি তুলতে চেয়েছিলাম । একটু টাকা কমিয়ে দিলে ছবি খানা তোলা হতো । ভদ্রলোক ফটোভিশনের মালিক বললেন, আজ যা পারেন তাই দিয়ে ছবি তুলুন যখন টাকা হবে তখন ছবি নিয়ে যাবেন । আর বাসার ঠিকানাটা দিয়ে যান ।
কতোদিন পেরিয়ে গিয়েছে আমরা ভুলে গিয়েছি ছবির কথা। আমরা আমাদের চতুর্থ ম্যারেজ ডের প্রস্তুতি নিচ্ছি । এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি – সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে চিড়িয়াখানায় যাবো। হঠাৎ একদিন দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ । কলিং বেলটা এখনও লাগাতে পারিনি । এটা কি সুজন সাহেবের বাসা ?
হ্যাঁ কিন্তু ফটোভিশন থেকে এটা পাঠিয়েছে আপনাদের জন্য । প্যাকেট খুলে আমি হতবাক! দেখলাম আমাদের দুজনের বাধাই করা বিশাল একখানা ছবি । আর ছোট্ট একটা খাম । সেই খামে আমাদের দেয়া সেই একশো টাকা আর একখানা চিঠি। চিঠি খানায় যা লেখা ছিলো আমি তার কিছু অংশ আপনাদের জন্য শেয়ার করলাম । ছবিখানা দীর্ঘদিন আমার ফটোভিশন স্টুডিও তে ঝুলানো ছিলো আমি আপনাদের জন্য অপেক্ষা করেছি কিন্তু আপনারা আর আসেন নাই। অনেক মানুষ আপনাদের ছবির মতো করে ছবি তুলেছে?? অনেকেই বলেছে আপনারা কি সেলিব্রিটি ? তবে হ্যাঁ আমি বলেছি, আমি সেটা জানি না তবে ওনারা আমার ফটোভিশনের সেলিব্রিটি । আপনাদের ছবিখানার পরিচয় অনেক মানুষ জানতে চেয়েছে । কিন্তু আমিই বা কতোটুকু জানি, যেটুকু জানা ছিলো তাই বলেছি । আরও অনেক মানুষ নিজের থেকে টাকা দিয়ে আপনাদের ছবিখানা পৌছে দিতে চেয়েছে কিন্তু আমি সেটা হতে দেইনি । এটা আমার পক্ষ থেকে আপনাদের চতুর্থ ম্যারেজ ডের উপহার ।
একদম শেষে উনি লিখেছেন জীবনে সুখী হতে হলে চাই আত্মবিশ্বাস, মানুষকে ভালোবাসা, সুন্দর মন, আর ভালো কাজ করে যাওয়া । আর আল্লাহ্ সব সময় ভালো কাজের উপহার দিয়ে থাকেন । জীবনের প্রতিটি দিনই ম্যারেজ ডে যদি উপভোগ করা যায় । আবার আসবেন খুশি হবো । সত্যিই সেদিন থেকে আমরা দুজন আর ম্যারেজ ডে নিয়ে ভাবনা নয়, লোকলজ্জার ভয় নয় একদম নিজেদের মতো করে আছি । দুজনের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, মানুষ কে ভালোবাসা, সুন্দর মন, আর ভালো কাজ করার চেষ্টা নিয়ে আছি । এবং আমরা খুব ভালো আছি । বলতে পারেন আমরা দুজন সত্যিই সেলিব্রিটি ।
গল্পের বিষয়:
গল্প