পরিবর্তন

পরিবর্তন
চিত্রার সাথে অনিম স্যারের ছবি দেখে খুব ঈর্ষা হলো আমার৷ রাগ হলো৷ তবুও আমি সমস্ত ব্যাপার এড়িয়ে গেলাম। কাল ফাংশনেও ঠিক এমন কাহিনী ঘটেছে৷ চিত্রা প্রায় পুরোটা সময় অনিম স্যারের সাথেই ছিল। কী অদ্ভুত ব্যাপার! মানুষ সময়ে সময়ে মানুষকে ভুলে যায়৷ দ্রুত নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলে। ছাই সেই অবস্থান তার মনের হোক, কিংবা তার দেহের৷ পাশের মানুষটা কেবল বদলে যায়। চিত্রা একটা সময় আমার পাশে ছিল। সময়ের বিবর্তন আর টাকা পয়সার আকর্ষণ তাকে আজ আমার পাশ থেকে টেনে নিয়ে গিয়েছে৷ অথবা আমি যা ভাবছি তা না’ও হতে পারে। এসব একান্তই আমার মনের ভাবনা।
চিত্রা খুবই চমৎকার একটা মেয়ে৷ স্যুট-কোট কিংবা জিন্স-টপস থেকেও তাকে শাড়িতে অসাধারণ লাগে৷ এই মেয়েটার চোখের কাজল জাদুর মতো! মোহ ধরায়৷ মাঝে মাঝে চুল ছেড়ে অফিস আসে। পরনে নীল শাড়ি৷ আমার যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। তাকে আশ্চর্যরকম সুন্দরী লাগে৷ আমি মুগ্ধ হই৷ আমার খুব ইচ্ছে হয় তাকে ধরে একটা বকা দেই। এতো সেজেগুজে অফিসে আসার কী দরকার? কিন্তু কেন জানি দিতে পারি না। অবশ্য তাকে বকা দেওয়ার অধিকারটুকুও আমার নেই৷ চিত্রা আমার কলিগ৷ বেশ মিশুক প্রকৃতির একটা মেয়ে। অল্প ক’দিনেই অফিসে আমাদের সকলের সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিলো। স্বভাবতই আমি একটু চাপা স্বভাবের৷ প্রথম প্রথম মানুষের সাথে মিশতে পারি না৷ কিন্তু একবার মিশতে পারলেই তার সাথে আমার ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়৷ আমার এই ব্যাপারটা অফিসের কেউই বুঝতে পারেনি৷ তাই তাদের সাথে আমার সম্পর্ক তেমন গভীর হয়নি। বিশেষ আলোচনাও হয় না৷ হাই-হ্যালো হয় কেবল। চিত্রা কীভাবে জানি ব্যাপারটা বুঝতে পারে। সে জন্যেই মেয়েটা যেন আগ বাড়িয়ে আমার সাথে কথা বলে।
-কী খবর? ভালো আছেন আপনি?
-আলহামদুলিল্লাহ! আপনি ভালো আছেন? চিত্রা হেসে জবাব দেয়,
-অবশ্যই ভালো আছি৷ আপনি কি কথা টথা কম বলেন নাকি? আমি মৃদু হেসে বলি,
-কম বলাই কি ভালো নয়?
-হ্যাঁ, তা ভালো। তবে মানুষের সাথে মেশাটাও কিন্তু জরুরি। আমি খানিকটা হাসি। কিছু বলি না৷ চিত্রা বলে,
-লাঞ্চ কি সাথে করে নিয়ে আনেন?
-নাহ! উপরের তলায় রেস্টুরেন্ট আছে। ওখানে সেরে নেই৷
-বেশ তো! আপনার সাথে লাঞ্চ করা যাবে৷ কি যাবে না? নাকি ভাবী রাগ করবে?
আমি হাসি দিয়ে বলি,
-রাগ করার মতো ভাবীটা থাকলে সাথে করে লাঞ্চবক্স নিয়ে আসতে হতো। উপরের তলায় গিয়ে খেতে হতো না।
-বাহ!
বেশ কথা জানেন তো আপনি৷ ভালো লাগলো৷ মনে রাখবেন, আমরা এক সাথে লাঞ্চ করবো৷ কেমন?
আমি মৃদু হাসি। মেয়েটা নিজের ডেক্সে ফিরে যায়। চিত্রা কথা বলায় পটু৷ মানুষকে চট করেই পটিয়ে ফেলতে জানে। মানুষের সাথে মিশতে জানে৷ মেয়েদের প্রতি পুরুষদের মনে একটা সফট কর্ণার থাকে৷ তাই পুরুষেরা চাইলেও মেয়েদের সব আবদার ফেলতে পারে না৷ আমিও পারিনি। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি আর চিত্রা এক সাথেই লাঞ্চ করেছি। ব্যাপারটা কারোই দৃষ্টি এড়ায়নি৷ নানান কানাঘুষাও শুরু হয়ে যায় অফিসে৷ এসবে আমার ভাবান্তর নেই৷ সে আমার অফিসের কলিগ, তার সাথে আমি মিশতেই পারি। এখানে মানুষের এতো ভাবার কী আছে? চিত্রাকেও তেমন ভাবতে দেখিনি আমি৷ সে স্বাভাবিকই থাকে৷
অফিসের বাইরেও আমরাদের আড্ডা জমে যায়। চিত্রা মেয়েটাই এমন। খুব সহজে মানুষকে আপন করে নেয়৷ সে আমাকে আপন করে নিয়েছে৷ আমরা খুব ভালো বন্ধ হয়ে যাই৷ অনেক ঘুরি। এদিক সেদিক যাই। একা একা বসে গল্প করি। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমাদের গল্প গুলো মধ্যবিত্ত ধরনের। নানান ব্যাথা বেদনার মধ্যে একটু খানি আনন্দ খুঁজে সেই আনন্দকে বিশালতা দান করে খুব উপভোগ করার গল্প। আমরা দু’জন দু’জনকে খুব বুঝি৷ দু’জনের ঝুটঝামেলা ঠিক একই। একই জায়গায় ঠেকে গিয়েছে আমাদের কপাল৷ ধীরে ধীরে চিত্রা মেয়েটা যেন আমার গভীরে চলে যায়। আমার অন্তরের ভেতরে তার ছায়া বিস্তার লাভ করে। চিত্রা বেশ আত্মবিশ্বাসী মেয়ে এবং খুব জেদি প্রকৃতির। যা বলবে তা করবে এমন টাইপ। তার আত্মবিশ্বাসটা আমার ভালো লাগলেও অতিরিক্ত জেদটা আমার ভালো লাগে না তেমন৷ একদিন অফিস শেষে চিত্রা বলল বসুন্ধরায় যাবে৷ তার কিছু শপিং করতে হবে। আমার ওই সময়ে বসুন্ধরায় যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই ছিল না। প্রথম কথা হচ্ছে সারাদিন অফিস করে আমি ক্লান্ত। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে সেদিন বাংলাদেশের খেলা ছিল৷ বাংলাদেশি মানুষ হয়ে কীভাবে আমি সেই ম্যাচ মিস করি? আমি বললাম,
-তুমি যাও। আমি যাবো না। চিত্রা ভ্রু কুচকে তাকালো। বলল,
-যাবে না কেন?
-ক্লান্ত লাগছে৷ চিত্রা কিছু বলল না৷ চট করেই সামনের দিকে হেঁটে চলে গেল। আমি পেছন থেকে বললাম,
-রাগ করলে নাকি? চিত্রা পেছন না ফিরেই বলল,
-আমি রাগ করলে তোমার কী? চিত্রা তখন পার্কিং লট পেরিয়ে গিয়েছে৷ আমি দৌড়ে তার কাছে গেলাম। বললাম,
-তুমি সত্যিই রাগ করেছো? চিত্রা জবাব দেয় না৷ গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রিক্সার অপেক্ষা করে। আমি বলি,
-আচ্ছা চলো! বসুন্ধরায় যাই।
-নাহ৷ তোমাকে যেতে হবে না। আমি একাই যাবো।
-আহা! এমন করছো কেন? যাই না? চিত্রা বলে,
-একবার বলেছি যাওয়া লাগবে না মানে যাওয়া লাগবে না৷ ব্যস৷
-আশ্চর্য! তুমি এতো রেগে যাচ্ছো কেন? চিত্রা আমার প্রশ্নটার উত্তর দেয় না৷ একটা রিক্সা পেয়ে গেলে সেখানে উঠে বসে। তারপর আমার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
-আগামী দুই দিন তুমি আমার সাথে কথা বলবে না৷ কোনো ভাবেই কথা বলার চেষ্টা করবে না৷
আমি সেখানে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি৷ মাথায় কেবল চিত্রার কথা গুলোই ঘুরতে থাকে৷ চিত্রা ঠিকই আমার সাথে দু’দিন কথা বলেনি৷ আমি বেশ কয়েকবার তার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম। মেয়েটা আমার দিকে এমন ভাবে তাকালো যে আমি ভয় পেয়ে গেলাম৷ সিনক্রিয়েট না হয়ে যায় সেটা ভেবে আর কিছু বলিনি৷ কিন্তু এই দুটো দিন কিছু ক্ষেত্রে আমাকে বেশ হেল্প করেছে৷ আমাকে চিত্রার অবর্তমান বুঝিয়েছে৷ চিত্রার শূন্যতাকে অনুভব করিয়েছে৷ চিত্রাকে নিয়ে যে আমার মনের ভেতর অন্য রকম কিছু একটা আছে সেটা জানিয়েছে৷ অথচ এসবের কিছুই পূর্বে আমার জানা ছিল না৷
প্রথম দিন অফিস গিয়ে তেমন কিছু অনুভব হয়নি আমার৷ কেবল মনটা খানিক খারাপ হয়েছে৷ চিত্রার আচরণ খুব ব্যাথা দিয়েছে। এই যা। তবে পরেরদিন রাতের বেলায় চিত্রাকে নিয়ে অনেকটা ভাবি আমি। সেই ভাবনটা অজান্তেই আমার মনে বাসা বেঁধেছিল৷ সন্ধ্যার সময় তখন৷ আমি সাধারণত ওই সময়ে চা খাই৷ চা নিয়ে যখন বারান্দায় বসি তখনই কেন জানি হঠাৎ চিত্রার চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠে৷ মেয়েটার চোখ, তার মুগ্ধ করা হাসি, হাত নাড়িয়ে কথা বলা, সবটাই যেন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে৷ ঠিক সেই মূহুর্তে আমার অন্য রকম একটা অনুভূতি হয়৷ কেমন জানি একটা টান অনুভব করি বুকের ভেতর। আচমকা আমি চিত্রাকে ভীষণ মিস করতে শুরু করি৷ আমার মন হঠাৎই কেমন কেঁদে উঠে। ইচ্ছে হয় তার সাথে কথা বলি৷ এখনই কথা বলি৷
ঠিক সেই সময়ে আমি কিছু না ভেবে চিত্রাকে ফোন দেই৷ সে ফোন ধরে না৷ অনেক বার দিলেও ফোন ধরে না৷ আমার কেমন জানি খারাপ লাগে৷ ভীষণ মন খারাপ হয়৷ আমি লাইট অফ করে নিজের রুমে বসে থাকি। সারারাত ঘুম হয় না আমার। মনের ভেতরে কেমন জানি করতে থাকে৷ অদ্ভুত এক কাঁপন হয়৷ শূন্য শূন্য লাগে৷ বারবার চিত্রার কথা মনে পড়ে যায়। মৃদুমন্দ ব্যাথা হয়৷ আমি অপেক্ষা করি। কখন ভোর হবে৷ আমি অফিস যাবো। চিত্রার সাথে কথা বলবো৷ তাকে জানাবো, একটি রাত, একটি মুহুর্ত, হঠাৎ আমার ভেতরটা নাড়িয়ে দিয়েছে। আমাকে বুঝিয়েছে, যে চিত্রার সাথে আমি এই মাস তিনেক মিশেছি সেই চিত্রা আজ আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে৷ অভ্যস্ত একজন মানুষের হঠাৎ একটা অভ্যাস ছুটে গেলে সে যেমন দিশেহারা হয়ে যায় আমিও ঠিক তেমন দিশেহারা হয়ে যাই। আমার পাগল পাগল লাগে৷ চিত্রাকে খুব মিস করতে থাকি৷
পরেরদিন অফিস গিয়্র দেখি চিত্রা নেই৷ আসেনি৷ আমি তার আসার অপেক্ষা করি৷ সেই অপেক্ষায় বেলা হয়৷ চিত্রা আসে না৷ আমি তার খোঁজ নেই৷ পিয়ন চাচা জানায় চিত্রা নাকি ছুটিয়ে নিয়েছে তিন দিনের জন্যে৷ আমার মাথায় বাড়ি পড়ে যেন! তিন দিন! তিন দিন আসবে না মেয়েটি? আমার মাথা হ্যাং হয়ে যায়। কাজে মন বসে না যেন৷ মনের ভেতর অদ্ভুত এক কম্পন অনুভব হয়৷ সেই কম্পন আমার খুব করে জানিয়ে দেয়, ‘চিত্রা আমার জন্যে স্পেশাল। ভীষণ স্পেশাল।’ পুরোটা দিন আমার মন মরা হয়ে কাটে৷ কেমন অস্থির হাসফাস লাগে৷ দম বন্ধ লাগে৷ চারদিক যেন ভীষণ শূন্য৷ কোথাও কেউ নেই। কেউ নেই৷
আপনি স্বাভাবিক এক নিয়মে চলছেন৷ সেই নিয়মে অভ্যস্ত আপনি। এখন চট করেই নিয়মে ভিন্নতা আসলে আপনার মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে৷ আপনি ঠিক নিতে পারবেন না। চিত্রা আমার নিয়ম ছিল। আমার তিন মাসের নিয়ম৷ হঠাৎ সেই নিয়ম বিগড়ে যাওয়ায় আমি কেমন জানি হয়ে যাই৷ ঠিক ব্যাপারটা যেন নিতে পারি না। অন্য রকম লাগে নিজের কাছে৷ চোখের সামনে কেবল চিত্রা ভাসে৷ চিত্রার হাসি মাখা মুখটা ভাসে। তৃতীয় দিন রাতে চিত্রার ফোন আসে। ফোন পেয়ে আমি ভীষণ খুশি হই৷ এতো খুশি হই যা বলার মতো না৷ ফোন হাতে নিয়ে রিসিভ করতে গেলেই কেমন যেন আঁটকে যাই৷ মন জানায়, মেয়েটার তিনদিন পর আজ কেন মনে পড়লো? এতো দিন কেন মনে পড়েনি? তার মনে কি আমার জন্যে অনুভূতি নেই? একটু নেই? কীভাবে এতো পাষাণ হতে পারল মেয়েটি? অভিমানে আমার হাতের আঙ্গুল আগায় না৷ ফোন রেখে দেই৷ রিসিভ করি না৷ মেয়েটাও জেদি! পাগলি টাইপ। লাগাতার ফোন দিতেই থাকে। যেন পন করেছে, আজ কল রিসিভ করিয়েই ছাড়বে৷ আমি কল রিসিভ করি৷ ওপাশ থেকে চিত্রার চিৎকার ভেসে আসে,
-এ্যাই? এ্যাই ছেলে? ফোন ধরিস না কেন হু? কী হয়েছে? কী সমস্যা?
আমি চুপ করে থাকি। কিছুই বলি না৷ চিত্রা চিৎকার করে,
-এ্যাই? এ্যাই সাদিক? শুনো না?
-শুনি।
-জবাব দাও না কেন?
-কী জবাব দিবো?
-মানে? জবাব দেওয়ার মতো কিছুই নেই? এই যে এতো ফোন দিলাম! ধরোনি কেন বলো?
-ইচ্ছে করেই ধরিনি। তুমি অফিস থেকে ছুটি নিলে আমাকে একবার বললেও না? একবার বললে কী হতো?
-তখন তোমার উপর রেগে ছিলাম আমি।
-আমিও তোমার উপর রেগে আছি৷
-সেকি? কেন?
-এই যে, না জানিয়ে হাওয়া হয়ে গেলে!
-খুব মিস করছো?
-নাহ৷
-এতো অভিমান?
-অভিমান টবিমান নেই আমার!
-হুহ! আমি বেশ বুঝি৷ আচ্ছা শুনো। আমি কিছু বলি না৷ চুপ থাকি। চিত্রা বলে,
-শুনো না?
-বলো। চিত্রা খানিকটা চুপ থাকে৷ তারপর বলে,
-আমিও তোমায় মিস করেছি বুঝলে! খুব মিস করেছি৷
শেষের এই কথাটাটুকু যেন আমার এতোদিনের ক্লান্তি, গ্লানি, বেদনা সমস্ত ধুয়ে মুছে ফেলেছে। হঠাৎই আমার মনের মাঝে অদ্ভুত এক প্রশান্তির সৃষ্টি করেছে। আমার এতো ভালো লাগলো যা আমি বলে বোঝাতে পারবো না৷ সেদিন, সেই রাত আমাদের অনেক কথা হয়৷ এ’কদিনের জমা হওয়া সব কথা যেন আমরা একে একে বলতে শুরু করি। সে জানায়, সে ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়ি গিয়েছে। রেগে ছিল বলেই আমাকে জানিয়ে যায়নি৷ আমি কিছুই বলি না আর৷ রাগ-অভিমান সব কোথায় যেন মিইয়ে যায়৷ হারিয়ে যায়৷ আমাদের এক সাথে চলে আবার শুরু হয়। নিত্য নিয়ম আবার ফিরে আসে। আমার প্রাণে অদ্ভুত প্রাশান্তি মিলে। অদ্ভুত প্রশান্তি। আমি তখন থেকে সুযোগ বুঝে তাকে প্রপোজ করার অপেক্ষা করি৷ উপযুক্ত দিন-সময় খুঁজি।
চেহারা সুন্দর, কথাবার্তা গুছিয়ে বলে, আধুনিক, এই ধরনের মেয়েদের সকলেই পছন্দ করে। এরা সকলের নজর কাড়ে দ্রুত৷ চিত্রা মেয়েটি ঠিক তেমন ছিল। আধুনিক, কথা বলায় পটু ধরনের। এই কারণে হয়তো এমডি স্যারের দৃষ্টি পড়ে তার উপর। ভদ্রলোকের ভালো লেগে যায় ওকে৷ আমাকে এইবার ডেকে নিয়ে নানান প্রশ্ন করলের চিত্রা সম্পর্কে। আড়াল করে বললেন, তার বড় পুত্র অনিমের জন্যে মেয়েটি কেমন হবে? আমি আমার বুকের একগাদা ব্যাথা চাপা দিয়ে, এক গাক হেসে স্যারকে আশ্বস্ত করি, মেয়েটি অধিক ভালো। এই মেয়েকে আপনার পুত্রবধূ হিসেবে বেশ মানাবে। স্যার মহা খুশি৷ যতো ব্যাথা এসে লুকায় আমার বুকে। পরের ক’দিন আচমকা চিত্রা ব্যস্ত হয়ে যায়৷ এমডি স্যারের রুম আর তার ডেক্স এই দুটোতেই তার সময় কাটে বেশি৷ আমাকে যেন সে চিনেই না৷ একদম ভুলে গিয়েছে৷ আচমকা তার দৃষ্টি আমার দিকে পড়লে সে মৃদু হেসে বলে,
-খবর কি সাদিক? ভালো আছো তো? তার স্বর কেমন অচেনা হয়ে যায়৷ গম্ভীর কিংবা আদেশ আদেশ ভাব! যেন অফিসের বড় কোনো কর্তি। আমি যতোটা না ব্যাথা পাই তার থেকে বেশি অবাক হই৷ মেয়েটি কতো দ্রুত কী পরিবর্তন হয়ে গেল! আজকাল তাকে দেখলে একদম অচেনা লাগে৷ যেন এই প্রথমবার দেখছি৷ অবাক হই তার সাজগোছ দেখলে। নিত্য শাড়ি পরে আসে। খোলা চুলে তার অনিন্দ্য রূপ দেখায়৷ এমডি স্যারের ছেলে অনিম একবার অফিসে এলে চিত্রা লজ্জায় লাল হয়ে যায়৷ সারাটাক্ষন এমডি স্যারের পেছন পেছন থাকে। তারপর অনিম স্যার আর চিত্রা দু’জনে মিলে কোথাও বের হয়৷ বাইরে কোথাও নাকি তাদের লাঞ্চের ব্যবস্থা রয়েছে৷ আমি অবাক হই৷ কষ্ট পাই৷ চোখে জল জমতে চায়৷ অথচ পুরুষ বলে সেই জল বাইরে আসতে পারে না৷ ব্যাথা গিলে নিতে হয়৷ ব্যাথা গিললেই জল আসার সম্ভাবনা কম থাকে।
কাল অফিসিয়াল একটা ফাংশন হয় একটা রিসোর্টে। সেখানে নানান বিশেষনের মাধ্যমে ঘোষণা হয়, অনিম চিত্রার বিয়ের কথা। চারদিকে হৈ-হুল্লোড় পড়ে যায়৷ অফিস কলিগরা অবাক হয়৷ কেউ আমার কাঁধে হাত রেখে ভরশা দেয়৷ কেউ দূরে দাঁড়িয়ে টিটকারি করে। কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না৷ যেন তারা জানতই এমন হবে।
ফেসবুক চালানোটাও বেশ কষ্টকর হয়ে গেল। চিত্রার আর অনিম স্যারের ছবিটি আবার আমার সামনে আসে। আমি এড়িয়ে যাই৷ ছবিটি নিউজফিডে বারবার ফিরে আসায় বিরক্ত হই আমি। অফিসের সবাইই তাদের শুভেচ্ছা-শুভ কামনা জানাচ্ছে৷ এসব ভালো লাগে না আমার৷ অসহ্য যন্ত্রণা আমার বুকের ভেতরে ঝড় তোলে। ঈর্ষা হয়। রাগ হয়। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হয়৷ অথচ আমি কাঁদি না। পুরুষ মানুষদের কাঁদতে হয় না৷ শক্ত পাথরের মতো কেবল সয়ে যেতে হয়। আমি ফোনটা বন্ধ করে রুম অন্ধকার করে বসে থাকি। অন্ধকার রুমের একাকী গল্পটা কেউ জানে না৷ কেউ না। আজ একই আকাশের নিচে ভিন্ন স্থানে দু’জনের কাছের মানুষের একজন ভীষণ হাসছে, অন্যজন কাঁদছে৷ অথচ যিনি হাসছেন তিনি জানেনই না এপাশের মানুষটা খুব কাঁদছে। তার জন্যে কাঁদছে। কিংবা হয়তো সে জানে। এখন ভান করছে কেবল। না জানার ভান৷ এই পৃথিবীটা অদ্ভুত। এরচে বেশি অদ্ভুত এর মানুষ গুলো।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত