ব্রেক জার্নি

ব্রেক জার্নি
আমার বিয়ে হয়েছে মাত্র তিন মাস , আমি ঢাকাতে একরুমের একটা সাবলেট বাসায় থাকি। একটা রুম, সাথে বাথরুম ও ছোট্টো একটা বারান্দা । আর রান্নাঘরটা ভাগাভাগি করে চলে । ফ্লোরে একটা পাতলা তোশকের বিছানা , দুটো বালিশ , দুখানা প্লেট, দুটো বাটি দুটো গ্লাস, সবই দু-একটা করে, তাতে কোনো সমস্যা নেই । কারণ, আমি বেশি কাজকর্ম করতে পারি না তাই যা আছে তাতেই যথেষ্ট । কোনোরকম ডালভাত রান্না করি , কখনও আইসক্রিম, কখনও বার্গার, আবার কখনও প্যাকেট বিরিয়ানি খেয়ে দিন চলে যায় । দুজনের গায়েই এখনও ছাত্রজীবনের গন্ধ লেগে আছে । আর যাই হোক রোমাঞ্চ আছে প্রচুর ।
তিনমাস পর বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাবো । বাবার বাড়িতে গিয়ে দেখাতে হবে আমি খুব ভালো আছি । এটা শুধু আমি না, প্রায় সব মেয়েই চায় বাবার বাড়ির লোক জানুক মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে খুব ভালো আছে । এটা অনেকটা নিজে ভালো থাকার জন্য, এবং সবাইকে ভালো রাখার জন্য । বিয়ের সময়ের সব জিনিস সবাই দেখে ফেলেছে । তিন মাস পর আবার সেই ব্যাগ, সেই জুতো, এসব তো পুরাতন লাগছে । সবাই ভাববে এগুলো তো বিয়ের সময়ের জিনিস । তিন মাসের মধ্যে আর কিচ্ছু কিনতে পারে নাই ? তাহলে তো ওর হাজব্যান্ডের বেতন একদম কম । এসব ভেবেচিন্তে দেখলাম, যদি কমদামিও হয় আমার নতুন কিছু কিনতে হবে । দুজন মিলে চলে গেলাম নিউমার্কেট । গিয়ে ঝকমকা একজোড়া স্যান্ডেল, সেই সাথে ঝাকানাকা একটা ভ্যানিটি ব্যাগ কিনে ফেললাম । ওহ্ কী শান্তি ! রিকশায় বসে দুজন দুটো আইসক্রিম খেতে খেতে আমার সাবলেট বাসায় ।
আজ শুক্রবার বাবার বাড়িতে যাবো । বনফুল থেকে মিষ্টি কিনে নিয়ে এসেছি । আমার হাজব্যান্ড খুব একটা খুশি না, ওনার একটু লজ্জা-লজ্জা লাগছে । ছেলেরা অবশ্য শ্বশুরবাড়ি যেতে একটু লজ্জাই পায় । রেডি হতে দেরি করে । ওরা সব সময় নিজের বাড়িতে যেতে গেলে দারুণ খুশি – তিন লাফে রেডি । আমার হাজব্যান্ড নিরব ও তার ব্যতিক্রম নয় । কি কষ্ট করে হাসছে ! মনে হচ্ছে শীতকাল । হাসতে গেলে ঠোঁট ফেটে যাবে । আমাদের যাত্রা শুরু গাবতলী থেকে । বাসে উঠেছি । আমার বাড়ি পদ্মা পার হলেই । বলতে পারেন পদ্মাপাড়ের মেয়ে আমি ।
আরিচা ঘাটে এসে লঞ্চে খুব ভিড় – ধাক্কাধাক্কি করে, ছোটোখাটো যুদ্ধশেষে লঞ্চে উঠলাম । ব্যাগের ঝামেলা নিরবের কাছে । কিন্তু লঞ্চে উঠতে গিয়েই আমার পা থেকে একটা স্যান্ডেল খুলে পানিতে পড়ে উধাও । স্যান্ডেল আর কানের দুল একটা হারিয়ে গেলে আর একটা মূল্যহীন । অগত্যা আর একটা স্যান্ডেলও আমি ভাসিয়ে দিলাম । দুই দিনের সফর তাই এক জোড়া স্যান্ডেল যথেষ্ট ছিলো । আমার এত সাধের ঝকমকা স্যান্ডেল ভেসে গেল চোখের সামনে । তবে লঞ্চে উঠেই দারুণ এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা – আমি এতটাই মুগ্ধ আমার হাজব্যান্ড ও স্যান্ডেল দুটোই ভুলে গিয়েছি । ভদ্রলোক বেশ পরিচ্ছন্ন পোশাক পরা । সুন্দর গুছিয়ে কথা বলছে । দেখতেও সুন্দর । সাক্ষাতেই উনি আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দিলেন আমি কোনো কিছু না ভেবেই বললাম আমার একটা স্যান্ডেল পানিতে পড়ে গেছে তাই আরেকটা রেখে কী হবে ? ওটাও ভাসিয়ে দিয়েছি । ঘটনাটা শুনে ভদ্রলোক চুপচাপ হালকা মাথা ঝাকালেন । লঞ্চে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দুজনেই পদ্মার পানির উথালপাথাল ঢেউ দেখছি । ওনাকে বেশ শুচিবাই টাইপের মনে হচ্ছে । লোকজন দেখলে এমন ভাব করছে, মনে হচ্ছে মঙ্গল গ্রহ থেকে এসেছে ।
এবার ওনার এক বন্ধুর সাথে ওনার গল্প শুরু হলো। দোস্ত চাকুরি না করে দেশে গিয়ে কি করছিস ? তার বন্ধুটা মনে হলো একটু গম্ভীর প্রকৃতির । সে সহাস্যে বললো গ্রামে একটা কারিগরি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছি । অনেক ছাত্রছাত্রী । ভালোই আছি । কিন্তু আমার সহযাত্রী ভদ্রলোক খুব সুন্দর করে বলছে আমিও আছি রাজার হালে । একটা চাকরি করি মাঝেমাঝে ট্যুরে যাই। হোটেলে থাকি অফিস খরচ দেয় । হোটেলের ছেলেগুলো আমি রুমে ঢুকলেই নতুন সাদা চাদর পেতে দেয় । জগভর্তি পানি, গ্লাস – সব রেডি করে দেয় । দুদিন থাকি । চারশো টাকা বিল হয় । আমি কাগজটা অফিসে জমা দেই । অফিস টাকা দিয়ে দেয় । আমি খুব মনোযোগ দিয়ে গল্পগুলো শুনছি । ভদ্রলোক এত প্রশান্তি নিয়ে গল্প করছে – আমার ভীষণ ভালো লাগছে । সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার আমি যে খালিপায়ে – এটা ভুলে গেছি। আর এক ফাঁকে দেখলাম নিরব আমার উপর রেগে সানগ্লাস চোখে খুব ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে দেখছে । আমি দারুণ মজা পাচ্ছি ।
একদিকে ঐ ভদ্রলোক, অন্যদিকে আমার হাজব্যান্ড । যদিও আমার হাজব্যান্ড দারুণ হ্যান্ডসাম । একদম তরুণ, তবুও এই মুহূর্তে আমি তাকে নিতে পারছি না । কারণ আমি এখন ভদ্রলোকের ব্যাপারে আগ্রহী । ভদ্রলোকের বন্ধু জিজ্ঞেস করলো তোর বাসা ভাড়া কতো ? ভদ্রলোক বললো বাসা নয় একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছি আমার তো চোখ কপালে যেখানে আমি থাকি সাবলেট উনি পুরো একটা বাড়ি ?! আহা কী শান্তি ! টিনশেডের দুই রুমের একটা ঘর, একটা বাথরুম আর একটা রান্নাঘর সাড়ে তিন হাজার টাকা ভাড়া । সামনে একটু জায়গা আছে । আমার মেয়ে টা ওখানে খেলাধুলা করে । আমি খুব ভালো আছি । বউকে প্রত্যেক রোজার ইদে আড়াই হাজার টাকার একটা দামি শাড়ি দেই । বউ খুব খুশি হয়। তখন আমি মনে মনে ভাবছি আমার সাবলেট রুমটার ভাড়াও সাড়ে তিন হাজার টাকা, আবার ভদ্রলোকের বাড়িটার ভাড়াও সাড়ে তিন হাজার টাকা !
লঞ্চ প্রায় ঘাটে চলে এসেছে অবশেষ ভদ্রলোকের বন্ধু জিজ্ঞেস করলো দোস্ত তোর বেতন কতো ? ভদ্রলোক খুব সুন্দর করে বললো তের হাজার টাকা । আমার চাকরি টা খুব ভালো আমি আছি রাজার হালে । আমি না খুব করে ভাবছি । এরই মধ্যে লঞ্চঘাটে হঠাৎ একজনের বড় লাগেজ ব্যাগের সাথে আমার ঝাকানাকা ভ্যানিটি ব্যাগের একটা হ্যান্ডেল বেধে কোথায় চলে গেল । আমি দেখলাম আমার ব্যাগের একটা হ্যান্ডেল সেই সাথে ব্যাগও খানিকটা ছিঁড়ে যা তা অবস্থা । অবশেষে ব্যাগের ভেতরের সামান্য জিনিস গুলো পার্স ব্যাগে ঢুকিয়ে ব্যাগও পদ্মার জলে ভাসিয়ে দিলাম । তারপর দেখলাম ভদ্রলোক আমার জন্য অপেক্ষা করছে সে এই ঘটনা দেখেছে আবার সেই মুচকি হাসি । বিদায়ের সময় আস্তে করে বলে গেল সুখী হতে অনেক কিছু লাগে না শুধু সবকিছুতে খুশি থাকতে হয় ।
তারপর হাত উঁচিয়ে উনি আমাকে বিদায় জানালো আমিও আস্তে করে হাত উঁচিয়ে বিদায় জানালাম । এর মধ্যে আমার হাজবেন্ড তো রেগে আগুন । ছেলেরা রাস্তাঘাটে, ট্রেনে হরদম মহিলা-পুরুষের সাথে গল্প করছে সমস্যা নেই । কিন্তু মেয়েরা যদি কারও সাথে কোথাও গল্প করে বিষয়টা মানতেই পারে না ! এটা এক ধরণের স্বভাব, কিছুটা স্বেচ্ছাচারী স্বভাব । যাই হোক আমরা বাবার বাড়িতে পৌঁছে গেলাম সবাই আমার খালি পা, ভ্যানিটি ব্যাগ নেই মনে মনে ভেবে মরছে । এদিকে নিরব গম্ভীর সবাই চিন্তিত – কী হলো দুটোর ? খাওয়াদাওয়া শেষে নিরব আমার ভাই ও বাবাকে বললো আপনারা সবাই আসুন কথা আছে । আমি তো হতবাক । কী কথা ?
শুনুন, আপনার মেয়ের বিয়ের আগে একটা প্রেম ছিলো লঞ্চের মধ্যে তার সাথে দেখা । শুনুন কী করেছে ? আমার বাবা খুব সুন্দর করে বললো, বিয়ের আগে তো তোমার সাথেই প্রেম ছিলো যে কারণে মেয়েটাকে দেখেশুনে বিয়ে দিতে পারলাম না। আর তুমি বা কেমন পুরুষ মানুষ যে মেয়ের একটা প্রেম ছিলো, আবার সেই মেয়ের সাথে প্রেম করেছিলে?? তারপর বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলো লন্ঞ্চের ভেতরের লোকটা কে ? আমি বললাম বাবা উনি কেউ নন । তবে মাত্র তের হাজার টাকায় যে জীবন সুন্দর হয় এবং রাজার হালে থাকা যায় সেটাই আমি ভদ্রলোকের গল্প শুনে জানার চেষ্টা করছিলাম । বাবা বললেন কিছু শিখতে পেরেছ ? আমি বললাম, হ্যাঁ বাবা আমি বুঝতে পেরেছি । সুখী হতে বেশি কিছু লাগে না । খুশি থাকাটাই জরুরি । তখন বাবা এক গাল হেসে দিয়ে বললো দেখেছো ব্যাগ-জুতো এসব কতো তুচ্ছ ? সেই থেকে আমি সব সময় অল্পতেই খুশি থাকি এবং ভালো আছি বলতে পারেন রাজার হালে ।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত