হারানোর ভয় হারিয়ে যাবার ভয়

হারানোর ভয় হারিয়ে যাবার ভয়
‘আমি শুধু মরলেই হয়, তুমি তো গুনে গুনে সাতদিনের মধ্যে বিয়ে করে নতুন বৌ ঘরে আনবে।’
‘কী করে বুঝলে?’
‘না বোঝার কী আছে? তোমার মত পুরুষ মানুষ আমার খুব চেনা।’
‘তাই বুঝি?’
‘শোন, এমন করে মুচকি মুচকি হাসবে না। বিয়ের কথা শুনে মনে খুব ফূর্তি লেগে গেল, তাই না?’
‘তুমিই তো বললে বিয়ের কথা।
এই বয়সে বিয়ের কথা শুনে মনটা কেমন যেন করে উঠল। তোমাকে বিয়ে করলাম সেই বারো বছর হয়ে গেল। ওহ, শোনো, সাতদিনের জন্য আটার রুটি বানিয়ে ফ্রিজে রেখে যেতে ভুলবে না কিন্তু। তুমি মরার পরে বিয়ে করতে তো সাতদিন লাগবে। এই সাতদিন সকালে রুটি ছাড়া আমার চলবে কী করে? ’
‘রান্না ঘরে নতুন বটিটা দেখছো। গতকাল বুয়াকে দিয়ে এই বটি কিনে আনলাম।’
‘বিয়ের মধ্যে আবার এই বটি কেন?’
‘আমি মরার আগে তোমারে এই বটি দিয়ে কুপিয়ে যাব।’
‘পারবে কোপাতে?’
বিথী চুপ করে আছে। অনেকক্ষণ, অনেকক্ষণ, অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল বিথী। আমি তাকিয়ে আছি বিথীর দিকে। হঠাৎ করে বিথী কেমন শান্ত হয়ে গেল। আমি আবার বললাম, কী ব্যাপার বিয়ের আয়োজনে ভাটা পড়ল?
বিথী খুব সিরিয়াস। খুব। কেমন একটা করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা আমার ছেলে দুইটার কী হবে? আমিও একটু সিরিয়াস হলাম। দেখি বিথী কী করে। আমি নিজের ভেতর ভালোবাসা লুকিয়ে একটু কঠিন সুরে বললাম, কী আর হবে। তাদের জন্য নতুন মা নিয়ে আসব। নতুন মায়ের কাছে খুব ভালো থাকবে।
‘আমার বড় ছেলেটা তো একটুও ঝাল খেতে পারে না। ফোরে পড়া অতটুকু ছেলে ঝাল খাবে কেমন করে বলো?’
‘আরে, ও নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। আস্তে আস্তে শিখে নিবে।’
‘আচ্ছা তুমি তো রোজ দিন ধোয়া স্যান্ডো গেঞ্জি পরো।’
‘তো?’
‘ধুর, কত গন্ধ হয় তুমি জানো? ঘামের গন্ধে সেই গেঞ্জি তুমি বুঝি গায়ে দিতে পারবে?’
এই নিয়ে তুমি না ভাবলে চলবে।’
‘তোমার তো খুব কষ্ট হবে। নতুন বৌ প্রতিদিন ধুয়ে দিবে তো?’
‘আমার স্যান্ডো গেঞ্জি নিয়ে তোমার এত চিন্তা কেন? নতুন বৌ ধুয়ে না দিলে তোমার তো খুশি হওয়ার কথা।’
বিথী এবার খুব মায়া নিয়ে বলল, মনে আছে আধোয়া গেঞ্জি গায়ে দিয়ে একবার কেমন চুলকানি হলো! সেই চুলকানিতে সারারাত না ঘুমিয়ে কেমনটা না করলে তুমি। বিথীর কথায় আমি দূর্বল হয়ে পড়ছি। আমি নিজেকে আরেকটু শক্ত করলাম। এই নিয়ে বিথীর সাথে আরো কিছূক্ষণ গল্প করতে ইচ্ছে করছে। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে খুব কঠিন করে বললাম, হলে হবে। আমি আছি বিয়ে নিয়ে আর তুমি চুলকানি। বিথী এবার একটু অভিমান করেই বলল, তোমার শরীরের যে অবস্থা! গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা উঠলে তো হুশ থাকে না। তখন তো এই বউ ছাড়া উপায় থাকে না। এই করো, সেই করো। সব এই বিথী। তখন তো বিথী ছাড়া কোনো শব্দ মুখে আসে না।
আমি বললাম, নতুন বৌ আসলে সেও এমন করে সেবা যত্ন করবে। বিথী এবার একটা হাসি দিয়ে বলল, সব ঠিক আছে মানলাম কিন্তু সরিষার তেল দিয়ে কালো জিরার ভর্তা? তুমিই তো বলো এই ভর্তা পৃথিবীর আর কেউ পারবে না। আর ঐ মসুর ডাল রান্না? কে করবে শুনি এমন করে মসুর ডাল? আমি বললাম, রাখো তোমার ওসব। নতুন বৌ এনে ট্রেনিং দিব, ট্রেনিং। বুঝলে! সবকিছু ট্রেনিং দিয়ে শিখিয়ে দিব। ট্রেনিং দিলে এই বিথীর চেয়ে হাজার গুন ভালো হবে রান্না। বিথী এবার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমার অতটুকু বাচ্চা। ছোট ছেলেটা তো রোজ সকালে একটু পায়েস খেতে চায়। অন্য কেউ এসব করবে বুঝি?
‘আরে পায়েস না করলে অন্য কিছু করবে।’
‘না, না, না। ছেলেটার পায়েসই লাগবে।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে আমি দেখব তখন।’
‘তুমি সত্যি সত্যি বিয়ে করে ফেলবে?
আমার ছেলে দুইটার জন্য একটুও মায়া হবে না। ছোট ছেলেটা যে তোমাকে ছাড়া মাঝরাতে বাথরুমে যেতে চায় না। এত ভীতু ছেলে। আমার ছেলেটা যদি একা একা কাঁদে? তুমি বিয়ে করলে এই ছেলে দুইটার যে খুব কষ্ট হবে।’
বিথীর এবার সত্যি সত্যি কাঁদছে। পানিতে টলমল করছে চোখ দুটি। আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে লুকিয়ে চোখের ভেতর জমে থাকা পানি একবার মুছে নিল। এই দৃশ্য দেখে আমার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। বিথীর সাথে মজা করতে গিয়ে নিজেই কেমন যেন হয়ে গেলাম। আমি বিথীর কাছে গিয়ে বললাম, ধুর । তুমি ঠিক ফাজলামিও বুঝো না। এত সহজে তোমাকে মরতেই দিলে তো। তাছাড়া এই তুমি চলে গেলে হবে কেমন করে বলো? আমরা বাপ-ছেলে তোমাকে ছাড়া একদিনও থাকতে পেরেছি বলো? বিথী আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদছে। আমি জানি এই সংসার, এই মায়া, এই ভালোবাসা ভয়ানক একটা জিনিস। সময় যেতে যেতে বিথী, আমি এবং আমরা এই সংসারে মায়া এবং ভালোবাসায় স্বার্থহীনভাবে জড়িয়ে পড়ি। এই ভালোবাসা জুড়ে সবসময় কেমন একটা ভয় জড়িয়ে থাকে। এই যেমন বিথীর ভেতরে ভয়। হ্যাঁ আমি জানি বিথীর মাঝে সব সময় একটা ভয় কাজ করে। ভয়টা হলো, সে না থাকলে তাঁর ছেলে দুইটার কী হবে? পৃথিবীতে আর কেউ নেই এই সন্তান দুটিকে তাঁর মত করে আগলে রাখবে। এই আমিও রাখতে পারব কি না তা নিয়ে খুব ভয় তাঁর।
প্রচলিত এই সমাজ সংসারের অনেক পরিবারের এমন করুণ দৃশ্য হয়তো সে দেখেছে বা গল্প শুনেছে। এই কারণেই হয়তো আরো বেশি উদগ্রীব হয়। তাঁর ভেতর জমে থাকা সব অভিশঙ্কা এই সন্তানগুলো নিয়ে। আমি বুঝতে পারি দিন দিন এই সংসারের মানুষগুলোকে আমাদের নিজের চেয়ে বেশি মূল্যবান হয়ে উঠে। এই ভয় শুধু কি বিথীর? এই ভয় যে আমারো। আমার ভেতর উদগ্রীবতা জন্মে, এই আমি না থাকলে স্ত্রী, সন্তান আর পরিবারের কী হবে? এই আমি না থাকলে সন্তানগুলো কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে? রোজদিন গলা জড়িয়ে ধরে এটা সেটা আবদার করা প্রিয় সন্তানগুলো তখন কার কাছে গিয়ে আবদার করে বলবে সত্যি, এমন করে ভাবতেই নিজের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠে।
গলা শুকিয়ে যায়। আমারো তো ভাবনা আসে, শঙ্কা হয় যে, আমার কিছু হয়ে গেলে এই বিথী আমার প্রিয় এই সন্তানগুলোকে আগলে রাখবে তো? নাকি অন্য কারো সংসারে গিয়ে সত্যি এই সংসার, এই সম্পর্ক প্রচন্ড মায়া আর ভালোবাসার। একটু একটু করে এই মায়া আর ভালোবাসার সমুদ্রটা বিস্তৃত হতে থাকে। এই বিস্তৃতি আমাদের ভেতর একটু একটু করে একটা ভয় তৈরী করে ফেলে। হারানোর ভয়, হারিয়ে যাবার ভয়। হারানোর ভয়, হারিয়ে যাবার ভয় নিয়েও আমি, বিথী, আমরা ভালোবাসা আর মায়া দিয়ে জড়িয়ে থাকতে চাই প্রিয় মানুষগুলোর মাঝে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত