একদিন কলিংবেলের আউয়াজ শুনে দরজা খোলে দেখি একজন হাতে একটা বক্স নিয়ে দাড়িয়ে আছেন , একটু ইতস্তত হয়ে বললেন,
: আপনারা বিল্ডিংয়ে নতুন এসেছেন, দেখা করতে এসেছি। আমিও একটু ইতস্তত করে, বাসায় বসতে বললাম। বললেন,
: আপনার জন্য একটু শাক নিয়ে এসেছি। আমিও অনেক খুশি হয়ে বললাম,
:- আমি শাক অনেক পছন্দ করি। জাযাকিল্লাহ।
আমার খুশি দেখে উনি একটু সহজ হয়ে গল্প জমিয়ে দিলেন। বুঝতে পারলাম ইনি সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারেন। সেই যে গল্প শুরু হলো, এখনো উনার সাথে কথা হলে সময় কখন চলে যায় বুঝতেও পারি না। আমার দুই ছেলে প্রচণ্ড দুষ্ট হওয়ার পরও উনি আমার ছেলেদের প্রতি কখনো বিরক্ত হননি। অই প্রথম দিনই বললেন, ভাবি আপনার ছেলেদের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েন আমার ফাইজা, সাইবার(উনার দুই মেয়ে) সাথে খেলবে।
ব্যস হয়ে গেল, অই প্রথম দিনই এত ভাব জমে গেল, আমার ছেলেরা স্কুল থেকে এসেই বা সময়ে, অসময়ে দৌড় দিত ফাইজাদের বাসায়। ওরা দুইবোনও ভাইদের সাথে খেলতে আমার বাসায় চলে আসত। যেন এক পরিবারের ভাই বোন। আমার কোথাও যেতে হচ্ছে বাচ্চাদের ভাবির কাছে এমনভাবে নিশ্চিন্তে দিয়ে যেতাম, যেন ওরা আমার আপন বোনের কাছেই আছে। এই ভাবি, আজ পর্যন্ত বলতে পারব না আমার ছেলেদের না দিয়ে তাদের কোন প্রিয় জিনিস খেয়েছেন। রাসুল (সঃ) আবু যার (রাঃ )কে বলেন, তুমি তোমার তরকারিতে ঝোল বাড়িয়ে দিও, যেন প্রতিবেশীদেরও দিতে পারো।
( মুসলিম: ২৬২৫) জানি না ভাবি এই হাদিসটি জানতেন কি না, তবে তিনি এই হাদিসটি খুব মানতেন। উনি যেটাই রান্না করতেন বা নতুন কোন নাস্তা বানাতেন আমার বাসায় না পাঠিয়ে কখনো খেতেন না। এমনকি একটু আলুভর্তা হলেও দিয়েছেন। আমার ছোট ছেলেটার সময়ে প্রেগন্যান্সির কারণে যখন কিছু খেতে পারতাম না এই ভাবির তরকারি দিয়ে ভাত খেয়েই নয়টা মাস আমি অতিবাহিত করেছি। কখনো আমি অসুস্থতার কারণে রান্না করতে না পারলে ভাবি এসে রান্না করে আমাকে খাইয়ে নিজের বাসায় যেতেন। ডেলিভারির পর ছোট বাবুটাকে নিয়ে যখন বাসায় আসি ভাবি বাসায় ঠিকতে পারতেন না, শুধু বাবুকে কোলে নেওয়ার জন্য। এমনও হয়েছে বাবুকে ঘুম পাড়িয়েছি মাত্র, ভাবি এসে ঘুমের মধ্যেই কোলে নিয়ে ফেলেছেন। কী অদ্ভুদ মায়া!! কোন কিছুর বিনিময়েই ভাবির এ-ই ঋণ শোধ হবে না।
রাসুল (সঃ) প্রতিবেশীর হক্ব সম্পর্কে বলেন, যদি সে তোমার কাছে ঋণ চায় তাহলে ঋণ দেবে, যদি তোমার সহযোগিতা চায় তাহলে তাকে সহযোগিতা করবে, যদি সে অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে তার খোঁজখবর নেবে, তার কোনোকিছুর প্রয়োজন হলে তাকে তা দেবে, সে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়লে তার খোঁজখবর নেবে, যখন সে ভালো কিছু লাভ করবে তখন তাকে শুভেচ্ছা জানাবে, যদি সে বিপদে পড়ে তাহলে সান্ত্বনা দেবে, মৃত্যুবরণ করলে তার জানাযায় শরিক হবে, তার অনুমতি ছাড়া তোমার ঘর এত উঁচু করবে না যে তার ঘরে বাতাস ঢুকতে পারে না, কোনো ভালো খাবার রান্না করলে তাকে এর ঘ্রাণ ছড়িয়ে কষ্ট দেবে না, তবে যদি তার ঘরেও সে খাবার থেকে কিছু পৌঁছে দাও। যখন কোনো ফল কিনে তোমার বাড়িতে নেবে তখন হাদিয়াস্বরূপ তাকে সেখান থেকে কিছু দেবে। (খারায়েতী, তবারানী, আবুশ শায়খ- ফাতহুল বারী[2], খ. ১০, পৃ. ৫১৯, কিতাবুল আদব, বাব-৩১) আমি সবসময় চেষ্টা করেছি এই হাদিসটির উপর আমল করতে। করোনাকালে ভাবির ফাইন্যান্সিয়াল কন্ডিশন কিছুটা খারাপ হয়ে যায়। এমনকি তখনো রান্নায় একটু বাড়িয়ে দিতে ভুল করেননি। আমার যে কোন প্রয়োজন ভাবিকে এত নিসংকোচে বলতে পারতাম যেন আমি আমাকেই বলছি।
কিছুদিন আগে ভাবি একেবারে গ্রামে চলে যান, যেদিন উনি চলে যান আমার অবস্থা এমন হয়ে গিয়েছিল, যেন আমার কলিজাটা কেউ ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে। সারাদিন কান্না করেছি, উনিও এক সপ্তাহ ধরে কান্না করে যাচ্ছেন। আমি এত এত বন্ধু, প্রতিবেশী পেয়েছি কিন্তু এই ফাইজার আম্মুর কাছে যে আন্তরিকতা, যে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা পেয়েছি তা আজ পর্যন্ত পাইনি। জানি না পাব কি না। আমার প্রিয় মানুষের তালিকা খুব ছোট, আমি এমন একজন মানুষ সহজে কারো সাথে মিশতে পারি না, কাউকে আপন করে নিতে সময় লাগে।৷ কিন্তু যাকে আপন করে নিই সে কখনো আমার মন থেকে মুছে যায় না। আর ভাবি নিজ গুণে আমার মনে এমন জায়গা দখল করেছে যা কোন কিছুর বিনিময়ে পূরণ হবে না। এই বাসায় যখন নতুন আসি, খুব একা ফীল করতাম, কাউকে চিনতাম না। প্রায় সাত বছর এক এলাকায় থাকার পর অন্য এলাকায় আসাতে মন এমনিতেই খারাপ হয়ে থাকত। সেই মন খারাপের দিনেই পেয়েছিলাম জীবনের পরম বন্ধুকে।
উনি ছিলেন আমার প্রতিবেশি, হয়তো বোন বা বোনের চেয়েও বেশি। দুই মায়ের পেটে জন্ম হলেও আপন বোনের চেয়ে কোন অংশে কম ছিলাম না। উনার জীবনের কোন কথা আমার কাছে গোপন ছিল না। কাউকে যেগুলো শেয়ার করতে পারতেন না সেগুলো আমার কাছে বলে হালকা হতেন। জানি না উনার সাথে আর কখনো দেখা হবে কি না তবে এটা জানি দুরত্ব কখনো আমাদের আন্তরিকতার পথে বাধা হয়ে দাড়াতে পারবে না। দোয়া করি সবসময় ভালো থাকুন।
গল্পের বিষয়:
গল্প