পাস ফেল

পাস ফেল
-মুখটা শুকনা লাগছে কেন খালা?
-মনডা ভালা না মামানী।
-কেন? খালু কি আবার পলায়ছে?
-হ্যায় পলায় নাই। বাসাত ঝিম মাইরা বইয়া আছে। হেই ফাঁকে মাইয়া দুইডা বিগড়াইছে। হ্যাগোরে ধরছে জুয়ার নেশায়।
-জুয়া?
-হ, মামানী। ক্যাসিনো খেইলা হ্যারা বিছনার নিচে ট্যাকার আড়ত বানাইছে। রাত্তিরি বড় ছাওয়াল বিছনায় মুতছে। রোদ্দুরি দিয়ার লাইগা তোশক উডাইছি। দেহি বিছনার নিচে সারি দিয়া ট্যাহা সাজানো। কেলেংকারীর শ্যাষ নাই।
-বলেন কী? দুদক খোঁজ পাইছে?
-মামানী কি গরীবের লগে টিটকারি মারেন?
-টিটকারি মারি না খালা। তবে জুয়ার টাকা তো অবৈধ।
-হ, ডাইরেক্ট হারাম। কী কমু মামানী, বিছনার নিচে ট্যাহাগুলা দেইখা মাইয়াগোরে ডাকছি।
জিগাইলাম, এই ট্যাহা কার? হ্যারা দুই বোইন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। স্বীকার যায় না। বদের বদ। পরে বিচরাইয়া জানলাম হ্যারা ক্যাসিনো খেইলা এই ট্যাহা জিতছে! ব্যাদনায় আমার বুকির ভিত্রে এমুন মোচড় দিছে! আপনারে বুঝাইতে পারুম না মামানী।
-এত দুঃখ পাইয়েন না খালা।
-দুক্ষু পামু না! নাউজুবিল্লা! ঘরের ভিত্রে জুয়ার হারাম ট্যাহা জাইনাও আমি আরামে চলমু! এইডা আপ্নে কী কন?
-আপনার মেয়ে দুইটা এখনো বাচ্চা মানুষ।
খালা থালাবাসন মাজছিল। কাজ থামিয়ে প্রায় খেকিয়ে উঠল- কীয়ের বাচ্চা? হ্যাগো বয়স জানেন? পরায় দুই হালি বছর। হ্যারা এইবার কেলাস ত্রি-ফোরে উডছে না? আমি যে রাইত-দিন বাসায় বাসায় কাম কইরা মরি কাগো লাইগা? হেইডা তারা বুঝবো না? তা না আমারে লুকায়া চাড়া দিয়া ক্যাসিনো ক্যাসিনো খ্যালে। জুয়ার ট্যাহা আইনা সাজায় রাহে আমার বিছনার নিচে। কত বড় কইলজ্যা! হ্যারা যুদি জুয়ারুই হবি তাইলে ট্যাহা খরচ কইরা আমি ইসকুলে পাডাইছি ক্যা রে? খালার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু স্কুল তো বন্ধ। করোনাকে কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। তবে রিস্ক নিয়ে স্কুল খোলার কোনো মানে নাই। এই অনির্দিষ্ট ছুটিতে বাচ্চাদের করার কিছু নাই। নিচের টিনসেড বাড়ির বাচ্চাগুলো জটলা পাকিয়ে গলিতে ফুটবল-ক্রিকেট খেলছে। কেউ কেউ খেলছে চাড়া। ব্যালকনি থেকে খালার মেয়ে দুটিকেও আমি এই দলে দেখেছি। কিন্তু তারা যে টাকা দিয়ে এটা খেলতে পারে আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবি নাই।
-ক্যাসিনো খেলে মেয়েরা কত টাকা জমায়ছে খালা?
-একশ’ তিয়াত্তুর ট্যাহা।
-অনেক টাকা!
-স্কুলগুলা অফ থাকায় বাচ্চাগুলা বদ হইতাছে। আমি মাথা ঝাকালাম।
-লেহা-পড়া যা এট্টুয়াট্টু পারত হেইডা তো ক্যাসিনো দিয়া গুলায়া খাইছে।
এইদিকে ইসকুল থেইকা নয় মাসের বেতন চায়া নুটিশ পাডাইছে। পরীক্ষা হইব। লগে হেইডার ফি। খা..কির পোলারা। বিজনেস বোঝে ষোল আনা। এহন আমি এই পরায় চাইরডা হাজার ট্যাহা কই পাই কন? খালাকে আশ্বস্ত করলাম। লাস্ট ডেটে টাকা পয়সা শোধ করে খালার মেয়েরা পরীক্ষার অনুমতি পেলো। সকাল থেকে খালার জন্য অপেক্ষা করছি। থালাবাসন জমে আছে। ধুতে হবে। ঘর নোংরা। মুছতে হবে। এখন বেলা সাড়ে দশটা। কিন্তু সে ফোন ধরছে না। আগাম বেতন দেয়ার এই হচ্ছে অসুবিধা। এগারটার পরে ফোন ব্যাক করল খালা।
-কোনো সমস্যা খালা? ফোন ধরছেন না যে।
-পরীক্ষার হলে ছিলাম গো মামানী। ফোন ছিল সাইল্যান্ড।
-পরীক্ষা তো আপনার মেয়েদের আপনি কী করেন?
-গাড দেই।
যাতে টুকলিফাইং না করতে পারে। বদ দুইডারে দিয়া ‘বিলিব’ নাই। এই বয়সেই পাক্কা জুয়ারু হইছে।টুকলিফাইং করলে আমার মুখ দ্যাহানোর জায়গা থাকব না। আরো এক মাস পরের ঘটনা। খালা কিচেনে না গিয়ে ড্রইংরুমে সোফায় গ্যাট হয়ে বসে আছে। তার চোখ ফোলা ফোলা। বোঝা যাচ্ছে কিছুক্ষণ আগে একদফা কান্নাকাটি হয়ে গেছে।
-খালা, পাস-ফেল বড় কথা না। আসল হইল শিক্ষা। মেয়েরা এইবার ফেল করছে, পরেরবার পাস দেবে। কান্নাকাটির কী আছে?
-মাইয়াগো ফেলের ব্যাদনায় কান্দি না মামানী। কান্দি অপমানে। মাস্টার ব্যাটায় কয়, আমাগো লাহান বস্তির মানষের পুলাপানের লাইগা ইসকুলির দুর্নাম। বই দেইখা লেখতে দিলেও এইগুলা পাস করে না।
আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। এই মাস্টারের শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে। লজ্জাও লাগছে। খালা বলল, শরম না কন? হ্যারা নাকি আমার মাইয়ার মতো ছাত্রীগো নাম কাইটা দেবো। মুখ্যু মানষির ঘরে হইছে বইলা কি আমাগো মাইয়ার ইজ্জত নাই? আমি মাথা ঝাকাই। খালা তার কী কর্থ করে জানি না। সে বলে- আমিও মুখির উপর কয়া আইছি, আপনেগো এই বিদ্যার দুকানে আমার মাইয়াগো পড়াইমু না। নতুন ইসকুলি দিমু। মামানী, আপনে আমারে এট্টা ভালা ইসকুল খুঁইজা দেন। দুকান না। ইসকুল। যারা খালি পড়াইব না, শিক্ষাদীক্ষা দেবো। যাগো কাছে পড়লে পুলাপান হারাম ট্যাহার লাইগা ক্যাসিনো খ্যালবো না। বেশি নম্বরের লাইগা টুকলিফাইং করব না। সদা সত্য কথা কইব, সৎ পথে চলব। আর নিজেরে নিজে ইজ্জত দেবো।
আমি মুগ্ধ হয়ে এই সহজসরল নিরক্ষর মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছি। খুব সাধারণ একটা মানুষ। অথচ কী অসাধারণ। শ্রদ্ধায় আমার মাথা হেলে যাচ্ছে। আমার খুব বলতে ইচ্ছে করছে, খালা আপনি পাস করেছেন। একমাত্র আপনিই পাস করেছেন। আপনার মেয়ের স্কুল, স্কুলের মাস্টারেরা সব আপনার কাছে ডাহা ফেল করেছে। আপনার মতো মা যেসব মেয়ের, তারাও সবচে ভালো পাস করবে। কিন্তু সব কথা বলতে হয় না। বলার দরকারও নেই। একটা প্রকৃত বিদ্যালয়ের খোঁজ জানতে খালা অধির আগ্রহে চেয়ে আছে। ভাবার চেষ্টা করি। আমি কি তাকে এমন একটা বিদ্যালয়ের খোঁজ দিতে পারব, যা তাকে হতাশ করবে না?
-মামানী, আপনে কি কিছু নিয়া ওরিড? আমি দু’দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে মুখে হাসি ফোটাই। কিন্তু আমি জানি এই হাসি ভিষণ ফ্যাকাস।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত