অপ্রত্যাশিত জীবন

অপ্রত্যাশিত জীবন
পেটের মাঝখানে ছুরিটা ঢোকানো হয়েছে। ছুরি ঢোকানো অবস্থায়ই ছুরিটা উপর নীচ করে অনেকখানি চাপ দিয়ে টানা হয়েছিল। এতে পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে গেছে সব। দেড় ইঞ্চি পর্যন্ত গভীর করে কাটা হয়েছে গলাটা।
রাফির লাশটা এরকম বিভৎস অবস্থাতেই ঘরের মেঝেতে পাওয়া গিয়েছিল৷ রাফির লাশটা সর্বপ্রথম আবিষ্কার করে তার স্ত্রী রিভা।
চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল সে৷ যখন বাসায় ফিরেছে তখন প্রায় বিকেল৷ ড্রয়িং রুমসহ তিন রুমের একটা ফ্লাট বাসা৷ তাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় একবছর হতে চললো৷ প্রেম করেই বিয়ে করেছে তারা৷ রুমের দরজা খোলাই ছিল৷ ভিতরে ঢুকে দেখে মেঝে জুড়ে রক্ত আর রক্ত। নিথর ও বিভৎস অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে একটা মানব দেহ। এমন ভয়াবহ লাশ এই নিয়ে দুবার দেখলো রিভা৷ প্রথম লাশটা ছিলো তার বাবার লাশ৷ তার বাবার লাশটা এই লাশটার থেকেও ভয়ঙ্কর রকম বিভৎস ছিলো৷ যেদিন বাবার বিভৎস লাশটা সে দেখেছিল সেদিন শুধু একটা কথাই তার বুক চিরে বের হয়েছিল ‘পিতার এমন ভয়ংকর ও বিভৎস লাশ যেন পৃথিবীর আর কোন সন্তানকে দেখতে না হয়।’ রাফি মার্ডার হয়েছে প্রায় তিন মাস হতে চললো৷ খুনিকে আজও ধরা সম্ভব হয়নি। সন্দেহভাজন কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম একজন হলো রাফির বন্ধু সাব্বির।
মাথার উপরে থাকা সিলিং ফ্যানটা ফুল স্পিডে ঘুরছে৷ তারপরেও রিভা ঘামছে৷ নাকমুখ ঘেমে তেলতেলে হয়ে গেছে৷ নিজেকে কেমন অসহায় অসহায় লাগছে তার। সে স্থির ও শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার সামনে বসে থাকা ওসি ইফতেখারউদ্দিন এর দিকে। আজকে থানায় আসতে বলা হয়েছিল তাকে৷ এ নিয়ে বহুবার আসা যাওয়া হয়েছে থানায়। রাফির মার্ডারের বিষয়ে কথা বলার জন্য আজকেও আসতে হল। কিন্তু রিভা কি জানে আজকে তার জন্য ভয়াবহ কিছু অপেক্ষা করছে? ভদ্রলোকের মুখে লাল চাপদাড়ি৷ সম্ভবত মেহেদী লাগিয়েছেন দাড়িতে৷ মাথার সামনের দিকটা চুলশূন্য। পেছনের দিকে চুল রয়েছে। তাও না থাকার মতোই। সেগুলো সাদা বর্ণ ধারণ করে আছে৷ চোখে কালো রঙের মোটা ফ্রেমের চশমা৷ চাকরির রিটায়ারমেন্টের আর দেড় বছর বাকী ইফতেখার উদ্দিনের। এরপর অবসর জীবনে চলে যাবেন ওসি ইফতেখারউদ্দিন।
ইফতেখার সাহেবকে কিছুটা ভাবগম্ভীর দেখাচ্ছে। পুলিশের লোকদের চেহারায় এই ভাবগাম্ভীর্য থাকাটা স্বাভাবিক হলেও এই মুহূর্তে ইফতেখার সাহেবের চেহারার এ ভাবগাম্ভীর্য অস্বাভাবিক কিছুর ইঙ্গিত। ঘটনা অস্বাভাবিক হলেও ইফতেখার উদ্দিন স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘মা, তুমি তো আমার মেয়ের বয়সী। তোমার দিকটা আমি ভালোভাবেই বুঝতে পারছি। জানি তুমি এখন একটা মানসিক প্রেসারে আছো৷ এই সিচুয়েশানে কথাটা আরও কষ্টদায়ক হবে তোমার জন্য। এ ক্ষেত্রে আমার কিছুই করার নেই৷ কথাটা বলতেই হবে তোমাকে৷’ ওসি সাহেবের দিকে কৌতুহলী ভঙ্গিতে তাকিয়ে রিভা বললো, ‘কী কথা স্যার?’ ‘তোমার নামে একটা কেস করা হয়েছে।’
স্বাভাবিকত পুলিশের কণ্ঠ এতো মোলায়েম হয় না৷ কিন্তু ওসি ইফতেখার উদ্দিন মানুষের ধরণ ও পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে মুহূর্তেই সুর পাল্টে ফেলতে পারেন৷ এটা তার অসাধারণ গুণগুলোর অন্যতম একটি। ওসি সাহেবের কথায় ভীষণ চমকে ওঠে রিভা। তার সমস্ত শরীর একবার ঝাকুনি দিয়ে ওঠে৷ তার চেহারা জুড়ে এখন কেবল অজানা আতঙ্ক ও বিচলিত ভাব। রিভা উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কেস! কীসের কেস? আমার নামে কেস? আমি কী করেছি, স্যর? কে করেছে কেস?’ রিভার গলা শুকিয়ে আসছে ক্রমশ৷ একদিকে গলা শুকিয়ে আসছে অন্যদিকে চোখে জল জমছে৷ কী অদ্ভুত! জীবনে যা কল্পনাতেও ভাবেনি আজ এই মুহূর্তে সেই কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন রিভা। আহ্! জীবন এতো নাটকীয় কেন?
ইফতেখার উদ্দিন তার সেই চিরাচরিত স্বাভাবিক ভাব বজায় রেখে বললেন, ‘তোমার শাশুড়ি তোমার নামে মামলাটা করেছে৷’ ‘আমার শাশুড়ি?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো রিভা। তার মুখ হা হয়ে গেছে৷ আর কী বলবে বুঝতে পারছে না সে৷ বিষ্ময়ে বাকরুদ্ধ হওয়া যাকে বলে৷ ‘হুম। তোমার শাশুড়ি। ৩০২/৩৪ ধারায়। তুমি নাকি তার ছেলেকে অর্থাৎ তোমার স্বামীকে মার্ডার করেছো৷’ হতভম্ব চোখে ওসি ইফতেখারউদ্দিন এর দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে রিভা। কথা বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না সে৷ কী বলবে? যার সাথে একই ছাদের নীচে, একই ঘরে দিনের পর দিন মাসের পর মাস কাটিয়েছে। যার জন্য বুকের বাঁপাশে কিছু ভালোবাসা সযত্নে সঞ্চিত করে রেখেছে। তাকে কীভাবে মার্ডার করবে রিভা? হতভম্ব রিভার দুচোখ বিদ্রোহ করে ওঠে। চোখ থেকে অনর্গল ঝরে পড়ছে বিদ্রোহী অশ্রু।
‘আমি আমার স্বামীকে মারিনি স্যার। আমি আমার রাফিকে কেন মারতে যাবো? ওকে তো আমি আমার নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবেসেছি। সত্যিই বলছি স্যার, সত্যিই বলছি। আমি আমার রাফিকে মারিনি৷ আমি আমার রাফিকে মারিনি৷’ রিভার চোখে শ্রাবণের বর্ষণ৷ বাচ্চা মেয়েদের মতো কাঁদছে রিভা। বারবার ডুকরে উঠছে৷ নিজের হাত দুটো ওসি সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘এই দেখুন স্যার, এই হাতে ওকে আমি রান্না করে খাইয়েছি। ওর মাথার এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিয়েছি৷ এই হাতে ওকে খাইয়ে দিয়েছি। এই হাতে আমি ওর সেবা করেছি৷ ওর অফিসের ব্যাগটা গুছিয়ে দিয়েছি৷ আপনিই বলুন স্যার, এই হাত দিয়ে আমি কীভাবে আমার স্বামীকে মার্ডার করবো? কীভাবে সম্ভব এটা? আমি তো ওকে আমার নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসেছি৷’ সন্তানের বয়সী একটা মেয়ে কান্না করছে৷ মায়া লাগছে খুব।
চাকরির সুবাদে কত শত মানুষের অনুনয় বিনয় দেখেছেন, শুনেছেন ইফতেখার উদ্দিন তার হিসেব নেই৷ কিন্তু কোনটাই তাকে তেমনভাবে নাড়া দেয়নি। আজ চাকরি জীবনের এই শেষান্তে এসে তার ভেতর কেমন মায়া মায়া একটা অনুভূতির টের পান ইফতেখার উদ্দিন। সামনে বসে থাকা মেয়েটার কান্না তার সহ্য হচ্ছে না। তার ভেতরটা নাড়িয়ে দিচ্ছে। ওসি সাহেব ইমোশনাল হয়ে পড়েন৷ তার চেখেও জল চলে এসেছে। মেয়েটার দিকে তাকালেই কেন জানি সায়িদার মুখটা ভেসে ওঠে বারবার৷ সায়িদা ওসি সাহেবের বড় মেয়ে৷ এখন স্বামীর সাথে আমেরিকা থাকে৷ তিন সন্তানের মা। ইফতেখার উদ্দিনের রোজ মনে পড়ে মেয়েটার কথা৷ কতগুলো বছর হয়ে গেলো এখনও ফিরলো না মেয়েটা৷ ইফতেখার উদ্দিন মনে মনে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলেন ‘পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিস ভালো কথা, তাই বলে এতো দূরে পালিয়ে যাবার কী প্রয়োজন ছিলো, বল তো? বাপটাকে একা ফেলে কীভাবে অতোদূর চলে গেলি?
যাবার আগে একটা বার দুজনে দেখা করে যেতে পারতি। অন্তত একটা বার৷ তোর বাবা পুলিশ দেখে ভয়ে আসিসনি তাই না? কীসের ভয়। আমি তো তোদের মেনেই নিতাম। কখনও তো তোর কোন আবদার অপূর্ণ রাখিনি। যেদিন তুই হয়েছিলি সেদিন পণ করেছিলাম যা চাইবি তাই তোকে এনে দেবো। এটাই হয়তো আমার অপরাধ ছিলো!’ কাছের আপন মানুষকে দূরে ঠেলে, দূরের মানুষকে আপন করার জন্য আজকাল মানুষ পালিয়েও যায়৷ মানুষ কী অদ্ভুত এক প্রাণী! মেয়ের জন্য ওসি সাহেবের বুকের ভেতরটা খা খা করতে থাকে৷ কাঁদতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেন ইফতেখার উদ্দিন৷ স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘তোমার নাকি আরেকটা ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে। তার হয়ে নাকি মেরে ফেলেছো? তোমার শাশুড়ি এটাই বললেন।’ ওসি সাহেবের কথা শুনে রিভা ভীষণ অবাক হয়৷ একজীবনে আর কতবার যে এরকম অবাক হতে হবে তা সে জানে না। কী অদ্ভুত সব প্রশ্নের মুখোমুখি আজ৷
এই জীবন তো রিভা কখনোই চায়নি৷ চেয়েছিল সুন্দর, স্বাভাবিক, সাংসারিক, আনন্দ পূর্ণ একটা জীবন৷ আনন্দপূর্ন না হোক৷ একটা স্বাভাবিক জীবন তো হতে পারতো। এই অস্বাভাবিক জীবন কীভাবে আমৃত্যু বয়ে বেড়াবে, ভেবে কোন কূলকিনারা খুঁজে পায় না রিভা৷ সামনে শুধুই অন্ধকার আর অন্ধকার দেখে সে৷ যে মেয়েটা সামান্য একটা তেলাপোকা দেখলে ভয় পায়। রক্ত দেখলে মাথা ঝিম ঝিম করে। সেই মেয়েটা নাকি তার স্বামীকে গলা কেটে কুপিয়ে হত্যা করেছে। আর সেই কারণে আজ সে ফাঁসির কেসের আসামি। জীবন কতই না রহস্যময়। জীবনের বাঁকে বাঁকে রহস্য৷ আর এই রহস্যের উদঘাটন করতে করতেই একদিন এই মানব জীবনের সমাপ্তি ঘটে৷ জীবনের সমাপ্তি ঘটলেও রহস্যের সমাপ্তি ঘটে না। রহস্য থেকেই যায়। কেন থেকে যায় রহস্য? কে জানে!
রিভা কান্না থামিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়। ইফতেখার উদ্দিনের কণ্ঠস্বর এই প্রথমবারের মতো অস্বাভাবিক শোনালো। কোন আসামির সাথে আগে কখনো এমন দরদ মাখা কণ্ঠে কথা বলেননি। রিভার সাথে বললেন৷ সুদীর্ঘ চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতার কারণে তিনি মুখ দেখলেই বুঝতে পারেন কে আসামি আর কে আসামি না৷ ইফতেখার উদ্দিন দরদি কণ্ঠে বললেন, ‘মা, এখন বলো আমি কী করতে পারি৷ তোমাকে কি বাসায় গিয়ে এ্যারেস্ট করবো নাকি এখানেই এ্যারেস্ট করবো? কী করবো বলো মা। তোমার ডিসিশানের ওপরই ছেড়ে দিলাম। তুমি যেভাবে চাইবে, সেভাবেই হবে। তুমি আমার মেয়ের মতো৷ তোমার ওপর কোন ফোর্স করবো না।’
ইফতেখার উদ্দিন বুকের বাঁ পাশে চাপা কষ্টের একটা অনুভূতি টের পান। কারণ ইফতেখার উদ্দিন জানেন মেয়েটা সম্পূর্ণ নির্দোষ। এই নির্দোষ মেয়েটার হাতে হাতকড়া পরাতে হবে৷ ভাবতেই নিজের ভেতর কেমন একটা না না অনুভূতির টের পান ইফতেখার উদ্দিন৷ রিভা কী বলবে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না৷ নিজেকে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মনে হচ্ছে, সবচেয়ে বড় অসহায়। ফাঁসির আসামী হয়ে জেল খাটতে হবে, ভাবতেই ভীষণ রকম কান্না পায় রিভার৷ স্বাভাবিক, সুন্দর জীবনটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। জীবন এতো এতো রহস্যময় কেন?
‘কী করবো মা, বলো?’ ইফতেখার উদ্দিন তাড়া দেন রিভাকে৷
বাসা থেকে যদি তাকে এ্যারেস্ট করা হয় তাহলে তার পরিবারকে ভীষণ রকম খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হতে হবে। তাই পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে রিভা বললো, ‘আমাকে এখানেই এ্যারেস্ট করেন স্যার। বাসায় গিয়ে কইরেন না স্যার৷ কারণ, আমার আম্মার একটা মান সম্মান আছে। আমার মামাদের একটা মান সম্মান আছে৷ বাসা থেকে করলে তারা সামাজিকভাবে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবে৷ তারা কোথাও গিয়ে সম্মান নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না৷ আমার জন্য তাদের কোন ক্ষতি হোক, চাই না স্যার৷ আমাকে এখানেই এ্যারেস্ট করেন স্যার৷’ রিভা কাঁদছে। বাচ্চাদের মতো করে কাঁদছে৷ এই জীবনে এতো বড় শকড আর পায়নি সে। ‘আচ্ছা, মা। তোমার কি সত্যিই কারো সাথে কোন সম্পর্ক আছে?’ রিভা কিছুটা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বললো, ‘না স্যার। আমি শুধু রাফিকেই ভালোবেসেছি। আর কারো সাথে আমার কোন সম্পর্ক ছিল না। এখনও নেই।’
‘সাব্বির ছেলেটার সাথে সত্যিই তোমার কোন রিলেশন নেই?’
‘জ্বি না স্যার।’
‘সাব্বির তো তোমারও ক্লাসমেট ছিল, তাই না৷’
‘জ্বি স্যার। আমরা একই ডিপার্টমেন্টে ছিলাম।’
ওসি সাহেব মনযোগী ভঙ্গিতে কিছু একটা ভাবছেন। রিভা বললো, ‘সাব্বিরের সাথে রিলেশন ছিলো না সত্য। কিন্তু ও আমাকে প্রপোজ করেছিল। প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। এমনকি বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিল। কিন্তু আমি প্রত্যাখান করি।’
‘প্রত্যাখ্যান করেছিলে কেন?’
‘ওর স্বভাব চরিত্র খুব একটা ভালো ছিল না। নেশা করতো৷ আরও বাজে বাজে কাজ করতো বলে শুনেছি। উগ্র স্বভাবের বলা যায়।’
‘এজন্যই প্রত্যাখ্যান করেছিলে?’
‘হ্যা।’
‘আচ্ছা।‘ বলে কিছুক্ষণ থামলেন ইফতেখার সাহেব৷ এরপর কপাল কুচকে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,
‘একটা জিনিস বুঝলাম না। তোমার শাশুড়ি হুট করে তিনমাস পর তোমার নামে মামলা কেন করলো?’
‘জানি না স্যার৷’
‘কিছু তো একটা কারণ আছেই৷ আচ্ছা,
তোমার স্বামীর যে প্রপার্টি আছে, এখন সেগুলোর মালিক কে? মানে বলতে চাচ্ছি, তোমার স্বামী তো এখন মৃত। তার অবর্তমানে তার সম্পদের মালিক কে হবে?’ ‘আমি।’ ‘আচ্ছা আচ্ছা। তোমার শাশুড়ি তো দেখছি খুব বুদ্ধিমান৷ ঝোপ বুঝে কোপ মেরে দিলো। আচ্ছা যাইহোক, এখন আমার কিছু করার নেই মা, তোমাকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হচ্ছি ।’ রিভার দুচোখ বেয়ে অনর্গল ধারায় অশ্রু ঝরছে৷ এই জনমে আর কোনদিন কি হাসতে পারবে রিভা? রিভা ভেবেছিল তাকে দুয়েক দিন গারদে থাকতে হবে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে৷ এরপর প্রমাণ হবে যে সে কিছুই করেনি তারপর তাকে ছেড়ে দেয়া হবে৷ মানুষ যা ভাবে তা কি আর হয় সবসময়? হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় উল্টোটা। রিভার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে৷
তাকে চালান করে দেয়া হয়েছে অন্য থানায়৷ এখানেই শুরু হয় রিভার দুর্বিষহ জীবনের নতুন অধ্যায়। তাকে যখন গারদে ঢোকানো হয় তখন তাকে চেক করা হয়৷ মহিলা পুলিশগুলো এতোটা জঘন্য এতোটা জঘন্য তা কখনো কল্পনাও করেনি সে৷ ঘৃণায় বমি আসে তার৷ শরীর তল্লাশির নামে সারা শরীর এমনভাবে ঘাটে রিভার প্রচণ্ড ঘৃণাবোধ হতে থাকে৷ ছিঃ মহিলা পুলিশরা এতোটা নোংরা, এতোটা জঘন্য কী করে হয়! এমনকি একজন মহিলা পুলিশ এসে তাকে লাঠি দিয়ে আঘাতও করে পায়ে৷ আঘাত করা জায়গাটা ব্যথায় টনটন করছে রিভার৷ কাপড় খুলছে না দেখে লাঠি দিয়ে আঘাত করেছিল৷ কাপড় খুলে উলঙ্গ হয়ে নাকি প্রমাণ করতে হবে যে তার কাছে অস্ত্র টস্র বা গোপনীয় কোন কিছু নেই। ছিঃ মানুষ এতোটাও জঘন্য কীভাবে হয়। তাও আবার নারী পুলিশ হয়ে আরেকজন নারীকে এ কথা কীভাবে বলে!
সামান্য লজ্জাবোধটুকুও কি এদের মধ্যে নেই। এরা দেশের সেবায় নিয়োজিত নাকি দেশের মানুষকে উলঙ্গ করায় নিয়োজিত৷ ভাবলেই গা শিউরে ওঠে রিভার৷ সকাল দশটা বাজে। খাবার দিয়ে যায় দারোগা পুলিশ। লাল রঙা রুটি আর সবজি। রিভা এক টুকরো রুটি আর সবজি মুখে নিলো ঠিকই কিন্তু গিলতে পারলো না৷ এ খাবার মানুষ খায় কী করে! মেডিসিন জাতীয় কিছু একটার গন্ধে বমি চলে আসে রিভার। রুটি, সবজি থেকে ভুরভুর করে গন্ধ বেরুচ্ছে। তিতকুটে গন্ধ। পেট গুলিয়ে বমি আসতে চায়। রুটির একটা টুকরো নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে আর ভাবে এটা কি সত্যিই রুটি! এগুলো মানুষ খায়!
একজনের কাছ থেকে জানতে পারে যে, এই রুটি নাকি গরুর ভুষি ও সাথে সামান্য ময়দা মিশিয়ে তৈরি করা হয়েছে। ছিঃ অবশেষে কপালে এই ছিলো আমার৷ গরুর খাবার খেয়ে বাঁচতে হবে। ভীষণ কান্না পায় রিভার। একজনকে জিজ্ঞেস করেছিল যে, খাবারে এই গন্ধটা কীসের গন্ধ? সে বললো, মেডিসিনের গন্ধ। জৈবিক উত্তেজনা যেন না থাকে সেজন্য খাবারের সাথে এই মেডিসিন মিশিয়ে দেয়া হয়। খাবার তো খেতেই হবে। খেতে বাধ্য। না খেয়ে বাঁচার উপায় কী? এভাবেই কাটতে থাকে রিভার কারাবন্দী গারদ জীবন। চরম দুর্বিষহ এ জীবন। যে জীবন কেউই চায় না। চায়নি রিভাও। তবুও, এই অপ্রত্যাশিত জীবনকে, জীবনের বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে বাঁচতে হবে আরও কিছু দিন, আরও কিছু রাত।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত