ইশিতার এরকম অদ্ভুত আচরণে তার পরিবার খুবই চিন্তিত। দিন দিন তার এ ধরনের পাগলামি বেড়েই চলেছে। এগুলোকে ঠিক পাগলামি বলবে নাকি অস্বাভাবিক এ আচরণকে ইশিতার কোনো মানসিক রোগ বা অসুস্থতা বলে আখ্যায়িত করবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না ইশিতার পরিবার আর তার আশেপাশের মানুষগুলো।
ইশিতার পরিবার এখানকার উচ্চবিত্ত পরিবারের মধ্যে একটি। ইশিতার বয়স বেশি না, ১১ বছর। এবার ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠেছে। তার বাবা খুব নামকরা একটা কোম্পানির ম্যানেজার। খুবই স্বচ্ছল ভাবে দিন যাপন করে তারা। সকাল হলেই স্যান্ডুইচ সহ ইশিতার পছন্দের খাবার গুলো খাবার টেবিলে সাজানো অবস্থায় পায় সে। এর মধ্যে থেকে যেটা ইচ্ছা যতটুকু ইচ্ছা খেয়ে তার টিফিন সহ টিফিন বাটি টি নিয়ে স্কুল ব্যাগে ভরে প্রাইভেট গাড়িতে করে স্কুলে যায় ইশিতা। পরনে থাকে দামি কাপড়ের ইস্ত্রি করা ইউনিফর্ম। হাতে দামি ঘড়ি, খুব সুন্দর পরিপাটি করে ভাল ক্লিপ এর সহিত চুল বাঁধা। স্কুলের সবাই তার খুব কদর করে। আর ক্লাসে তো তার বন্ধুসহ শুভাকাঙ্ক্ষীর অভাব নাই। নিজের ফিটফাটের ব্যাপারেও ভালই সচেতন ইশিতা।
তবে হঠাৎ করে কী এমন হল ইশিতার! ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করছে না সে, চুল আচড়াচ্ছে না নিয়ম করে, চুল গুলো কেমন যেন উষ্কখুষ্ক থাকে। এমনকি স্কুলের ইউনিফর্মও লন্ড্রিতে পাঠাতে দিচ্ছে না সে। বাবা মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে হওয়ায় তার সব আবদারই রাখে সবাই। তাই ইউনিফর্ম লন্ড্রিতে না পাঠানোর জেদ টাও কিছুটা সংকোচ বোধে মেনে নিয়েছিলেন তার মা। কিন্তু মেয়ের এমন অদ্ভুত আবদারে তিনি একটু অবাকই হয়েছিলেন।
তার অবাক হওয়ার পরিধি আরো বেড়ে গেছিল সকালে ইশিতার অনাকাঙ্ক্ষিত ক্রিয়াকলাপ দেখে।
ইশিতার বাবা নিজের কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে তাদের পারিবারিক ব্যাপারেও অত খোঁজ খবর নেওয়ার সময় নাই তার। এজন্য ইশিতার মা ই বাসার সব দেখাশোনা করে, যেমন: বাসার সব কর্মচারীরা ঠিকমত তাদের উপর সপিত দায়িত্ব পালন করছে কিনা আর তার মেয়ে সময়মত সব পাচ্ছে কিনা বা করছে কিনা। তো সেদিন সকালে ইশিতার যে কীর্তি তার মা সহ বাসার সবাইকে এত বিস্মিত করেছিল সেটা হল ইশিতার অপরিপট্যতা দেখে। তার পরনে ছিল ইস্ত্রি না করা কোঁচকানো ইউনিফর্ম, মাথার চুল উষ্কখুষ্ক, হাতের সেই আকর্ষক ঘড়ি টা অনুপস্থিত, কোনোরকম কিছু একটা খেয়ে, কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দ রুটি আর আলুভাজি টিফিন হিসেবে নিয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হচ্ছে।
তার মা তাকে যখন তার প্রতিটা খুঁত ধরিয়ে দিয়ে ঠিক করতে বললে সে বলে, “ঠিকই তো আছে আম্মু, সমস্যা নাই”
ইশিতার মা তো রীতিমত তার আচরনে অবাক। এ কোন ইশিতাকে দেখছেন তিনি! যে ইশিতা প্রতিটা ক্ষেত্রে খুব সেন্সিটিভ, যে কিনা খাওয়া-দাওয়া সাজগোজ এর ব্যাপারে এত সচেতন তার এরূপ আকাশ-পাতাল বদলের কারণ কী হতে পারে তা ভেবেই কুল করতে পারছেন না তিনি। এরপর তো ইশিতা গাড়ি না নিয়েই স্কুলে যাওয়ার জন্য বায়না করলো। কিন্তু, সব বায়না রাখলেও আজকের এই বায়নাতে আপত্তি জানালেন ইশিতার মা। এভাবে রোদের মধ্যে রাস্তায় ছেড়ে দিতে পারেন না তিনি তার এই আদরের মেয়েকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইশিতাকে মায়ের এ সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে গাড়িতেই স্কুলে যাওয়া লাগল।
এভাবে কয়েকদিন চলতে থাকে, ইশিতার মা তাকে তার এ পরিবর্তনের কারণ বারবার জিজ্ঞেস করলেও ইশিতা “কই, কিছুনাতো” এরূপ উত্তর দিয়ে এড়িয়ে চলতে থাকে। কিছুদিন পর ইশিতার মা ইশিতার বাবাকে সব জানানোর পর একদিন তারা প্লান করে ইশিতার অগচরে তার পিছু পিছু স্কুলে গেল, তাদের মেয়ের আচরণের এরূপ আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ খোঁজার উদ্দেশ্যে। দেখা গেল ইশিতা স্কুলে পৌঁছেই ক্লাস রুমে গিয়ে সোজা শেষ বেঞ্চে গিয়ে একটি মেয়ের পাশে বসল। মেয়েটির পরনে পুরানো মলিন কাপড়ের ইউনিফর্ম আর চুলগুলো তার কোনো রকম বাঁধা। দেখে অনেকটা অপরিচ্ছন্ন আর আগোছালো মনে হচ্ছিল।
এটা দেখে ইশিতার বাবারও অনেক রাগ হল আর ইশিতার মা ক্লাসে ঢুকে ইশিতার হাত ধরে সজোরে টেনে বাইরে নিয়ে এসে এই প্রথমবারের মতো ইশিতার গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। ইশিতা কান্না জুড়ে দিল আর ইতোমধ্যে তাদের চারিপাশে শিক্ষার্থীদের ভীড় জমে গেল। এমনকি স্কুলের প্রিন্সিপাল ম্যামও এক পর্যায়ে এসে দাঁড়ালেন।
ইশিতার মা বজ্রকন্ঠে ইশিতাকে বারবার তার এই আচরণের কারণ জানতে চাওয়ার এক পর্যায়ে ইশিতা তার কান্না কিছুটা আয়ত্তে এনে উত্তর দেওয়া শুরু করল, “আম্মু, আজ যার পাশে বসার জন্য তুমি আমাকে মারলে সেই মেয়েটির নাম রুপা। স্কুলের প্রথমদিন থেকে খেয়াল করছি মেয়েটা সবসময় একা একা থাকত, ওর সাথে কেউ কথা বলত না, বসতে নিতো না, কেন জানো?
কারণ, ও অপরিচ্ছন্ন বলে, ও ভাল ভাল খাবার টিফিন আনতো না বলে। আমি যখন স্কুলে প্রবেশ করতাম সবাই আমার চারিপাশে ভীড় করতো কথা বলার জন্য, আমার ভালো মন্দের কদর করতো। আর তখন দেখতাম রুপা দূরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভাবতাম মেয়েটা হয়তো খারাপ, তাই মেয়েটার সাথে কেউ মিশতে চায় না। কিন্তু মেয়েটার ব্যাপারে সবার মন্তব্য শুনে মনে হল মেয়েটা তাদের কাছে এজন্য খারাপ কারণ, তার পরনে ভাল কাপড়ের পোশাক নেই, চুলগুলো আগোছালো, টিফিনে ভাল খাবার আনতে দেখা যায়না তাকে। তখন হঠাৎ মনে হল আম্মু যে, মেয়েটার এসব নেই যেগুলো আমার আছে, এতে মেয়েটার কি কোনো দোষ আছে নাকি আমার সবকিছু আছে এতে আমার কোনো কৃতিত্ব আছে! তাই একদিন মেয়েটার সাথে একাকি কথা বলে জানতে পারলাম যে ওর মা নেই, আমাকে গুছিয়ে দেওয়ার জন্য তো তুমি আছো তাইনা আম্মু, কিন্তু ওকে গুছিয়ে দেওয়ার তো কেউ নাই। আর আমাদের সবকিছু আছে কারণ, আমার বাবার তো অনেক টাকা আছে, কিন্তু ওর বাবা না রিক্সা চালায় জানো আম্মু?
ওদের অত টাকা নাই, তাই ও ভাল পোশাক পায় না, ভাল খাবার পায় না। এভাবে আগোছালো থাকা ছাড়া ওর কি আর কোনো উপায় আছে বলো!? আর আমি তো এতে ওর কোনো দোষও খুঁজে পেলাম না। আর তাছাড়া বিনা দোষে ও যদি এভাবে বাঁচতে পারে, তাহলে আমি কেন পারবনা! তাছাড়া আমি ওর মত করে ওর সাথে মিশলে ওর ও একাকিত্ব টা ঘুচবে। তাই আমি ওর মত করে বাঁচার চেষ্টা করছিলাম, আম্মু। আর আমি এভাবে থাকতে গিয়ে অনেক কিছু শিখেছি, জানো? সেটা হল, আমার এত বন্ধুরা, সহপাঠীরা আমাকে এত গুরুত্ব দিতো আমার সব আছে বলে, আমাকে ভালবাসে বলে না! ওরা আমাকে না, আমার ঐশ্বর্যকে ভালবাসত। এখন আর আমার সাথে কথা বলা তো দূর ওরা আমার দিকে তাকায়ও না, জানো আম্মু..? এখন বুঝতে পারি যে রুপা কোন অন্যায়ে এরকম অবহেলা পেত সবার থেকে! এবার বুঝলে তো আমার এ পরিবর্তনের কারণ?”
উপস্থিত সবাই ছোট্টো ইশিতার মুখে এত বড় দামি দামি সত্যের উপলব্ধি শুনে চমকে গেল, কয়েকটা ম্যাম তো তাদের চোখের পানি আটকাতে ব্যর্থ হলেন! প্রিন্সিপাল ম্যাম বললেন, “আসলে বাচ্চাদের মধ্যে ফেরেশতা থাকলেও তার অবপ্রকাশ ঘটতে খুব একটা দেখা যায় না, ইশিতা তার ব্যতিক্রম একটি মেয়ে।” ইশিতার মা ছলছল চোখে মেয়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন।
গল্পের বিষয়:
গল্প