আপনাদের এলাকায় না কি একটা মঠ আছে? সেটা কোথায়? চোখ বড় করে ইনবক্সে লেখাটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে পাখি । পরান ছেলেটার সাথে তিনমাস হয়েছে পরিচিত হবার, এই তিনমাসে একবারো নক দেয় নি! কোনো এক গল্পের মন্তব্যে তুমুল তর্কবিতর্কের মাধ্যমে পরিচয় দুজনের। এর পর যতবার প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে কথা হয়েছে, পাখিকেই নক দিতে হয়েছে প্রতিবার । রসকষহীন একটা মানুষ। মেয়েদের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলার স্বভাব সব ছেলেদেরই, অন্ততপক্ষে সে এটাই জানতো । ইনবক্সে প্রতিনিয়ত শত শত ছেলের হাই, হ্যালো, কেমন আছো? কথা বলো- এর ভিড়। কিন্তু এ ছেলের সাথে পরিচিত হবার পর ধারনা ভেঙে গেছে।
সেই ছেলে হঠাৎ নক দিয়ে মঠের কথা জানতে চাচ্ছে! ঘটনা কি? আর সে মঠ তো তাদের গ্রামের মধ্যেই পরেছে ।
কাউনিয়া দিয়ে ট্যাপা মধুপুর হয়ে ভাইয়ের হাট এসে যে কাউকেই বললেই দেখিয়ে দিবে মঠ। জবাব দিলো সে।
আমি ট্যাপা মধুপুরে এখন। বলো কি? কেন? আমার আপুর বাড়ি। জানতাম না তো। আপনাকে বলি নি, তাই জানেন না। ও। মঠ দেখতে চাচ্ছো? হুম। কখন আসবে? এখন যাচ্ছি। আসো দেখা হবে। আমিও আসতেছি। আপনি আসবেন মানে? আমাদের বাড়ি মঠের পশ্চিমের গ্রামে। আপনার ইচ্ছা। পাখি তুমি করে সম্বোধন করে, পরান আপনি! এটা স্বাভাবিক , পাখি পরানের চেয়ে বয়সে বড়। তবুও বন্ধুত্বের চেয়েও বেশিকিছু এ সম্পর্কে এই তুমি আমি’র সম্বোধনের পার্থক্যটা অনেক দুরত্ব মনে হয় তার । চেষ্টা করেও তুমি বলাতে পারে নি সে পরানকে।
পরানের হঠাৎ করে নক দেয়ার মানেটা বুঝতে কষ্ট হলো না পাখির । সে যে এসেছে , মূলত ওর সাথে দেখা করবে বলে! কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারবে না বলেই মঠের কথা বলেছে! যদিও এ মঠের কথা তার কাছ হতেই জেনেছে পরান। কিছুদিন আগের ম্যাসেঞ্জারের কথোপকথন মনে পড়লো ওর। আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ করেই ইনবক্সে বলেছিলো পরান। কিছু পিক দিচ্ছি ইনবক্সে। আমাকে দেখো। রিপ্লেই দিয়েছিল সে। না। কেন? ছবির মানুষের চোখ কথা বলে না । ঠোট কেঁপে ওঠে না কথা বলার জন্য। ভুরু ওঠানামা করে না। হেসে উঠলে নাক আর কপাল কুচকে যায় না। ওরেব্বাস! আমি জলজ্যান্ত মানুষটাকে দেখতে চাই। আপনি একটা গোলাপী রঙের শাড়ি পরে আমার সামনে এসে দাড়িয়ে হেঁসে হেঁসে কথা বলবেন। আমি মুগ্ধ হয়ে আপনার কথা শুনবো আর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখবো। যাবো? কোথায়? তোমাদের ওখানে? আমাকে দেখবে মুগ্ধ হয়ে! না।
তাহলে তুমি আসো। আমার মায়ের একটা গোলাপী শাড়ি আছে। এখন না। সময় হলে কোনো একদিন যাবো আপনাকে দেখতে। দেখা হবে আমাদের। সেই সময়টা সম্ভবত এসেছে । ফেসবুকিং আর চাচীকে রান্নার কাজে সহযোগিতা করছিলো সে। সব কিছু ফেলে তড়িঘড়ি করে বের হতে ছুটলো । মেয়ে মানুষ, সাজতে সময় লাগে একটু আধটু! মায়ের শাড়ি খুজতে শুরু করলো। একটা হালকা গোলাপী রঙের শাড়ি আছে, সেটাই খুজছে সে। গোলাপী রঙটা পরানের পছন্দের রঙ। শাড়ি পরতে দেখেই তেড়ে এলো ওর মা। মেয়ের দিকে তাকিয়ে রুঢ় স্বরে জানতে চাইলেন, কই যাস এই অবেলায় শাড়ি পিন্দি? অর্পিতাদের বাড়ি। সন্ধার আগে ফিরবি। আচ্ছা। ওর তাড়া আছে। বের হয়ে আসে বাড়ি হতে দ্রুত। ওর চাচাতো বোন ওর পিছু নেয়। আপু কই যাস। মঠের পাড়। ওখানে ভুত আছে। ধ্যাৎ ভাগ তো। ভুতটুত ওসব কিছু নেই। তাহলে আমিও যাবো।
দুই বোনে মঠের রাস্তায় দাড়িয়ে থাকে। ওদিকে যেতে ইচ্ছে করে না। লোকে নানান কথা বলে। যদিও বিশ্বাস করে না। কালীর পূজো হয় ওদের বাড়ির পেছনে। অমাবস্যাতিথি তে সারা রাত জানালা খুলে রাখে সে ভুত দেখবে বলে। অথচ ভুত দেখা দেয় না। সময় পেরিয়ে যায়। সেকেন্ড , মিনিট, তার পর ঘন্টা। রাস্তার দিকে তাকায় বার বার । উশখুশ করে । যার আশা করে তাকে দেখতে পায় না। ওর বোন ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টিতে প্রশ্ন। মঠ দেখতে যাবে, অথচ রাস্তায় দাড়িয়ে আছে ওরা। ছোট মাথায় বোধগম্য হয় না ব্যাপারটা। ডাটা অন করে ম্যাসেঞ্জারে লগ ইন করে। পরানের আইডি একটিভ নেই। পরানের নম্বরও ওর কাছে নেই। কখনো চায় নি, সারাক্ষণ ম্যাসেঞ্জারে কথা হতো, নম্বরের প্রয়োজন বোধ করে নি। কিন্তু নম্বর না নেয়াটা গাধামি হয়েছে বুঝতে পারে।
চল, বাড়ি যাবো। ছোট বোনকে বলে পাখি। বাধ ভেঙ্গে কান্না আসতে চায় ওর। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কতটা উচ্ছাস আর আশা নিয়ে এসেছিল সে, এটা সে কাউকে বোঝাতে পারবে না। পরান এলো না কেন? না কি আসে নি!
বাড়ি ফিরে আসে। কিছুই ভাল্লাগে না। শাড়ি খুলে ছুড়ে ফেলে দেয়। বিছানায় শুয়ে বালিশ ভেজায়। ম্যাসেঞ্জারে বার বার খোজে , একটিভ দেখলেই যা তা শোনাবে সে ছেলেটাকে। না আইডিটা একটিভ নেই। ফেসবুকে যায়। ক্রল করে, একটার পর একটা গল্প আসে । নানান পোষ্ট আসে । হঠাৎ করে চোখ আটকে যায় একটা ছবিতে। কি বিভৎস দৃশ্য। রাস্তার পাশে একটা মৃতদেহ। একটা হাত পিষ্ট হয়েছে, একটা পা নেই। বুক ফেটে বের হয়ে এসেছে সবকিছু! সেই রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডের সাথে লেপ্টে আছে একটা গোলাপ। রক্তাক্ত, লাল। তবে অক্ষত আছে মুখটা।
মুখটা পরিচিত মনে হয়। চিনতে কষ্ট হয় না। পিষ্ট ক্ষত বিক্ষত শরীর নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। কার জন্য? কাকে দেখার জন্য? তাকে! হঠাৎ করেই অনুভূতি শূন্য হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে।
ছবিটার ক্যাপশনে লেখা, মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা , ট্রাকের নিচে পিষ্ট হয়ে এক অজ্ঞাত যুবকের মৃর্ত্যু।
গল্পের বিষয়:
গল্প