কেউ মনে রাখেনি

কেউ মনে রাখেনি
জহিরের মাথায় হুট করে একটা কথা মনে পড়লো। কথাটা মাথায় আসার সাথে সাথেই অপরাধ সমেত মাথায় হাত দিয়ে একটা চটকানা মারলো সে। বড্ড ভুল হয়ে গেছে। সে খালি হাতে এসেছে। দূর থেকে কারো সাথে দেখা করার জন্য যে কিছু একটা আনা উচিত ছিল, তা এখন তার মাথায় এসে ধরা দিচ্ছে। এমন ভুল প্রায়শই হয় তার। মুদ্রাদোষ! জহির নিজেকে মনে মনে ইচ্ছে মতো করে ঝেড়ে নিচ্ছে। কিছু একটা কেনা দরকার। কিন্তু কী কিনবে? এই শহর যে তার অচেনা। প্রথম এসেছে সে।
জহির যতোটুকু সম্ভব লোকদের কাছ থেকে জেনে নিরলস ভাবে খুঁজে একটা বুকশপের দোকানে ঢুকলো। একটা ডায়েরী কিনবে সে। ঐশির জন্য। কালো রঙের ডায়েরী। ঐশির প্রিয় রঙ কালো। অধিকাংশ মেয়েদের পছন্দের রঙ হয় নীল, লাল, গোলাপি, হলুদ অথবা সাদা। কিন্তু কালো রঙ পছন্দীয় কোনো মেয়েকে সে দেখেনি, শুনেনি। ঐশিই প্রথম কোনো মেয়ে জহিরের কাছে। কালো রঙ কারো পছন্দ হয়? কি একটা অশুভ রঙ। ঐশিকে একদিন জহির এই প্রশ্নটি করেছিল। ঐশির সহসা চাপা হাসি মুখে বলেছিল, ‘সবাই আলোতে বাঁচতে চায়, আলোরঙে জীবনটাকে রাঙাতে চায়। কিন্তু আমি অন্ধকারকে বড্ড ভালোবাসি। অন্ধকারের মাঝে লুকায়িত সৌন্দর্যের মাঝে নিজেকে মেলে ধরি। নিঃশ্বাস নেই। উপলব্ধি করি পৃথিবীর সৌন্দর্যকে। পৃথিবীর সৌন্দর্যরা যে অন্ধকারে বন্দী।’ জহির ঐশির কথায় বিমর্ষ হয়ে পড়ে। উদ্ধীগ্ন কণ্ঠে বলে, ‘অন্ধকারের মাঝে সৌন্দর্য কীভাবে বুঝা যায়?’
‘চোখ বন্ধ করে।’ ঐশি দ্বিধাহীন উত্তর দেয়।
‘চোখ বন্ধ করে বুঝা যায়?’
‘উহু! অনুভব করা যায় শুধু। চোখের মাঝেই তো সৌন্দর্যরা বন্দী থাকে। চোখ বন্ধ করেই তা উপলব্ধি করতে হয়।’
জহির ঢোক গিলে। কি অদ্ভুত সব চিন্তা ভাবনা! ঐশি মেয়েটাই অদ্ভুত। তার কথা, চাঞ্চলতা, অনুভূতি সব।
কিন্তু এই অদ্ভুত মেয়েটার প্রতিই জহিরের যতো দুর্বলতা‌। জহির ভেবে পায় না, এর কারণ কী? ব্যাখা কী? ধরার মাঝে এতো অতৃপ্তির মাঝে মেয়েটার মধ্যেই যেন সে তৃপ্তি খুঁজে পায়। ঐশির সাথে জহিরের পরিচয়টাও অদ্ভুতভাবে। এক অজানা সময়ে। অজানা কোনো কারণে। কিংবা ঈশ্বরের লেখা ইচ্ছার প্রলয়ে। একটা দশ টাকার নোট।
জহির তার বন্ধু আসিফের সাথে একদিন বাসে করে ফিরছিল। বিভিন্ন প্রসঙ্গসমেত আসিফ হুট করে এক কাণ্ড করে বসলো। জহিরের ফোন নাম্বার দশ টাকার নোটে লিখে দিল। আসিফ ছেলেটা কিছুটা পাগলাটে। মাথায় সবসময় উদ্ভট চিন্তা ভাবনা। অন্যরা যা করে না, সেটা সে করতে সবসময় উৎসুক। কিন্তু ভীষণ নরম। নরম মনের মানুষরা কিছুটা পাগলাটে হয়। আপন মানুষদের জন্য। আসিফও তাই। জহির মানা করলো। আসিফ মানলো না। দশ টাকার নোট ভাড়া হিসেবে আসিফ ব্যবহার করলো। গতানুগতিক সাধারণ ঘটনার মতো কিছু ঘটার ছিল। কিন্তু হলো না।
এরপর দুএক সপ্তাহ পর, জহিরের কাছে রাতে একটা ফোনকল আসে। জহির ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলবার আগেই ও পাশ থেকে এক নারী কণ্ঠ বলে উঠে, ‘আপনার কি দশ টাকা হারিয়েছে?’ জহির অবাক হয়। কান থেকে ফোন নামিয়ে চেনার চেষ্টা করে কে ঐ রমনী? জহির চিনতে ব্যর্থ হয়। প্রসঙ্গসমেত দশ টাকা হারানোর যোগসূত্র খুঁজে। আবার ব্যর্থ হয়। কিছু মনে পড়ে না ওর। সপ্রশ্ন উত্তর না পেয়ে ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠ আবার বলে উঠে, ‘চিনতে পারছেন না? আচ্ছা টাকার নাম্বার বলছি, ঘ ছ ৬ ৪ ০!’
জহির ডায়েরী কিনে ফুটপাতে এসে দাঁড়ালো। জহিরের বাম হাতে থাকা ঘড়ির দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখলো দুপুর একটা বেজে সাত মিনিট। ঐশির আসার কথা বারোটা বাজার ত্রিশ মিনিট পর। কিন্তু এখনও আসছে না। এই শহরে কোনো জ্যাম থাকলেও থাকতে পারে। জহিরের জানা নেই। অচেনা শহরের অনেক কিছুই জানে সে। জীবনের বৃত্তান্তে এক প্রতিক্ষিত সুখ দুঃখ মিশ্রিত এক সময়ের নাম অপেক্ষা। সেটা বোধহয় এই মুহূর্তে জহির ক্ষণে ক্ষণে টের পাচ্ছে।
জহিরের ডান হাতে কালো ডায়েরীটা। জহিরের ইচ্ছে ছিল ঐশিকে একটা ডায়েরী দিতে। জহিরের জমা অনুভূতিগুলো ঐশির হাতের লেখায় আঁকতে। ঐশি কবিতা ভালোবাসে। জহির কবিতা লিখতে ভালোবাসে। পত্র পত্রিকায় টুকটাক কবিতাও দেয়। আর এই বিষয়টি জানার পরেই জহিরের সাথে ঐশির সাথে একটা সম্পর্ক হয়। অদ্ভুত এক সম্পর্ক। এই সম্পর্ক নাম নেই। কোনো মিথ্যে গল্প নেই। আদৌও সম্পর্ক কিনা সেটাও প্রশ্ন। এই কাছে আসা দূরে যাওয়ায় আবদ্ধ।
কিন্তু ডায়েরীর ভেতর এই অদ্ভুত সম্পর্কের অনুভূতি গুলো জহির ঐশির হাতের লেখায় ছাপতে চায়। ঐশি চাপা স্বভাবের মানুষ। এইধরণের মানুষ সুখ দুঃখের অনুভূতিগুলো লিখে রাখতে পছন্দ করে। এই উদ্ভট ভাবনা জহিরের কাছে এসেছিল ঐশির থেকে একটা ডায়েরীর কথা শুনে। ডায়রির নাম ‘কেউ মনে রাখেনি’। কি অদ্ভুত নাম! জহির যখন ঐশি থেকে ডায়রির নামটা শুনে, তখনই সে কিছুটা চমকালো। প্রশ্ন করলো ঐশিকে, ‘এটা কেমন নাম?’
ঐশি প্রত্যুত্তরে বলেছিলো, ‘যেমন নামই হোক, এই ডায়রি আমার ফেলা আসা অনূভুতিগুলো বন্দী করার স্থান। আমার অতীতের ভুলে যাওয়া মানুষের স্মৃতিগুলো আমি এখানে লিখে রাখি, যতোটুকু সম্ভব মনে থাকে। অথচ তারা অনেকেই নেই। কেউ হয়তো আমাকে মনে রাখেনি। কেউবা মনে রেখেছে। কিন্তু তারা কেউ মনে রাখুক বা না রাখুক, আমি রাখবো। এই ডায়রীর পাতার ভাঁজে।’
ঐশির কথায় জহিরের মনে ভাবান্তর হলো। সে দ্বিধাগ্রস্ত প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো, ‘কতোজনের স্মৃতি লেখেছো?’ ‘ডায়রীর কথা ডায়রীর মাঝেই থাকুক।’জহির হঠাৎ কী যেন ভাবলো। অস্ফুট স্বরে বললো, ‘আমার নাম আছে?’ ঐশি উত্তর দিল না। জহির বেশ খানিকক্ষণ ফোন কানে হাতে উত্তরের অপেক্ষায় রইলো। ঐশির উত্তর এলো না। ঐশির নিরবতা জহিরের মনে ভাবান্তর সৃষ্টি করলো। সে চাই না ঐ ডায়রীর পাতায় লিপিবদ্ধ হতে। সে হারাতে চায় না। জহির আর ঘাঁটেনি। সপ্রশ্ন নিয়ে ফোনটা রেখে দিয়েছিল। জহিরের ঠোঁট নির্বাক। কিন্তু মনে ভীষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে অস্থিরতায় আচ্ছান্ন। ঐশির সাথে প্রথম দেখা। জহিরের মনে প্রশ্ন জাগছে, জীবনে চাওয়া মূল্যবান মানুষটিকে প্রথম সামনাসামনি দেখার অনুভূতি কেমন? জহির উত্তর খুঁজে পায় না। কিন্তু মনজুড়ে আকুলতা জহিরকে মনেপ্রাণে ক্রমশ অস্থির করে তুলছে। আচ্ছা ঐশির মনে কি এমন কোনো অনুভূতি বয়ে যাচ্ছে?
এই যে জহির ঐশিকে না জানিয়ে কিছুটা কৌতুহল বশত এক উদ্ভ্রান্ত আবেগে তাকে একটিবার দেখার আশায় কতোপথ পাড়ি দিয়ে তাকে দেখতে চলে এসেছে। ঐশিও কি মনে মনে আনন্দ উপলব্ধি করছে? না-কি জহিরের হঠাৎ আগমনে বিচলিত হয়ে, নাকের ডগায় বিরক্ত অনুভূত জমা করেছে? ঐশির সাথে প্রথম দেখায় যদি শুনতে হয়, ‘আপনি হঠাৎ এখানে কি মনে করে? কোনো কাজ বা দরকার ছিল?’ তখন জহির কি উত্তর দিবে? চুপ করে থাকবে হয়তো। যদিও ঐশিকে ফোন করে জহির যখন বললো, ‘আমি তোমাদের এই ইটপাথরের শহরে এসেছি, দেখা করবে?’জহির ভাবলো ঐশি চমকাবে। কিন্তু ফোনের ওপাশে সহসা এক দীর্ঘশ্বাস মিশ্রিত ছোট্ট করে শুধু জহিরের অবস্থান ব্যতীত ঐশি আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। জহিরের এমন আগমনে ঐশির ভেতর কোনো চাঞ্চল্য বুঝতে পারেনি সে। জহির ভেবেছিলাম ঐশি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলবে, ‘হঠাৎ! কোথায়? কীভাবে? কিংবা কেন?’ এসব নানান প্রশ্ন ছুঁড়ে হয়রান করে ছাড়বে তাকে। কিন্তু ঐশির ফেলা দীর্ঘশ্বাস জহিরকে বারবার বিচলিত করছে। ভুল করলো না তো সে?
অথচ জহির অনুভূতির চার দেয়ালে বন্দী। জহিরের মনে প্রিয়তকে শুধু একটিবার দেখার আকুলতা। জহিরের মনে দ্বিধা ছিল, ঐশি ধীরে ধীরে দূরত্ব সৃষ্টি করছে ওর কাছ থেকে। এড়িয়ে চলছে জহিরকে। জহিরের মনে ভয় জাগে। অনুভূতি উন্মাদনা শুরু করে। অথচ দূর প্রান্তের মানুষের মনের ভেতরের অনুভূতিটুকু তার অজানা। জহির জানতে চায়। ঐশির মনে তার অভিব্যক্তির প্রতিফলন সে প্রত্যক্ষ করতে চায়। জহিরের মন ঐশির জন্য যে উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে তা সে ঐশিকে আজও বলেনি। কিন্তু বুঝিয়েছে।
বিভিন্ন কথাবার্তা, চালচলনের মাধ্যমে। ঐশি কি কখনো বুঝেছিলো? হয়তো। হয়তোবা না। জহির চায়ে কাপে চুমুক দিতে দিতে ঐশি থেকে সম্ভবত সাত আট হাত দূরের গাছের দিকে তাকালো। একটা শালিক পাখি বসেছে গাছের ডালে। খোলামেলা এই কফিশপটা বিভিন্ন গাছ দিয়ে সাজানো। ফুলের গাছ, সবুজের গাছ। রঙের গাছ। শালিক পাখিটি একটু আগেই একটা সবুজ গাছের ডালে বসেছে। জহির গাছটার নাম জানে না। তবে চিনে বোধহয়। হয়তো নামটাও শুনেছে, কিন্তু মনে পড়ছে না। শালিক পাখিটি সুন্দর। কিন্তু ঐশির মতো নয়। ছবির থেকেও সুন্দর ঐশি। ‘কাউকে চমকে দিতে ভালোই লাগে। তোমার থেকেই শেখা। যেমন করে প্রথমবার চমকে দিয়েছিলে।’ ঐশি ছোট্ট করে উত্তর দিল, ‘হয়তো!’
জহিরের এতো বড় কথার প্রত্যুত্তরে ঐশির এমন ছোট অভিব্যক্তি জহিরকে কেমন যেন বিচলিত করে তুললো। এই বিচলিত শুধু যে আজ তা নয়, বেশ পুরনো। জহিরের সাথে ঐশির ফোন কিংবা মেসেজে কথা বলার সময়ও ঐশি এমন করে। জহিরের ওর এমন অভিব্যাক্তি দেখে বারবার মনে একটা কথা ভাবান্তর হয়। কিছুটা সন্দেহ জাগে। ঐশি কি জহিরের উপর কোনো কারণে বিরক্ত? এই প্রশ্ন অনেকবার করবে করবে করেও করা হয়নি। যদি ভ্রান্ত ধারণা হয়। অথচ ঐশির মনের অভিব্যক্তি জানা হয়নি। আচ্ছা আজ জিজ্ঞেস করা যায় না? ‘ঐশি, তুমি আমার প্রতি কি একটুও বিরক্ত?’ ঐশির হাতে তার গোল চশমা। নরম রুমাল দিয়ে তা পরিষ্কার করছে। জহিরের এমন প্রশ্ন শুনে ঐশি বিমর্ষ কণ্ঠে বললো, ‘হঠাৎ কেন এমনটি মনে হলো?’ জহির কিছুটা বিব্রত হয়ে বললো, ‘আমি গত কয়েকদিন ধরে ফোন করলে, তুমি ফোন ধরো না। কথা বলতে চাও না। কেমন যেন এড়িয়ে চলার প্রশ্ন উঠে?’
ঐশি জহিরের দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বললো, ‘এইতো ধরতে পেরেছেন। আপনার এসব কথা শুনলেই বিরক্ত লাগে। আপনাকে বলেছি না, আমি আপনার প্রতি কোনো অভিযোগ, অভিমান জমা রাখি না।’ জহির ঐশির এমন প্রত্যুত্তরে বেশ মূর্ছা গেলো। কিছু বলতে গিয়েও দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছিলো যেন। ঐশি মনে হয় ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। জহিরকে বললো, ‘আপনি কখনো পরিবর্তন হবেন না। এতো বেশী বুঝা ভালো নয়। আমার মন খারাপ থাকে প্রায়শই। আর মন খারাপের দিনে যতো আজগুবি উদ্ভট সব কান্ড করি। যেমন করে আপনার সাথে প্রথম কথা হয়েছিল। পরিচিতদের বড়ো অচেনা লাগে। কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। অকারণেই এমনটি করি। আবার অনুতপ্তও হই। আমি চাই না, আমার জন্য কারো মন খারাপ হোক।’
জহিরকে ঘিরে নিস্তব্ধতার বিচরণ ঘটলো। চুপটি করে রইলো সে।অদ্ভুতভাবে ঐশির ভিতরেও তা ছড়িয়ে গেল। জহির ইতস্তত করে বললো, ‘আজ কি মন খারাপ? ভুল সময়ে এসে পড়লাম না তো?’ ঐশির উত্তর এলো, ‘কিছুটা খারাপ। তবে আপনার সাথে সময় কেটে যেন ভালো হয়, সেই দায়িত্ব না হয় আজ আপনার হোক।’ ঐশির এই কথায় অভিব্যক্তি জহিরকে কিছুটা অবাক করলো বোধহয়। ঐশির ঠোঁটের শেষ সীমানায় একটু টুকরো হাসি চিবুকের কাছে এসে যেন বিলীন হয়ে গেল। জহির শুধু অস্ফুট স্বরে বললো, ‘তোমাদের শহরে কোনো নদী আছে? যেখানে বসে এই সুন্দর স্নিগ্ধ দিনটি উপভোগ করা যাবে।’ ‘ভালোবাসতে দেবে তোমায় আমায়?’
জহির খানিকটা ঢোক গিললো। জহির জানে এই কথাটুকু বলার পর কোনো কিছু আর আগের মতো থাকবে না। হয়তো হারিয়ে যাবে। ভেঙে যাবে। নয়তো বদলে যাবে। জহির মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। পাশে ঐশি দাঁড়িয়ে। নদীর ধারে, কিছুটা নিরাবতায় স্থানে। লোকজনের দৃষ্টি নেই ওদের দিকে। সূর্য ডুবছে অদূরে। রক্তাক্ত একটা সন্ধ্যা। ঐশির নিস্তব্ধতা জহিরের ভেতর উন্মাদনা সৃষ্টি করলো। এতো দূর ছুটে আসার আকুলতা জহিরকে চট করে ছন্নছাড়া করে তুললো যেন। আবেগের বশে ঐশির একহাত জড়িয়ে ধরলো সে। চোখে মুখে শুধু একটুখানি ভালোবাসা পাবার তীব্র আকুলতা। আর অপেক্ষা নয়। দু’বছর। এই সময়টুকু কীভাবে জহিরকে ঐশির প্রতি দুর্বল করে তুললো। সেদিন প্রথম কথা বলার পর একটু একটু করে জানা হলো। কথা হলো। অনূভুতি হলো। এক টুকরো স্বপ্ন এসে দানা বাঁধলো জহিরের চোখে।
এখন শুধু ঐশিকে তার প্রয়োজন। ঐশিকে যতোটুকু জেনেছে ততোটুকু সমেত তার প্রয়োজন। বড্ড প্রয়োজন তার। আজকের দিনে স্বপ্নময় সময় কেটেছে তাদের। ঐশির মুখে হাসি ফুটেছে।জহির এই হাসিটুকুর মাঝে অমর হতে চায়। বাঁচতে চায় সবসময়ের জন্য। জহির এগিয়ে চললো ঐশির কাছে। পৃথিবীর কোলাহলের মাঝে তাদের চারদিক অনুভবের ছোঁয়ায় নিস্তব্ধতা। কিছুই শুনতে পাচ্ছে না তারা। ঐশি কী যেন একটা বলতে গিয়ে বলতে পারলো না। জহির আরো এগিয়ে গেল। কাছে। আরো কাছে। ঐশির ভীত চোখের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো, ‘একটু ভালোবাসবে আমায়?’ তারপর এক নারীর চিৎকার। জহিরের বুকে গিয়ে বিধলো। জহির কেঁপে উঠলো। চোখে মুখে ভয়। হারানোর ভয়।
গ্লাস ভাঙার শব্দে জহির হতদন্ত হয়ে পড়লো। টেবিলের পাশে হাত রাখলো। পানি রাখার গ্লাস নেই। পড়ে গেছে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বজ্রপাতের শব্দ শোনা যাচ্ছে। গভীর রাত। অন্ধকার সব। ঐশির কথা মনে পড়লো হঠাৎ। ঐশিও অন্ধকার ভালোবাসতো। এখন জহিরও বাসে। ভালোবাসার মানুষের সবকিছুর উপর ভালোবাসা জন্ম নেয় একসময়। প্রিয় মানুষটার উদ্ভ্রান্ত আবেগ, গরম নিঃশ্বাস আর অপবিত্র স্পর্শটুকুও যেন পবিত্র মনে হয়। জহিরের মনে পড়লো সে রক্তিম সন্ধ্যায় ঐশির ভীত চোখের কথা। ঐশি সেদিন কতোটা ভয় পেয়েছিল। ভয় পেয়েছিল জহিরও। অপমান, ঘৃণা সমেত তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ভয়। কিন্তু ঐশি নির্বাক হয়ে সেখান থেকে একপ্রকার দৌড়ে চলে যায়। কোনো অভিযোগ বিহীন। জহির পেছনে ছুটার সাহস পায়নি। লোকজনের দৃষ্টির সীমানায় সে। শাড়ি পড়া এক তরুণীর অকল্পনীয় প্রত্যাখ্যানে পিষ্ট এক ক্লান্ত যুবক। ডায়েরীটাও দেওয়া হয়নি। অনুভূতি লেখার লেখক যে ফিরিয়ে দিয়েছে তাকে।
ক্ষত বিক্ষত হৃদয় নিয়ে চলে আসলো ঐশির শহর থেকে। দিনরাত এক দ্বিধাবোধে আচ্ছন্ন অপরাধে ভোগলো সে। চেষ্টা করলো ক্ষমা চাইতে ঐশির কাছে। অনুতপ্তের কান্না করতে। অপরাধের কষ্ট বুঝাতে। কিন্তু পারলো না। ঐশির সাথে যোগাযোগের সবকিছু অকেজো হলো। এরপর কেটে গেল এক সপ্তাহ। দুসপ্তাহ। কটা সপ্তাহ অথচ কতো কষ্ট জমছে জহিরের বুকে। একটু কথা বলার আকুতি। ক্ষমা চেয়ে শুধরে নেওয়ার জন্য ঈশ্বরের কাছে বুক চিরে প্রার্থনা। হঠাৎ একদিন রাত্রি আঁধারে ফোন বাজলো। সেই চিরচেনা নাম্বার থেকে ফোন। জহির চমকে উঠে। ফোন ধরার সাথে আবারও হ্যালো বলার আগেই ও পাশ থেকে এক নারীর কণ্ঠ বলে উঠে, ‘আপনি কি কখনো প্রিয় কাউকে হারিয়েছেন?’
জহির প্রশ্ন শুনে বিমূঢ় হয়। কী উত্তর দিবে ভেবে পায় না। জহির কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে, ‘হারাইনি। তবে পাইওনি।’
‘আমার হারিয়েছে। এক প্রিয় মানুষ হারিয়েছিল। চারবছর আগে। এখনও সে আক্ষেপ কুঁড়ে কুঁড়ে মারে আমাকে। চোখে জল নামায়। এক ভয়ানক দুঃখ কষ্টের অনুভূতিতে আজও বন্দী আমি।আমি মুক্তির উপায় খুঁজি। পারছি না আর। জানেন?’ জহিরের বুকটা কেঁপে উঠে। ঐশি কার কথা বলছে? তবে কি ঐশির মনে নেই সে? এতদিন তবে মিথ্যা আশা নিয়ে প্রহর গুনছিলো? জহির আজও বুঝতে পারেনি ঐশি সেদিন দুঃস্বপ্নের মতো ঘটনা ঘটার পরেও কেন দূরে সরে যায়নি। ঐশির এক মানুষ ছিল। ঠকিয়েছে ওকে। প্রচন্ড ঘৃণাবোধ ছিল তার প্রতি। এই বন্দী যন্ত্রণায় ধুঁকে ধুঁকে মরার অনুভূতির প্রতি। কিন্তু কী বা কী কারণে জহির থেকে দূরে সরে যায়নি সেটা অজানা। নারীজাতি রহস্য। ভালোবাসা হারানোর পরেও কি কেউ ভালোবাসা খুঁজে?
কিন্তু ঐশি অদ্ভুত মেয়ে। ঐশি আবার খুঁজলো। জহির আগের থেকে ঐশিকে আরো কাছে পেল। অন্যরকম এক ঐশিকে। মানুষ বদলায়। দুঃখ কষ্টে পুড়লে, প্রয়োজন হারালে। ঐশিও বদলেছে। দেয়ালের ওপারের হৃদপোড়া অনুভূতিগুলো রেখে। এক প্রাপ্তির অনুভবকে সঙ্গী করে বাঁচতে। জহির প্রথমে বুঝেনি। সে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। অসহায় ছিল। ক্লান্ত ছিল। প্রশ্ন ছিল, কেন এই কাছে আসা? ঐশি উত্তর দিয়েছিল। দ্বিতীয় দেখায়। ঐশির আমন্ত্রণে জহির আবার ছুটে গিয়েছিল ঐশির শহরে। জহিরের খুশিতে ভরে উঠলেও ভয় ছিল। অজানাকে জানার ভয়। অবশেষে জহির জানলো। চমকালো ভীষণ। জহির কাঁপা কাঁপা স্বরে বলেছিল, ‘হোয়াট!’
‘হ্যাঁ। ফিলোফোবিয়া। একটা মানসিক রোগ। এই রোগে মানুষ সম্পর্ক জড়াতে ভয় পায়। প্রেম ভালোবাসা ঘৃণা করে।’
‘যেমন?’
‘অতীতে কেউ কষ্ট পেয়েছে খুব, বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছে কিংবা প্রিয় কারোর যদি মৃত্যু হয়েছে। তবে পরবর্তী সময়ে সে কাউকে আর বিশ্বাস করতে পারলো না, ভালোবাসার সম্পর্কে জড়াতে চাইলো না। হারানোর ভয়ে। যন্ত্রণার ভয়ে। আর কখনোই কোনো সম্পর্ক জড়াতে পারলোনা। ইটস কলড ফিলোফোবিয়া।’ জহির নির্বাক দৃষ্টিতে ঐশির দিকে তাকিয়ে থাকে। কী বলবে ভেবে পায় না। জহিরের থেকে ঐশির দূরত্বের কারণ খুঁজে পায় সে। এতো ভালোবাসা, এতো অনুভূতি, অনুভব সব এই ভয়ের কাছে বন্দী। ঐশি আবার বললো, ‘আমাকে ভুলতে পারবেন?’ জহির কিছু বলে না। নির্বাক হয়ে গোধূলি বিকেলের মাঝে নিজেকে চোখ বন্ধ করে অনুভব করলো। এই রমনীর জন্য বুকে জমা অনুভূতিগুলো ফেলে দেওয়া যায়? জহির চোখ খুলে। চোখজুড়ে জল নামে। ঐশির হাত ধরে বলে, ‘এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই?’
‘আছে। কিন্তু জটিল। দীর্ঘমেয়াদি।’
‘কী সেটা?’
‘আরেকটা অদ্ভুত মানসিক রোগের নাম বলি, ক্যাটসারিডাফোবিয়া। সাধারণ হলেও তেলাপোকা ভীতিকে বলে ক্যাটসারিডাফোবিয়া। এই রোগ সারানোর একটা বিকল্প রিস্কি উপায় আছে।’
‘সেটা কী?’
‘এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির গায়ে কিছু তেলাপোকা ছেড়ে দেওয়া।’
‘তাহলে রোগটা সেরে যাবে?’
‘হয়তো। নয়তো অতিরিক্ত ভয়ে মারা যাবে কিংবা আরো অসুস্থ হবে।’
জহির কিছু বুঝতে পারলো না। কিন্তু ঐশির ঠোঁটের কোণে একটুকরো মুচকি হাসি ছড়িয়ে গেল। ঐশি জহিরের কাছে আসলো। জহিরের কানে কানে এসে বললো, ‘আমার যা হারিয়েছে। তা আমি পাবার আশা রাখি না। কিন্তু ভয় হয়। বড্ড ভয়। আপনার জন্যেও সে ভয় এসে গেছে। আপনাকে আমি হারাতে চাই না।’ জহির কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। ঐশির চোখে জল দেখতে পেল সে। স্বচ্ছ অনুভূতির নোনা জল। যে জলটুকু দুহাত দিয়ে মুছে দেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন এই স্নিগ্ধ মেয়েকে আঁকড়ে ধরা। আর হারাতে দেওয়া যাবে না। জহির হারাতেও দেয়নি। সে যত্নে আগলে ধরে রাখলো ঐশিকে। একটা পবিত্র সম্পর্কের মাধ্যমে। এশিকে আপন করে নিল। এক ছাদের নিচে ওদের সংসার হলো। স্বপ্ন হলো। একসাথে বাঁচার ইচ্ছাগল্প হলো। কিন্তু সব স্বপ্ন কিংবা ইচ্ছা কি পূরণ হয়?
এক বৃষ্টি ভেজা রাত। রাত গভীর, বৃষ্টি বাড়ছে। এক অন্ধকার চার দেয়াল। এক নবদম্পতির চোখে জল। এক নারীর গগণবিদারী চিৎকার। ভীতু চোখ। হারানোর ভয়ে পিষ্ট এক ক্লান্ত নারী। নোংরা খেলায় ছিন্নভিন্ন হচ্ছে বুকের মাঝে তিলতিল করে দেখা, গড়া স্বপ্ন। একটা তাজা প্রাণ খুলেখুবে খাচ্ছে শকুনের দল। হাসছে। কাঁদাচ্ছে। রক্ত ঝরাচ্ছে। চোখ দিয়ে। মুখ দিয়ে। উদ্ধৃত যৌবন দিয়ে। তারপর এক সুন্দর সকাল। এক অসহায় স্বামী। ছিন্নভিন্ন এক নারী। শকুনের দল দৃষ্টি কেড়েছে স্বামীর। বউটার প্রাণ। তখনো ওরা দুজন ঘুমাচ্ছে। একজন যন্ত্রণায়, ক্লান্তিতে। আরেকজন চিরস্থায়ী শান্তিতে।
গভীর রাত। বাইরে বৃষ্টি। আজও। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে একটু পর পর। অন্ধকার। বৃষ্টির সৌন্দর্য অন্ধকারে বন্দী। জহির অনুভব করে এই সৌন্দর্যকে। জহিরের হাতে একটা ডায়েরী। ডায়েরীর নাম ‘কেউ মনে রাখেনি’। সে এখন পড়তে পারে না। দৃষ্টি নেই।কিন্তু ডায়রীর গন্ধ অনুভব করতে পারে। ডায়েরী জুড়ে ঐশির ভয়ের গন্ধ। কাছের মানুষদের হারানোর ভয়। ঐশির বড্ড ভীতু ছিল। ডায়েরীতে যেন জহিরের নাম না উঠে সে ভয়ে সবসময় তটাস্থ থাকতো। কিন্তু ঈশ্বর হয়তো তার আশা মেনে নিয়েছিল। জহিরের নাম লেখার আগে ঐশিই চলে গেল। ঈশ্বরের কাছে। জহিরের চোখে জল জমে। এই ভুবনে সবাই কারণে অকারণে চলে যায়।
ঐশি ভাবতো কেউ কাউকে মনে রাখেনা, রাখতে পারে না। চায় না। কিন্তু কেউ মনে রাখে। মনজুড়ে মিশে থেকে, ভালোবাসায়, ঘৃণার মাঝে সন্তর্পণে কেউ থাকে। তাকে ভুলা যায় না। আজীবন বেঁচে থাকে মনে, চোখের জলে। জহির দিগ্বিজয়ী আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে একজনকে আনমনে আঁকে। একটা সাদা কচকচে কাগজে দশ টাকার পেন্সিল দিয়ে অন্ধকার চোখে ঘষাঘষি করে এখন সে। একটা প্রিয় মুখ, কল্পনায় বেঁচে থাকে তার। সে কাগজে তা ছুঁয়ে দেয়। স্বর্গীয় রমনী হয়ে মিশে থাকা কোনো অপার্থিব মায়ার জন্য প্রতি রাত্রি শেষে একটা অস্বচ্ছ, অতৃপ্ত কিংবা অপ্রাপ্তির মিশানো কোনো এক উথাল পাতাল বুকে আছড়ে পড়ার স্বপ্নলোকের স্বপ্নে। কিন্তু! তা ছুঁতে পারা যায় না।
আঁকড়ে জড়িয়ে ধরে, কাছে টেনে, ঘাম শুকে, গরম শুদ্ধ নিঃশ্বাসে তীব্র আর্তনাদ করলেও তা হৃদয় ব্যতীত কোনোকিছু দ্বারা অনুভব করা যায় না। এমন কেন হয়? কেউ জানে না। জহির জানার চেষ্টাও করে না। এক টুকরো মায়া দূরেই থাকুক। অভিমানে, আঁখি জলে, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জোছনা ছায়ায় মিশে থাকুক। জহির গলা ছাড়ে। কান্নায় নয়। হাহাকারে নয়। এক অপার্থিব দুঃখ নিয়ে একটা গান গাইতে। অভিমানী গান। হারানোর গান। বেদনার গান। ‘তুমি নেই, আমি এই, ভালো নেই, ভালো নেই, ভালো তে- তুমি নেই, আছে সব, কিছু নেই, আলো নেই, আলো তে।’
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত