মালিহা আপুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। বিষয়টা নিশ্চিত করেছি আমি। সকাল দশটায় বের হয়েছেন বাসা থেকে তিনি। এখন বাজে সাড়ে দশটা। ত্রিশ মিনিট একুশ সেকেন্ড ধরে তিনি নিখোঁজ। দুই হাত পেছনে নিয়ে মাথা সামনে ঝুঁকে বাসার বারান্দা থেকে কিচেন পর্যন্ত সিরিয়াস ভঙ্গিতে পায়চারি করছি আমি। আব্বুর অফিস নেই আজ। খাওয়ার টেবিলে বসে তিনি বেশ কিছুক্ষণ আমার পায়চারি লক্ষ্য করে কৌতুহলী চোখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আব্বু, জগিং করছো?’
আমি কপালে দুইটা ভাঁজ ফেলে আব্বুর দিকে তাকালাম। এই মানুষটি আদৌ আমার বিষয়ে কখনোই সিরিয়াস নন। মালিহা আপু বাসা থেকে বের হয়েছে ত্রিশ মিনিট, এখনো ফিরেনি। টেনশনে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। ফ্রিজে আইসক্রিম থাকার পরও খেয়ে গলা ভিজাচ্ছিনা। কাষ্ঠ গলায় অস্থির পায়ে পায়চারি করছি। মানুষটির কাছে মনে হচ্ছে জগিং। কান লাল হয়ে এলেও অতিকষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে পায়চারি অব্যাহত রাখলাম। আম্মু কিচেন থেকে প্লেট হাতে নিয়ে টেবিলে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন, ‘মাথা খাচ্ছে সকাল থেকে।’ আব্বু মাথা সামনে ঝুঁকে যাতে আমি না শুনতে পাই, ফিসফিস করল, ‘কী হয়েছে ওর?’ ‘মালিহাকে দাওয়াত করেছে। আজকে রাতে খাওয়ার জন্য। আমার আঁচল টেনে টেনে সকাল থেকেই নাচাচ্ছে পুরো বাসা। আমি পারবোনা অত আয়োজন ফায়োজন করতে।’
শেষ বাক্যটি একটু গলা চড়িয়ে বলা হলো যেন আমার কানে আসে। আমি পায়চারি থামালাম না। আব্বুর পুরাতন ট্র্যাঙ্ক থেকে একটা বই খুঁজে পেয়েছি গত সপ্তাহে। ছেঁড়া ছেঁড়া পুরনো পাতা। অনেক কষ্টে মাঝখান থেকে খানাদানার কার্টুন আঁকা পৃষ্ঠা থেকে খানিকটা পড়েছি। লেখা আছে, ‘যাহার সঙ্গে আজন্ম শতবর্ষী শত্রুতা, তাহারেও এক দুই বেলা নিজ গৃহে খাইতে অনুরোধ জানাইবা। মনোমালিন্য ধুইয়া মুইছা যাইবে। ইহা আমি লিখিয়া দিতেছি।’
এক সপ্তাহ লাগলো কঠিন কঠিন শব্দগুলোর অর্থ বুঝতে। বেশ কৌশল খাঁটিয়ে আব্বু এবং মালিহা আপুর থেকে জেনে নিয়েছি। মালিহা আপু অবশ্য ভ্রুঁ কুঁচকে সন্দেহ করে ফেললেন, ‘আবার চিঠি ফিঠি লিখছিস না তো?’
আমি সজোরে মাথা নাড়ালাম। আমার কি আর সেই বয়স আছে!
আমি খেয়াল করেছি আম্মু মালিহা আপুকে দেখতে পারেনা তেমন। বাসায় যখনই আমি মালিহা আপুর নাম উচ্চারণ করি, তখনই তার মুখে কালো একটা ছায়া এসে প্রকটভাবে উঁকি দেয়। দু’জনের মধ্যে শত্রুতা কিংবা মনোমালিন্য ধুয়ে মুছে ফেলতে এক টেবিলে বসে খাওয়া দরকার। মালিহা আপুকে দাওয়াত করেছি একদম ভোর ভোর। ঘুম ভেঙে উঠেই তিন লাফে দোতলার দরজায়। কলিংবেল চাপতেই মালিহা আপুর আব্বু ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে দরজা খুললেন। তারপর চোখ বুজে হাই দিলেন। চোখ খুলে দেখলেন দরজা ফাঁকা। আমি পাশ কেটে ততক্ষণে মালিহা আপুর রুমে। আপু ঘুমাচ্ছে।
বাম কাত হয়ে। ভোরের দিকে একটু শীত শীত লাগে বোধহয়। কাঁথা গায়ে জড়ানো। খোলা চুলগুলোও ঘুমাচ্ছে।
এলোমেলো শুয়ে। পা এদিকে তো মাথা অন্যদিকে। চুলগুলো আমার স্বভাব পেয়েছে। চট করে কাঁথার একপাশ তুলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম আমি। মুখোমুখি। আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। একটা মানুষ এত সৌন্দর্য কেন হবে! আব্বুর ট্র্যাঙ্কটা আরেকটু ঘাঁটা দরকার। এই বিষয়ে কোনো বই টই থাকতে পারে। আপু চোখ বুজেই টের পেলেন এই ভোর ভোর কে এসে কাঁথা উল্টে শুয়ে পড়তে পারে গায়ের উপর পা তুলে। ঘুমজড়ানো কন্ঠে বললেন, ‘সকাল সকাল কী রে?’ আমি গায়ে পা প্যাঁচিয়ে একহাতে কোমর আঁকড়ে বুকের একদম ভেতরে ঢুকে বললাম, ‘তোমার দাওয়াত আজকে। রাতে আমাদের বাসায় খাবা। বিরাট আয়োজন।’
আপু হেসে ফেললেন। ‘কার বিয়ে?’ আমি জবাব দেওয়ার প্রাণপন চেষ্টা করলাম। ‘কনুই ভাইয়ের বিয়ে।’ দিয়েছি কি-না শেষপর্যন্ত জানিনা, তার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভেঙে উঠে দেখি বিছানা খালি। আপু বাইরে বের হয়েছেন। এবং ত্রিশ মিনিট ধরে তার কোনো খোঁজ নেই। পায়চারি থামিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। নিচে মৃন্ময়ী গাঁদা ফুলের সঙ্গে কথা বলছে হাত নাড়িয়ে। রাগ মাথায় চড়লো ওকে দেখে। সর্বক্ষণ আনন্দে থাকে এই মেয়ে। এত আনন্দ কেন ওর! রেলিং-এর ফাঁকে বাবুটা বের করে একটু হিসু করে দিলে রাগ কমতো বোধহয়। আমি একবার পেছনে তাকালাম। আব্বু আম্মু খাওয়ার টেবিলে। উদাস মনে জিপার খুললাম।
মাঠের চারকোনায় দুই চক্কর দেয়া হয়ে গিয়েছে। বাসায় হুমকি দিয়ে এসেছি, খানার আয়োজন করো। নইলে বিল্ডিং-এর প্রতিটা বাসার দরজার সামনে হিসু করে আসবো। হিসুর পাশে থাকবে একটা চিঠি। চিঠিতে লেখা থাকবে, ‘আমি অমুকের ছেলে তমুক। তৃতীয় তলায় থাকি। আমার আব্বু আম্মু আমাকে আদেশ দিয়াছেন আপনার বাসার দরজায় যেন সামান্য হিসু করি। উনারা আরও বলেছেন, যাহার সঙ্গে আজন্ম শতবর্ষী শত্রুতা, তাহার গৃহের সামনে এক দুই বেলা হিসু করিয়া আসিবা। ইহাতে মনোমালিন্য ধুইয়া মুইছা যাইবে। ইহা আমি লিখিয়া দিতেছি।’ আমি যে হুমকি কথার কথা দিচ্ছিনা এটা প্রমাণ করার জন্য ভুলভাল বানানে চিঠিটা লিখেও ফেলেছি। পুরো চিঠি নয়। শেষের অংশ শুধু। পকেটে গুজা আছে। মালিহা আপু মাঠে নেই।
গলির মাথায় টং দোকানের পাশে কনুই ভাই দাঁড়িয়ে। পায়ে ব্যান্ডেজ। হাতে ক্রাচ। এখনো সেরে উঠেনি। আমায় এগুতে দেখে ক্রাচটা দুই উরুর মাঝখানে রেখে সংবেদনশীল অঙ্গটা আড়াল করে দাঁড়ালো। বলল, ‘হার্মাদ, কাছে আসবিনা তুই। দূরে দূরে.. ছু ছু।’ কোমরে হাত রেখে মন খারাপ করে বললাম, ‘মালিহা আপুকে যেতে দেখেছেন এইদিক দিয়ে?’ কনুই ভাই সজোরে মাথা নাড়ালো। আরেকটু হলেই মাথাটা খুলে পড়ে যেত। কনুই ভাই কিছুই দেখেনি। কনুই ভাই আজ সকাল থেকে অন্ধ। চোখ থাকতেও অন্ধ। কোনো ঝামেলায় জড়াবেনা সে। মাঠ দুই চক্কর শেষে বন্ধু আতিফ জানালো সে দেখেছে মালিহা আপুকে। সকালে। একটা সিএনজি করে যাচ্ছে।
‘সিএনজি কোনটা? গলির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে যে ওটা?’ ‘না না। এই ড্রাইভারের মাথায় টাক।’ সিএনজি করে আপু কলেজ যায় অধিকাংশ সময়। অবশ্যই কলেজ গিয়েছে। আমি হাঁটা দিলাম। কলেজ চিনি। গেইট দিয়ে সিংহের মতোন ঢুকে আশেপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখলাম। দুইজন ঝড়ের বেগে ছুটে এল। মালিহা আপুর বান্ধবী। আমি এক পা পিছুলাম। তারপর দুই হাত দুই গালে বিছিয়ে গাল আড়াল করে দাঁড়ালাম। দুই বান্ধবীকে আমি ভালো করে চিনি। একজন ছোঁ মেরে আমায় কোলে তুলে নিয়ে অদ্ভুত স্বরে বলল, ‘ওমা বাট্টু আসছে রে তুলা তুলা, আমি কামড়াব।’
আমি ঢোক গিলি। বাট্টু, তুলা এইগুলো আমার নাম নয়। আমার কলেজ আসা উচিৎ হয় নাই। অন্য বান্ধবী ছোঁ মেরে কোল থেকে নিয়ে নিলো আমায়। তারপর সেও অদ্ভুত স্বরে অকারণে কথার মধ্যে ‘ল’ লাগিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলল, ‘আমি তো পুরো চমকে গেছি বাবলুলকে দেখে। একদম একবাক্স তুলা। হাত সলাও বাবু গাল থেকে আল্লাহ, এত্ত কিউত! দেখ না, গালে হাত দিয়ে রেখেছে, আমি কামড়াব। হি হি মালি কই?’ আমার নাম বাবুললও নয়। এরা অনর্গল নাম রাখছে আমার। কামড়াকামড়ির আলোচনা করছে। কোল থেকে নেমে আমার এক দৌড়ে গেইট পার হওয়া উচিৎ। যা জানার জেনেছি। মালিহা আপু কলেজে আসেনি। ‘আমায় নামান কোল থেকে।’ ধমক দেয়ার চেষ্টা করলাম। বান্ধবী একজন অন্যজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওমা দেখ… ধমকও দেয় হাবলুলটা। হাত সলাও তুমি আগে। গালে ওপ্পা দেবো। তারপর কোল থেকে নামাব।’ অনিচ্ছাসত্ত্বেও হাত সরালাম। দুই গালে ঝাপিয়ে পড়লো দুই ক্ষুধার্ত যুবতী। কোনরকমে কোল থেকে নেমে দাঁড়ালাম। বান্ধবী সামনে ঝুঁকে বলল, ‘মালিহা কই থাকবে আর। লাইব্রেরী ছাড়া। আল্লাহ কত্ত টেনশন মালির জন্য। গাল লাল কলে ফেলেছে টেনশনে। আমাদের জন্যও টেনশন কলো তো এট্টু। প্লিজ করো।’
আমি ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালাম। টেনশনে নয় মোটেও, গাল লাল হয়েছে ‘ওপ্পা’জনিত আক্রমনে। আমার এখন উচিৎ গেইটের দিকে দৌড় দেওয়া। আমি পা ঘঁষলাম মাটিতে। বান্ধবী এক গাল টেনে কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘বুলবুল তুমি একা একা যাবা কী করে বাসায়? আমরা পৌঁছে দিই?’ দুই বান্ধবী একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে নাম রাখছে এবং গাল টানছে আমার। এক বান্ধবী টানলে অন্য বান্ধবীও টানে। গাল পুনরায় লাল হয়ে উঠার আগে কিংবা নাম বুলবুল থেকে ঘুলঘুলে পৌঁছুনোর আগে পেছন ফিরে দৌড় দিলাম আমি। বান্ধবী পেছন পেছন গেইট পর্যন্ত আসলো। একজন চিৎকারও করল, ‘আস্তে দৌড়াও ঘুলঘুল, হোঁচট খেয়ে পরে পা ভাঙ্গবা।’ লাইব্রেরিতে একবার উঁকি দিলাম। ভেতরে বসে নিরিবিলি পড়ার যথেষ্ট জায়গা আছে। অথচ মালিহা আপু নেই। লাইব্রেরি মামাকে ধমক দিলাম, ‘মালিহা আপু কই?’
‘মালিহা আপু কে?’
‘এক দুই দিন আসে যে এখানে, বই টই পড়ে। অনেক সুন্দর। লম্বা চুল।’
লাইব্রেরি মামার বয়স আব্বুর মতোন। উচ্চতা আব্বুর মতোন। স্বভাবও আব্বুর মতোন। বইয়ের দিকেই তাকিয়ে আছেন, আমি সামনে দাঁড়িয়ে আছি জ্বলজ্যান্ত। মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজনবোধ করছেন না। বরং আমার কথা শুনে ফিক করে হেসে বললেন, ‘এখানে যারা আসে, সবাই সুন্দর।’
‘মালিহা আপুর থেকে সুন্দর কেউ নাই।’
‘আচ্ছা নাই।’
‘আপু আসছিল?’
‘জানিনা বাছা।’
অপমান মাত্রা ছড়াল এইবার। বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টিয়েছেন তিনি। মনোযোগ আকর্ষণ করা জরুরি। ‘এ্যাটেনশন লাইব্রেরির সবাই ঘুরে তাকালো চিৎকার শুনে। লাইব্রেরি মামার চোখে ভয় স্পষ্ট। বইগুলিকে শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গ কলিজা কিডনীর মতোন ভালোবাসেন। এবং আমি আপাতত লাইব্রেরির সবচেয়ে উঁচু টেবিলের উপর ওই কলিজা কিডনী উদ্দেশ্য করে জিপার খুলে দাঁড়িয়ে আছি। যেকোনো মুহূর্তে অবিরল ঝর্ণার সৃষ্টি করতে পারি। কলিজা কিডনী ভিজিয়ে চুবচুবু করে ফেলতে পারি। লাইব্রেরি মামা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘কী করছো বাছা? খবরদার। খবরদার। বই সব ভিজে যাবে।’ ‘মালিহা আপু আসছিল এখানে?’ লাইব্রেরি মামা এক পা এগুতেই আমি নাড়াচাড়া করে বললাম, ‘আমি কিন্তু শুরু করবো, এক দুই তিনও গুনবোনা। সকালে এক গ্লাস দুধ আর এক গ্লাস পানি খেয়েছি। সব ছেড়ে দেব।’ ‘মালিহা আপু আসেনি বাছা। ভগবানের দিব্যি দিয়ে বলছি। আসেনি।’
লাইব্রেরি মামা কাতর চোখে তাকিয়ে। আমি অন্য সবার দিকে তাকালাম। ওরা চেনেও না মালিহা আপুকে। তবু আমার মানবসৃষ্ট ঝর্ণা যাতে চালু না হয়, সমস্বরে বলল, ‘মালিহা আপু আসেনি লাইব্রেরিতে। আমরাও দেখিনি।’
জিপার বন্ধ করলাম। সিএনজি স্টেশন। দুপুর হয়ে এল। এটাই বাকি আর। টং দোকানের বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছে সিএনজি ড্রাইভারগুলো। সবার মাথায় গাদা গাদা চুল। ফর্সা টাক খুঁজে পাচ্ছিনা। অনতিবিলম্বে পেলাম। মাত্রই সিএনজি থামিয়ে বেঞ্চিতে বসেছে টাকমাথা। থু করে একদলা থুতুও ফেলেছে। আমি কাছে গিয়ে মাথায় অঙুলি নির্দেশ করে বললাম, ‘এই রকম চকচকা আর কারো কাছে আছে?’
ফর্সা টাক প্রথমে বুঝলোনা। যখন বুঝল তখন রেগে লাল হয়ে উঠল। টাক নিয়ে মশকারি। আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, ‘তুই কে রে?’ আমি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলাম। তোমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়েছে তুমি প্রশ্নের জবাব দিবা। তা না। মেজাজ দেখালা। সকাল থেকে না খেয়ে আছি এমনিতেই। ক্ষিধে মাথায় চড়ে আছে। এক লাফে কাঁধের উপর চেপে বসলাম। গলা জড়িয়ে ধরলাম একহাতে, অন্যহাতে টক টক মাথায় ঘুষি মারতে লাগলাম। বড় মাথা ছোট হাত হওয়ায় ঘুষিগুলো ঘুষির মতোন না হয়ে টোকার মতোন দেখাল। টাকমাথা আমায় নাড়িয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করল কাঁধ থেকে। আমি চিৎকার করলাম, ‘বল রে শুয়ার, মালিহা আপুকে কোথায় রেখে এসেছিস?’
আশপাশের ড্রাইভারগুলো আচমকা বিস্মিত হয়ে প্রথমদিকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেও একটু পর ছুটে এল। আমায় কাঁধ থেকে টেনে নামানোর চেষ্টা করল দুই জন। আমি চেপে বসে রইলাম। টানাটানির মধ্যে একটা টং দোকান উল্টে গেল রাস্তার পাশে। ভীষণ গন্ডগোল হলো বটে। কে যেন পুলিশও ডেকে আনলো। আমায় নামানোর চেষ্টা করল ওরাও। আমি নামলাম না। কাঁধে চেপে বসে রইলাম। টাকমাথা এখন ভয়ে চুপসে আছে। কথা বললেই ফর্সা মাথায় টোকা পড়ছে। মগজ নড়ে উঠছে। তার চুপ করে থাকাই শ্রেয়। টাকমাথাকে থানায় নিয়ে আসা হলো। মূলত আনা হয়েছে আমাকে। আমি টাকমাথার কাঁধে চেপে বসা। ফলে টাকমাথাকেও আসতে হলো। টেবিলের ওপাশের মোটা পুলিশটা আমায় আদুরে স্বরে বললেন, ‘আংকেল, কাঁধ থেকে নামো উনার। কেন কাঁধে চেপে বসে আছো?’
আমি শক্ত করে গলা প্যাঁচিয়ে ধরে বললাম, ‘মালিহা আপুকে কোথায় রেখে এসেছে এই লোক বলছেনা আমায়। কিডন্যাপিং। আমি নামবোনা।’ পুলিশ ধমক দিলেন টাকমাথাকে, ‘এই, তুমি বলোনা কেন কোথায় রেখে এসেছো?’ ‘আল্লার কসম স্যার, আমি মালিহাপুরে চিনিনা। আর সকাল থেইকা একটাও ভাড়া মারি নাই আইজ। আল্লার কসম স্যার। আমার কান্ধে ব্যথা করে, গুড়া শয়তানডারে নামতে কন।’ পুলিশ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মালিহা আপু কে? আমিও চিনিনা।’আমি উদাস স্বরে বললাম, ‘অনেক সুন্দর। লম্বা চুল।’ ‘আচ্ছা, যাই হোক। উনি কিছুই জানেন না এই ব্যাপারে। তোমার অনেক সুন্দর লম্বা চুলকে আমরা খুঁজবো। তুমি নামো কাঁধ থেকে।’ আমি একটু ইতস্তত করে নামলাম। টাকমাথা ছাড়া পেয়েই ঘাড় সোজা করে দৌড় দিলো। পুলিশ কিছুক্ষণ কোথায় কোথায় যেন ফোন করল। তারপর বলল, ‘অনেক সুন্দর লম্বা চুলের আব্বু আম্মু ভাই বোন কেউ তো কোনো কমপ্লেইন করেনি আংকেল।’
‘উনার আব্বা আম্মা কিডন্যাপিং এর সঙ্গে যুক্ত। আমার আব্বু আম্মুও যুক্ত। আর মালিহা আপুর দুইটা বান্ধবীও যুক্ত।’
এই ফাঁকে ওই দুই ক্ষুধার্ত যুবতীকে ফাঁসানোর চেষ্টা করলাম। মাঝে মাঝে নিজেই নিজের বুদ্ধিতে হতভম্ব হয়ে যাই। জিনিয়াস একটা বটে আমি। পেটমোটা পুলিশ অতিকষ্টে হাসি নিয়ন্ত্রণ করলেন। তারপর উঠে আমায় কোলে নিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, তোমার বাসার ঠিকানা বলো। আমরা তোমায় বাসায় নামিয়ে দিয়েই দ্রুত এ্যাকশনে যাব। কেমন?’
গলির সামনে পুলিশের গাড়ি থামতেই আমি নামলাম দরজা খুলে। অদূরে কনুই ভাই দাঁড়িয়ে ছিল। পুলিশের গাড়ি কিংবা আমায় দেখে কি যেন হলো তার। হুট করেই ক্রাচ ফেলে ব্যান্ডেজ পায়েই দৌড় দিলো। চোরের মন পুলিশ পুলিশ। আমি আঙুল তাক করে বললাম, ‘এই শুয়ারটাও যুক্ত স্যার দৌড় দিলাম পেছন পেছন। গেইটের কাছে আসতেই দেখি মৃন্ময়ী ভেজা গায়ে বসে আছে রাস্তায়। কাঁদছে। চোখের জল নাকের জল গাল গড়িয়ে রাস্তায় টুপ টাপ পড়ে জমে গিয়ে এক অজানা খবিশ ড্রেনের পানে ছুটছে। পাশে মৃন্ময়ীর আব্বু আম্মু দাঁড়িয়ে বুঝাচ্ছে, ‘আম্মা উঠেন প্লিজ। কে পানি ফেলেছে উপর থেকে, আমরা খুঁজে বের করে তার গায়ে এক বালতি পানি ঢালব। প্রমিস।’ মৃন্ময়ী উঠছেনা।
আমি পাশে গিয়ে বললাম, ‘আংকেল, সকালে কনুই ভাইকে দেখেছি আমাদের বাসার ছাদে উঠতেছে পানি নিয়ে। কাঁদিস না রে মৃন্ময়ী, তোর আব্বা কি আর কনুই ভাইয়ের মতোন মাস্তানের গায়ে পানি ঢালতে পারবে। কাঁদিস না।’
বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম আমি। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে শুকনো চোখ কচলে নেওয়ার পর দেখি রাস্তায় মৃন্ময়ীর আব্বা নেই। বাতাসের গতিতে ফুড়ুৎ! মৃন্ময়ীর আম্মা ভেজা স্বরে বলল, ‘কনুই ভাই মাত্রই বাসায় ঢুকেছে দৌড়ে। আমরা ভাবলাম কোনো দরকারে। হারামজাদাকে পিটিয়ে ছাল তুলবো পিঠের। আম্মা, উঠেন এইবার।’ মৃন্ময়ী উঠেছে। নাক টানছে খচ খচ। এতটুকুনও মায়া হচ্ছেনা আমার। এমন একটা খবিশ মেয়ের উপর রোজ পানি ঢালা উচিৎ উপর থেকে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় কনুই ভাইকে টেনে হিঁচড়ে নামাতে দেখলাম মৃন্ময়ীর আব্বাকে। কনুই ভাই হতভম্ব, বিস্মিত এবং একইসাথে বাকরুদ্ধ। শীঘ্রই রাস্তার মাঝখানে তার গোসলের আয়োজন হবে। বিয়ের গোসল। দুই তলার দরজায় কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলেন মালিহা আপুর আব্বু। হাই তুলে চোখ খুলে দেখেন দরজায় কেউ নেই। বিরক্ত হয়ে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করলেন। আমি পাশ কেটে ততক্ষণে রুমে। মালিহা আপু বাসায়। ওয়াশরুমে। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলাম। ওয়াশরুম থেকে ফিরে আমায় দেখে চিৎকার করলেন, ‘কলেজ গিয়েছিলি তুই?’ আমি সজোরে মাথা নাড়ালাম। ‘মোটেও না। কে বলেছে?’
‘ওরা বাসায় ফোন করেছে। তুই একা কি করতে গিয়েছিলি কলেজে?’
‘এমনি ঘুরতে গেলাম।’
মালিহা আপু চোখ পাকালেন। এই দৃষ্টিতে খানিকটাও প্রশ্রয় নেই। আমায় প্রশ্রয় দেয়া যাবেনা। ধমক দিলেন, ‘হারায়ে গেলে কী হতো? আরেকদিন এইরকম একা একা বেশী দুরে গেলে প্রাইভেট বন্ধ।’ কোনো প্রাইভেট টিচার আজ অবধি স্টুডেন্টকে ‘প্রাইভেট বন্ধ’ বলে ধমক দিয়েছে কি-না আমার জানা নেই। এই ধমক আদৌ স্টুডেন্ট ধমক হিসেবে নেয় কি-না আমি জানিনা। আমার ব্যাপার উল্টো। আমি নিই। এবং এটা আমার সবচেয়ে বড় দূর্বলতা। তারচেয়েও বড় দুর্বলতার কথা হলো, এই দুর্বলতা সম্পর্কে মালিহা আপু জেনে ফেলেছেন। আমি চুপচাপ বসে রইলাম বিছানায়। শুধু কলেজেরটা শুনেছে ভাগ্যিস। লাইব্রেরি, সিএনজি, থানা পুলিশ শুনেনি। ঢোক গিলে বললাম, ‘কই গিয়েছিলে তুমি?’ ‘বলবোনা।’ মালিহা আপু ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুলে চিরুনি গাঁথলেন। রাগ করেছেন তিনি। সারা সকাল দুপুর কিছু খাইনি। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে এসেছিল বটে। এখন সব ঠিকঠাক। আমি হাসিমুখে তাকিয়ে রইলাম। বাইরে হট্টগোল শুনা গেল। আপু একবার বারান্দায় উঁকি দিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাইরে কি হচ্ছে রে?’
‘কনুই ভাইকে গোসল করানো হচ্ছে।’
‘ওমা কেন?’
‘সকালে বললাম তো, বিয়ে। বিয়ের গোসল।’
আপু ঠোঁট টিপে রাখলেন। এখন হাসা যাবেনা। হাসি পেলেও হাসা যাবেনা। হাসলে আমি লাই পেয়ে যাব। তারপর আরেকদিন ছুটে যাব কলেজ থেকে আরও দূরে। হারিয়ে যাব। আপু তা হতে দিবে না। আমি পা দুলিয়ে বললাম, ‘সন্ধ্যার আগে চলে আসবা বাসায়। মঙ্গলগ্রহ দেখাবা বলেছিলে। দেরি হলে নিভে যাবে।’ মালিহা আপু জবাব দিলেন না। আপুর আব্বু রুমে উঁকি দিয়ে আনন্দিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বালতি হবে একটা? পানি ঢালব।’ মালিহা আপু অবাক হলেন, ‘কার গায়ে?’ ‘কনুই ভাই। কলিংবেল টিপে দৌড়ে পালিয়ে যায় বেয়াদবটা। আজ সারাদিন জ্বালাইছে।’
রাত। হুমকিতে কাজ হয়েছে। আম্মু প্রায় পাঁচ ছয় পদের রান্না করেছেন। মালিহা আপু সেজেছে আজ দাওয়াত উপলক্ষ্যে। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। কলিংবেল টিপলে দরজা খুলব। হাত ধরে বাসায় ঢুকাব। চেয়ার টেনে বসাব। ইউটিউবে দেখেছি। কলিংবেল বাজতেই দরজা খুলে ধপাস করে পড়লাম। মালিহা আপু শাড়ি পরেছে একটা। কড়া নীল। লম্বা আঁচল, আর চুল খোলা। দরজা খুলতেই সুগন্ধ এসে এক ধাক্কা দিলো, নীল রঙ আরেক ধাক্কা। ফাইনাল ধাক্কা দিলো মালিহা আপু স্বয়ং। তার হাতে একটা বাক্স। চকমকা রঙিন কাগজ দিয়ে মোড়ানো। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম সকাল সকাল কোথায় এবং কেন হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন। চিৎ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে মুখে হাত চেপে খিলখিল শব্দে হাসতে হাসতে কোলে তুলে এনে চেয়ারে বসালেন আমায় তিনি। হাতে টুং টুাং করে উঠল তখন। শীট! চুড়িও পরেছে। আমি ভাত খাব কী করে। গলা দিয়ে নামবে এই ভাত?
ইলিশ রান্না হয়েছে আজ।
আম্মু সব বেড়ে দিচ্ছে পাতে। আব্বু খুব খুশি। আমি খুশি মানে আব্বু খুশি। আম্মুকেও খুশি দেখা গেল। তবে আমার মনে হয় তা ভান। সিরিয়াল দেখে দেখে আম্মু প্রচুর ভান শিখেছেন। আপু খাওয়া শেষে বাসায় ফিরে গেলেই মুখ কালো করে বলবেন, ‘সব ঝামেলা। এখন এইসব আমার ধোয়া মুছা লাগবে। মেহমান তো খেয়ে যাবে এসে। ধোয়া মুছা করে দিয়ে তো যাবেনা। এমন মেহমান আছে জগতে? এক্সিস্ট করে?’ আমি ইলিশ খাইনা। মালিহা আপু ভ্রুঁ কুঁচকে বললেন, ‘ওমা কেন?’ ‘কাঁটা অনেক।’ ‘দাঁড়া আমি বেছে দিই।’ আম্মু ভ্রুঁ উঁচু করে পর্যাপ্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন, ‘খাবেনা ও। আমি কত জোর করি। এক চিমটিও খায়না কখনো।’ মালিহা আপু মাছ থেকে কাঁটা বেছে বললেন, ‘হা কর।’ আমি আম্মুর দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে হা করলাম। আব্বু চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘বাহ। ইলিশ খাচ্ছে তো। এখন থেকে ইলিশ রান্না হলেই মালিহা চলে আসবা বাসায়। কী বলো?’
আমি অতিদ্রুত মাথা দুলিয়ে সহমত হলাম। আব্বুর দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে জোর করে একটা মিষ্টি হাসি টাঙিয়ে আম্মুও সহমত হওয়ার ভান করলেন। আমি হাসি মুখে গিলছি। আপু নিজেও খাচ্ছেন, আমায়ও খাইয়ে দিচ্ছেন। আপুর আঙুলগুলো নরম। হুট করেই টের পেলাম ওই দুইটা বান্ধবী কেন আমায় দেখলেই দুই হাত খাবলা করে ছুটে আসে। মালিহা আপু বললেন, ‘এই তো খাচ্ছে। কই কাঁটা? আছে কোনো কাঁটা?’ পাঙ্গাস মাছ খেলেও আমার গলায় কাঁটা ফুটে। এটা তো ইলিশ। প্রথম হা করার পর পরই একটা কাঁটা গলায় ইতিমধ্যে ফুটে আছে। আমি ঢোক গিলে হাসি মুখে বললাম, ‘একদম নাই। হা মালিহা আপু হা করা মুখে আরেকটু ভাত গুজে দেয়। বাইরে চিৎকার চেঁচামেচি শুনা যায়। কনুই ভাইকে রাস্তায় গোসল করানোর অপরাধে তার সাঙ্গ পাঙ্গ শরীফ গ্যাঙ এসে মৃন্ময়ীর বাগানের এক তৃতীয়াংশ পুনরায় লন্ডভন্ড করে দিয়ে গিয়েছে। আশ্চর্য হলেও সত্য এই ঘটনায় আমার কোনো হাত নেই। চিঠি ব্যবহার করা যেত বটে, করিনি। এখনো পকেটে গুজা আছে।
খাওয়া শেষে, আমি আর মালিহা আপু বারান্দায় এসে দাঁড়াই। দমকা হাওয়ায় আঁচল উড়ে তার। আমি একহাতে ধরে রাখি ওটা। সারাদিন আকাশ মেঘলা ছিল। আপু ঢেঁকুর তুলে বললেন, ‘গিফট খুলবিনা?’আমি মাথা নাড়ালাম। এখন না। তিনি নিজেই একটা আস্ত গিফট। এখন পরিষ্কার হতে শুরু করেছে আকাশ। আপু আমায় আজ মঙ্গল গ্রহ দেখাবেন। লাল গ্রহ। খুব স্পষ্ট দেখা যায় ইদানিং। আঁচলখানা হাতের কব্জিতে প্যাঁচিয়ে মালিহা আপুর কোমরে মাথা ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আমি ঘুম ঘুম চোখে। আমার বাসার বারান্দায় যে উজ্জ্বল নক্ষত্র, ওটা ছাড়া আস্ত ছায়াপথও শূন্য। হাত ধরে টেনে আনি বিছানায় তাকে। তুমি থেকে যাও আজকে।’
বলে জবাবের অপেক্ষা না করে শুয়ে পড়ি। আমার চুলে হাত বুলায় কেউ একজন। প্রতিটি চুলের গোড়ায় যত্ন করে গুজে দেয় নিষ্কলুষ মায়া। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসার আগে আমার বড্ড ইচ্ছে করে আরেকটু জেগে থাকি। গিফট বাক্সটা খুলি। ভেতরে কী আছে দেখি। চোখ ভারী হয়ে আসে। মালিহা আপু বাসায় ফেরত যাওয়ার আগে উপুড় হয়ে কপালে চুমু এঁকে দেন আমার। সকালে ঘুম থেকে উঠে আরেকটা হুমকি দেয়া আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায় এইবার।
বাসায় রোজ ইলিশ রান্না না হলে বিল্ডিং-এর একটা বাসার দরজাও শুষ্ক রাখা যাবেনা। আমি এক কথার মানুষ।
গল্পের বিষয়:
গল্প