কুয়াশা

কুয়াশা
“আচ্ছা নিয়ান,তুমি কি পারতে না মীরার সন্তানের দায়িত্ব নিতে ??এত অর্থ থাকা সত্ত্বেও মীরার সন্তানের জন্য তুমি একটা পয়সাও খরচ করোনি।কেন?কেন মীরা কে যেতে হয়েছে এই বাড়ি ছেড়ে?নিজের সন্তানকে নিয়ে ও কোথায় গেছে??বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে?সেটুকু খোঁজ অবধি রাখোনি তুমি।কেন?”শ্রেয়ার স্বাভাবিক কণ্ঠের এই প্রশ্নগুলো নিয়ানের হৃদপ্রকোষ্ঠে অজানা এক ঝড় তুলছে।
আজ দশ বছর পর হঠাৎ মীরার প্রসঙ্গ কিভাবে উঠলো আর শ্রেয়াকেই বা মীরার কথা কে জানালো?বারান্দার রেলিংয়ে হাত রাখা দুজনের,মাঝে দু ইঞ্চির দূরত্ব।এই দূরত্বটা যে ক্রমশ বেড়ে যাবে তা নিয়ে নিশ্চিত নিয়ান।পা কাঁপছে তার।কুয়াশায় ঢেকে আছে চারপাশ।একটা সময় ছিল যখন নিয়ান উষ্ণতার চাদরে মীরা কে আলিঙ্গন করে এভাবেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে কুয়াশা ঢাকা এই আঁধার রাতকে পর্যবেক্ষণ করত।ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়ল।সম্পর্কে ফাটলটা তখনই ধরল যখন মীরার প্রথম সন্তান হলো।এক ফুটফুটে কন্যা আসলো তাদের কোল জুড়ে।সংসারের বন্ধনে চিরতরে আবদ্ধ হয়ে গেল মীরা।সারাদিন শাড়ি কোমরে গুঁজে সংসারের একাজ সেকাজ সামলাতে ব্যস্ত।
খোঁপা করা চুলগুলো বারবার সামনে এসে বিরক্ত করলেও নিয়ানের আর ইচ্ছে হয়না পেছন থেকে মীরা কে জড়িয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিতে।বিরক্তবোধ করে সে।কোথায় যেন নিজেদের জন্য সময়টুকু হারিয়ে ফেলেছে তারা।দিন কাটে ব্যস্ততায় আর রাত কাটে ছোট্ট কলিটাকে সামলাতে।নিজের মেয়ের প্রতিও একপ্রকার বিরক্তিবোধ চলে আসে নিয়ানের।অবশেষে বিচ্ছেদ।মীরা কখনো ভাবেওনি পাঁচ বছরের ভালোবাসার এমন এক ইতি টানতে পারে নিয়ান।সেদিন মীরা কেঁদেছে,খুব কেঁদেছে কিন্তু আগের মতো নিয়ান তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেনি।শক্ত -পাথর দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল নিয়ান যে আপদটা কখন বিদেয় হবে।একহাতে কলিকে কোলে নিয়ে অন্যহাতে চোখের পানি মুছে বেরিয়ে যায় মীরা।পরিবার কখনোই ছিল না তার।যারা ছিল তারা অসহায় মামা আর লোভী মামী।নিয়ানের সাথে প্রেম করার পর ও বাড়িতে আর ঠায় হয়নি তার।নিয়ান একটাবারও ভাবেনি যে তার সন্তানটার কি হবে।চলে যায় মীরা।একপ্রকার হারিয়ে যায় শীতের কুয়াশার ন্যায় কোন অস্বচ্ছ,অস্পষ্ট জগতে।
অতঃপর শ্রেয়া আসে নিয়ানের জীবনে।শ্রেয়াকে পাওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই নিয়ান উপলব্ধি করে একটা ছোট সদস্যের অভাব।মীরার সংসারী হয়ে ওঠা যেমন তার সহ্য হয়নি,তেমনি বিয়ের পরও শ্রেয়ার প্রেমিকার মতো আবদারগুলো মেনে নিতে পারতো না কিন্তু ছাড়তে পারেনি শ্রেয়াকে।সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা নিয়ানের তখন লাগে যখন জানতে পারে শ্রেয়া কখনো মা হতে পারবেনা।নিজের পাপের শাস্তি যেন হারে হারে টের পেতে থাকে নিয়ান কিন্তু মীরার কথা তো শ্রেয়ার জানার কথা না।শ্রেয়া জানলো কিভাবে?
দু ইঞ্চির ফারাক অতিক্রম করে নিয়ানের হাতে হাত রাখলো শ্রেয়া।ছলছল চোখে বলল,”অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি আমি নিয়ান,অনেক বড় ভুল।স্বার্থপরতার চরমে পৌঁছে গেছি আমি।”শ্রেয়ার কথায় নিয়ানের বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে।”ক….কি করেছো তুমি শ্রেয়া?বলো আমায়।”গলা কাঁপছে নিয়ানের আর শ্রেয়ার চোখমুখ লাল।”ম..মী..মীরা একটা আশ্রমে ছিল।সেখান থেকে কল এসেছিল তোমার ফোনে।”কন্ঠ ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে শ্রেয়ার।”কি বলেছে ওরা??”নিয়ানের দৃষ্টি শ্রেয়ার মুখের দিকে।”মী…মীরা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে।জানতে পারে ওর দুই কিডনিই ড্যামেজড।শেষবারের মতো তোমায় দেখতে চেয়েছিল।আমি জানায়নি তোমায়।স্বার্থপরত হয়ে গেছিলাম।ভেবেছিলাম তুমি মীরা কে ফিরিয়ে আনবে নিজের জীবনে হয়তো তোমার সন্তানের জন্য।বেশি কিছু জানতাম না তখন।অতঃপর আলমারির এক কোণে পেলাম তোমাদের হারিয়ে যাওয়া গল্পটা।”বলেই ছাইরঙা ধুলো জমা ডায়েরিটা নিয়ানের হাতে তুলে দিল শ্রেয়া।
“ডায়েরির কথাগুলো মীরা লিখেছে।তোমাকে নিয়ে মীরার সহস্র অনুভূতি।আবার কল দিলাম ঐ নম্বরে।জানতে পারলাম মীরা কয়েক ঘণ্টা আগেই মারা গেছে।তো তোমার মেয়েকে একটা ফ্যামিলি এডপ্ট করেছে।কে তা জানতে পারিনি।”কথাগুলো বলেই নিয়ানের পায়ের কাছে বসে কাঁদতে লাগল।নিয়ান স্তব্ধ।ছাইরঙা ডায়েরিটায় সযত্নে হাত বুলিয়ে দূরের কুয়াশাভেজা প্রান্তরে নয়নজোড়া স্থির করল।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত