কিপ্টা জামা

কিপ্টা জামা
তিন মাসের মাথায় এসে টিউশনিটা হারাতে হলো। ইন্টারমেডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিল, সপ্তাহে চার দিন রসায়ন আর জীববিজ্ঞান পড়াতাম আর তার জন্য মাসে সাত হাজার টাকা করে পেতাম। যদিও শেষের মাসে এক হাজার টাকা কম পেয়েছিলাম তবুও মফস্বল শহরের হিসেবে একটা টিউশনি থেকে এই পরিমান টাকা পাওয়াটা খুব কম ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। কিন্তু আজ যখন আন্টি এসে বললেন, ‘মা কাল থেকে তুমি আর কষ্ট করে এসো না।’, তখন মুচকি হেসে ‘আচ্ছা’ বললেও এতো ভালো একটা টিউশন হাতছাড়া হয়ে গেলো বলে ভিতরে ভিতরে আফসোসের লেলিহান শিখা ধুকে ধুকে জ্বলে উঠছিলো।
আমি মারিয়া, শহরেরই একটা ভালো কলেজ থেকে রসায়ন বিষয়ে স্নাতক প্রথম বর্ষে আছি। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, বড় কোনো ভাইও নেই। তাই ইন্টার লাইফ থেকেই হালকা পাতলা টিউশন করাতাম। ভালো ছাত্রী হওয়ার সুবাদে অনেকেই আমার কাছে পড়তো। আর তার পরিবর্তে যা পেতাম তাতে পরিবারে তেমন কিছু না দিতে পারলেও নিজের পড়াশোনার খরচ এবং প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলো পূরণ করে নিতে পারতাম। টিউশন জীবনের তিন বছরে যারাই আমার কাছে পড়তে এসেছিলো, আমি নিজের সবটা দিয়েই তাদের বুঝাতাম। কোনো প্রকার ত্রুটি রাখতাম না। আর সেজন্য সকল স্টুডেন্ট আর অভিভাবকদেরও খুব প্রিয় ছিলাম আমি।
ওই টিউশনটাতেও আমার ছাত্রী শুভাকে খুব যত্ন সহকারেই পড়াতাম। শুভা, ছাত্রী হিসেবেও ভালো ছিল। আর প্রথম থেকেই আন্টি আমাকে খুব আদর করতো। শুভার একটা বারো বছরের ছোট ভাইও ছিল। সবার সাথেই খুব সহজেই মিশে গিয়েছিলাম আমি। খুবই আন্তরিক, সহজ সরল আর প্রাণোচ্ছল ছিলেন তারা। আমার করানো টিউশনের মধ্যে সবচেয়ে সেরা টিউশন ছিল এইটা। প্রথম দুই মাস সবই ঠিকঠাক যাচ্ছিলো, কিন্তু বাধ সাধলো তিন মাসের শুরুর দিকে। সেদিনও ঘড়ির কাটায় বিকাল ঠিক ৪.০৩ এ আমি শুভাদের বাসায় এসে হাজির হলাম। দুইবার কলিংবেল টেপার পরও যখন কেউ দরজা খুলছিলো না, আমি দরজায় মোটামুটি জোড়েই কয়েকটা ধাক্কা দিলাম। আবারো কলিংবেল টিপে যখন দরজায় ধাক্কা দিলাম, পেছন থেকে কে যেনো বলে উঠলো,
~আরে আরে, করছেন কি? দরজা কি ভেঙে ফেলবেন নাকি? ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন দিকে তাকাতেই অপরিচিত একটা মুখ দেখতে পেলাম। পরনে ঢিলেঢালা টিশার্ট, শর্টস আর পায়ে দুই বেল্টের স্যান্ডেল। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা আর হাতে একটা বিড়ালছানা নিয়ে এক সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট! এদিকে এতোক্ষণ ডাকাডাকি করেও কেউ দরজা খুলছে না বলে আমার মেজাজও চটে ছিল। তাই ভ্রু কুঁচকে মুখ বাকিয়ে বললাম,
~দরজা ভাঙি নাকি জোড়া লাগাই তাতে আপনার কি?
~আমার কি মানে? এই দরজাটার দাম জানেন? একদম পিউর সেগুন কাঠের দরজা। বজ্জাত মিস্ত্রী একটা টাকাও কম রাখেনি। আর তাছাড়া দিন দুপুরে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকার চেষ্টায় আছেন। আপনি কি চুরি করার ধান্দায় এসেছেন নাকি? প্রথমত এই লোকের মুখে দরজার ইতিহাস শুনে আমি পুরোই আক্কেলগুড়ুম হয়ে ছিলাম। আর তারউপরে যখন আমাকে চোর বললো তখন মাথা পুরোই নষ্ট হয়ে গেলো। একজন শিক্ষককে এখানে চোর বলা হচ্ছে! আর কোনোকিছু বিবেচনা না করে কিছুটা চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,
~হাউ ডেয়ার ইউ কল মি চোর! সিরিয়াসলি? আপনি জানেন আমি কে? ছেলেটা সাথে সাথেই তাল মিলিয়ে উত্তর দিলো,
~এক্সেক্টলি! হু আর ইউ? আগে তো কখনো দেখিনি।
~আগে তো আপনাকেও আমি কখনো দেখিনি। হনুমানের মতো এমন চশমাওয়ালা পাবলিক তো এই বাসার আশেপাশেও দেখিনি। আমি এই বাসার সবার পরিচিত। শুভার হোম টিউটর আমি।
~ওহহ, আই সি! শুভার টিউটর আপনি? লেট মি ইনট্রুডিউস মাইসেলফ। আমি হলাম শাহাদাত আহমেদ। আরেকটু ভালো করে বলতে গেলে আপনার স্টুডেন্ট শুভার বড় ভাই আমি। হঠাৎ করে মাথায় ছোটখাটো একটা বাশ ভেঙে পরার অনুভুতি হলো। কি বলবো বা কি করবো তা ভাবার আগেই ওপাশ থেকে দরজা খোলার শব্দ হলো। মুখভর্তি হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুভা। বললো,
~আপু আপনি এসে গেছেন? এজন্যই বলি ভাইয়ার তো এখনো ছাদ থেকে নামার সময় হয়নি।তাহলে কে আসলো? আমি আসলে বাথরুমে ছিলাম আপু আর আম্মু ঘুমিয়ে। তাই দরজা খুলতে দেরী হলো। আসুন আপু! মর্মবিদ্ধ হরিণীর ন্যায় পরাজিত একটা ভাব নিয়ে কোনোরকম ঘরে ঢুকে শুভার সাথে গিয়ে বসলাম। মাথা তখনো কাজ করছে না। একটা মানুষ কতটুকু গাধা হতে পারে তা ভেবে নিজেকে গালাগাল করা সবেমাত্র শুরু করেছিলাম, তখনই সেই শাহাদাত নামক ভদ্রলোক এসে হাজির। এসে কতক্ষণ চুপচাপ বিছানায় বসে আড়চোখে আমাকে দেখে যাচ্ছিলেন। এদিকে আমি অস্বস্তি বোধ নিয়েও কোনোরকম শুভাকে পড়িয়ে যাচ্ছি। প্রায় আধ ঘন্টা পর শুভাই হঠাৎ লেখার ফাঁকে বলে উঠলো,
-শাহী ভাইয়া, তুই এখানে বসে আছিস কেনো? যা এখান থেকে। আপুর হয়তো আনইজি ফিল হচ্ছে। ভিতরে ভিতরেই চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম, ‘এই না হলে আমার স্টুডেন্ট! নির্লজ্জ লোকটা সেই কখন থেকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে! হনুমান কোথাকার!’ শাহাদাত ওরফে শাহী আস্তে করে একটা শ্বাস ফেলে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,
~এখানে বসে থাকতে আমার কোনো ঠেকা পরেছে নাকি? শুধু দেখছিলাম তোর ‘আপু’ তোকে কেমন পড়ায়?
এবার ছোটখাটো না, বেশ বড়সড় একটা বাশই আমার মাথায় খুব জোরে ভেঙে পড়লো। ভাবলাম কি, আর হলো কি? ওই লোক এখানে বসে তাহলে বোনের পড়ার উপর নজর রাখছিলেন। আর আমি কি না কি ভাবছিলাম। ছি ছি, লজা লজ্জা!
ওইদিন থেকে শুরু হলো আমার টিউশন হাতছাড়া হওয়ার পালা। শুভার ভাই চুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করে চাকরীতেও জয়েন করে ফেলেছে, সাইন্সের সবই হয়তো উনার একদম ভাজা ভাজা। শুভাকে পড়ানোর শুরু থেকে একদম শেষ পর্যন্ত ওখানে বসে থেকে আমার পড়ানোর দক্ষতা যাচাই করতো। মাঝেমাঝে ভুলও ধরতো। একদিন বললো, আমি নাকি সময় খুব কম দেই। তার পরদিন থেকেই এক ঘন্টার জায়গায় দেড় ঘন্টা করে সময় দিতে লাগলাম। এর কিছুদিন পরেই বললেন, পড়ানোর তুলনায় আমার বেতন নাকি বেশি হয়ে গেছে। লজ্জায় পরে ওইদিন আন্টিকে নিজ থেকেই বললাম এক হাজার টাকা করে কম দিতে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একদিন পড়ার ফাঁকেই শুভা আমাকে বলেছিলো,
~আপু, কিছু মনে করবেন না। আসলে আমার ভাইয়া একটু কৃপন স্বভাবের। আমরা সবাই ওকে কিপ্টা বলেই ডাকি। উনার মাথায় সবসময়ই কিভাবে কোনোকিছুতে কম খরচ করা যায় সেই চিন্তা ঘুরতে থাকে। এই কথা শুনে ভিতরে ভিতরে ওই হনুমানকে না জানি কত ধরনের গালি দিয়েছিলাম তা নিজেরই মনে নেই। কিন্তু শুভাকে মুচকি হেসে বলেছিলাম,
~না না সমস্যা নেই। একটু মিতব্যয়ী হওয়াই ভালো।
এতকিছুর পরেও আমার শেষ রক্ষাটা হয়নি। টিউশনটা হারাতেই হলো। সব ওই চশমাপরা হনুমানের জন্য! কিপ্টার কিপ্টা! হাড় কিপ্টা! এতো কিপ্টা কি করে হয় মানুষ! দেখতে একদম সাধাসিধে, স্মার্ট। প্রথম যেদিন দেখেছিলাম, সত্যি স্বীকার করতে গেলে ছোটখাটো ক্রাশও খেয়েছিলাম। কিন্তু এর ভিতরে যে এতো পঁচন ধরে আছে তা কে জানতো!
টিউশনি হারিয়ে প্রথম থেকেই মন মেজাজ ভালো ছিলো না। তার উপর এখন আম্মু এসে যা শুনিয়ে গেলো তাতে মাথার স্নায়ুকোষগুলো এক মুহূর্তের জন্য কাজ করাই বন্ধ করে দিলো। কাল পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে। পছন্দ হয়ে গেলে কালই বিয়ে! ছেলেপক্ষ এতো জাঁকজমক পছন্দ করে না। তাই ছোটখাটো বিয়ের আয়োজনও করবে না। কবুল বলিয়েই বউকে সাথে করে নিয়ে যাবে। মানে কি এসবের! সকল কিপ্টা প্রজাতির মানুষ আমার সামনেই হুট করে কেনো এসে পরছে আমি বুঝছি না। পরদিন সকালেই প্রচন্ড রকম মুড খারাপ নিয়েই পাত্রপক্ষের সামনে বসার জন্য তৈরি হলাম। কিন্তু তার আগেই মা এসে খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন,
~ছেলেপক্ষ তোকে আগে থেকেই পছন্দ করে রেখেছে। তোকে আর ওদের সামনে যেতে হবে না। এখন শুধু আমাদের পছন্দ করলেই হলো। আমার আর তোর বাবার দুজনেরই পছন্দ হয়েছে। একটু পরেই ছেলে তোর রুমে আসবে। ভালো করে দেখে নিস! তুই যা বলবি তাই হবে। ভালো করে অবাকও হতে পারলাম না। তার আগেই পাত্র এসে আমার রুমে হাজির। ঘরে ঢুকেই খকখক করে কেশে নিজের উপস্থিতি আমাকে জানান দিলেন। পিছু ফিরে কোনোরকম তাকালাম। এবার আমার উপরে আর বাশ ভেঙে পরলো না। আমি নিজেই আস্ত একটা বাঁশঝাড়ের উপরে গিয়ে পরে গেলাম। স্বয়ং হনুমান ওরফে শাহী দাঁড়িয়ে আমার সামনে! কিছুক্ষণ নিজের চোখ কচলেই আবার ভালো করে তাকিয়ে যখন তাকেই দেখতে পেলাম তখন নিজ থেকেই মুখ ফুটে বিরক্তির সাথে বেরিয়ে গেলো,
~নাহ।
~নাহ মানে? আমার দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে বললেন তিনি।
~আপনাকে বিয়ে করবো না। এমন হাড়কিপ্টা মানুষকে বিয়ে করলে আমার জীবন বাঁশময় হয়ে উঠবে।
~সত্যি বলতে, এমনিতে সবকিছুতে কিপ্টেমি করলেও তোমাকে ভালোবাসার ব্যাপারে কোনো কিপ্টেমি করবো না। আই প্রমিস!
জানি না কেনো কথাটা ভালো লেগে গেলো। আর তাছাড়া চশমাপরা হনুমানকে আগে থেকেই তো একটু আকটু ভালো লাগতোই! নিমিষেই মুচকি হাসলাম। বিয়ে হয়ে গেলো। আমি বাসর ঘরের খাটে বসে আছি। আগে থেকেই পরিচিত স্টুডেন্টের বাড়ি, এখন আমার শশুরবাড়ি। ভাবতেই গা কেঁপে আসছে। এক পা দুপা করে উনি রুমে ঢুকলেন। আমার সামনে বসতেই আমি কৌতুহুল নিয়ে বলে উঠলাম,
~আচ্ছা, আপনি কি আমাকে প্রথম থেকেই পছন্দ করতেন? এজন্যই বিয়ে করেছেন? উনি হাতের ঘড়িটা খুলতে খুলতে বললেন,
~তা তো পছন্দ করতামই। কিন্তু বিয়ে করেছি অন্য কারনে।
~মানে?
~মানে এমনিতে তো তুমি শুভাকে এক/দেড় ঘন্টা করে সময় দিতে।
এখন সারাদিনই পড়াতে পারবে। আর তার জন্য মাস শেষে ছয় হাজার টাকাও বেঁচে গেলো! লাভের উপর লাভ। বলেই আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে দিলেন উনি। দাঁত কিড়মিড়িয়ে হাতের কাছা থাকা বালিশ দিয়ে উনার দিকে জোরে একটা ঢিল ছুড়ে বললাম,
~কিপ্টার কিপ্টা!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত