মা

মা
পাঞ্জাবিটা বড্ড ঢলছে। বারবার বলেছি আমার পাঞ্জাবি ভালো লাগে না। কিন্তু ও বেছে বেছে আমাকে পাঞ্জাবিই পড়তে বলে।[ফোন বাজবে]
– হ্যালো
– কোথায় তুমি? আসছো?
– হ্যাঁ। তুমি?
– আমি মানে? তুমি না আসলে আমি বেরুবো কেমনে?
– কেন? পায়ে হেটে বেরোও।
– মাথা খারাপ করো না। তাড়াতাড়ি আসো। পনের মিনিটের মধ্যে।
এই বলেই ফোনটা রেখে দিলো কল্প। বেড়িয়ে গেলাম। তবে শার্ট পড়ে। গিয়ে দেখি রমণী দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা কেমন যেন লাল দেখাচ্ছে। আমি কাছে যেতেই রিকশা ডেকে উঠে পড়লো। চুপচাপ বসে রইলো। আমি কিছুই বুঝছি না, দাঁড়িয়ে আছি।
– তোমাকে কি রিকশায় উঠার জন্য পা ধরতে হবে নাকি?
– না না উঠছি।
রিকশা চলছে। আমার কথা বলার সাহস হচ্ছে না ওর সাথে। ওর আবার রাগ বেশী। ঘুড়িয়ে চড় দিয়ে বসলে ইজ্জত যাবে। আর হাতের ব্যাগটা দিয়ে মারলে দাঁত ২-১টাও রিলিজ হয়ে যাবে।
– এটা কি পাঞ্জাবী?
– মানে, পাঞ্জাবীটা ছিঁড়ে গেছে একটু।
– কিইই? আমার দেয়া পাঞ্জাবী তুমি ছিঁড়ে ফেলেছো?
– হ্যাঁ। না মানে ছিঁড়ে গেছে।
– কিভাবে?
– খেয়াল করিনি কবে ছিড়লো। আমার দেয়া পাঞ্জাবী তুমি ঠিক মতো রাখতে পারো না? আমার খেয়াল রাখবে কিভাবে? এই ভালোবাসো তুমি? নামো রিকশা থেকে। এই চাচা দাড় করান রিকশা।
– এমন করছো কেন? রিপু করে নিবো তো। রাগ করে না প্লীজ।
– আদিখ্যেতা দেখাবে না একদম। নামতে বললাম নামবা।
অনিচ্ছা স্বত্বেও নেমে গেলাম। জানি না নামলে সে চীৎকার করা শুরু করে দিবে। সিনক্রিয়েট করবে। থাপ্পর ও দিতে পারে। তাই চুপচাপ নেমে গেলাম। খুব অপমান লাগছে নিজের। সামান্য বিষয়ে এমন করার কারণ অহেতুক। ঘরে গিয়ে চুপচাপ ফোন বন্ধ করে বসে আছি। বন্ধ করার আগে মেসেজ দিলাম যে, ব্রেকআপ। আজ তিনদিন আমার সাথে কল্পর কোন যোগাযোগ নেই। আমি ঘুমুচ্ছিলাম। মায়ের ডাকে ঘুম ভাংলো। উঠে মাথা চুলকাতে চুলকাতে গেলাম ড্রয়িং রুমে। গিয়ে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ি। এ কি কাকে দেখছি! স্বপ্ন দেখছি নাকি? কল্প ওর বান্ধবী নিয়ে হাজির বাসায়। আমার কলিজায় আর পানি নেই। মা বললো, বাবা এরা পরিবার দপ্তর থেকে এসছে। কি নাকি পরিসংখ্যান করবে। কল্পর দিকে তাকিয়ে বলে, এটা আমার ছেলে। মায়ের তখন ফোন আসাতে মা উঠে গেল। আমার তখনো ঘোর কাটছে না। তখনি কল্প উঠে আমার কলার ধরে বলে,
– তোমার ফোন অফ কেন? ব্রেকআপের মেসেজ দিসিলা কেন? নতুন কাউকে পাইছো তাইনা? কে সে? নামটা বলো। কেটে ফেলবো, সাথে তোমাকেও৷ এতোদিন রিলেশন করে কিনা এখন বলে ব্রেকআপ? আমি হা করে ওর ধমক শুনছি। ওর বান্ধবী জোড় করে বসালো ওকে। মাও চলে আসলো তখন। ভাগ্যিস মা দেখে নি। সেই দিনের মতো যা হবার হয়ে গিয়েছে। যাওয়ার আগে বলে গেল বিকেলে যেন দেখা করি আগের জায়গায়। মা কে দেখে মনে হচ্ছে কিছুটা সন্দেহ করছে। খুব রাগ হচ্ছে কল্পের উপর। যতই বলুক রিলেশনে আর ফিরবো না। মরে গেলেও না। বিকেলে গিয়ে দেখি কল্প দাঁড়িয়ে আছে।
– তুমি ব্রেকআপ করবে বললে কেন?
– আগে জবাব দাও যে তুমি আমার বাসায় গিয়েছিলে কেন? মা যদি ধরে ফেলতো?
– আরে আমার শ্বশুরবাড়িতে আমি গেলে ক্ষতি কি?
– শ্বশুরবাড়ির গুষ্টি কিলায়। আর যাবে না কখনো। আমার সাথেও আর কথা বলার দরকার নেই। (চীৎকার করে)
ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার এই রূপের সাথে ও পরিচিত না। আসলে আমি খুব রাগিনা, কিন্তু আজ না রেগে পারলাম না। কল্প আমার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে। ছোট্ট করে বললো,
– সরি আর হবে না এমন। লাভ ইউ।
– থাক তুমি তোমার মতো। লাভ ইউ আর শুনতে চায় না।
হঠাৎ কল্প আমাকে জড়িয়ে ধরলো কিছু বুঝে উঠার আগেই। আমার বাহুতে ওর চোখের পানির অস্তিত্ব অনুভব করছি। অবাক এবার আমার হওয়ার পালা। কারণ আমি কোনদিন ওর চোখে পানি দেখিনি। আমি ভাবতাম ও কাঁদতেই পারে না। নাহ পারলাম না রেগে থাকতে। আমিও জড়িয়ে ধরলাম। আমিও যে ভালোবাসি খুব। কল্পকে যতই দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। হ্যাঁ ওকেই বিয়ে করেছি। তবে আগে যতটা ভয় পেতাম ততটা এখন আর পাইনা। কেন জানি খুব অদ্ভুত শান্ত এখন। মাকেও কি সুন্দর মানিয়ে নিয়েছে। মাঝে মাঝে মায়ের কথা শুনে মনে হয়, ও আমার মায়ের আপন মেয়ে আর আমি ঘর জামাই। কিন্তু আমি যে আমার আগের চঞ্চল কল্পকে চাই। কল্প প্রেগন্যান্ট। আমার আবার কল্পের মতোই প্রাণচঞ্চল সন্তান চাই।
– এই শুভ?
– হুম বলো।
– কি ভাবো?
– তুমি এতো চুপচাপ কিভাবে হলে তাই ভাবছি।
– আরে সামনে আমার বাচ্চা হবে না, এতো দুষ্টুমি করলে চলবে? তবে কিছু দুষ্টুমি আমার বডিতেই রেখে দিলাম যাতে আমার বাচ্চা এসে তোমাদের সবাইকে মাতিয়ে রাখে।
– পাগলি কোথাকার।
– আচ্ছা ছেলে নাকি মেয়ে হবে বলো তো?
– মেয়ে।
– কেন? মেয়েই কেন?
– জানিনা বাট মেয়েই হবে।
– তুমি কি চাও?
– আমি চাই সুস্থ সন্তান। ছেলে হোক মেয়ে হোক সমস্যা নেই। আমাদের মেয়েই হয়েছে। দুষ্টুর সেরা হয়েছে। মেয়েটা আমাদের সবার চোখের মনি। বিশেষ করে আম্মুর। দেখতেও আমার মায়ের মতো হয়েছে। থাকেও সবসময় আমার মায়ের পাশে পাশে, রাতেও। একদিন রাতে,
– বাবাই গুড নাইট, মা গুড নাইট।
– আচ্ছা মামনি গুড নাইট, আর তোমার দাদুকে জ্বালিয়ো না। তোমার দাদুর শরীর খারাপ তো তাই।
– উফফ তোমরা এত্তো কথা বলো না। আমি দাদু থেকে আগে গল্প শুনবো বাবা, যাও তো।
আম্মুকে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে বলে চলে আসলাম। শুক্রবার সকাল বেলা সকালে উঠে কল্পকে জিজ্ঞাসা করলাম মা আর মেয়ে কোথায়? ও জানালো দুজনে এখনো ঘুমুচ্ছে। আমিও আবার শুয়ে পড়ি। পরক্ষনেই আমার ঘুম ভাংলো কল্পের আর্ত-চীৎকারে। কি হলো? দৌড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি মেয়েকে কোলে নিলাম। মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি কল্প মায়ের পা ধরে বসে আছে। মেয়েকে নামিয়ে মায়ের গায়ে হাত দিয়ে দেখি সারা শরীর ঠান্ডা।
মায়ের সামনে বসে আছি। নিথর দেহ। বাসায় অনেক মানুষ। সবার চোখে পানি। আমার মেয়ে এইসব অবাক হয়ে দেখছে, আর মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করছে ওর দাদু উঠছে না কেন? বারবার দৌড়ে যাচ্ছে মায়ের কাছে। বুঝাতেই পারছিলাম না ওকে। মায়ের লাশ যখন নিয়ে যাচ্ছি, তার সে কি কান্না। তার শুধু একটায় কথা, ওর দাদুকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি, কেন নিয়ে যাচ্ছি? কথা বলছে না কেন? দাদুকে এনে দিতে হবে, ও দাদুকে ছাড়া থাকবে না। মেয়েকে আমি সান্ত্বনা দিবো কি, আমি নিজেই তো নিজেকে সামলাতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমার কলিজা থেকে একটা টুকরো কেটে নেয়া হয়েছে। মা চলে গেল আমাদের সবাইকে একা করে।
ডাক্তার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার মেয়ের দিকে তাকালো। এতক্ষণ আমার জীবনের গল্প শুনছিলো ডাক্তার, আর আমার সুখের পর একে একে জীবনের নির্মম আঘাত গুলো। আমার মেয়ে সেইদিনের পর থেকে কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। কথায় বলে না কারো সঙ্গে। ঠিক মতো খাইনা। শুধু কাঁদে আর উদভ্রান্তের মতো তাকিয়ে থাকে। আমি আমার ছোট্ট মাকে হারাতে চাইনা ডক্টর। এক মাকে হারিয়ে আমি ঠিক মতোই চলতে পারিনা। ডাক্তারের হাত ধরে মিনতি করে বললাম, প্লীজ ডক্টর আমার মেয়েকে আগের মতো সুস্থ করে দিন। আমি এক মাকে হারিয়েছি, এই মাকে আমি হারাতে চাইনা। পাশে বসা কল্প মাথা নিচু করে রইলো। ডাক্তার আমার দু’হাত চেপে মাথা নাড়ালো। ডাক্তারের চোখ থেকেও কয়েক ফোটা পানি আমার হাতে এসে পড়লো। হয়তো এই পানি আমার মেয়ের জন্য বা আমার মায়ের জন্য।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত