রাস্তার মোড়ে ফুটপাত থেকে কিছু জিনিস কিনছিলাম।বড় বড় দোকানের চেয়ে ফুটপাতের জিনিসগুলোর দাম কম থাকে।মান যদিও ওতোটা খারাপ নয়।তবুও আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের জন্য এসব দোকানই শ্রেষ্ঠ। পাশে আমার স্বামী দাড়িয়ে আছে, কোলে আমার বছর পাঁচেকের ছেলে।ছেলেটাকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি এবার। খুব দুরন্ত সে।প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যাওয়া আসার কাজ আমাকেই করতে হয়।মাঝে মাঝে আমার স্বামীও আসে।তবে চাকরীর সুবাদে সময় পায়না বেশি।
আমাকেই নিয়মিত আসতে হয়।আমি আবার চাকরী বাকরী করিনা।মাস্টার্স পাস করে স্বামীর সংসার সামলাচ্ছি।
কখনো বাইরে চাকরী করার প্রয়োজনীয়তা মনে উঠেনি। সারাদিন ছেলেকে সামলানো,ঘর সংসার গোছানো নিয়েই আমার দিন কাটে। কেনাকাটা শেষে পিছু হটতেই আমার চোখ আটকে যায়।যদিও আহামরি কোন ঘটনা না তবুও আমার চোখে বাধে। এক মহিলা,খুবই সুদর্শনা এক মহিলা! আমাদের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছেন। চোখের পলক পর্যন্ত পরছেনা তার। আমি কপাল কুঁচকে তীক্ষ্ণ চোখে সেদিকে তাকালাম। কেন যেন মনে হলো মহিলাটা আমার দিকে নয়,আমার স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে। আমি দুজনার দিকে বারকয়েক চোখ ফিরালাম। আমার স্বামী মানে রাহাতের সেসব দিকে হুশ নেই।সে ছেলেকে নিয়ে ব্যাস্ত। আমি তাড়াহুড়ো করে কিছু কেনাকাটা করে রাহাতের হাত ধরে হাটা শুরু করলাম।রাহাত হকচকিয়ে উঠলো।
—আরে,এভাবে টানছো কেনো লিয়া? আমি কথা বললাম না।কেন যেনো মহিলাটির দৃষ্টি আমার সহ্য হচ্ছেনা।যদিও কোন স্ত্রী নিজের স্বামীর দিকে অন্য মহিলার এমন দৃষ্টি সহ্য করতে পারেনা। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। বাড়ি ফিরে আমি রাহাতকে কাঠকাঠ গলায় জানিয়ে দিলাম,
—এখন থেকে বাবুর স্কুলে যাওয়া আসার কাজ শুধু আমি করবো,তুমি না। রাহাত অবাক হয়ে বললো,
—কেনো?তুমিই না আমায় জোর করো সবসময় যাওয়ার জন্য?তবে আজ কি হলো?
—জানিনা।তুমি যাবা না ব্যাস।
—আচ্ছা ঠিকআছে যাবোনা।
আমি চুপ হয়ে গেলাম।রাহাত মানুষটা খুবই সাধাসিধা ধরনের।আমার মুখের ওপর কখনো কথাও বলেনা। তবুও আজ কেন যেনো তার উপর সন্দেহ উঁকি দিতে শুরু করলো।আমি মনকে বারবার প্রবোধ দিলাম।আমার রাহাত কক্ষনো এমন না। তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিন মহিলাটি স্কুলের সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখি। আমাদের দেখলেই একধ্যানে হা করে তাকিয়ে থাকে। আমার অস্বস্তি হয় খুব।বাবুকে নিয়ে আমি একপ্রকার দৌড়ে সে পথটুকু অতিক্রম করি। ভেতরে একটা কথা বারবার ঘুরে ফেরে। মহিলাটি নিশ্চয়ই রাহাতের প্রেমিকা।নয়তো আমাদের দিকে ওভাবে তাকায় কেনো?তাছাড়া প্রথমদিন রাহাতের দিকেও তো তাকিয়েছিলো। তবে কি সে আমার সংসার ভাঙতে চায়?আমার থেকে রাহাতকে কেড়ে নিতে চায়? কিন্তু রাহাত কি ওমন মানুষ?সে তো খুব ভালবাসে আমায়।এরেন্জ ম্যারেজ হলেও আমাদের ভেতর কখনোই ভালবাসার অভাব হয়নি। পরক্ষনেই মনের অন্য একটা সত্তা ফিসফিস করে,
—তুই জানিসনা অতিরিক্ত চালাকরা নিজেদের চালাকি ঢাকতে সরল সেজে বসে থাকে? আমি সাথে সাথে মাথা দুলাই।কথাটা সত্যিই তো! এ নিয়ে রাহাতের সাথে আমি ঝামেলাও করি। কারনে অকারনে ঝগড়া বাধাই। ও কিছু উত্তর দিতে গেলেই বলি,
—এখন তো আমাকে ভাল লাগবে না তাইনা?নতুন কাউকে পেলে পুরনো মানুষটাকে ভালো লাগে নাকি? রাহাত অবুঝের মতো তাকিয়ে থাকে। আমি নরম হইনা। ছেলেটা দেখতে সহজ সরল হলেও মনে যে অন্য কথা চলে। বাবুর স্কুল পরিবর্তন করার জন্য উঠেপড়ে লাগি আমি।রাহাত বাঁধা দিতে চায়।বছরের মাঝামাঝি সময়ে স্কুল পরিবর্তন করলে পড়াশোনায় ক্ষতি হতে পারে। আমি আমলে নেইনা।
ওই মহিলা স্কুলের সামনে প্রতিদিন দাড়িয়ে থাকে,স্কুল পরিবর্তন করলে আর আমাদের খুজে পাবেনা সে। তবে আমাকে ভুল প্রমানিত করে পরেরদিনই বাড়ি থেকে বেরোনোর পথের মোড়টাতে মহিলাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখি। আমার চোখ কপালে ওঠে। আমার বাড়ির পরিচয়টাও সে জানে?কিভাবে?নিশ্চয় রাহাত দিয়েছে? মহিলা দেখতেও বেশ সুন্দরী! আমার মতো না।আমি দেখতে মোটামুটি ধরনের। অতিরিক্ত খারাপ ও না ভালো ও না। রাহাত বলতো আমি ওর চোখে সেরা সুন্দরী। কিন্তু এখন মনে হয় সে কথা ভুল ছিলো।হয়তো আমাকে পটানোর জন্য বলেছিলো। আসল সুন্দরী চোখে পরলে নকল সুন্দরকে কি আর মনে ধরে?, বাবুকে নিয়ে নতুন স্কুলে যাওয়ার পথে আমি মহিলার পাশ ঘেসে যাই।ভাবি আজ কিছু বলবোই তাকে। তবে আমাকে কিছুই বলতে হয়না। তার কাছাকাছি আসতেই সে বলে ওঠে,
—কোথায় যাচ্ছেন আপনারা? আমি কপাল কুঁচকাই। কোথায় যাচ্ছি না যাচ্ছি সেকথা ওনাকে কেনো বলবো?আমার মনের ভাবাগোতি হয়তো বুঝতে পারেন তিনি। একটু ইতস্তত করে বলেন,
—না মানে বাচ্চাটার আগের স্কুলে যান না এখন?হঠাৎ বদলি করলেন কেনো? আমি ভদ্রতাসূচক হাসি দেই।পাবলিক প্লেসে উল্টো পাল্টা কিছু বলতে ইচ্ছে করেনা আমার।
—আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না? মহিলাটি মাথা নিচু করেন। বলেন,
–আমি কিন্তু আপনাদের চিনি।প্রায় প্রতিদিনই দেখি আপনাদের। ওইযে ঐ রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে থাকি আমি। আচ্ছা, আপনার বাচ্চাটার নাম কি?
—আয়ান। সে বাবুর গাল টেনে দেয় আলতো করে।এতো আলতো করে ছোয় যেনো একটু বেশি জোরে ধরলেই ব্যাথা পাবে। ছোয়ার সময় তার হাত কাপে। আমি স্পষ্ট দেখি।
—আপনার বাচ্চাটা খুব সুন্দর জানেন?খুব সুন্দর! কথা বলার সময় তার গলা কেপে ওঠে। সে কিছুক্ষণ চুপ থাকে। আমিও চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে থাকি। মহিলাটি ফট করে আমার হাতে একটা কাগজ গুজে দেয়।আমি হতবাক হই।অচেনা অজানা একজন হঠাৎ আমার হাতে কিসের কাগজ দিচ্ছে? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই। সে মুচকি হাসে। বলে,
—আপনি খুব ভাগ্যবতী আপা,খুব ভাগ্যবতী!আপনাকে দেখলে আমার এতো হিংসে হয় কেনো বলুনতো?
আমি তাজ্জব হয়ে যাই।বলে কি মহিলা?আমাকে দেখলে তার হিংসে হয়?কেনো?আমার সুখের সংসার দেখে?
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তিনি গটগট হেটে চলে যান।যে মহিলা আমাদের দেখার জন্য রাস্তার মোড়ে দৈনিক দাড়িয়ে থাকেন,সে চলে যাওয়ার সময় একবারও পিছে ফিরে তাকালেন না। আমি হা করে তাকিয়ে থাকি। পরক্ষনেই মেজাজ চড়া হয়। মনে হয় নিশ্চয়ই সে কাগজটায় লিখেছে সে রাহাতকে কতো ভালবাসে,আমি যেনো তাকে ছেড়ে দেই। উহু,এটা কক্ষনো হবেনা।তারচেয়ে বরং আমি এই চিঠিটা পড়বোই না। মনে মনে নানা জল্পনা কল্পনা করে বাড়ি ফিরি। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তারপর থেকে মহিলাকে আর কক্ষনো আমি দেখিনি। আমি বিষয়টা বলবোনা বলবোনা করেও রাহাতকে জানাই।সে আমলে নেয়না। লোকটা বরাবরই খামখেয়ালহীন। জোন বিষয়েই তার আগ্রহ নেই।
এমন মানুষকে বিনা কারনে সন্দেহ করায় আমার মনে অনুসচনা হয়।নিজেকে বারংবার ধিক্কার জানাই। তার অনেকদিন পরের কথা।বেশ কয়েকবছর পেরিয়ে গেছে। চিঠির কথা তো দুর মহিলার কথাও ভুলে গেছি প্রায়। ছেলে এখন কলেজে পরে। আগের চেয়েও ব্যস্ততা বেশি বেড়েছে আমার। ছেলে কলেজে যাওয়ার পর নিজের আলমারি গোছাতে বসে গেলাম আমি। রাহাত বড্ড অগোছালো। আলমারিতে কিছু খুজতে গেলে বারোটা বাজিয়ে ফেলে। শাড়ি কাপড় একে একে ঠিক করতে করতে হঠাৎ একটা সাদা কাগজ নিচে পরে। আমি কৌতুহলী হয়ে তুলে নেই। ফেলে দিতে গিয়েও কি মনে করে খুলে বসি। কাগজে লেখা, আপনাকে কি বলে সম্মোধন করবো বুঝতে পারছিনা।তবে আপা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। আচ্ছা, আপনাকে কি আমি আপা বলে ডাকতে পারি?আপনি কি আমায় বোন হিসেবে মানবেন?আপনি তো আমায় পছন্দই করেননা। কি অবাক হচ্ছেন?
আমি কিন্তু ঠিক জানি,আপনি আমায় অপছন্দ করেন,এবং সেটা খুব আকারে। আমি আপনাকে খুব বিরক্ত করি তাইনা?খুব অস্বস্তি হয়? কিন্তু কি করবো বলুন?আমি যে নিরুপায়। ছেলেটাকে না দেখতে পেলে আমার তো ঘুমই হয়না।কেমন দম আটকে আসে। আপনার ছেলেটা খুব মিষ্টি জানেন? একেবারে আমার বাচ্চাটা মতো। আমার বাচ্চা! হুবহু আপনার বাচ্চাটার মতো দেখতে। সেই একই নাক,এক মুখ,চোখ!আচ্ছা দুটো আলাদা মানুষের এতো মিল হওয়া কি অদৌ সম্ভব? আপনি কি ভাবছেন আমার ছেলে রেখে আমি প্রতিদিন আপনার ছেলেকে কেনো দেখতে আসি? আসলে আমার ছেলেটা এ পৃথিবীতে নেই। বছর চারেক বয়সে মারা যায় সে। আপনার ছেলেটাকে দেখলেই আমার মনে হয় আমার নিচের বাচ্চাটাকে দেখছি। কি যে ভালো লাগে তখন আমার!
তবে ভেবেছি আপনাকে আর বিরক্ত করবোনা।আমার জন্য আপনার বাচ্চার স্কুল পর্যন্ত পরিবর্তন করতে হলো।
আমি সত্যিই দুঃখিত। আর কখনো আমার জন্য কোনরকম কোন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আপনাকে পরতে হবেনা। তবে মাঝে মাঝে ছেলেটাকে আমায় কি এক নজর দেখতে দেবেন?আমি শুধু একনজর করে দেখবো। শুধু একটা নজর! আমি চিঠিটা পরে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। ভেতরে এক অজানা কষ্টরা দামামা বাজিয়ে চলেছে। চিঠির পেছনে একটা ঠিকানা লেখা।আমি ঝাপসা চোখে ঠিকানাটায় চোখ বুলালাম। বাইরে কলিং বেল বেজে উঠলো। কাজের মেয়েটা হয়তো দরজা খুলে দিয়েছে। ছেলেটা দৌড়ে আমার ঘরে ঢুকলো। বাইরে থেকে এসেই আমার রুমে আসা তার অভ্যাস। আমাকে ফ্লোরে বসে থাকতে দেখে সে উতলা হয়ে উঠলো।বললো,
—কি হয়েছে মা?এভাবে নিচে বসে আছো কেনো?খারাপ লাগছে তোমার?শরীর ঠিক আছে? আমি হাতে থাকা কাগজটা তার সামনে মেলে ধরলাম। সে অবাক হয়ে বললো,
—এটা কি?
—ঠিকানা!
—কার ঠিকানা?
—তোর একটা মায়ের,যে মা তোকে একনজর দেখার জন্য দিনের পর দিন রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাস্তায় দাড়িয়ে থাকতে পারে।সেই মায়ের ঠিকানা!
গল্পের বিষয়:
গল্প