আশরাফ উদ্দিন সরকার দেখে ফেললেন, তাঁর মেয়ে পুষ্প পাশের বাড়ির মুকুলের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। পুষ্প’র বিয়ে আর মাত্র চারদিন পরে। অথচ এখন অন্য একটি ছেলের সাথে রাতের অন্ধকারে তাঁর কিসের কথা? আশরাফ উদ্দিন দাঁতে কিড়মিড় করে ঘরে গিয়ে আমেনা বেগমকে বললেন, “দুইদিন পরে তোমার মাইয়ার বিয়া। এহন এই রাইতের বেলা মুকুলের লগে তাঁর কিয়ের কথা? চিন্তা করছ তুমি বিষয়ডা?” আমেনা বেগম ভয়ে রীতিমত কাঁপতে লাগলেন। নিচু স্বরে বললেন, “আমি এহনি ডাইকা আনতাছি।” পুষ্প ততক্ষণে তাঁর বাবার গলার স্বর শুনে মুকুলকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তুমি তাড়াতাড়ি যাও। বাবা টের পাইয়া গেছে।”
মুকুল দ্রুত অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। মেহেদী গাছের পাতার ফাকে কয়েকটা জোনাকি ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পুষ্প আর এক মূহূর্ত দেরি না করে এক প্রকার দৌড়ে ঘরে যেতে গিয়ে দেখে তাঁর মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমেনা বেগমও রাগে ফুঁসতে লাগলেন। দরজা থেকে উঠানে নেমে পুষ্প’র চুলে ধরে বললেন,”কই গেছিলি? রাইতের বেলা তোর বাইরে কী?” পুষ্প চুলে টান খেয়ে ব্যথায় কুকড়ে উঠে উঃ করে উঠলো। তারপর বলল, “মা, তাসলিমাদের ঘরে গেছিলাম।” আমেনা বেগম বাম হাতে চুল ধরে ডান হাতে মেয়ের গালে চড় বসিয়ে দিলেন। গাল ধরে টেনে বললেন, “তোর বাবা তাইলে ভুল দেখছে? দুই দিন পর তোর বিয়া আর তুই মান ইজ্জত ডুবাইয়া দিবি?” আশরাফ উদ্দিন সরকার ঘর থেকে চিৎকার করে বলছে, “আগে ঘরে নিয়ে আয় তোর মাইয়ারে, বাইরে দাঁড়াইয়া তো তুই মান-ইজ্জত ডুবাইয়া দিতাছোস।”
আমেনা বেগম আর কথা বলতে পারে না। আশরাফ উদ্দিন যখন প্রচন্ড রেগে যায় তখন আমেনা বেগমকে তুই করে বলে। এমনকি গায়েও হাত তুলে। এতো গুলো বছরের সংসার জীবনে মেয়েদের জন্য বহুবার আমেনা বেগম মার খেয়ে হজম করেছে। একটি ছেলের আশা করতে করতে তিনটি মেয়ে হয়েছে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বাকি আছে শুধু পুষ্প। চারদিন পর হাজীপুর এলাকার ভূঁইয়া বাড়ির ছেলের সাথে পুষ্প’র বিয়ে। পুষ্প আর আমেনা বেগম ঘরে ঢুকার সাথে সাথে আশরাফ উদ্দিন বললেন, “আমেনা বেগম দরজা লাগাও।” আমেনা বেগমের মনে হলো কলিজায় পাানি এসেছে। এখন অন্তত তুমি করে বলছে। আশরাফ উদ্দিশ দাদার বানানো খাট থেকে নেমে হাত দুটো পেছনে দিয়ে ডানে বামে কয়েকবার পায়চারি করলেন। পুষ্প মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আশরাফ উদ্দিন মুখ বাঁকিয়ে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, “মুকুল তোরে জাদু করছে? জাদু আমি বাইর করমু। তোর মতোন মাইয়া কাইটা নদীতে ভাসাইয়া দিলে আমার কিচ্ছু হবে না। আরো দুইডা আছে মাইয়া আমার।” পুষ্প মুখ খুলে বলে ফেলল, “জাদুই করছে মুকুল আমারে। মাইরা ফেলেন আমারে। বিয়া যে ঠিক করছেন, জিগাইছিলেন আমারে একবার?”
আশরাফ উদ্দিন বসার পিঁড়ি খুঁজে পেলেন ঘরে। মেয়ের চুল ধরে সেই পিঁড়ি দিয়ে পিঠে বসিয়ে দিলেন দুই তিন ঘাঁ। আর বলতে লাগলেন, “কী হইবো আমার? তোর মতো মাইয়ারে মাইরাই ফেলমু।” আমেনা বেগম একবার ফেরাতে গিয়ে আশরাফ উদ্দিনের চোখ ঘুরানো দেখে সাহস করতে পারে না। পুষ্প গলা ফাটিয়ে কান্না শুরু করলো। দুই তিন ঘরের মানুষ এসে দরজার বাইরে থেকে ডাকছে। সন্ধ্যা রাত, এলাকার সবাই প্রায় জেগেই ছিল। আশরাফ উদ্দিন হাত থেকে পিঁড়ি রেখে মনে মনে ভাবতে লাগলো, ছোট একটা ভুল হয়ে গেল।
এখন এতো মানুষকে কী বলবে সে? দরজা খুলে দেখে চার ঘরের মানুষ এসে হাজির উঠানে। মুকুলের মা এসেছে সবার আগে। পুষ্প তখনো কেঁদেই যাচ্ছে আর বিলাপ করে বলছে, “মাইরা ফেলাও আমারে, মুকুল আমারে জাদুই করছে।” আশরাফ উদ্দিনের অনিচ্ছায় উঠানের সবাই বিষয়টা শুনতে পেল। লুকোচুরির কিছু নেই। আশরাফ উদ্দিন মুখ খুললেন। “আমার মাইয়াডার দুই দিন পরে বিয়া। আর মুকুল রাইত-বিরাতে পুষ্পর লগে দেহা করে। এইডা ঠিক নাকি?” দুই বাড়ি পর থেকে আসা কলিম চাচা বললেন, “দেখরে আশরাফ, পুষ্প আর মুকুল যে দুইজনই দুইজনরে ছোডো বেলাত্তে পছন্দ করে এইডা মনে অয় এলাকার হগলেই জানে। তুই মাঝখান দিয়া হাজীপুর মাইয়ার বিয়া ঠিক করছোস, মাইয়ারে জিগাইছোস দুইডা কথা?”
আশরাফ উদ্দিন কথা ঘুরিয়ে বললেন, “মুকুলের থাহোনের একটা ঘর নাই। থাহে মাইনষের বাইত। সূতার মিলে একদিন কাম পাইলে আরেকদিন পায় না। আমার মাইয়ারে রাখব কই? খাওয়াইবো কী” কলিম চাচা বললেন, “এরে আশরাফ, রিজিকের মালিক রাজ্জাক, ওদের খাওয়েন চিন্তা তোর করা লাগতো না।” পরদিন আশরাফ উদ্দিন সকাল থেকে নিশ্চুপ ছিলেন। কিন্তু তাঁর চেহারায় বেশ অস্তিরতা লক্ষ করা গেছে। বিকেল বেলা সুলেমান ঘটকরে দিয়া হাজীপুর পাঠিয়ে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন।।পুষ্প যখন আমেনার গলা ধরে খুশিতে আত্মহারা, তখনো আশরাফ উদ্দিন দাঁতে কিড়মিড় করছিলেন। গলায় রাগী ভাব নিয়ে বললেন, “মুকুলের থাহনের জায়গা নাই। আমার মাইয়া অন্য মাইনষের বাইত গিয়া থাকতে পারবো না। মুকুলরে কইয়া দিস, তারে আমার বাংলা ঘরেই থাকতে হইবো।”
মুকুল আসলেই আরেক বাড়িতে থাকে। মোতালেব মিয়ার ছেলের সাথে ঘুমায়। মুকুলদের বাড়িতে দুইটাই ঘর। এক ঘরে তাঁর বাবা মা, আরেক ঘরে বড় ভাই আর ভাবী। নতুন করে যে পাতা-লতা, পলিথিন দিয়ে ঘর তুলবে সে জায়গাটুকু নেই। কাজ করে সূতার মিলে। বদলিওয়ালা হিসেবে জয়েন করেছে। কারো শরীর খারাপ থাকলে, কেউ কাজে না আসলে তারা পরিবর্তে মুকুল কাজ করতে পারে। সপ্তাহে দুই দিন বা তিন দিন কাজ পায়। ভাগ্য ভালো হলে চারদিনও পায়। সপ্তাহে যে টাকা পায় তা দিয়ে অবশ্য দুইজন মানুষের চলতে বেশ কষ্ট হবারই কথা। তাছাড়া বিয়ের পর একটা নতুন সংসারে সব জিনিস-পত্রই নতুন করে কিনতে হয়। আশরাফ উদ্দিন কড়া গলায় আমেনা বেগমকে বলে দিলেন, “খবরদার, এক চিমটি লবনও যেন ঐ ঘরে না যায়।” শুরু হলো টোনা টুনির সংসার। মুকুল ধার-দেনা করে বিয়ে করে ফেলেছে। ধার শোধ করা যাবে, পুষ্পকে হারালে অন্য কিছু দিয়ে শোধ হবে না।
বছর খানেক ধরে মুকুল শুধু ধার-দেনা করেই সংসার চালাচ্ছিল। যখন তাদের কোল জুড়ে পুত্র সন্তান এলো, তখন মুকুল অভাবে পড়ে গেল। বাড়তি খরচ হিসেবে বাচ্চার দুধও কেনা লাগে। বাচ্চা বুকের দুধ কিছুতেই খেতে চায় না। শুধু কান্না করতেই থাকে। বাচ্চার কান্না শুনলে কী আর বাবা মায়ের মন স্থির থাকে? দুয়েকদিন মুকুলকে পথে-ঘাটে টাকার জন্য কয়েকজন আটকিয়ে রেখেছিল। একবার সন্ধ্যা রাতে বাচ্চার দুধ শেষ। ডানো দুধ খাওয়ায় বাচ্চাকে। মুকুল দুধ আনতে গেল বাজারে। পাওনাদার কয়েকজন দেখে ফেলল। সবসময় তো আর লুকোচুরি করে থাকাও যায় না। মুকুল উপায় না দেখে বলল, “ভাই, বাচ্চার দুধ নিয়ে যেতে হবে বাড়িতে। আমাকে যেতে দিন।” ইন্টার পাশ করা মুকুলের শুদ্ধ বুলি পাওনাদের মন গলাতে পারে না। একটা ঘরে আটকে রেখে বাইরে থেকে শিকল দিয়ে মুকুলকে বলল, “আগে পাওনা টাকা দিবি, তারপর বাড়ি যাবি।”
পুষ্প পথ চেয়ে বসে থাকে। বাচ্চাটা যখন কেঁদে উঠে, বাচ্চাটার ছোট্ট মুখখানি আঁচল তলে দেয়। কিন্তু বাচ্চা বুকের দুধ খায় না। তাকে ডানো দিয়ে দুধ বানিয়ে ফিটারে ভরে খাওয়াতে হবে। বাচ্চাটার কান্না আর পুষ্প সইতে পারে না। আমেনা বেগম একবার উঁকি দেয় মেয়ের ঘরে। জানতে চায়, “কিরে, আজ দেহি নাতিডার কান্না থামে না। কী হইছেরে?” পুষ্প মিথ্যা বলে, “মা, আইজ টিকা দিবস আছিলো। তুমি নানীগো বাইত গেছিলা, আমি গেছিলাম টিকা দিতে। সুঁই দিছে তো, এর লাইগ্যা কান্দে।” বাচ্চাটা এক সময় পেটের ক্ষিধায় বুকের দুধ একটু খায়, আবার কাঁদে। মায়ের মন তখন পাখি হতে চায়। পুষ্প’র ইচ্ছে করে পাখি হয়ে ওড়ে গিয়ে বাচ্চার জন্য দুধ নিয়ে আসতে।
মুকুল তখনো ঘরে বন্দী। পরদিন সকালে দরজা খুলে পাওনাদার দু’জন মুকুলের শার্টের কলার টেনে ধরে। মুকুলের একটাই কথা মুখে, “বাচ্চাটা কিছু খায়নি ভাই। বাচ্চাটার জন্য দুধ নিয়ে যেতে হবে। আপনাদের টাকা দিয়ে দেব।”
একজন পকেট থেকে দুধ কেনার টাকাটা নিয়ে গিয়েছিল। আরেকজন কী মনে করে টাকাটা ফেরত দিয়ে মুকুলকে এক সপ্তাহের সময় বেঁধে দিলো। তখনো দোকান-পাট খুলেনি। মুকুল দোকানের বাইরে বসে আছে, দোকান খুললে দুধ নিয়ে বাড়ি ফিরবে। সারারাত ঘরে বন্দী থেকে দুই চোখের পাতা এক করেনি মুকুল। বাচ্চার কান্নাভরা মুখটা বারবার ভেসে উঠে।। সকালে পুষ্প’র ঘুম ভাঙ্গে তাঁর ছেলের কান্নার শব্দে। শেষ রাতে একটু ঘুমিয়েছিল। বাচ্চার সাথে পুষ্পও কান্না করছে। একেক সময় দাঁতে কিড়মিড় করে বলছে, “তোর বাপে দুধ কিনতে গিয়া মরছে, এজন্য এহনো আসে না।” আরেকবার মনে মনে ভাবলো, কথাটা বলা উচিত হয়নি। সাথে সাথে চোখ বুজে উপরের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয় পুষ্প।
মুকুল এসে পুষ্প’র চোখের দিকে তাকাতে পারে না। পুষ্পও কোনো কিছু জিজ্ঞেস করে না। মুকুল নিজেই দুধ বানিয়ে ফিটারে ভরে বাচ্চার মুখে দেয়। ক্ষুধার্ত শিশুটি তৃষ্ণার্তভাবে খেতে থাকে। মুকুল জানতে চাইলো, “পুষ্প ভাত আছে? খুব ক্ষিধা লাগছে।” পুষ্প মলিন মলিন চেহারায় বলল, “দুই কেজি চাল আনছিলা। ঘরে থাকলে তো রানমু নাকি?” পুষ্প বাকি কথাটি বলে না, গতকাল দুপুরের পর থেকে সেও কিছু খায়নি। আমেনা বেগম আঁচলে করে চাল নিয়ে আসে মেয়ের জন্য। চালের নিচে তিনটা আলু। পুষ্প’র কাছে দিয়ে বলল, “আলু তিনডা ভাতের সাথে দিয়া সিদ্ধ কইরা ভর্তা বানাইস।” পুষ্প তার মা’কে চোখের পানি দেখাতে চায় না। বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বহুবার তাঁর মা চাল দিয়েছে। ধরা পড়লে মায়ের কী হাল হবে সেটাও ভাবে পুষ্প। আমেনা বেগম বলল, “কাল তোর বাপে ধান ভাঙ্গাইবো। চাল ঝেড়ে দিয়ে খুদের চাইল নিয়া আসলে তোর বাপে কিছু কইবো না।’
মুকুলের অভাব চূড়ান্ত রকমে দেখা দিলো। সত্তর হাজার টাকার উপরে ঋনের বোঝা ঘাড়ে। সপ্তাহে যা কাজ করে তার অনেকটাই চলে যায় সুদ দিতে দিতে। পুষ্প’র একটাই কাপড়। গোসল করে ভেজা কাপড়ের অর্ধেক রোদে মেলে রাখে শুকানোর জন্য। অর্ধেক শুকিয়ে গেলে বাকি অর্ধেক পরনে রেখে আবার শুকাতে দেয়। ছেলেটা বড় হয়ে যাচ্ছে। ছেলের নাম মিদুল। এবার ক্লাস থ্রীতে পড়ে। মায়ের ঘর থেকে পুষ্প আঁচলে করে চাল চুরি করে নিয়ে আসে। ছেলের চোখে ধরা পড়ে মুচকি হাসে। ছেলে যখন জানতে চায়, “মা তুমি চুরি করছ?” পুষ্প জবাব দেয়, “মা’র ঘর থাইকা কিছু আনলে চুরি হয় না রে বাপ।”
আশরাফ উদ্দিন এতো বছরের ভেতর মুকুলের সাথে ভালো করে দুইটা কথাও বলেনি। কিন্তু এবার নিজেই ডেকে আনলেন মুকুলকে। জায়গা সম্পত্তির দলিল, পর্চা, নকশা আর খারিজের কাগজ বের করে মুকুলকে দেখায়। সিএস, আরএস, আর এসএ পর্চা অনুযায়ী জমি আশরাফ উদ্দিনের নামে খারিজ করা নেই। তল্লাশি দিয়ে অনেক কিছুই বের করতে হবে। মুকুল এসব আগে থেকেই বুঝে। এক এক করে কাগজ বেরিয়ে আসে রেজিস্ট্রি অফিসের কার্যালয় থেকে। মুকুল সেই সুযোগে মনের ভিতর চেপে রাখা কথাটি বলে তাঁর শ্বশুরকে। আশরাফ উদ্দিন চিৎকার করে বলে, “সত্তর হাজার টাকা ঋন, সেই ঋন আমি মিটামু নাকি?”
মুকুল বলে, “বাবা আমাকে ধার দেন। আমি সব টাকা দিয়ে দেব। সপ্তাহে যা কাজ করি সব চলে যায় সুদ দিতে দিতে। আপনি টাকাটা দিলে প্রতি সপ্তাহে আর শোধ দিতে হবে না। সেই টাকাটা দিয়ে আপনার পাওনা মিটাতে পারবো।”
আশরাফ উদ্দিন সরকারের মন গলেনি। তিনি বললেন, “আমার কাগজপত্র অন্য মাইনষেরে দিয়া দেখামু, তবু আমি টেহা দিতাম না।” পুষ্প’র বড় দুই বোন আর বোন জামাইরা আসলে পুষ্প চায় লুকিয়ে থাকতে। মাঝে মধ্যে ঘরের দরজায় শিকল দিনে অন্য বাড়িতে গিয়ে বসে থাকে। কারণ বোনেরা, বোনের জামাইরা উপহাস করে কথা বলে। মুকুলকে ঘর জামাই বলে খোটা দেয়। পুষ্প’র এগুলো সহ্য হয় না। একবার বড় বোন দুইটা সস্তা কাপড় এনে বলেছিল, “ইদ উপলক্ষে অনেক মাইনষেরে কাপড় দিছি, তোর লাইগা দুইডা আনছি। ছিঁড়া কাপড় আর কত পিনবি?” পুষ্প জানে এগুলো জাকাতের কাপড়। সে কাপড় ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিল, “ছেঁড়া কাপড় পিন্দি, তবুও যাকাতের কাপড় নিতাম না।”
প্রতিটা সংসারে যেমন ঝগড়া হয়, মুকুল আর পুষ্প’র সংসারেও হতো। তাদের ঝগড়া মূলত অভাবের জন্য হতো। অভাব দরজায়, ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালিয়ে না গেলেও ঘরের কোণে ঘাপটি মেরে বসে থাকতো। মুকুল ঝগড়ার এক পর্যায় পুষ্পকে মারধোরও করতো। বহুবারই এমন ঘটেছে। তবে তাদের ভালোবাসা কেন যেন পালিয়ে যায়নি। পুষ্প সিদ্ধান্ত নিলো, কিছু একটা করতে হবে। এভাবে আর অভাবের সাথে লড়াই করা যায় না। সে তাঁর বাবার পায়ে ধরে বসে আছে। আমেনা বেগম আঁচলে চোখের পানি মুছে। চোখের সামনে মেয়েটার সুখ দেখতে পেল না। পুষ্প বলছে, “বাবা জায়গা সম্পত্তি তোমার বাকি দুই মাইয়ারে দিয়া দেও, আমার কোনো আপত্তি নাই। আমারে শুধু এক লাখ টেহা দেও, সেইটাও ধার হিসেবে।
আমি দিয়া দিমু তোমার টেহা।” আশরাফ উদ্দিনেরর মন কেন যেন নরম হলো। পরদিনই মুকুলের হাতে এক লাখ টাকা দিয়ে বলল, “আমি জানি ফেরত দিতে পারবা না, তবে যদি ফেরত দিতে পারো তোমার পুরষ্কার আছে।” মুকুল বলল, “আপনার পুরষ্কারের আশায় না, এই টাকা ফেরত না দেয়া পর্যন্ত আল্লাহ যেন আমাকে বা আপনাকে কাউকেই কবরে না পাঠায়।” পরদিন মুকুল তার সমস্ত দেনা পরিশোধ করে ফেলল। মাত্র দশ হাজার টাকা ঘুষ দিতে না পারার জন্য এতো বছর বদলিওয়ালা কাজ করতো। মুকুল সূতার মিলে তাঁর কাজ স্থায়ী করে নিলো। মুকুল বিশ্বাস করে কাজটা স্থায়ী হলে শ্বশুরের টাকা এক বছরের মাথায় পরিশোধ করে ফেলতে পারবে।
পুষ্প’র মুখে হাসি ফুটেছে। তার সংসারের অভাব আস্তে আস্তে দূর হতে লাগলো। আশরাফ উদ্দিন প্রায়ই মুকুলকে দিয়ে এক এক করে জায়গা সম্পত্তি সব খারিজ করিয়ে আনে। সুখের দিনগুলো এক বছরও অতিবাহিত হয়নি। এরই মধ্যে আশরাফউদ্দিন সরকার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বুক ব্যথা বলে চিৎকার করতেন। কিন্তু হাসপাতাল, ডায়াগনোষ্টিক সেন্টার, হেকিম-কবিরাজ কেউ বুক ব্যথার উৎস খুঁজে পায়নি। কেউ বলতো আলসার, কেউ বলতো গ্যাস্টিকের ব্যথা, কেউ বলতো আপনার তো কোনো রোগই নাই। কিন্তু আশরাফ উদ্দিন দিনদিন অসুস্থ হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছিলেন প্রায়। মিতা নার্সিং হোম নামে এক ক্লিনিকের মহিলা ডাক্তার বললেন, “ইমার্জেন্সি শরীরে তিন চার ব্যাগ রক্ত লাগবে। রক্ত শূণ্যতা আশরাফ উদ্দিনের শরীরে।”
বাকি দুই বোন এক ব্যাগ করে দুই ব্যাগ রক্ত দিলো। পুষ্প তেমন স্বাস্থ্যবান না, রোগা পাতলা। আশরাফ উদ্দিন সরকার খবর পেলেন তাঁর মেয়ে পুষ্পও তাকে এক ব্যাগ রক্ত দিয়েছে। পুষ্প রক্ত দেয়ার পর থেকে বেশ কিছুদিন দুর্বলতায় বিশ্রামে ছিল। আশরাফ উদ্দিন সরকার কিছুটা ভালো অনুভব করছিল। বাসায় নিয়ে আসা হলো দুয়েকটা দিন ঘুরে ফিরে যাবার জন্য। হাসপাতালে বেশিদিন থাকলে ভালো মানুষও রোগী হয়ে যায়। মুকুল পরদিন সকালে তাঁর শ্বশুরের হাতে এক লাখ টাকা বুঝিয়ে দিয়ে বলল, “বাবা, এই এক লাখ পুরোটাই আমি কাজ করে সংসার চালিয়ে এক বছরে জমাইছি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে আমি আপনার ঋন পরিশোধ করতে পেরেছি।”
আশরাফ উদ্দিন বললেন, “তাইলে আমার আরেকটা উপকার করো। আমার কোনো ছেলে-সন্তান নাই। মরার আগে আমার জায়গা সম্পত্তি মাইয়াগো নামে লেইখা দিতে চাই। তুমি ব্যবস্থা করো।” মোট সম্পত্তি পাঁচ পঞ্চাশ শতাংশ, তিন মেয়েকে একেক জনকে চৌদ্দ শতাংশ করে লিখে দিলেন। স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রি করলেন ছয় শতাংশ। বাকি থাকে সাত শতাংশ। এই সাত শতাংশ জমি আশরাফ উদ্দিন মুকুলের নামে দিতে চাইলেন। মুকুল বলল, “আপনার পায়ে ধরে অনুরোধ করি, আমার নামে এক ছটাক জমিও আপনি দিবেন না।” আশরাফ উদ্দিন বললেন, “আমি যে বলছিলাম তোমারে পুরষ্কার দিমু।” মুকুল তবুও নিতে অস্বীকার জানালো। শেষ অবধি সেই সাত শতাংশ আশরাফ উদ্দিন নিজের ভাতিজাকে লিখে দিলেন।
এক কুয়াশার ভোরে আশরাফ উদ্দিন সরকার মারা গেলেন। মারা যাবার আগে মুকুলকে ডেকে বললেন, “বাবা তুমি ইট্টু আমার কাছে আসো।” মুকুল কাছে গিয়ে বসলো। আশরাফ উদ্দিন মুকুলের মাথায় হাত রেখে বলল, “তোমারে আমার অনেক আগে চিনা দরকার আছিলো, চিনতে পারি নাই। তোমার টেহা ছিল না, সততা ছিল মিয়া। তুমি তো পুরষ্কারটা নিলা না। দোয়া দিয়া গেলাম তোমারে, এই পুরষ্কারটা যেন আল্লাহ তোমারে দেয়।” পুষ্প’র চোখে কেন যেন পানি দেখা যায়নি। অন্যদিকে তাকিয়ে বসেছিল উঠানে। বাবার মৃত্যুতে তাঁর কান্না করার কথা। কেউ শোকে পাথর হয়, কাঁদতে ভুলে যায়। পুষ্প হয়তো কাঁদতে ভুলে গেছে। আশরাফ উদ্দিন পালকিতে চড়ে সাড়ে তিন হাত ঘরের জন্য শেষ যাত্রা করলেন।
গল্পের বিষয়:
গল্প