বুঝ হবার পর থেকেই দেখে আসছি আমাদের তিন বোনের মাঝে আব্বা আম্মা মেজো জনকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। স্পেশাল কিছু রান্না হলে আমরা সবাই একসাথে খেতে বসলেও আম্মা তার জন্য আলাদা একটু বাটিতে তুলে রাখতো যাতে পরে মন চাইলে খেতে পারে, পরের বার খাওয়ার সময় আমাদের মন চাইলে মেজোজন দিতো না, আম্মা তখন বলতো,
“তোরাতো খাইছোসই, এখন আবার ভাগ বসাইতে আসলি কেন?”
“আমাদের সাথে ও তো খাইছে। ও পরে খেলে আমরা পাবো না কেন?”
“ও তখন ঠিকমতো খেতে পারে নাই।”
খাবার নিয়ে এমন ঘটনা হর হামেশাই ঘটে আমাদের সাথে। আব্বা আবার একটু বউ ঘেঁষা মানুষ। তাই কষ্ট মনে আমরা দুইজন আব্বাকে এসব বললে তিনি বলতেন,
“তোর মেজো বোন একটু বেশি আদরেরতো, তাই অমন করে। মন খারাপ করিস না।”
বড় হতে হতে ব্যাপারটা সয়ে যাচ্ছিলো মোটামুটি। সমান সমান আদর আহ্লাদ পাবার আশা মন থেকে মুছে ফেলেছিলাম আমি আর ছোট। ওদিকে আমার মন গিয়ে আটকিয়েছে ভার্সিটির এক বড় ভাইয়ের উপর। বিয়ে করতে মন চায়। তার দিক থেকে সব ঠিক। বিপত্তি হলো আমার বাসায়৷ নিজের পছন্দে বিয়ে মেনে নেয়া যাবে না। না মানে না। হ্যাঁ হবার কোন চান্স নেই। বাধ্য হয়ে সম্পর্ক বেশিদূর আগানো গেলো না। তাদের পছন্দের ছেলের সাথেই বিয়ে হলো আমার।
এখানেও ঘটনা আছে, আমাদের তিন বোনের জন্য আব্বা আম্মা বিয়ের বন্দোবস্ত করতে টাকা পয়সা জমিয়েছেন। আমার আর ছোটর জন্য বরাদ্দ হলো সাত লাখ আর মেজোর জন্য দশ লাখ। আদরের মেয়েতো, তাই তার বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন বেশি, আর স্বপ্ন বেশি হলে খরচও বেশি। দাদীর ব্যবহৃত গহনার সম পরিমাণ স্বর্ণের এক জোড়া ঝুমকা আমার, গলার চেইন ছোটর, মেজো পেলো চার ভরির সিতা হার, হাতের বালা মা নিজের জন্য রাখলেও মেজো বলেছে বালা জোড়া সুন্দর, জানি, বিয়ের সময় এই বালাও তার ভাগেই যাবে। আমি আর ছোট ব্যাপারগুলো এড়িয়ে যেতে চাইলেও পারতাম না, প্রতি পদে পদে এমন সব আচরণ আসে যা আমাদের বার বার মনে করিয়ে দেয়, আব্বা আম্মার কাছে মেজোই সব, আমরা দায় সারা সন্তান। আমিতো বাধ্য মেয়ের মতো আব্বা আম্মার পছন্দেই বিয়ে করলাম কিন্তু মেজোর বিয়ে হলো ওর তিন বছরের প্রেমিকের সাথে। কেউ কোন আপত্তি করলো না বরং আমি যখন আপত্তি করলাম তখন আব্বা বললেন, “তোর তো অল্প দিনের পছন্দ ছিলো তাই না করেছিলাম, ওরা তিন বছর ধরে একে অপরকে জানে, বিয়ে হলে সুখেই থাকবে।”
ছোট জেদ ধরে বসলো ও বিয়েতে থাকবে না। সবসময় ওকে এইভাবে প্রোটেক্ট করার কি মানে? ওর পছন্দের এতো খেয়াল আর আমাদের? আমাদের বেলায় একরকম হলেই হলো? অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে ওকে আটকালাম, বাবা মায়ের অসম্মান হবে। লোকে খারাপ বলবে। আর মেজোর প্রতি এমন আচরণ তো নতুন নয়, বুঝ হবার পর থেকেই দেখছি এমনটাই চলে আসছে। ছোট তো ছোটই। জেদ চাপলো ও সাত দিন প্রেম করে বিয়ে করবে। পছন্দ ইজ পছন্দ। সেটা যতোদিনের খুশি হোক। আমাদেরকে কড়াকড়ি শাসন করে প্রেম করতে বারণ করেছে আর মেজোজন তিন বছর ধরে প্রেম করছে এটা তাদের নজরে পড়ে নি? যেই জেদ সেই কাজ। পরিচিত এক ছেলেকে বিনা নোটিশে বাসায় এনে ছোট বলছে, “এই বাড়িতে আমি থাকি। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে সিরিয়ালে এখন আমি। বলো, কেমন দেখলে সব?”
আব্বা আম্মার মতে নিজের বিয়ে নিজেই ঠিক করেছে ছোট, তাদের মতামত দেয়ার কোন জায়গাই রাখে নি। কিছু বলতে চাইলে তখন সে ছোটবেলা থেকে বড়বেলার সকল হিস্ট্রি তুলে ধরে বিশাল এক গন্ডগোল পাকিয়ে বসে। আব্বা আম্মা বুঝতে পারে, ওকে দমানো যাবে না, রাজি হয়ে যায়, বিয়েও হয়। তিন বোনের সংসারই সুখের। আব্বার বাসায় আমাদের এক সাথেই দাওয়াত করা হয়। এতোদিন যা চলেছিলো বোনদের মাঝে এখন তা শুরু হয়েছে জামাই নিয়ে। মেজোর জামাইর প্রতি আব্বা আম্মার শকুনের নজর, তার যত্নে কোন ত্রুটি হচ্ছে না তো? এমনকি আমাদের পর্যন্ত বলে দেয় মেজোর জামাইর দিকে যেনো একটু নজর রাখি, কখন কি লাগে!
ছোট আর আমার জামাইতো খুব ক্ষেপলো। একই বাড়ির তিন জামাই অথচ দেখা হচ্ছে ভিন্ন নজরে! সিদ্ধান্ত নিলো মেজো যখন যাবে তখন তারা দুজন শ্বশুরবাড়ি যাবে না। আমাদেরও তাদের কিছু বলার মতো মুখ থাকলো না, আপোষে সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম। হঠাৎ শুনি মায়ের অসুখ। পরীক্ষা নীরিক্ষা করে জানা যায় ক্যান্সার। আব্বা তার সবটা উজাড় করে নেমে যান মাকে সুস্থ করার পেছনে। কিন্তু ক্যান্সারের খরচতো আর কম নয়, এদিকে আমরা তিন বোনের এক বোনও চাকরি করি না, পাক্কা গৃহিণী। জামাইরা তাদের জায়গায় টুকটাক করছে কিন্তু সেভাবে আর কোথায় পারে? সুযোগ পেলেই বলে দেয়, মেজো জামাইকে দিতে বলো, তোমার মায়ের খুব আদরেরতো। মেজো যে দেয় নি তা নয়। কিন্তু ও হিসাব করে দেয়, তিন বোন সমান সমান। শেষ বেলায় এসে ভীষণ ঝগড়া হলো, টাকা দেবার বেলায় সমান সমান হিসাব করছো আর নেবার বেলায় পারলে আমাদেরটা সহ নিতে চেয়েছো। আব্বা বলছিলেন,
“মা তো তোদের সবারই, সবাই মিলে সমানভাবে দেখে রাখবি।” ছোট বললো,
“মা আমাদের সবার হলেও আমরা মায়ের সমান সন্তান ছিলাম না।
তোমরা হাতে ধরে শিখিয়েছো কিভাবে কম বেশি করে ভালোবাসা যায়, যত্ন করা যায়, কারও পেছনে খরচ করা যায়। এখন আমরা কিভাবে সমান সমান দায়িত্ব নিতে পারবো আব্বা? আমাদেরতো সমতার শিক্ষা তোমরা দাও নি। মেজো মেজো করে যা করেছো এখন সেই মেজোকে বলো ওকে বেশি দায়িত্ব নিতে। তাছাড়া সব ভুলে সমানভাবে করতে পারতাম যদি অন্তত জামাইদের সাথে সমতা করতে। এমন সব ব্যবহার করেছো ওরাতো এখন ফটাফট বলে দেয় মেজোকে করতে। আমাদের কি করার আছে এখানে বলো?”
সত্যিই আমাদের কিছু করার ছিলো না। রাগ করে দেখবো না দেখবো না করেও আমরা দুই বোন স্বামীদের কাছ থেকে এগারো লাখ টাকা নিয়েছিলাম। আর মেজো দিয়েছিলো তিন লাখ। অথচ ওদের অবস্থা আমাদের দুই বোন থেকে অনেক ভালো ছিলো। ক্যান্সার প্রাথমিক স্টেজে থাকায় সে যাত্রায় মাকে রক্ষা করা গিয়েছিলো। সুস্থ মা’কে বলেছিলাম, “সব সন্তানের কাছে সমান আদর যত্ন পেতে চাইলে সব সন্তানকে সমানভাবে আদর করতে হয়। রাগ হলেও বিবেকের তাড়নায় পিছিয়ে যেতে পারিনি, তাই বলে ভেবো না তোমার মাতৃত্বের কলা কৌশল ঠিক ছিলো। তোমাদের আদরের মেজোকে নিয়ে বাকি জীবন সুখে থাকো।”
গল্পের বিষয়:
গল্প