দুইশত টাকার সাজেক ভ্রমণ

দুইশত টাকার সাজেক ভ্রমণ
“মাত্র দুইশত টাকায় সাজেক ভ্রমণের দুর্দান্ত অফার!! দেরি না করে এখনই রেজিস্ট্রেশন করে ফেলুন।” – মাঝরাতে এমন লেখা দেখে প্রথমে বুঝতে না পেরে ফেসবুক স্ক্রল করে চলে যাচ্ছিল জিসান। হঠাৎ খেয়াল হতেই তড়াক করে উঠে বসল। চোখ কচলে কয়েকবার পিটপিট করে তাকাল মোবাইলের পর্দায়৷ সত্যি দুইশত টাকায় সাজেক নিয়ে যাওয়ার অফার দেয়া হয়েছে! মূলত একটা কাপড়ের কোম্পানি এই ভ্রমণ স্পনসর করছে তাদের প্রচারের জন্য। কোম্পানির নাম ‘জেমস & রিংস’। বর্তমানে মোটামুটি জনপ্রিয়। জিসান তাদের পেজটা ভালো করে ঘুরে আসল। রেটিং ভালো। পুরানো পেজ৷ মাঝখানে কিছু অফারও দেয়া হয়েছিল, তবে এটার মতো দুর্দান্ত আর কোনোটাই নয়।
অফারের লিংকে চাপ দিয়ে বিস্তারিত জেনে নিল জিসান৷ মাত্র প্রথম এক হাজার জনই এই অফারটি পেতে পারে। তাই অতি দ্রুত রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। পোস্টটা করা হয়েছে পনেরো মিনিট আগে। এর মধ্যে চারশত জন রেজিস্ট্রেশন করেও ফেলেছে। জিসানের হাত পা কাঁপতে শুরু করল। এমন সুবর্ন সুযোগ জীবনে খুব একটা আসে না। সে তক্ষুনি টাকা পাঠাবে বলে ঠিক করল। কিন্তু বিকাশে গিয়ে দেখল একাউন্ট ফাঁকা। মনেও নেই বিকাশে যে টাকা নেই। এই মাঝরাতে চুল ছিঁড়তে মন চাইল জিসানের। এদিকে রেজিস্ট্রেশন করার লিস্ট পাঁচশ জন ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষ পাগল হয়ে গেছে মনে হয়। তাও ভালো এখন মাঝরাত৷ নইলে দশ মিনিটে হাউজফুল হয়ে যেত! কিন্তু মাঝরাত বলেই তো জিসান টাকা পাঠাতে পারছে না! কী মহা মুশকিল! তার হঠাৎ মনে পড়ল বাবার বিকাশে টাকা আছে। মোবাইলটা চুরি করতে পারলেই হয়। বাবার বিকাশ সে-ই খুলে দিয়েছিল, তাই পিন নাম্বার জানা আছে৷ তাড়াতাড়ি উঠে বাবার ঘরের দিকে দৌড় দিল সে৷ কিন্তু মাঝপথে সজোরে ধাক্কা খেল বাবার সাথেই।
বাবার হাতে পানির গ্লাস ছিল। তিনি পানি নিয়ে নিজের ঘরে যাচ্ছিলেন৷ এর মাঝে ছেলের আচমকা ধাক্কায় পানি পড়ে তার জামা লুঙ্গি ভিজে একাকার! চোখ গরম করে তিনি বললেন, “রাতের বেলা দৌড়াইতেছিস কেন?” জিসান আমতা আমতা করে বলল, “বাথরুমে যাইতেছি। বেশি চাপ তো “বাথরুম এইদিকে না ওইদিকে?” জিসান ঢোক গিলে বলল, “আব্বা ঘুমের মধ্যে গুলায় ফেলছি।” বাবা তার বিশ্বাস করলেন কি না বোঝা গেল না। তিনি পানির গ্লাসটা টেবিলে রেখে জিসানের ঘাড় ধরে নিয়ে গিয়ে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিলেন। এদিকে তলপেটে প্রচন্ড চাপ থাকলেও বাথরুম হলো না তার। মিনিট পাঁচেক ভেতরে থেকে বের হয়ে দেখল বাবা বাইরে দাঁড়িয়ে। জিসানকে উনি আবার ঘাড় ধরে নিয়ে গেলেন বিছানা পর্যন্ত। হুঙ্কার দিয়ে বললেন, “আর কোনোদিন মাঝরাতে দৌড়াইতে দেখলে ঘাড় ধইরা বারান্দা দিয়া নিচে ফালায় দিব। ফাজিল কোনখানকার!”
বাবা চলে গেলে জিসান কাঁপা হাতে মোবাইল অন করল। সাতশত জন হয়ে গেছে! সে আবার বের হলো। একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। পেট ব্যথার ঔষধ নেয়ার বাহানায় মোবাইল হাত করতে হবে। সে পা টিপে টিপে বাবার ঘরে ঢুকে দেখল বাবা নেই। কাপড় বদলাতে বাথরুমে! জিসান বাবার মোবাইল নিয়ে এক দৌড়ে নিজের ঘরে। বাবার একাউন্ট থেকে টাকা চালান করে দিল নিজের বিকাশে৷ সাত হাজার টাকা আছে বাবার বিকাশে। জিসান এক হাজার টাকা নিল। বাবা মোটামুটি বেখেয়ালি লোক। খেয়ালই করবে না হয়তো৷ তারপর চওড়া হাসি দিয়ে টাকাটা নির্ধারিত নাম্বারে পাঠানো শুরু করল। কিন্তু বিধি বাম! এত চাপে তার মাথা থেকে নিজের বিকাশের পিন নাম্বারটা বের হয়ে গেছে৷ অজস্রবার যে নাম্বার সে ব্যবহার করেছে সেটাই একেবারেই মনে পড়ছে না৷ বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করে এবার সে কেঁদেই ফেলল। কিন্তু মনে আর পড়ল না। অথচ বাবারটা সেই কবে খুলে দিয়েছিল, তাও মনে আছে। অবশ্য মাঝেমধ্যে চুরিচামারি করেনি তা নয়।
জিসানের হঠাৎ মনে পড়ল সে একটা ডায়েরিতে পিন নাম্বারটা লিখে রেখেছিল। তাও অনেক আগে। ডায়েরিটা আছে টেবিলের ড্রয়েরে। ড্রয়ের খুলে ডায়েরিটা বের করল সে। পাতা ওল্টাতেই একটা ছবি তার কোলের ওপর পড়ল।
জিসানের প্রাক্তন প্রেমিকার ফটোগ্রাফ। কী সুন্দর মায়াময় চেহারা! মেয়েটার নাম বেবী নাজনীন। জিসানের সাথে তার সম্পর্ক ছিল দুই বছর। প্রথম প্রথম সে মেয়েটাকে বেবী বলে ডাকত। তার বন্ধুরা শুনলেই পাশ থেকে বেবীট্যাক্সি বলে ক্ষ্যাপাত। কিছুদিন পর সহ্য করতে না পেরে নাম বদলে দিল জিসান। ডাকতে শুরু করল নাজু। সেই নাজুর হঠাৎ বিয়ে হয়ে গেল। ওর বাবা জোর করে বিয়ে দিয়ে দিল টাকাওয়ালা ব্যবসায়ীর সাথে। বিয়ের আগের দিন দু’জন দু’জনের সাথে দেখা করে কেঁদে ভাসিয়েছিল। নাজু কথা দিয়েছিল সে প্রথম সুযোগেই জিসানের কাছে পালিয়ে আসবে। জিসানও কথা দিয়েছিল নাজুর জন্য তার দরজা সবসময় খোলা থাকবে।
সেই নাজুর আর পালানো হয়নি। কিন্তু কিছুদিন আগে গাউছিয়ায় নাজুর সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল জিসানের। নাজুর বিয়ের সাড়ে তিন বছর হয়ে গেছে। দুটো মেয়ের জন্ম দিয়েছে সে এর মধ্যে। আরও একজন যে আসছে সেটা তার ফুলে ওঠা পেট দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। নাজু কেঁদে জিসানের হাত ধরে বলেছিল, “দোয়া করো জানি এবারও আমার মেয়ে হয়। শ্বাশুড়ি বলেছে মেয়ে হলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। তখন তোমার কাছে চলে আসব।”
জিসান শুকনো হাসি দিয়েছিল। তারপর থেকেই সে দোয়া করে যাচ্ছে নাজুর যেন ছেলে হয়। যতই ভালোবাসা থাকুক, তিন বাচ্চার মাকে বিয়ে করে ঘরে আনলে বাবা দু’জনকে দুই পা দিয়ে লাথি দিয়ে বের করে দেবে। নাজুর কী হয়েছে তা অবশ্য জানা যায়নি এখনো। সম্বিত ফিরে পেতেই জিভ কাটল জিসান। হায় হায় কত দেরি হয়ে গেল শুধু শুধু! কাঁপা হাতে মোবাইলটা দেখল। আর মাত্র দুটো সিট খালি!
সে ঝড়ের গতিতে পিন নাম্বার বের করে টাকা পাঠাল। ভয়ে ভয়ে অপেক্ষায় রইল। দু’মিনিটের মাথায় জানল তার রেজিস্ট্রেশন সম্পূর্ন হয়েছে। সে সাজেক ট্যুরের এক হাজারতম সদস্য। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল জিসান৷ তিরতির করে প্রশান্তির স্রোত বয়ে গেল তার শরীরজুড়ে। ঘুমিয়ে জিসান স্বপ্নে দেখল সে সাজেকের পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সামনে বিস্তৃত মেঘমালা। আকাশে কত রঙ! আহা! তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ে। জলছাপের শাড়ি পরা। চুলগুলো হাঁটু ছাড়িয়ে নিচে নেমেছে। হাতে রেশমী কাচের চুড়ি। জিসান এগিয়ে গেল তার দিকে। ডাক দিল তাকে। মেয়েটা যখনই তাকাবে, জিসানের ঘুমটা ভেঙে গেল!
তাকে ডাকছে মা। মা গিয়েছিল আপার বাড়িতে। সাত সকালে এসে পড়েছে। জিসান বলল, “এত ভোরে ডাকো কেন?” মা চিৎকার করছে। আংশিক কানে ঢুকল জিসানের- “নবাবজাদার এগারোটা বাজে ভোর হইছে জিসান মাথা চুলকে বের হলো। আর ছুটির দিন। বাবা পত্রিকা পড়ছেন টেবিলে বসে। খেতে খেতে জিসান সবাইকে তার সাজেক যাওয়ার কথাটা জানাল। বাবা চোখ কুঁচকে বললেন, “আমার এক পয়সাও পাবি না। হাইট্টা গেলে যাইতে পারোছ।” জিসান বিজয়ী হেসে বলল, “তোমার টাকা আমার লাগব না। আমি নিজেই ব্যবস্থা করছি।” বাবা আর কিছু বললেন না। বাঁকা চোখে তাকিয়ে থেকে পত্রিকায় মনোযোগ দিলেন। মা গায়েই লাগাল না ব্যাপারটা। শুধু ছোট বোন মিথিলা কয়েকবার গাল ফুলিয়ে বলল, “আমাকেও নিয়ে যাবা।” জিসান হেসে বলল, “হুহ। বড় হইলে যাইছ।”
পেজে বলেছিল আজ সবাইকে গ্রুপে ভাগ করা হবে। একেক গ্রুপ পরপর যাবে। জিসান ভারি উৎসাহ নিয়ে পেজে ঢুকল তার গ্রুপ দেখতে। লোকজনের সাথে আলাপ করা যাবে আগে থেকে। দুয়েকটা বন্ধু জুটে গেলে মন্দ হয় না। আফসোস আজকে একটা প্রেমিকা নাই! পেজে ঢুকে জিসানের চোখ ছানাবড়া! গতকালকের পোস্ট গায়েব! সেখানে আজ সকালে একটা ছোট্ট স্ট্যাটাস দিয়ে রেখেছে- “গতকাল রাত বারোটার পর আমাদের পেজ হ্যাক হয়ে যায়। আমরা নিরলস পরিশ্রম করে পেজটা ফেরত আনতে পেরেছি ভোর ছয়টায়। এর মাঝে যা যা হয়েছে সেগুলোর জন্য ‘জেমস & রিংস’ এর কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই দায়ি নয়।”
জিসানের হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেল। ইচ্ছে হলো চিৎকার করে কাঁদতে। এত বড় ধোঁকা! এমন সময়ে পেছন থেকে গর্জন এলো, “ওই তুই আমার বিকাশ থেকা এক হাজার টাকা চুরি করছোছ?” জিসান পেছনে ঘুরে দেখল বাবার রুদ্রমূর্তি। তার মনে পড়ল দুশো টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশনের পর গতরাতেই সে বাকি টাকা দিয়ে অনলাইনে একটা হেডফোন অর্ডার করেছে! নিজের ওপর নিজেরই বমি পেল এবার। ভয়ে কিছু না ভেবেই অজ্ঞান হওয়ার ভান করে পড়ে গেল জিসান। বাবার পেছনে মা ছিলেন। মা দৌড়ে এলেন। জিসানের মাথাটা কোলে নিয়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে শুরু করলেন। জিসান এদিকে দাঁত কামড়ে অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু কতক্ষণ আর পারবে! আবার বাবার চিৎকার, “তোমার পোলা নাটক করতেছে। আমি মাত্র দেখলাম হাতে মশা বসছে, ও মশাটা সরায় দিল।” মা অবাক হয়ে তাকালেন জিসানের দিকে। জিসানের বুকটা ঢিপঢিপ করছে। সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, তার চোখের সামনে সাজেকের দৃশ্য ভেসে উঠেছে। সেই স্বপ্নের মেয়েটা মুখ তুলে তাকিয়েছে। আরে! মেয়েটা তো নাজু! নাজু হাসিমুখে বলছে, “আমার আরেকটা মেয়ে হইছে জিসান। বের করে দিছে শ্বশুরবাড়ি থেকে। আমারে তুমি সঙ্গে নিয়ে যাও না”
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত