কাহিনীর শুরু গত বছরে। একটানা বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলাম। ঠান্ডা, জ্বর, কাশি ধরেছে তো ধরেছেই। যাওয়ার নাম নেই। নিজেই হাতুড়ে ডাক্তার সেজে কয়েকদিন নাপা-প্যারাসিটামল গিললাম। উপকারে আসলো না। পরিবারের চাপাচাপিতে স্থানীয় ডাক্তারের শরণাপন্ন হলাম। কয়েক পদের ওষুধ দিল। খাইলাম কয়েক দিন ধরে। নাহ, কিছুতেই কাজ হয় না।
এদিকে ঠান্ডায় শরীরের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ ছুটে যায়। জ্বরে দিনদুনিয়া লাটিমের মতো ঘুরতে থাকে। আর কাশি এমন পর্যায়ে গেল প্রতিবার কাশি দেবার সময় মুখ দিয়ে যেন কলিজা বেরিয়ে আসে। পরে এক নিকটাত্মীয়ের পরামর্শে শহরের এক নামকরা ডাক্তারের কাছে গেলাম। নাম আসাদ জামান। ভিজিট ফি দেখে ধারণা পাওয়া যায় তার চিকিৎসা কেমন। দুই হাজার টাকা ভিজিট ফি দিয়ে তার সাক্ষাৎ মিললো। তাকে আমার সকল সমস্যার কথা খুলে বললাম। সব শুনে খুব গম্ভীর চেহারা বানালেন আসাদ সাহেব। আমার পা থেকে মাথার চুল অবধি বেশ কয়েকবার গভীর মনোযোগ সহকারে দেখলেন। এরপর এমনভাবে চোখ ফেরালেন যেন আমার বাঁচার আর কোন সম্ভাবনা নাই।
‘ডাক্তার সাহেব, এতক্ষণ তো দেখলেন। কিছু একটা বলেন।’
‘বলে আর লাভ কী! আমি কিছু ওষুধ আর টেস্ট লিখে দিচ্ছি। ওষুধগুলো নিয়মিত খান। আর টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে সামনের মাসে আসুন।’
‘সামনের মাস! এত দেরি! বলছিলাম কী, একটু জলদি যদি রিপোর্ট দেখে দিতে পারেন…।’
‘আরে মিয়া এত কথা কেন? মরবেন না আপনি। এবার আসুন প্লিজ। সামনের মাসে দেখা হবে। টাটা।’
একগাদা ওষুধ লিখে দিয়েছিল আসাদ সাহেব। পুরো এক মাসের ওষুধ খরচ দাঁড়ালো ৭ হাজার টাকা। আর প্রেসক্রিপশনে উল্লেখ করা টেস্টগুলো করাতে খরচ হলো ১৩ হাজার টাকা। এক ধাক্কায় এতগুলো টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় শরীরের সাথে সাথে মনটাও ভেঙে পড়লো। যাকে কাছে পাই তাকেই জিজ্ঞেস করি- আচ্ছা ভাই, সামান্য জ্বর কাশির জন্য কাউকে বিশ-বাইশ হাজার টাকা খরচ করতে দেখেছেন? জবাব সবসময়ই না শুনতে হয়েছে। ব্যস, আমার কচি মনটা আরও একদফা ভেঙে খানখান হয়। তবে আশার কথা হলো ডাক্তারের দেওয়া ওষুধে কিছুটা উপকার হয়েছে। পুরোপুরি সুস্থ না হলেও কন্ডিশন আগের থেকে কিছুটা বেটার। তারপর এক মাস পেরুলে টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে গেলাম আসাদ সাহেবের চেম্বারে। তিনি আমার কন্ডিশন দেখলেন। টেস্ট রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করলেন। সবকিছু দেখেটেখে বেশ গম্ভীরভাবে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে রইলেন। এরপর চেহারায় হতাশা ভাব এনে মাথা ডানে-বামে ঘুরালেন কয়েকবার। আমার দিকে একটু পরপর তাকান আর মাথা ডানে-বামে ঘুরান। এই দৃশ্য দেখে আমার বুকের খাঁচা থেকে জানপাখি উড়াল দেয় দেয় অবস্থা।
‘ডাক্তার সাহেব, এমন করছেন কেন? খুব খারাপ কিছু কী পেয়েছেন?’
‘আর খারাপ কিছু! আপনি কীভাবে বেঁচে আছেন সেটাই ভেবে কূল-কিনারা করে উঠতে পারছি না।’
‘মানে? কী বলছেন এসব? কী হয়েছে আমার? ডাক্তার সাহেব, প্লিজ টেল মি।’
‘মিয়া আপনার তো এক পা অলরেডি কবরে। আমার কাছে আসতে আর একটু দেরি করলেই সোজা গোরস্থানে যেতে হতো। রিপোর্টে কী নাই, সবই আছে। রক্তের সমস্যা, হাঁড়ের সমস্যা, কিডনি সমস্যা, লিভারে সমস্যা, হৃদপিন্ডে সমস্যা, আনলিমিটেড সমস্যা!’ ‘হায় খোদা! এখন উপায়? আমি কী বাঁচবো না?’
‘সেটা আপনার উপর নির্ভর করছে। নিয়মিত চেকআপ করাতে হবে, ওষুধ খেতে হবে। আমি আপাতত কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি। সেগুলো নিয়মিত খান। আর ধাপে ধাপে প্রচুর টেস্ট করাতে হবে। প্রথম ধাপে অল্পকিছু টেস্ট লিখে দিচ্ছি। সেগুলো করিয়ে সামনের মাসে দেখা করুন।’
‘সামনের মাসে?’
‘অফকোর্স। বাঁচতে চান না?’
‘অবশ্যই চাই। তাহলে আজ যাই!’
‘সি ইউ নেক্সট মান্থ।’
আসাদ সাহেবের সাথে দ্বিতীয় সাক্ষাতের পর জীবন পাল্টে যায়। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনকে টাটা বাইবাই জানিয়ে অফিসিয়ালি অসুস্থ অস্বাভাবিক জীবন কাটাতে থাকি। ভাত-তরকারির বদলে ওষুধের পরিমাণ বেড়ে যায়। পেটভরে তাই ওষুধই খেতে হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য আর কাজকর্ম কমে যায়। বেড়ে যায় টেস্ট রিপোর্ট। বাসায় কম থাকা হয়। বেশিরভাগ সময় কেটে যায় হাসপাতাল আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এভাবে চলতে থাকে মাসের পর মাস।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়ে যায় যে মেডিসিন স্টোরে গিয়ে বলে দিতে পারি কোন ওষুধ কোথায় রাখা, কোন কোম্পানির। এমনকি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আসা ইন্টার্নদের শিখিয়েও দেই এই টেস্ট এভাবে করাতে হবে। এটা করতে হবে ওটা করতে হবে। এই যে হাতে ধরে শিখিয়ে দিই, বিনিময়ে ওরা আমাকে ফ্রীতে চা-বিস্কুটও খাওয়ায়। এর মাঝে সারাবিশ্বে তোলপাড় পড়ে যায়। করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। শুরু হয় লকডাউন। আমার জীবন তো এমনিতেই নানান সমস্যায় জর্জরিত। এবার আশপাশের মানুষও নানাবিধ সমস্যায় পড়তে থাকলো। স্বাভাবিক জীবন রইলো না কারও। আমার জন্য মুশকিল হয়ে গেল বাসা থেকে বেরুনো। ওষুধ কেনা, টেস্ট করানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। ব্যবসা-বাণিজ্যও মন্দা। ভাবলাম যতদিন বাঁচি পরিবার-পরিজন নিয়ে কাটিয়ে দিবো। আর চিকিৎসা করাবো না। কিন্তু ডাক্তার সাহেব নাছোড়বান্দা। আমাকে তিনি ছাড়লেন না। একের পর এক কল দিতে থাকলেন।
‘এইটা কোন কথা! শেষতক আপনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন?’
‘ছি ছি! আত্মহত্যা কেন করবো? এসব কী বলেন?’
‘ঠিকই তো বলি। চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন না, চেকআপ করাচ্ছেন না। এটা তো হাল ছেড়ে দেওয়ার লক্ষ্মণ।
যার মানে দাঁড়ায় আপনি আর বাঁচতে চান না। যেচে মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছেন, এটা তো একরকম আত্মহত্যাই!’
‘না গো না, আপনি ভুল বুঝেছেন ডাক্তার সাহেব। করোনার মধ্যে কী করে চিকিৎসা নেবো? বাসা থেকেই তো বেরুনো নিষেধ।’ ‘এখন তো আবার সরকার বিদ্বেষী কথা বলছেন! ব্রো, এইটা ডিজিটাল বাংলাদেশ। হাতে ফোন তুলে নিন, ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনুন, ভিডিও কল করেন। সিম্পল।’
এরপর আর কথা বাড়ানো গেল না। আমি আসাদ সাহেবের সিম্পল ফাঁদে পা দিলাম। তিনি জোর করে ভিডিও কলের মাধ্যমে আমার চিকিৎসা চালু রাখলেন। এমনকি ছাড়লেন না ভিজিট ফি’টাও। প্রতিবার ভিডিও কল শেষে তাকে ২ হাজার টাকা বিকাশ নাহয় রকেট পেমেন্ট করতে হয়। এসব নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে দমবন্ধ হয়ে আসে আমার। করোনার মাঝে চিকিৎসা নিয়মিত রাখতে প্রচুর টাকা খরচ হয়ে গেল। শেষ পর্যায়ে ধর্না দিলাম বউয়ের কাছে। নিধিকে বললাম তোমার গয়নাগুলো দাও, বন্ধক রাখি। তাতেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো সে। চেঁচিয়ে গোটা বাড়ি মাথায় তুলে ফেললো। তার কথা হলো কী এমন ডাক্তার দেখাই যে এতগুলো টাকা ভিজিট ফি, ওষুধ-টেস্টের শেষ নেই, রোগ-বালাই কমে না। আমার কোন বিষয়ে তেমন একটা জেরা করে না নিধি। কিন্তু এবারই প্রথম করায় বেশ ঘাবড়ে গেলাম। ডাক্তারের ডিটেইল ও আমার রোগ-ব্যাধি সম্পর্কে জানালাম। সব দেখে-শুনে বউয়ের কপালে হাত।
‘ওরে গাধা, তুমি কী ডাক্তারকে চেনো নাই?’
‘মানে! ডাক্তারের আবার কী চিনবো?’
‘বিয়ের পর আমার এক্স সম্পর্কে তোমাকে বলেছিলাম, মনে নেই?
এই আসাদ জামানই আমার এক্স, সাবেক প্রেমিক। বিয়েতেও এসেছিল। কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে গেছে দাওয়াত।’ বউয়ের কথা শুনে আমার মাথার ভেতর ঘূর্ণিঝড় শুরু হলো। সামান্য ঠান্ডা, জ্বর, কাশি থেকে জল কতদূরে গড়িয়েছে এবং কেন গড়িয়েছে সেটা আঁচ করতে পারলাম। অন্য ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে আমার প্রেসক্রিপশন, ওষুধ ও টেস্ট রিপোর্ট চেক করালাম। জানতে পারলাম এতদিন ধরে সামান্য জ্বর, মাথাব্যথার ওষুধ আর ভিটামিন খেয়ে দিন পার করেছি। টেস্ট রিপোর্টও নরমাল। আসাদ জামান, মানে আমার বউয়ের এক্স, আমাকে আচ্ছামতোন খেলে দিয়েছে। এইবার বুঝলাম এক্স’কে কেন সবাই কালসাপের সাথে তুলনা দেয়!
গল্পের বিষয়:
গল্প