নভেম্বরের শুরুতেই এবার কুয়াশা পড়ে গেলো। ভোরের ফিনফিনে শীতে, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে প্রচন্ড আলসেমি লাগে আমার। তবুও কম্বলের মোলায়েম ওম ঠেলে ঠান্ডা মেঝেতে রাখা স্লিপারে পা জোড়া গলিয়ে দিলাম। তখনও পিতা পুত্র কুম্ভকর্ণের মতোই গভীর ঘুমে বিভোর। ঝটপট ফ্রেশ হয়ে এক কাপ কড়া লিকারের চা করে ব্যালকনিতে এসেছি।
সকালের সুর্যটা এখনো চোখ মেলেনি। সবেমাত্র পত্রিকাওয়ালাদের সাইকেল আর কিছু রিক্সা, ভ্যান রাস্তায় বেরিয়েছে। এখান থেকে রাস্তার শেষ মাথাটা স্পষ্ট দেখা যায়। সার বাঁধা দুটো বাড়ি পরেই পুরোনো ধাঁচের তিনতলা বাড়ি। তবে বাড়ির বাইরে জোর করে চাপানো রঙের আবহে আধুনিকতার আধিক্য বেশ চোখে লাগে। ওই প্রাচীন কাঠামোর নব্য সংস্কার্রজিত বাড়িটিই, জেবাদের বাড়ি। আজ ক’দিন যাবত বাড়ি জুড়ে বর্ণিল মরিচ বাতিগুলো দিনমান অবিরামভাবে জ্বলছে আর নিভছে। যেনো সমস্ত শহরকে জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আজ এ বাড়িতে বিরাট আনন্দ উৎসব। উৎসবের বাড়িতে মানুষ দিন নেই রাত নেই, সর্বক্ষন আলো জ্বালিয়ে রাখতে চায়। আর শোকের বাড়িকে ঢেকে দেয় অন্ধকারের কালো পর্দায়। যেন এটাই অঘোষিত নিয়ম।
ক্যালেন্ডারও জানান দিলো আজ নভেম্বরের দশ তারিখ, শুক্রবার। আজ জেবার বিয়ে। জেবা, আমার ছোট খালার মেয়ে। উনিশ বছরের সতেজতায় মোড়ানো স্নিগ্ধ এক প্রানবন্ত তরুণী। তবে স্বভাবে সে কিঞ্চিৎ চঞ্চল। উজ্বল মিষ্টি হাসিমাখা মুখখানা চকচকে সোনালী জরির মতো ঝলমল করে সারাটিক্ষন। দীর্ঘ পল্লবের ডাগর চোখ জোঁড়া দেখলেই বুকের ভেতর কেমন চিনচিনে ব্যাথা হয়। মনে হয় এ চোখ জোড়া যে কোনো পুরুষ হ্রদয় মুহুর্তেই বিবশ করে দিতে বড় উদগ্রীব। সত্যি বলতে, মেয়েরা যদি জানতো তাদের দৃষ্টি বুকের কতখানি গভীরে গিয়ে ছুঁয়ে দেয়। তাহলে তারা এক সেকেন্ডের জন্যও হয়তো চোখের পাতা জোড়া ঝাপটাতো না। মোবাইল ফোনের কর্কশ শব্দে ভাবনা বেলুন ফস করে উড়ে গেলো। এই সাতসকালে কে ফোন করলো আবার? জেবা নয়তো? আমি শোবার ঘরের দরজায় এগোতেই দেখি সাজ্জাদ হাত বাড়িয়ে ফোন আমার দিকে এগিয়ে ধরেছে।
– ছোট খালা কল করেছে। খুব রাগ। নাও সামলাও। আমি তড়িৎবেগে মোবাইল হাতে তুলে নিলাম। সাজ্জাদ আবার গলা অবধি কম্বল টেনে সটান হয়ে শুয়ে পড়েছে।
– হ্যাঁ খালা বলো। এত ভোরে ভোরে কল দিলে।
– তোর কি হয়েছে বীথি? এক ডালা ডালের পাঁকন আর দুইটা ডিমের পুডিং পাঠিয়েই দায়িত্ব শেষ করে দিলি? ওইদিকে জেবার যে কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশ অবস্থা। একবার উঁকি দিয়েও দেখার প্রয়োজন বোধ করলিনা?
আমি ছোট খালাকে কি উত্তর দেবো ভেবে পাইনা। অকস্মাৎ দ্রুত ভেবেচিন্তে, প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলি।
– সব ঠিকঠাক ছিলো তো খালা। জেবা খেয়েছে? ওর তো ভীষন প্রিয়।
– তুই এসে দেখে যা। আজো যদি না আসিস আমি জীবনেও আর তোর মুখ দেখবো না। বলে দিলাম।
ছোটখালা দুম করে কলটা কেটে দিলো। আমি ম্লান মুখে এন্ড্রয়েডের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলাম। প্রচন্ড অসহায় লাগছে নিজেকে।
– বীথি, এ্যাই বীথি। তোমার কি হয়েছে বলবে? এত আদরের বোনটার হলুদে গেলেনা। বিয়েতেও যাবেনা বলছো। অতুল ভীষন উদ্বিগ্ন গলায় বললো।
– শরীটা ভালো লাগছেনা। জ্বর এসেছে মনেহচ্ছে।
– কই? কাছে আসো তো। কপালটা দেখি।
– ছাড়ো তো, লাগবে না এখন। আমি মেপে দেখেছি, ১০১ এর মতো টেম্পারেচার।
– নাপা খেয়েছো?
– হুম খেয়েছি। নাস্তা দিচ্ছি। জলদি টেবিলে এসো।
এক চুলায় সাজ্জাদের গ্রীন টীর পানি বসিয়ে অন্যপাশে নিহালের ডিম পোচ করলাম। দুপুরে আজ ওরা বিয়ে বাড়িতে খাবে। বুয়াকেও আসতে না করেছি। একা আজ আমার রান্নার ওতো ঝুট ঝামেলা নেই। ফ্রীজে গতকালের তরকারী রাখা আছে। ক’টা ভাত ফুঁটিয়ে নিলেই হয়ে যাবে।
রিফাত আবার গ্রীনটি খেতে পারতো না। ওর ছিলো আমার মতই কড়া লিকারের ঘন দুধ চায়ের নেশা। জেবা ওকে চা- খোর বলে বলে ক্ষ্যাপাতো সারা দিন। তবে শান্ত স্বভাবের রিফাত প্রতিবাদ করতো না তেমন। নেহাতই পেরে না উঠলে তখন আবার আমার দারস্থ হতো। বিপরীত মেরু আকর্ষন করে বলেই জেনে এসেছি। তাই হয়তো, বিবাদ মিটিয়ে ওরা নিজেরাই চুপে চুপে শান্তিচুক্তি করে নিয়েছিলো। কিন্তু সেই চুক্তি যে প্রনয়ে বদলে যাবে তা আন্দাজ করতে আমার খুব বেশি সময় ব্যয় করতে হলো না। মেয়েরা ভাব-ভালোবাসার বিষয় দ্রুত আঁচ করতে পারার ক্ষমতা নিয়েই জন্মায়। রিফাত সাজ্জাদের ফুফাতো ভাই। দুর্দান্ত মেধাবী অথচ দরিদ্র ঘরের সন্তান। অসচ্ছলতা যদিও ওর মেধাকে তিল পরিমান অনুজ্বল করতে পারেনি। বুয়েটে চান্স পেয়েও অর্থাভাবে যখন হিমশিম খাচ্ছিলো। সাজ্জাদ ওকে ডেকে এনে বললো, ‘ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যদি ভুলে যাস, তাই তোকে ঋনী করে রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম।” কাছাকাছি বাড়ি হওয়ায় জেবা প্রায়ই বাসায় আসতো। একদিন বললো,
– আপা, দুদিন পর ফার্স্ট ইয়ারের এক্সাম। আমি হায়ার ম্যাথে যাচ্ছে তাই। রিফাত ভাইয়া যদি একটু ম্যাথ বুঝিয়ে দিতো। আমি ভাবলাম, ভালোইতো হবে তাহলে। শাপে বর। দুজনই পড়াশোনা নিয়ে ব্যাস্ত থাকবে। তাই বললাম,
– ঠিক আছে। আমি বললে রিফাত না করবে না। সেই থেকে শুরু। তুমুল প্রেমে যখন দুজনই আচ্ছন্ন। একশো একটা লাল গোলাপের তোড়া নিয়ে একদিন বাসায় এসে উপস্থিত হলো জেবা। জিজ্ঞেস করলাম,
– কে দিয়েছে রে? বললো ওর কলেজ বান্ধবী। অথচ তোড়া’র ভেতর ছোট কার্ডে কিছু একটা লেখা দেখলাম। ‘ এবেলার দহন দিনের শেষে, মেঘ বাদলে ভেজে বুক। অনেক অভাব চিনে বুঝেছি, সুখ মানে সে তোমার মুখ।’ আর তার এক পাশে ছোট্ট করে নীল কালীতে ইংরেজি বর্ণ (R) লেখা। এ আর (R) যে স্বয়ং রিফাত সেটা আবিষ্কার করতে গোয়েন্দা হবার প্রয়োজন নেই। সেদিনই সমস্ত সংশয় উপেক্ষা করে জিজ্ঞেস করলাম,
– তুই রিফাতকে ভালোবাসিস? জেবা হঠাৎ আমার মুখে এমন প্রশ্নে রীতিমতো ঘাবড়ে গেলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
– আমাকে ছুঁয়ে কথা দাও কাওকে বলবে না। আমি নিজের উত্তেজনা সামলাতে পারলাম না। ঠাস করে জেবার বাম গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। তারপর বললাম,
– এই গোলাপ কেনার টাকাটাও হয়তো কারো কাছ থেকে ধার করে এনেছে। জানিসই তো ও ওর বাবা কৃষক। মা সারাদিন গরু ছাগলের পেছনে দৌড়ে মরে। তোর শ্যানেলের দামী পারফিউম কি ওদের হাতের গোবরের গন্ধ ম্লান করতে পারবে? তার’চে সব কিছু ভুলে যা, সুখে থাকবি তুই। জেবা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। আমি ওর পীঠে হাত বুলিয়ে দেই। ও হঠাৎ আমার চোখে দৃষ্টি স্থির করে। তারপর এক দমে বলে বলে যায়
– তুমি কি এখনো তোমার প্রাক্তনকে ভুলতে পেরেছো আপা? ওর প্রশ্ন অপ্রস্তুত আমাকে মুহুর্তেই টেনে নিয়ে যায় বারো বছর আগের এক বৃষ্টি বিধুর সন্ধ্যায়। যেখানে আষাঢ়ে ঘন বর্ষন ছাপিয়ে শুধু একটি বাক্যই সাইরেনের মতো কানে বেজেছিল বার বার। ‘ ভালো থেকো বীথি, খুব ভালো থেকো ‘ আমি তো দিব্যি ভালো আছি এখন। নিজের অতীত বরাবরই সবার কাছ থেকে আড়ালে রেখেছি। যে অতীত স্বপ্ন দেখায় না। বরং ভাঙে। তাকে কেউ জিইয়ে রাখতে চায় না। আমিও চাইনি। আমি কড়া গলায় ধমক দিয়ে জেবাকে বললাম,
– হ্যাঁ ভুলে গিয়েছি। তুইও যত জলদি ভুলে যাবি ততো ভালো হবে। সেই ঘটনার দু’দিন পর আমি রিফাতকে ডেকে বললাম।
– হলে সিটের ব্যবস্থা কবে হবে তোমার? যতো জলদি পারো ব্যাবস্থা করো। আর এখানে থাকা চলবে না। আমার রুঢ় কণ্ঠস্বরে ও নিমেষেই সবকিছু বুঝে নিয়েছিলো। মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকে শুধু বলেছিলো,
– ভাবী, মানুষ কেনো ভালোবেসে ভুল করে? তাকে নিজের করে পাবেনা জেনেও কেনো হাত বাড়ায়? বলতে পারেন?
ওর আর্ত চোখে জল টলমল করে। আমি চুপ করে ছিলাম। কারন, এ প্রশ্নের উত্তর আজো আমি খুঁজে পাইনি। তবে এই কষ্টের গভীরতা আমিও গভীরভাবে অনুভব করি। সেই ছেলেটার নাম ছিলো নিলয়। আমি ডাকতাম নিলয় ভাই বলে। আব্বার চাকরীর সুবাদে আমরা তখন কাপ্তাই থাকতাম। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সরকারী কোয়াটারের দোতলায় আমাদের পাঁচ জনের গোছানো সংসার। বিল্ডিং এর সবার সাথে পরিবারের সদস্যের মতোই সম্পর্ক ছিলো। শবে বরাতের হালুয়া রুটি, রমজানের ইফতার কিংবা শীতের ভাঁপা-পুলি কেউই কাউকে ছাড়া উদরস্থ করতো না সহজে।
সেই সাথে ছিলো প্রয়োজনে চিনি, নুন, তেল, হলুদ সহ এটা ওটার মধুর লেনা-দেনা। সেই সুবাদেই আম্মা এক ভরদুপুরে আধা কাপ হলুদ আনতে পাঠালেন নাসরিন ভাবীর বাসায়। হলুদ ছাড়া নাকি আম্মার ডাল রান্না হবেনা। ওনারা থাকতেন নিচ তলায়। গিয়ে টোকা দিতেই নিলয় দরজা খুলে দিয়েছিলো। সেই প্রথম দেখা আমাদের। কে জানতো স্বল্প সময়ের দেখাই সামনের দিনগুলোয় দীর্ঘ বিরহের কারন হবে। নাসরিন ভাবী তখন আট মাসের অন্তঃস্বত্তা। বিকেলে সবে কলেজ থেকে ফিরেছি। হঠাত হন্তদন্ত হয়ে নিলয় ভাই বাসায় এসে আম্মাকে ডাকতে শুরু করেছেন। আতংকে আর চিন্তায় বিবর্ণ ফ্যাকাশে চেহারা। কি হয়েছে আম্মা জিজ্ঞেস করতেই বললো,
-খালাম্মা, আপার মনে হয় পেইন উঠেছে। আমি বুঝতে পারছিনা কি করবো। দুলাভাইতো অফিস থেকে এখনো ফেরেনি। আম্মা সেকথা শুনেই ছুটলেন তার পিছু পিছু। আমিও পা মেলালাম। সাথে সাথেই লোকজন খবর দিয়ে পরিচিত একজনের গাড়িতে করে পৌঁছুলাম হাসপাতালে। সারা রাস্তায় নাসরিন ভাবী আম্মার হাতটা ধরে ছিলেন। প্রসব ব্যাথায় কাঁদতেই কাঁদতেই বলেছিলেন,
– খালাম্মা, আমার যদি কিছু হয়, আমার ভাইটার কি হবে খালাম্মা। আমার মা মরা ভাই।
আমি তখন সদ্য কলেজের সিঁড়ি ছোঁয়া তরুনী। বোনের কষ্টে নিলয় ভাইয়ের ছল ছল চোখজোড়ায় যেনো নিজেকে অতলে হারিয়ে ফেলছিলাম। সারা রাত সবাই নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়েছি। নাসরিন ভাবীর শারীরিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করলো।দায়িত্বরত ডাক্তার অপারেশানের পারমিশান চাইলেন। কিন্তু ভাবীর প্রচুর ব্লিডিং হওয়ার দরুন তক্ষুনি ব্লাড দিতে হবে। নিলয় ভাই আমতা আমতা করে বললেন যে তিনি দিবেন। সেইম ব্লাড গ্রুপ তাদের। নার্সের সাথে ব্লাড দিতে যাওয়ার আগে উনি পানি খেতে চাইলেন। আমি সাথে করে আনা বোতল এগিয়ে দিলাম। লক্ষ্য করে দেখলাম উনার হাত কাঁপছে। বোতলটা ঠিককরে ধরতে পারলেন না। মেঝেতে ফেলে দিলেন। আমি বললাম,
– রক্ত দিতে ভয় পাচ্ছেন? এত ভীতু কেনো আপনি?
যখন কেবিনে গিয়ে বেডে শুলেন। খেয়াল করে দেখলাম ফ্যানের নিচেও উনি দর দর করে ঘামছেন। অবশেষে রাত প্রায় দশটার দিকে নবজাতকের কান্নার শব্দে পুরো হাসপাতালও খিলখিল করে হেসে উঠেছিলো সেদিন। নাসরিন ভাবীর শ্বশুর পক্ষের আত্নীয়দের সব বুঝিয়ে দিয়ে আমরা চলে যাওয়ার জন্য তিন তলা থেকে নিচে নামছিলাম। আম্মা আগে আগে নেমে গিয়েছেন। সিঁড়ির কাছে আসতেই হঠাৎ ইইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলো। কিন্তু সাথে সাথেই জেনারেটরটা চালু হলোনা। আমি অন্ধকারে দিগ্বিদিক জ্ঞ্যান ভুলে আতংকে চিৎকার করে আম্মাকে ডাকতে আরম্ভ করেছি। তখনই পেছন থেকে নিলয় ভাইয়ের গলা পেলাম।
– ভেবেছিলাম আপনি খুব সাহসী।লজ্জা আর অস্বস্তিতে ততক্ষনে আমার মাথা বুক অবধি নেমে গিয়েছে। এক মিনিট বাদেই জেনারেটর চালু হলো। তারপর উনি স্বাভাবিক গলায় বললেন,
– আমার ট্রিপানোফোবিয়া আছে।
– এটা আবার কি? কখনো শুনিনিতো।
– আমি ইঞ্জেকশানের সূঁচ মারাত্বক রকমের ভয় পাই। ছেলেবেলায় রীতিমতো অজ্ঞান হয়ে যেতাম। এখন অনেকটা সামলে উঠেছি।
– আর আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পাই আমাকে পুরো বাক্য শেষ করতে না দিয়েই উনি বলে উঠলেন,
– অন্ধকার তাইতো? দুজনেই সমস্বরে হেসে উঠলাম সে কথায়।
-বীথি কই তুমি? চা দিলে না তো এখনো! সাজ্জাদের ডাকে যেন সম্বিত ফিরে পেলাম। তাকিয়ে দেখি চুলোয় চায়ের পানি শুকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। জলদি নতুন করে পানি ফুটতে বসালাম। নিহাল কিচেনে এসেই ঘুম জড়ানো গলায় বললো,
– মা আমার নীল শার্টটা খুঁজে দিয়ে যাও না প্লীজ। কাবার্ডে পাচ্ছিনা। সাজ্জাদকে চা দিয়ে নিহালকে তৈরী করতে করতেই ঘড়িতে বারোটার ঘন্টা বাজলো।
– গেলেই কিন্তু পারতে। জ্বর তো কমেছে বোধহয়। জেবা কাল খুব কাঁদছিলো। আমার বিয়েতে না যাওয়ার কারন সাজ্জাদ জানে না। ভেতরে ভেতরে রিফাতের জন্য মনটা ভার হয়ে আছে। ল্যাব পরীক্ষাগুলো নিশ্চই খুব খারাপ হচ্ছে। কী কষ্টটাই না পাচ্ছে ছেলেটা। বললাম,
– আমি পরে গিয়ে একদিন দেখা করে আসবো। আর নাহয় জেবাকে রাতে ফোন করে নিবো। ওরা বেরিয়ে গেলে দরজার নব লাগিয়ে আবার ব্যালকনিতে এসেছি। এই ভর দুপুরেও বিয়ে বাড়ির বাতিগুলো জ্বলছে। তবে এই আলোকে দিনের সত্যিকারের আলোয় ভীষন ক্ষীণ দেখাচ্ছে। আমরা তখন যুগল প্রজাপতির মতো পুরো কাপ্তাই শহর চষে বেড়াতাম। এক একটা বিকেল কী মধুর সিম্ফনি দিয়ে আমাদের মাতিয়ে রাখতো। গোধুলীর দুপুর ধোঁয়া সুর্যটাও মেঘেদের কাঁধে চুল এলিয়ে দিয়ে, আমাদের দেখে মুখ টিপে হাসতো। নিলয় ভাই তখন পাশে দাঁড়িয়ে বলতো,
– বীথি, দুজন ভীতু মানুষ একসাথে থাকলে ভয়কেও হারিয়ে দেয়া যায় খুব সহজে? আমি জানতে চাইতাম,
– কিভাবে? উনি মুচকি হেসে বলতেন,
– এই যে এখন যেমন আছি। তোমার ছায়ার পিঠে আছড়ে পড়েছি সমুদ্রের তেড়ে আসা ঢেউয়ের মতন। আর তুমি আঁজলা পেতে নির্ভয়ে পিপাসা মেটাচ্ছো। এই অনুভূতির নাম কি ভয়? আমি মাথা নেড়ে “না” বোঝাতেই উনি চোখে দুষ্টু হাসি এনে বলতেন,
– এই অনুভূতির অন্য একটা নাম আছে। তুমি কি জানো সেটা কি?
আমি হাসতাম। লজ্জায় রাঙা হতাম। কিন্তু সবচেয়ে যে ভয়ে সারাক্ষন তোলপাড় চলতো অলিন্দের গভীরে। সাঁড়াশির মত চেপে বসতো আরো প্রবল হয়ে। সে ভয়ের তীব্রতা তখনও বুঝিনি। এই তুমুল বসন্তের দিনগুলোতে আচমকা আষাঢ়ে মেঘের গর্জনে চারদিক কাঁপিয়ে তুললো। বিধ্বংসী ক্ষ্যাপাটে ঝড় এসে উপস্থিত হলো একদিন। কলেজে হঠাৎ সেকেন্ড পিরিয়ড চলাকালীন প্রিন্সিপ্যাল স্যার তার রুমে ডেকে পাঠালেন। আমাকে দেখেই স্যার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালেন। ভারী কালো ফ্রেমের চশমাটা আলগোছে শার্টের কোনায় মুছে নিয়ে বললেন,
– বীথি, তোমার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমি সিদ্দিককে তোমার সাথে যেতে বলেছি। ও হাসপাতালটা ভালো করে চেনে। স্যারের কথায় মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে দারোয়ান সিদ্দিক চাচার সাথে হাসপাতালে গেলাম। গিয়ে দেখি আম্মা প্যাথলজি ল্যাবের সামনে বসে আছে। রিপোর্টে মোটা ব্লক লেটারে লেখা “সেরিব্রাল হেমারেজ”। অথচ সকালে দিব্যি সুস্থ মানুষটা হেঁটে অফিসে গিয়েছিলো। তারপর দুটো দিন, কী যে হুড়োহুড়ি ব্যাস্ততা। আব্বা ব্রেইনস্ট্রোক করেছেন। তার প্রভাবে শরীরের বা’পাশে কোনও শোধবোধ নেই। অথচ আর দু’বছর পর উনি চাকরী থেকে অবসরে যেতেন।
শয্যাশায়ী আব্বার অবস্থায় ক্রমাগত অবনতি দেখে আম্মা সিদ্ধান্ত নিলেন ঢাকায় যাবেন। সেখানে আত্নীয় স্বজন বুক পেতে না দিলেও একেবারে পায়ে ঠেলবে না। ছোট বোনটা মাত্র ক্লাস এইটে পা দিলো আর ভাইটা ফাইভে। দুশ্চিন্তার দরিয়ার দিনভর আম্মাকে ডুবে থাকতে দেখে আমি নিলয় ভাইয়ের কাছে একখানা ভাসা চর খুঁজে মরতাম। কিন্তু নাসরিন ভাবীও আর আমাদের সাথে আগের মতো আহ্লাদ করতেন না। বরং নিজ থেকেই গা বাঁচিয়ে চলতেন। প্রধান প্রকৌশলী থেকে পংগু বাবার মেয়ের দাম দাঁড়িপাল্লায় সুর সুর করে নিচে নেমে গিয়েছিলো ততদিনে। নিলয় ভাইয়ার ভার্সিটির ছুটি ফুরিয়ে এসেছিলো। আমরাও ঢাকার টিকেট কেটেছিলাম। যাবার আগে একবার শেষবারের মতো দেখা করার সুযোগ পেয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটেছিলাম চার তলা বাড়ীর খোলা ছাদে। আমার অসহায় মন সেদিন চূড়ান্তভাবে ভেঙে চুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিলো সে ছাদের ওখানে ওখানে।
– বীথি, যদি বলি অপেক্ষা করতে, সেটা এই মুহুর্তে সম্ভব হবেনা,জানি। আর যদি বলো এখন বিয়ে করতে সেটাও অসম্ভব। তবে জানিয়ে রাখি সামনের মাসে আমার অনার্স ফাইনাল। তাছাড়া আপার আমাকে নিয়ে আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন। সরকারী চাকুরে হবো। মা-বাবা নেই তো। আপাই আমার সব।
– তাহলে, এই যে স্বপ্ন দেখালেন? তার দায় কার? একা আমার? ঘুড়ি উড়িয়ে দিয়ে সুতো ছিড়ে দিলেন।
উনি নিরুত্তর। দলা পাঁকানো কান্নায় কণ্ঠরোধ হয়ে আসে বার বার। তবুও খটখটে শুকনো চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,
– আপনার সিদ্ধান্ত কি বলুন।
– ভেবে নেবে এটা একটা আলপটকা স্বপ্ন ছিলো। দেখবে ভালো থাকবে তাহলে।
– আর আপনি?
– ভবিষ্যত তো দেখা যায় না। তবে আমি বিশ্বাস করি যেখানেই থাকি না কেনো, আমাদের আবার দেখা হবে। হয়তো অন্য কোথাও, অন্য কোনও ভাবে।
সেদিনের ঘন বর্ষার বৃষ্টিতে, চার তলার সেই ছাদে, একা আমি অকারন ভিজেছি। তখনই বুঝেছি কষ্টেরা জলে ধুয়ে যায় না। প্যারালাইজড আব্বাকে নিয়ে আম্মা আবার মোহাম্মদপুরে আমার নানার বাসায় এসে উঠলেন। সেই আর্থিক এবং মানসিক সংকটের মুহুর্তে, নানাবাড়ির সবার তাগাদায় আমাকে বিয়ের পিড়িতে বসতে হলো। আব্বা যেনো অন্তত মেয়ের বিয়েটা স্বচক্ষে দেখেন। তাছাড়া নিলয় আর আমার ব্যাপার আঁচ করতে পারলেও নিলয়কে আত্নীয় স্বজনরা কেউই চিনতো না। না সাজ্জাদের সাথে বিয়েতে আমি অসুখী হইনি। বিয়ের পর আমাকে নিজ উদ্যগেই কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। নিজে একজন ব্যাবসায়ী হয়েও কখনো দাম্পত্য জীবনে লাভ লোকশানের সওদা অন্তত সে করেনি। বেল বাজছে অনেকক্ষন ধরেই। কী পুরোনো ভাবনায় ডুবে ছিলাম এতক্ষন!
-ওমা এত জলদি ফিরে এলি? কি রে নিহাল, বউকে কেমন দেখলি।
– মা, জেবা খালামণিকে সিনেমার রাণীর মতো করে সাজিয়েছে। অনেক ছবি তুলেছি আমি। বাবার ফোনে আছে। দেখাবো?
– আগে ফ্রেশ হয়ে নে। ঘাঁড় ঘুরিয়ে দেখি সাজ্জাদ আবার বেরুচ্ছে।
– কি ব্যাপার। আবার কোথায় যাচ্ছো।
– ফার্মেসিতে। তোমার নাপার পাতা দেখলাম শেষ। নিয়ে আসি। নিহাল ফ্রেশ হতে গেলো। সাজ্জাদ ফোন ফেলে গিয়েছে ভুলে। দু’মিনিটের মাথায় দৌড়ে এসে বললো।
– মা এবার ছবি দেখো। ফোন গ্যালারীতে গিয়ে পপ আপ করতেই জেবা আর নিলয় ভাইয়ের যুগল ছবি ভেসে উঠলো স্ক্রীনে। সেই ছবি দেখে আমার হাত- পা ক্রমশ অবশ হয়ে এলো। দাঁড়ানো থেকে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লাম। হাত ভিজে গিয়েছে ঘামে। ছবিতে নিলয়ের পাশে তো আজ বধু বেশে আমিও থাকতে পারতাম! নিহাল অবাক হয়ে জানতে চাইছে,
– কি হয়েছে মা? আমি নিষ্প্রভ চোখে তাকিয়ে শুধু বলি,
-কই কিছু হয়নি তো!
যেদিন ছোট খালা বাসায় এসেছিলেন। চট্টগ্রাম গনপুর্ত অধিদপ্তরে চাকুরীরত ইঞ্জিনিয়ার মাবরুর রহমানের
বায়োডাটা নিয়ে। সেদিন বায়োডাটার এক কোঁনে সাঁটা পাসপোর্ট সাইজ ছবিটি দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। শরীরের লোম লেবু কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে ছিলো অনেকক্ষন। সেই সরকারী ইঞ্জিনিয়ার আর কেউ নয়, স্বয়ং নিলয়। ট্রিপানোফোবিয়া ভোগা ছেলেটি এখন প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার। হাসিখুশি নিলয়ের ছবি দেখে মনে পড়ে গেলো অনেকবছর আগের বলা সেই কথাগুলো, ‘যেখানেই থাকি না কেনো, আমাদের আবার দেখা হবে। হয়তো অন্য কোথাও, অন্য কোনও ভাবে।’ পৃথিবী গোলাকার বলেই হয়তো নিলয়ের মুখাবয় ঘুরে ফিরে আবার সমুখে এলো। শুধু আমাদের সম্পর্কের নামটা বদলে গিয়েছে এখন।
সময় বদলায়, মানুষ বদলায়। বদলায়না শুধু মানুষের অতীত। আসলে ভবিষ্যতে রিফাত আর জেবার কষ্টের ভার দ্বিগুণ হোক, সেটা আমি চাইনি। আমার পরিপাটি সংসারে অযাচিত অশান্তি এসে আস্তানা গাড়ুক সেটাও আমি চাইনি। তাই প্রচন্ড স্বার্থপর হয়ে দুজনকেই নিরবে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। জেবার বিয়ের এ ক’টা দিন অপরাধবোধের অতল গহবরে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলাম। শত শতবার ওদের দু’জনের কান্নাভেজা চোখ বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুঁচড়ে শেষ করে দিয়েছে। একদিকে নিলয়কে নিয়ে আমার অতীত। অন্যদিকে রিফাত জেবার বিচ্ছেদী বর্তমান। যেনো একই আয়নার দু’টো দিক। সে আয়নায় আমি আর মুখ দেখতে চাই না। কখনো চাইনা। সাজ্জাদ হাতে করে নান্নার কাচ্চি নিয়ে ফিরলো। সাথে বোতল ভর্তী বোরহানি। আমি ওর কাজকর্মে কিছুটা বিরক্ত। দুপুরে এত ভারী খাবার খেয়ে এখন সন্ধ্যে না গড়াতেই কেনো এসব?
– বীথি, এখনো বেশ গরম। নিহালকেও ডাকো।
– তুমি কি এখন আবার এই রিচ ফুড খেয়ে ব্লাড প্রেশারের দফারফা করে ছাড়বে? শেষে তো আমাকেই দৌড়াতে হবে হাসপাতালে। সাজ্জাত চুপ করে রইলো। ফিল্টার থেকে পানির জগ ভরলো। বক্স থেকে প্লেটে খাবার নিলো। তারপর যেটা করলো। তার জন্য আমি একদমই প্রস্তুত ছিলাম না।
– বীথি, নাও, হা করো, নান্নার কাচ্চি কিন্তু।
– হা করবো মানে? ভর সন্ধ্যায় কি ন্যাকামো শুরু করেছো।
-আজ তো দেখলাম কিছুই রান্না করোনি। ভাতও না। না খেয়ে বসে আছো। তাই ভাবলাম তোমার পছন্দের কিছু কিনে আনি। তাছাড়া তোমার শরীরটাও খারাপ করেছে। এরই মাঝে নিহাল এলো রুমে,
-ওমা জানো, বাবাও তো খায়নি আজকে। বলেছে পেট ব্যাথা করছে। আমি চোখ বড় বড় করে সাজ্জাদের দিকে তাকালাম।
-কি বলছে নেহাল? কি হয়েছে? সত্যি খাওনি?
– ওসব কিছুনা। আসলে তোমাকে ফেলে খাবার আমার গলা দিয়ে নামতো না। এতদিনে কখনো এমন হয়েছে বলো?
– এত ভালোবাসো আমাকে? সাজ্জাদ ভ্রু কুঁচকে জাবাব দেয়,
– সন্দেহ আছে বুঝি?
-আচ্ছা, আমার একটা কথার উত্তর দেবে?
– বলো কি কথা। আমি কয়েক মুহূর্ত ভেবে বললাম,
– মানুষ কেনো ভালোবেসে ভুল করে, বলোতো? ভুল সময়ে কেনো অনুভূতি জমায়?
– এটা তো খুব সাধারন প্রশ্ন বীথি।
ভালোবাসায় ভুল বলে কিছু নেই, ভুল থাকে কেবল মানুষে। অনুভুতিতেও ভুল থাকেনা, ভুল থাকে সময়ের ছঁকে।
আমার এতগুলো বছরের অমিমাংসীত প্রশ্নের কি সহজ উত্তর খুঁজে দিলো সাজ্জাদ! প্রশ্ন করা শেষ? আচ্ছা নাও এবার হাঁ করো, সাজ্জাদের তুলে দেয়া খাবারের নলা মুখে নিয়ে আমি বিড়বিড় করে বলি, এতোটা কাল নিজের অজান্তেই একজন ভুল মানুষের জন্য কী তীব্র অনুভূতি বয়ে বেড়িয়েছি। স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে থেকে বর্তমানের প্রাপ্তিগুলোকেও গাহ্য করিনি। আমাকে মাফ করে দিও তুমি। সাজ্জাদ আমার কথার কিছুই শুনতে পায় না। হাতে কাঁচের গ্লাস নিয়ে বলে,
– এক চুমুক বোরহানি খাও। তোমার ভালো লাগবে। বুকের ভেতর ততক্ষনে জমাট কান্নারা মাতম তুলতে অস্থির। চোখ ফেটে গরম জল বেরিয়ে আসতে চায়। সাজ্জাদ প্রচন্ড হতবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে, জিজ্ঞেস করে,
– এ্যাই বীথি কি হয়েছে তোমার? এমন করে কাঁদছো কেনো? আমি উত্তরে শুধু বললাম, ঠিক মানুষটাকে ভালোবেসেছি বলে। আমার কথা শুনে সাজ্জাদ হাসছে। কী অদ্ভুত সুন্দর সে হাসি।
গল্পের বিষয়:
গল্প