মায়াবিনী

মায়াবিনী
বছর কয়েক আগে সোস্যিয়াল মিডিয়াতে আপত্তিকর ছবি ভাইরাল হওয়া একটা মেয়ে যে আমার বউ হবে এ আমার কল্পনারও বাহিরে।বাবা-মায়ের পছন্দমত মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী করবো ভেবে নিজেকে তেইশ টি বছর মেয়েদের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছিলাম।অবশ্য তারজন্য বন্ধুমহলেও কম বেগ পেতে হয় নি আমাকে।অনেকজনের অনেকরকমের কথার সম্মুখীন হতে হয়েছে বহুবার।কিন্তু সেইসব তোয়াক্কা করে চলেছি বরাবরই।বন্ধুরা সবাই বলতো,’দোস্ত এইবার একটা প্রেম করেই ফেল,আর কতদিন এভাবে একা একা থাকবি।বন্ধু হিসাবে তো আমাদেরও একটা দায়িত্ব আছে নাকি? তাদের কথা শুনে আমি প্রত্যুত্তরে শুধু হেসেছি। ইচ্ছে ছিলো নিজে স্বাবলম্বী হয়ে তারপর বিয়ে করার।বেকার জীবনটা যে একধরনের অভিশাপ, তা আমার হাই-স্কুলের বন্ধু নিতিনকে দেখে ভালোমত বুঝে গিয়েছি।সবাই যখন এস এস সি তে পাস করে কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম,তখন নিতিন মারিয়া নামক একটা মেয়ের প্রেমে ডুবে গিয়ে লেখাপড়াকে চান্দে তুলে দিয়ে বিয়ে করে বসলো কাউকে না জানিয়ে।আমরা সবাই রীতিমতো অবাক,এতো অল্প বয়সে বিয়ে!অবশ্য নিতিনের পরিবার থেকেও বিয়েটা মেনে নেই নি।
ফলস্বরূপ নিতিনকে বাধ্য হয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে গার্মেন্টস-এ ঢুকতে হলো।যেই বয়সে ওর আমাদের সাথে ক্যাম্পাসে বসে থেকে আড্ডা দিতে দিতে একসাথে কফি খাওয়ার কথা,সেই বয়সে কর্মজীবন ওর মাঝ থেকে দিনের আলো টুকুও কেড়ে নিয়েছে।মাঝেমধ্যে নিতিনের সাথে দেখা হয় আমার।ব্ড্ড খারাপ লাগে ওর জন্য।উজ্জল শ্যামবর্ণের চেহারাটা কালো আলকাতরার মত হয়ে গিয়েছে।শরীরে মাংসের ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাওয়া যায় না।আমাকে দেখলেই কেমন যানি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বোকার মত হেসে বলে,”ভালোই আছি মোটামোটি। সেই ভালো থাকার ভিতরে আমি সুস্থ্যতা আর সুখ খুঁজে পাইনা।কেমন যানি এক বুক হতাসা আর দারিদ্রতা মিশে একাকার হয়ে থাকে সবসময়।
নিতিনকে দেখে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম,নিজে স্বাবলম্বি না হয়ে কখনো বিয়ে করবো না।আর প্রেম তো একবারেই নয়।
কিন্তু হঠাৎ করে মায়ের অসুস্থতার জন্য আর তা সম্ভব হলো না।হুট করেই মা একদিন বলে বসলো,”বাবা তোর কি কাউকে পছন্দ হয়,মানে তোর কি কোনো মেয়েকে ভালো লাগে?যদি পছন্দ করে থাকিস,তাহলে বলতে পারিস আমাকে।” ভার্সিটির জন্য রেডি হচ্ছিলাম,মায়ের মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে চোখ মুখ একসাথে গোল আলুর মত হয়ে গেলো।অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,”কেন মা!হঠাৎ একথা জানতে চায়ছো কেন? মা মৃদু হেসে বললো,”আসলে এখনকার জেনারেশনের সব ছেলে-মেয়েদের তো নিজ নিজ পছন্দের মানুষ থাকে।আর তুই যেহেতু ভার্সিটিতে পড়াশোনা করিস,তাই জানতে চাইলাম।কেন আমি মা হয়ে কি ছেলের খোঁজ নিতে পারিনা?
-তুমি ছাড়া আর কে খোঁজ নিবে আমার।তবে আমার ওসব নেই।মানে কোনো পছন্দের মানুষ নেই। কথাটা বলে বেরিয়ে আসলাম।রাতে বাসায় এসে শুনলাম,মা আমার জন্য একটা মেয়ে পছন্দ করে এসেছেন।মেয়ে দেখতে শুনতে মাশআল্লাহ্,তার দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয়ের মেয়ে।আগামী সপ্তাহে নাকি সেই মেয়ের সাথে আমার বিয়ে।সন্তান হিসেবে বরাবরই বাবা-মায়ের বাধ্যগত আমি।আর এটাও মনে প্রানে বিশ্বাস করি,যে বাবা-মা যখনই যা-ই করুক না কেন,কখনো আমার খারাপ চাইবে না।তবুও একটাবার বললাম,”মা নিজে স্বাবলম্বী না হয়ে বিয়ে করাটা কি ঠিক হবে?
মা আশ্বাস দিয়ে বললো,”বিয়ে উপরওয়ালার নিয়ামত।বিয়ে করলে রোজগারের পথ উম্মুক্ত হয়,আর তুই স্বাবলম্বী না হলে কি হয়ছে এখন নাই কয়েকদিন না হয় কয়েকমাস পর তো হবি।আর আমার শরীরের অবস্থা কেমন তা তো ভালোই জানিস।এমন অবস্থাতে সংসারের কাজ করা আমার জন্য কষ্টকর।আর বউমা আসলে অন্তত গল্প করে সময় কাটানোর মত একটা মানুষ তো পাবো।তুই আর না করিস না বাবা। মায়ের কথাগুলো শুনে আর হ্যা বা না কোনকিছুই বললাম না।
পারিবারিকভাবে এক সপ্তাহ পর আমার আর নীলার বিয়ে হলো। বিয়ের আগে কখনো মেয়েটাকে দেখি নি। তবে মা বলেছিলো,”মেয়েটা নাকি দেখতে অনেক সুন্দর। আজকে আমাদের বাসর রাত,বন্ধুরা নানানরকম কথা বলে ঠেলেঠুলে রুমে পাঠিয়ে দিলো।হার্ট বিটের ধপধপ শব্দটাকে আজ কেন যানি খুব কাছ থেকে অনুভব করছি,কেমন যানি একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে মনের ভিতরে। রুমে ঢুকে দেখলাম একঝাক গাঁদা ফুলের মাঝে লাল দোপাট্টা নামিয়ে একটা গোলাপ ফুল চুপটি মেরে বসে আছে। পা টিপে টিপে কোনরকমে কাছে এসে দাঁড়ালাম।গলাটা কেমন যানি শুকিয়ে গিয়েছে।বুকের ধপধপ শব্দটা ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে।মেয়েটা এখনো আগের মতই দোপাট্টা নামিয়ে বসে আছে।
মেয়েটাকে দেখার জন্য মনটা কেন যানি ছটফট করছে,এই প্রথম কোনো মেয়েকে দেখার জন্য মনের মাঝের ব্যাকুলতার স্পিড বাড়ছে ক্রমাগতভাবে। একবার ইচ্ছে হলো দোপাট্টা টা তুলে একপলক দেখে নেই।পরক্ষণেই আবার হাতটাকে নিজের জড়তা টেনে ধরলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,”আসসালামু আলাইকুম। দোপাট্টার ভিতর থেকে মৃদু কণ্ঠে জবাব এলো,”ওয়ালাইকুম আসসালাম। কণ্ঠটা শোনা মাত্র মেরুদন্ড বেয়ে হিমশীতল বাতাস বয়ে গেলো মুহূর্তে।মেয়েটার কণ্ঠটা ভারি মিষ্টি,মেয়েটা নিশ্চয় তার কণ্ঠের মতই দেখতেও মিষ্টি আর মায়াবি হবে। নিজের ভিতরে সাহস এনে খাটের এক পাশে চুপটি করে বসলাম।তারপর কাপাকাপা হাতে দোপাট্টাতে হাত দিতে যাবো,ঠিক তখনি মেয়েটি বলে উঠলো,”আমাকে ধরবেন না। আমি কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
মেয়েটা আবার বললো,”আপনি কিছু মনে করবেন না প্লীজ।আপনি আমার মুখ দেখলে হয়তো আমাকে আর এই ঘরে থাকতে দিবেন না। মেয়েটার কথার আগামাথা কিছুই বুঝলাম না।বিয়ের আগে তো মা বলেছিলো মেয়েটা দেখতে অনেক সুন্দর।রুমে ঢুকার আগেও কাজিন বললো,তাদের ভাবি নাকি অনেক সুন্দরী।তাহলে আমাকে কেন বলছে মুখ দেখলে আর রুমে থাকতে দিবো না। “কেন আপনার মুখে কি এমন আছে,যে মুখ দেখলে আর রুমে থাকতে দিবো না? মেয়েটা জড়তার সাথে বললো,” কিছুই নেই।তবে এই মুখের আড়ালে একটা ছোট্ট গল্প আছে,ভিষণ করুন আর নোংরা গল্প।যেই গল্পটার জন্য এই মুখটাকে কেউ সহ্য করতে পারে না।
আমি আরো জানার ইচ্ছে দেখিয়ে বললাম,”আমি আপনার মুখ দেখতে চাই।কি এমন আছে ঐ মুখে,যে মুখ দেখলে আপনাকে আর সহ্য হবে না।আমি আপনার মুখ দেখতে চাই। “কথা দিন আমাকে ডিভোর্স দিবেন না। ” কি সব উল্টাপাল্টা কথা বলছেন।দেখান তো আপনার মুখ দেখান আগে। মেয়েটা ইতস্ততভাবে তার মুখের উপর থাকা দোপাট্টা টা সরাতেই নিজের ভিতরে একটা কম্পন অনুভব হলো আমার।মনে হলো কেউ এসে সজোরে ধাক্কা মেরে খাট থেকে দূরে সরিয়ে দিলো। আরে এইটা তো সেই মেয়ে,যার আপত্তিকর ছবি কয়েকমাস আগে পুরো নেট দুনিয়ার বুকে সোস্যিয়াল মিডিয়াতে তোলপাড় শুরু করেছিলো।এমন কি ক্যাম্পাসে এখনো পর্যন্ত অনেকের মুখেই এই মেয়েকে নিয়ে বলতে শুনি।আর এখন কি না সেই মেয়ে আমার বউ।যাস্ট ভাবতে পারছি না আমি।মাথাটা কেমন যানি মূহুর্তে চক্কর দিয়ে ঘুরে উঠলো। আমি সরে গিয়ে বললাম,”আপনি!
আমার এমন রিয়াক্ট দেখে মেয়েটা খাট থেকে নেমে পা চেপে ধরে আকুতি-মিনতি করে বলতে লাগলো,” দয়া করে চিৎকার করবেন না।সবাই শুধু উপরের গল্পটা জেনে আমাকে ঘৃণা করে এসেছে এতদিন ধরে। কিন্তু সত্যি টা কেউই জানে না।দয়া করে একটু ধৈর্য ধরে পুরোটা শুনুন।তারপর আপনি যা বলবেন তাই মেনে নিবো আমি।ডিভোর্স দিলেও মুখ বুজে এ বাসা ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যাবো।কোনদিন আপনার সামনে আসবো না। মেয়েটার কথাগুলো কেন যানি আমাকে দমিয়ে দিলো।আমি মেয়েটার হাত ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে জানতে চেয়ে বললাম,”বলেন। মেয়েটা তার চোখের পানি মুছে নিয়ে বলতে শুরু করলো,”সেদিন ছিলো বৃষ্টির রাত।পুরো এলাকা জুড়ে ভারি বর্ষনে বৃষ্টি ঝরে পড়ছিলো।বৃষ্টি আমার ভালো লাগলেও বিদ্যুৎ চককানোকে আমি প্রচন্ড ভয় পাই। তাই সেদিন রুমের দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমার স্পষ্টভাবে মনে আছে,সেদিন রাতে বেশ কয়েকবার মা আমার রুমে এসেছিলো।যতবারই এসেছিলো,ততোবারই আমার কপালে হাত রেখে মৃদুস্বরে বলেছিলো,”মা নীলা, ঘুমিয়েছিস?
আমি প্রতিবারই ঘুমঘুম চোখে আধো চোখ খুলে মায়ের ঝাঁপসা মুখটা দেখে আবার ঘুমিয়ে পড়ছিলাম।কিন্তু বুঝি নি,এমন আসা যাওয়া টা আমার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াবে। সেদিন রাতে আমাদের বাসায় আমি বাবা-মা সহ আমার দুঃসম্পর্কের এক কাজিন ছিলো। নাম,রহিত।বাহিরে থাকে,কয়েকমাসের ছুটিতে দেশে ফিরে আমাদেরকে দেখতে এসেছিলো সেইদিন।কিন্তু তখন বুঝি নি,ঐ বিলেত ফিরত কুত্তাতা আমার পবিত্র ইজ্জতে কামড় দিয়ে দাগ বসিয়ে দিবে। হয়তো আমার নিয়তিতে ছিলো এমনটা,তা না হলে রহিত যেদিন এসেছিলো,সেদিনই কেন বৃষ্টি নামতে হয়েছিলো। বৃষ্টির জন্য বাবা-মা রহিতকে যেতে বারণ করলে সেও আর জোর না করে থেকে যায়। তিন রুমের বাসা হওয়াতে কারো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়,অযথা কেন বৃষ্টির ভিতরে বাড়ির অতিথি বার হয়ে যাবে।
এমনটাই বলেছিলো বাবা,তারপর আর রহিত না করে নি।থেকে গেছিলো আমার পাশের রুমে।কিন্তু কে জানতো,ওর মনের ভিতরে এমন একটা বাজে চিন্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে,জানলে সেইদিনই তাকে খুন করে ফেলতাম আমি। নীলার কণ্ঠটা কেমন যানি ভারি হয়ে আসছিলো,আমি টেবিলের উপর থাকা পানির জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে ওর হাতে দিতেই নীলা ঢকঢক করে পুরোটা পান করার পর কিছুক্ষণ দম নিলো। তারপর আবার বলতে শুরু করলো,” তখন বাজে,রাত বারোটার মত। রহিত রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,”এই নীলা ঘুমিয়েছিস? অপরিচিত কণ্ঠস্বরে নিজের নাম শুনতে পেয়ে আমি ঘুমের ভিতরে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বসে দেখি,রহিত আমার রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। বিছানা ছেড়ে উঠে বললাম,”ভাইয়া এতো রাতে তুমি?
-কেন ডিস্টার্ব করলাম তোকে?
-নাহ্ ডিস্টার্ব করবা কেন?ভিতরে আসো।
রহিত আমার থেকে তিনবছরের বড়,তবুও লম্বা আর শারিরিক দিক থেকে কেন যানি আমাকেই ওর থেকে বড়লাগতো।তবুও বড় হওয়াতে তুমি করেই বলতাম আমি। রহিত ভিতরে এসে বললো,”তোর জন্য একটা জিনিস এনেছি,জানি না তোর পছন্দ হবে কি না। আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম,”আমাদের যা দেওয়ার তা তো সেই বিকেলেই দিয়ে দিছো।এখন আবার এতো রাতে কি দিবা?
-আর বলিস না,তখন দিতে খেয়াল ছিলো না।তুই তো এখন বড় হয়েছিস।ভার্সিটিতে যাস।তাই তোর জন্য এই বিলেতি পারফিউমটা নিয়ে এসেছি। ঘ্রাণ নিয়ে দেখ,তোর পছন্দ হয় কি না? কথাটা বলে ব্লু কালারের একটা কাচের শিশি আমার দিকে এগিয়ে দিলো,রহিত। বোতলটা বেশ ছোট।আমি বললাম,”ভাইয়া এখন রেখে দেই,আগামীকাল সকালে ভার্সিটি যাওয়ার সময় লাগিয়ে দেখবো।
-আরে কি বলিস,আমি তো কাল ভোরে চলে যাবো।তখন যদি তোর ঘ্রাণটা পছন্দ না হয়।
তার চায়তে এখন শুঁকে দেখ,তোর পছন্দ হয় কি না। আমি বাধ্য হয়ে পারফিউমের বোতলটা নিয়ে হাতের তালুতে একটু লাগিয়ে নাকের কাছে ধরতে মাথাটা চক্রর দিয়ে উঠলো।মূহুর্তের ভিতরে দু চোখে রাজ্যের ঘুম এসে ভিড় জমালো আমার।তারপর আর কিছু মনে নেই আমার। পরদিন ভোরে সবকিছুই ঠিকঠাক।ঘুম থেকে উঠে মায়ের মুখে জানতে পারলাম,রহিত ভোরের ট্রেনে বার হয়ে গিয়েছে। সবকিছুই বেশ স্বাভাবিকভাবেই চলছিলো। কিন্তু ঝামেলাটা হলো সেইদিন,যেদিন শুনলাম বাবা-মা আমার সাথে রহিদের বিয়ে ঠিক করেছে। সেইদিন প্রথম মায়ের মুখের উপরে আমি না করে দেই। বলেছিলাম,”ভাই ভাই এর জায়গাতে থাকুক।তাকে কখনো স্বামীর স্থান দিতে পারবো না। রহিতেরও আমাকে খুব পছন্দ হয়েছিলো।তবে আমার এভাবে সবার মুখের উপরে না করে দেওয়াটাই ছিলো সবচায়তে বড় ভুল। একদিন সন্ধ্যার সময়,রহিত আমাকে ফোন দিয়ে বললো,”তুই নাকি আমাকে বিয়ে করবি না বলেছিস?
-হ্যা,আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না।তুমি আমার ভাই,ভাইয়ের জায়গাতেই ভালো আছো।
-তারমানে আমাকে বিয়ে করবি না।
-না ভাইয়া,সম্ভব না। সেদিন আর রহিত কিছু বলে নি।কয়েকদিন পর রহিত আবার বাহিরে চলে গেলো। বাহিরে যাওয়ার কয়েকদিন পর আমাকে একদিন ফোন দিয়ে বলে,”একটা ভিডিও দেখবি?
-কিশের ভিডিও দেখাবা তুমি?
-ওয়েট দিচ্ছি।
মিনিট পাঁচেক পর মেসেঞ্জারে একটা তিনমিনিটের ভিডিও আসলো রহিতের আইডি থেকে।আর ভিডিও টা চালু করা মাত্রই আমার মাথার উপরে আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।হাত থেকে মোবাইলটা মেঝেতে পড়ে গেলো।মেঝের উপর পড়ে থাতা মোবাইলের স্ক্রীনে আমার ভিডিও চলছে।
আমি অর্ধনগ্ন অবস্থাতে বিছানাতে সুয়ে আছি।আর সেই ভিডিও কেউ ধারণ করেছে। বৃষ্টির শব্দ শুনে আর বুঝতে বাকি রয়লো না,কাজটা রহিত নিজেই করেছে।এবং ঐদিন রাতেই করেছে। ফোনটা হাতে নিয়ে সাথে সাথে মেসেজ দিলাম,”এই ভিডিও কে করছে,নিশ্চয় তুমি? জবাবে রহিত অনেকগুলো হাসির ইমোজি দিয়ে বললো,”আগে জানলে আমার ক্যামেরাটা নিয়ে যেতাম।তাহলে ভিডিওটা আরো সুন্দর হতো,কি বলিস? নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না,সাথে সাথে গালি দিয়ে বসলাম,”কুত্তার বাচ্চা,তোর মনে এই ছিলো।এই তোর নারীদের প্রতি সম্মান।ভিডিওটা ডিলেট কর বলছি। আমার কথা শুনে,রহিত আরো ক্ষেপে গিয়ে বললো,”তোর রূপের খুব বড়াই,তাই না।
দাঁড়া তোর বড়াই ছুটাচ্ছি।বলেই আমাকে ব্লক মেরে দিলো।আর তারপর থেকে একের পর এক বন্ধু-বান্ধবি আপত্তিকর মেসেজ আসা শুরু করলো। বুঝতে বাকি রয়লো না,মানুষরূপি জানোয়ারটা আমার ভিডিও আর কিছু ছবি সোস্যিয়াল মিডিয়াতে আপলোড করে ভাইরাল করে দিয়েছে। বাবা জানতে পারলেও তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো।রহিতকে লন্ডনের পুলিশ গ্রেফতার করে।কিন্তু ততোক্ষণে যা হবার হয়ে গিয়েছে। দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ তখন আমার আপত্তিকর ছবিগুলো আর ভিডিওটা দেখে নিয়েছে। সবাই ধরেই নিয়েছে,আমি ইচ্ছে করে আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে ওমনভাবে ছবি আর ভিডিও ধারণ করেছি।কিন্তু সত্যিটা কেউই জানে না।সেদিনের পর থেকে আর কখনো বাসার বাহিরে বার হয় নি।যেই ভার্সিটিতে একদিন না গেলে ছটফট করতাম,সেখানে দিনের পর দিন না গিয়ে নিজ বাসার চার দেওয়ালের মাঝে বন্দিদশা জীবন কাটিয়েছি।
কি এমন দোষ করেছিলাম,যার জন্য এতো বড় একটা শাস্তি পেতে হলো আমাকে।আমি তো শুধু আমার মতামত
টাই জানিয়েছিলাম।সেটাই কি আমার অপরাধ ছিলো? এখন আপনার ইচ্ছে,আপনি যা বলবেন তাই হবে।তবে দয়া করে আজকের রাতটা আমাকে আপনার রুমে থাকতে দিন। ছোট থেকে শুনে এসেছি,প্রতিটা মেয়েরই নাকি বাসর রাতকে ঘিরে সুন্দর একটা স্বপ্ন বুনা থাকে।আমারো ছিলো,দয়া করে আজকের রাতটা এই রুমে থাকতে দিন আমাকে। নীলা কাঁদতে কাঁদতে খাটের উপর ধপাস করে বসে পড়লো।মেয়েটার কান্নার ভিতরে কোনোরকম অভিনয় বা মিথ্যের আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছি না আমি।একদম বাচ্চাদের মত ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। শরিরের রক্ত গুলো কেন যানি টগবগ করে ফুটছে,ইচ্ছে করছে খুব করে মারধর করতে।তবে সামনে থাকা সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী,নীলাকে নয়।বিলেতে থাকা ঐ অমানুষটাকে।
একটা মানুষ,এতোটা নিকৃষ্ট কিভাবে হতে পারে?সামান্য বিয়ের জন্য একটা মেয়ের সুন্দর ভবিষ্যৎ টাকে এভাবে নষ্ট করে দিলো। ঘুরে দাঁড়িয়ে নীলার কাছে এসে থমকে দাঁড়ালাম।আচ্ছা কখনো পতিতা দেখেছেন? নীলা আমার কথাতে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,”টিভির পর্দাতে দেখেছি। “তারা হাজার টা পুরুষের সাথে দৈনিক শারিরিক সম্পর্ক করার পরও যদি একটা সুস্থ্য-সুন্দর জীবনের কল্পনা করতে পারে,তাহলে সেখানে তো আপনি একদমই নিষ্পাপ।আপনি তো ইচ্ছে করে আর ওসব করেন নি। বর্তমানে এমনও কত মেয়ে আছে,প্রেম ভালোবাসা নামক মোহ তে পড়ে,বয়ফ্রেন্ড নামক যৌবন-শোষক একটা মানুষের হাতে সবকিছু ছেড়ে দেয়। অনেকের টা ভাইরাল হয়,অনেকের টা আবার গোপন থাকে,কোই তারা তো দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাহলে আপনি কেন নয়? আপনাকে আমি সেই সাহসটা দিবো।
আমারো ছোট থেকে স্বপ্ন ছিলো,আমার জীবনসঙ্গিনী এমন একজন মেয়ে হবে,যে সদা সর্বদা সত্যি কথা বলবে।
আর জন্ম,মৃত্যু,বিয়ে এইগুলো নিয়ে আমি তেমন মাথা ঘামাই না। কারণ এই তিনটা জিনিস উপরওয়ালা ঠিক করে রাখে,এখানে কারো হস্তক্ষেপ করার অধিকার থাকে না।আর উপরওয়ালা যেহেতু আপনাকে আমার জীবনে এনে দিয়েছেন,সেহেতু সে নিজে কিছু ভেবে তারপরই এনেছেন। সুতরাং আপনাকে চায়লেও আমি আমার জীবন থেকে আলাদা করতে পারবো না। আমি হতে চাই আপনার ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্নগুলোকে গড়ে দেওয়ার কারিগর,সেই সৌভাগ্য টুকু কি আমার হবে? নীলা আমার দিকে বাকরুদ্ধ নয়নে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়লো,তারপর খাট থেকে নেমে পায়ে সালাম করতে গেলে তাকে তুলে নিয়ে বললাম,” তোমার জায়গা ওখানে নই,আমার বুকে। আজ থেকে তেইশ বছর ধরে খালি রাখা জায়গাটা তোমার নামে রেস্ট্রি করে দিলাম।
তুমি তোমার ইচ্ছেমত বসত করো,বিনিময়ে আমি আর আমার পরিবারটাকে ভালোবেসে আগলে রেখো। কি পারবে না? নীলা বুকের ভিতরে মুখ লুকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললো,”হুম,খুব পারবো। কথাটা বলে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। মনে হচ্ছে হৃদয়ের শিরা উপশিরা জুড়ে মেয়েটা তার আত্মাকে আমার ভিতরে প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে।গাঁদা,গোলাপ আর রজনীগন্ধার সুভাসে ডিম লাইটের আলোতে আলোকিত রুমটা যেন সুবাসিত হয়ে মো মো করছে। হয়তো এতোদিন ধরে এই মেয়ের জন্যই আমার তিতিক্ষা,আর প্রতিক্ষা।যা আজকে তাকে বাহুডরে জড়িয়ে নেওয়ার পর পূর্ণতা পেলো।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত