শ্রাবণী রেগে আছে

শ্রাবণী রেগে আছে
আমার বিয়ের জন্য আজ মেয়ে দেখতে যাবো। আমার সাথে আমার বাবা মা, আমার এক কলিগ আর এক চাচা যাবেন। এই অব্দি ঠিক ছিলো কিন্তু না, আমার সাথে আরো যাবেন মামা-মামী, খাল-খালু, ফুফা-ফুফি, মামাতো ভাইবোন, খালাতো ভাইবোন, মার একবান্ধবী আর তার ছেলে আরো কয়েকজন যাবে যাদের আমি নিজেই ভালো করে চিনি না এত মানুষ দেখে আমি বাবাকে বললাম,
— বাবা, এইসব কি! এতজন কেন? বাবা মুখ গোমড়া করে বললো,
– আমি নিজেও জানি না। তোর মাকে জিজ্ঞেস কর আমি মাকে আলাদাভাবে ডেকে বললাম,
— মা, আমি তো মেয়ে দেখতে যাচ্ছি। মেয়ে তুলে আনতে তো যাচ্ছি না। আমার জানামতে মেয়ের বাবা হাই স্কুলের মাস্টার আর মেয়ের একটা ছোট ভাই আছে ক্লাস এইটে পড়ে। সেই হিসাবে ওরা মেয়ে দেখানোর নাম করে আমাদের কিডন্যাপ করার চান্স নেই। তাহলে শুধু শুধু এত সামরিক বাহিনী নিয়ে যাচ্ছো কেন? মা কিছুটা রেগে বললো,
– তুই এত বুঝবি না। আমার একমাত্র ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাবো। এতজন নিয়ে যাচ্ছি কারণ মেয়ের কোন খুদ(সমস্যা) থাকলে কারো না কারো চোখে নিশ্চয়ই পড়বে আমি এই মুহুর্তে কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। যাত্রা পথে মেয়ের বাড়ির জন্য বাবা দোকান থেকে যখন ১৫ কেজি মিষ্টি কিনছিলো তখন পিছন থেকে মা’র বান্ধবী বলে উঠলো,
~আরে দুলাভাই, আপনার কি বুদ্ধি-শুদ্ধি জীবনেও হবে না? মেয়ে দেখতে যাওয়ার সময় এত মিষ্টি কিনে নিয়ে যাওয়ার কি দরকার? দেখা গেলো মেয়ে পছন্দ হলো না তখন মিষ্টি সাথে নিয়েও আসা যাবে না। তারচেয়ে বরং ৫কেজি মিষ্টি নেন বাবা আমতা আমতা করে বললো,
– এতজন মানুষ শুধু ৫কেজি মিষ্টি নিয়ে যাবো? মা তখন বললো,
— রিনা ঠিক কথায় বলেছে। মেয়ে পছন্দ না হলে শুধু শুধু এতগুলো টাকার মিষ্টি জলে যাবে আমার নিরীহ বাবা, মা’র উপর কখনোই কিছু বলার সাহস পায় না। তাই মা’র কথা মতই ৫কেজি মিষ্টি কিনলো। আমি বাবার চেয়েও আরো বেশি নিরীহ। মা’র উপর আমারও কিছু বলার সাহস নেই মেয়ে দেখার আগে সবাই ভরপেট খাওয়া দাওয়া করে নিলো। কারণ পরে মেয়ে পছন্দ না হলে খেয়ে নাকি তৃপ্তি পাওয়া যাবে না। তাই আগে খাওয়া-দাওয়া পরে মেয়ে দেখা খাওয়া শেষ করে সবাই যখন মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন কিছুক্ষণ পর মেয়ে আসলো। পরনে সবুজ শাড়ি আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিকে মেয়েটাকে ভয়ংকর রকমের সুন্দর লাগছিলো। মেয়েটা আমার পাশের সোফাতে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলো। এমন সময় আমার ফুফি মেয়েকে বললো,
~মা, একটু হেটে দেখাও তো মেয়েটি মুচকি হেসে আমার ফুফিকে বললো,
-আমি তো কিছুক্ষণ আগে হেটে এসেই এইখানে বসলাম। উড়ে উড়ে এসে তো আর বসি নি, যে এখন হেটে দেখাতে হবে মেয়ের কথা শুনে বাবা বললো,
– মাশাল্লাহ, মেয়ে দেখছি বুদ্ধিমতী। মেয়ের কথায় যুক্তি আছে আমি বাবার হাতে চাপ দিয়ে বাবার কানে কানে বললাম চুপ থাকতে কারণ মা রেগে যাচ্ছে.. আমার বড়খালা উনার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা কলম আর কাগজ বের করে মেয়ের হাতে দিয়ে বললো,
~ তুমি এক কাজ করো মা। তোমার ঠিকানাটা ইংলিশে এই মুহুর্তে এইখানে একটু লিখে দাও মেয়েটি আবারও মুচকি হেসে খালাকে বললো,
– আমি ইংলিশে অনার্স করেছি আর আপনি বলছেন আমি যেন ইংলিশে আমার ঠিকানাটা লিখি। বিষয়টাকি আমার জন্য অপমান জনক না? বাবা তখন বললো,
– না না মা, তুমি অপমানবোধ করো না। আসলে আমার এই বড় শালীকে বর পক্ষ যখন দেখতে আসে তখন ইংলিশে ওর বায়োডাটা লিখতে বলেছিলো। তখন সে একলাইন লিখতে গিয়ে ৩বার কলম ভেঙেছিলো। এজন্যই সে ভাবে হয়তো সবাই ওর মতই কলম ভাঙবে। ও তোর আর এটা বুঝে না সবাই তো আর ওর মত ssc তে ইংলিশে দুইবার ফেল করে নি বাবার কথা শুনে মেয়েটি মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো আর আমি বাবার হাত চেপে ধরে বললাম, চুপ করো এইবার। বাসায় গেলে মা তোমার ১২টা বাজাবে মা’র বান্ধবী রিনা আন্টি বললো,
~সবি ঠিক ছিলো কিন্তু মেয়েটা একটু খাটো মেয়েটি তখন রিনা আন্টির পা থেকে মাথা অব্দি দেখে বললো,
– খাটো বলে সমস্যা কি? আমাকে দিয়ে তো আর বাসার সিলিংফ্যান পরিষ্কার করাবেন না, যে আমাকে লম্বা হতে হবে। ২ইঞ্চি হিল জুতা পড়ে চলাফেরা করলে বাকি মেয়েদের খাটোই মনে হবে। জুতা খুলে আমার পাশে এসে দাঁড়ালে দেখবেন আমার চেয়ে আপনি ১ইঞ্চি খাটো আছেন মেয়ের বাবা-মা মেয়েকে অনেকবার বুঝানোর চেষ্টা করছে মেয়ে যেন চুপ থাকে। কিন্তু মেয়ে উনাদের কোন কথা শুনে নি বাবা তখব মেয়েকে বললো,
– সিলিংফ্যান পরিষ্কার নিয়ে তোমার কিছু ভাবতে হবে না মা। তোমার শ্বাশুড়ি ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি। এইকাজ তোমার শ্বাশুড়িই করতে পারবে মা তখন কিছুটা রেগে গিয়ে মেয়েকে বললো,
– তোমার মুখ যেভাবে চলে রান্নার হাত সেভাবে চলে কি? রান্না বান্না কিছু পারো? মেয়েটি মার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো,
– আমি রান্নার কিছুই পারি না। বাবার বাড়ি কষ্ট করে রান্না করা শিখবো পরে যদি শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সে রান্না পছন্দ না হয় তখন তো আমার সব কষ্ট বৃথা যাবে। তাই ঠিক করেছি বিয়ের পর শ্বাশুড়ির থেকেই রান্না শিখবো মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে মা উঠে দাঁড়িয়ে মেয়ের মা-বাবাকে বললো,
– মেয়ে আমাদের পছন্দ হয় নি। আগে মেয়েকে আদব কায়দা শিখান কিভাবে বড়দের সাথে সম্মান করে কথা বলতে হয় মেয়েটি তখন মাকে বললো,
– পছন্দ হয় নি ভালো কথা। আপনারা আমাকে ২৫হাজার টাকা দিয়ে চলে যান কোন সমস্যা নেই মা অবাক হয়ে বললো,
– মানে! মেয়েটি দাঁড়িয়ে তখন বললো,
– এটা কোন কাঙ্গাল ভোজ না, যে আপনি দলবল নিয়ে এসে খেয়ে দেয়ে চলে যাবেন আর কোন দাম দিবেন না। আপনাদের জন্য আমার বাবার ১৮ হাজার টাকার বাজার করতে হয়েছে। আর আমার মা,খালা মিলে ভোর সকাল থেকে সেগুলো রান্না করেছে। তাদের কষ্টের তো একটা দাম আছে নাকি? সেই হিসাবে আমাকে হয় ২৫ হাজার টাকা দিবেন নয়তো আপনার ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে করাতে হবে। আপনি আপনার ছেলের জন্য মেয়ে দেখতে আসবেন সেজন্য আপনি, আপনার ছেলে আর বড়জোর পরিবারের দুই একজন আসতে পারেন। কিন্তু আপনি তা না করে চোদ্দগুষ্টি নিয়ে এসে হাজির হবেন এটা কেমন কথা?
আপনারা এতজন আসবেন শুনে আমার বাবা অন্যের থেকে টাকা ধার করে বাজার করেছেন। আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারের মায়েদের কখনো সাহস হয় না একসাথে ৩ পদের তরকারি রান্না করতে। কিন্তু আমার মা আপনাদের জন্য ৭ পদের তরকারি রান্না করেছে যাতে আপনাদের খেতে কোন সমস্যা না হয়। এত কিছুর পরে যখন আপনারা বলেন, “মেয়ে খাটো তাই পছন্দ হয় নি” কিংবা ” মেয়ে রান্নাবান্না পারে না তাই মেয়ে পছন্দ হয় নি”
তখন মেয়ের বাবা মার কিংবা মেয়ের মেনে কতটা কষ্ট হয় জানেন? নেক্সট টাইম যখন ছেলের জন্য মেয়ে দেখতে যাবেন তখন দলবল না নিয়ে গিয়ে ছেলে আর আপনার পরিবারের ৩-৪ জন যাবেন। এতে মেয়ে পছন্দ না হলেও মেয়ের বাবা মার এতটা হয়রানি আর এতটা কষ্ট হবে না আমি বাবার হাতে চাপ দিতেই আমার নিরীহ বাবাটা হঠাৎ সাহসী হয়ে বললো,
– এই মেয়ে আমার পছন্দ হয়েছে। এই মেয়েকেই আমি আমার ছেলের বউ হিসাবে চাই। বিয়ে এখনি হবে। আমার পরিবারের কেউ যদি এই বিয়েতে বাধা দেয় তাহলে ৩য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে বলে দিলাম রাত ১২ঃ৪০ বাজে। আমি আর মেয়েটি ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। মেয়েটি ছাদের কার্ণিশে হেলান দিয়ে আনমনে অন্যদিনে তাকিয়ে আছে। আমি মেয়েটির কাঁধে হাত রাখতেই মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে রেগে গিয়ে বললো,
– ইচ্ছে করছে তোর নাক বরাবর ঘুষি মারি। অই, আমাদের বাসায় কি আগুন লেগেছিলো যে তুই দমকল বাহিনী নিয়ে এসেছিলি? আমি তখন মেয়েটিকে (মানে শ্রাবণী আমার বহুদিনের গার্লফ্রেন্ড) বললাম,
— আরে আমি জানতাম নাকি ওরা এতজন আসবে এমন সময় আমার ফোনটা বেজে উঠলো। আমি ফোনটা রিসিভ করতেই উপর প্রান্ত থেকে বাবা বললো, ” হারামজাদা, তোর ভালোবাসার মানুষকে তুই যেন বিয়ে করাতে পারিস সেজন্য তোকে সাহায্য করার কারণে আমার ভালোবাসার মানুষ আমায় ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তোর মা নাকি আমায় ডিভোর্স দিবে” আমি কিছু না বলে ফোনটা কেটে অফ করে দিলাম। বাবা-মার বিষয়টা কাল সকালে দেখা যাবে আপাতত শ্রাবণীকে এখন শান্ত করি কারণ শ্রাবণী রেগে আছে…
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত