ভ্রান্তি বিনাশ

ভ্রান্তি বিনাশ
– ওই যে দেখ মেয়েটা যায় ওর বাপে দুই বিয়ে করছে, খুব লুই* স্বভাবের লোক ওই ব্যাটা।
কথাটা বলেই সবাই সমস্বরে হাসতে লাগলো। তাদের কথাগুলো শুনে রেহানার মনে হলো কেউ ওর কানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে যে আগুন হৃদয়ে পৌঁছে সমস্ত শরীরকে দগ্ধ করে ছারখার করে দিচ্ছে। সে আগুনকে সুপ্ত রেখে রেহানা তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে সুন্দর করে বলল, “তোমরা আমাকে নিয়ে কিছু বলছিলে?”
– না মানে ইয়ে….
– তোমরা কি জানো আড়ালে কাউকে কিছু বলাটা হলো গীবত। আর গীবত করা মৃত ভাইয়ের গোস্ত খাওয়া সমান। তোমরা কি তা খেতে খুব পছন্দ করো?
তাদের একজন বলে উঠলো, “ওই চুপ কর। বেশি জ্ঞান দিবি না, নিজের ঘর ঠিক নাই আসছে মানুষকে জ্ঞান দিতে।” আরেকজন বলল, “তোর বাপ লুই*, তোর বাপে দুই বিয়া করছে লজ্জা লাগে না? আবার তুই আসছিস জ্ঞানের কথা বলতে। তোর মুখে এসব বড় বড় কথা মানায় না বুঝলি?” রেহানার চোখে অশ্রু টলমল করছে ওদের কথার আঘাতে। কিন্তু নিজেকে সামলে সে বলল, “দ্বিতীয় বিয়ে করা মানেই কি একটা মানুষ খারাপ? তাহলে তো সবার আগে আমাদের নবীজী (সা.)কে খারাপ লোক বলতে হয় (নাউজুবিল্লাহ), কারণ তিনি একাধিক বিয়ে করেছেন। তাহলে কেন তোমরা দ্বিতীয় বিয়েকে এত খারাপ চোখে দেখো?”
ওরা কি বলবে হয়তো ভেবে পাচ্ছিলো না। রেহানা কোনরকম চোখের পানি মুছে বলা শুরু করলো, “শুনো একটা সময় ছিল যখন এই কথাগুলো আমাকে রোজ কাঁদাতো। অনেকেই খোঁচা দিতে বলতো কি রে, ছোট মা কে দেখছিস? খুব সুন্দরী বুঝি? আত্মীয় স্বজনদের বাসায় গেলে সবাই যেন সব জেনেশুনে ইচ্ছে করে আমাদের ছোট করতে জিজ্ঞাসা করতো, কিরে তোর বাবা নাকি আরেকটা বিয়ে করছে সত্যি নাকি? কেউ কেউ আবার নতুন বিয়ের কারণ জিজ্ঞাস করতো। যার কোন উত্তর আমার জানা ছিল না।
সেই সময়গুলো আমার এতটা কষ্ট লাগতো, মন চাইতো মাটি ফেঁটে দু’ভাগ হয়ে যাক আমি সেই মাটির ফাঁকে চিরতরে লুকিয়ে পড়ি যাতে আর কারো এই প্রশ্ন আমাকে শুনতে না হয়। লজ্জায়, ঘেন্নায় চোখে আসা অশ্রুকে সেখানে কোনভাবে সামলে নিলেও বাড়ি ফিরে কান্নায় বালিস ভেজাতাম। একটা সময় আর কারো বাড়ি যেতে ইচ্ছা করতো না। যেখানেই যেতাম সবাই এই প্রসঙ্গটা টেনে নিয়ে আসতো। মানুষ অন্যের খারাপটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে কেন এত মজা পায় আমি জানিনা। অথচ যাকে বলা হচ্ছে সে কতটা লজ্জা পাচ্ছে তার কতটা কষ্ট হচ্ছে কেউ তা একটি বার বোঝার চেষ্টাও করে না। তাদের কথার আঘাতে আমার বুকটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতো, ঠিক যেন তীরের মতো অন্তরে বিঁধতো তাদের কথাগুলো।
বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লো রেহানা। রেহানার কান্নায় মেয়েগুলো একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ কান্নার পরে নিজেকে শান্ত করে রেহানা আবার বলতে লাগলো, “এই ঘটনার কারণে মাঝেমাঝে বাবার উপর প্রচন্ড রাগ হতো সমাজের কাছে নিজেদের খুব ছোট মনে হতো। নতুন বন্ধু-বান্ধবের কাছে ব্যাপারটা হাইড করে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করতাম। সব সময় ভয়ে থাকতাম, তারা জানলে কি ভাববে! আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশিরা বলাবলি করতো, ছেলেরা তো ছেলে এই মেয়ের কি উপায় হবে৷ বাপের এমন কুকীর্তির কথা শুনলে কোন ভালো ফ্যামিলিই এই মেয়ে বিয়ে করাবে না। ভাববে বংশের চরিত্র খারাপ। যে বাপ এমন কাজ করে তার মেয়ে কি ভালো হতে পারে?
মূলত এইসব কথা বলে তারা আমার মা কে উস্কে দিত। তাদের কথায় মা বিলাপ করে কান্না করতো। আমার মা কে সান্তনা দেওয়ার মত কোন ভাষা ছিল না, কিন্তু মাঝে মাঝে মায়ের কান্না, বাবার সাথে অশান্তি সব আমার কাছে খুব বিরক্ত লাগতো। এই ঝামেলার কারণে কখনো কখনো পড়াশোনাতেও মনোযোগ দিতে পারতাম না। ইচ্ছা করতো সব ছেড়ে আমি দূরে কোথাও চলে যাই, কখনো টাকার জন্য, কখনো অনিশ্চয়তার ভয়ে, আবার কখনো ভোরের আলোর সাথে রাতের আধাঁরের কষ্টগুলো হারিয়ে যেতো বলে আমার আর কোথাও যাওয়া হয়ে উঠতো না।” একটানা কথাগুলো বলে দম নিলো রেহানা। ততক্ষণে ওই মেয়েগুলোরও চোখে পানি চলে এলো৷ তাদের মনে রেহানার জন্য মায়া জন্ম নিলো। তারা রেহানার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তারপর?”
রেহানা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলতে শুরু করলো, “এসবের মধ্য দিয়ে কেটে গেলো ৪ বছর। আমি এসএসসি পরিক্ষা দিয়ে ভালোভাবেই পাস করলাম। তারপর বাবা আমাদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। এখানে এসে আমি শহরের একটি কলেজে এডমিশন নিলাম। আর জানো তো গ্রামের মানুষের কাছে এসএসসি পাস মানেই একটি মেয়ে অনেক বড় অর্থাৎ বিয়ের উপযুক্ত। তো নানান প্রতিবেশি, আত্মীয়রা আমার জন্য পাত্র দেখা শুরু করলো। পড়ালেখার চিন্তা বাদ দিয়ে দু’একদিন পর পর আমি শাড়ি, চুড়ি পড়ে তাদের সামনে হাজিরা দিতে লাগলাম। সবাই আমায় পছন্দ করে গেলেও শেষ পর্যন্ত বাবার কথা জেনে আমার বিয়ে ক্যানসেল হয়ে যেত। বিয়ে ক্যানসেল হওয়ায় আমার দুঃখ হতো না, কিন্তু নিজেদের খুব ছোট আর অসহায় মনে হতো। খুব অপমানবোধ করতাম। সিদ্ধান্ত নিলাম নাহ! এভাবে বাঁচা সম্ভব না, আমাকে আমার বাবার পরিচয়ে নয় লোকে আমার পরিচয়ে চিনবে।
মা কে বোঝালাম বিয়ের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে। আগে নিজের পরিচয় তৈরি করবো যেন সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারি। তারপর বিয়ের চিন্তা। কারো কাছে মাথা নুইয়ে আমি বাঁচতে পারবো না। মা ও আমার কথায় সম্মতি দিলেন। এরমধ্যে এনড্রয়েড ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক খুব সহজলভ্য হয়ে যায়। তো ফেসবুকে বিভিন্ন ইসলামিক, গ্রুপ পেজ এসবের মাধ্যমে ধর্মীয় জ্ঞান লাভ করতে থাকলাম। সত্যি বলতে এর আগে নামাজ বা ধর্মীয় ব্যাপারে আমার জ্ঞান ছিল খুবই স্বল্প। মুসলিম পরিবারে জন্ম নিলেও আমাদের পরিবার প্যাক্টিসিং মুসলিম ছিল না। যার ফলে আমার ধর্মীয় জ্ঞান উন্নত ছিল না। ইসলামের ব্যাপারে যত পড়তে লাগলাম, জানতে লাগলাম ততো মুগ্ধ হতে লাগলাম। সেই সাথে মনের ভিতর নানানরকম প্রশ্ন সৃষ্টি হতে লাগলো। বিভিন্ন বিষয়ে জানার জন্য অন্তর ছটপট করতে লাগলো। সেই সময় দেখা পাই ফেরেশতার মতো একজন মানুষের।
যিনি আমার কৌতুহল গুলো মেটাতে নিঃস্বার্থভাবে চেষ্টা করে গেলেন। সকাল, বিকাল, দুপুর, রাত যখন যে প্রশ্ন মনে আসতো উনাকে জিজ্ঞাস করতে থাকতাম। উনি যা জানতেন বলতেন আর যা জানতেন না তা পরে জেনে বলবো বলতেন। ইসলামকে বোঝার সাথে সাথে দুনিয়াবী চিন্তাগুলো, কষ্ট গুলো আমার মন থেকে দূর হতে লাগলো। সেখানে বইতে লাগলো এক প্রশান্তির সু-বাতাস। তো একদিন বেশ হতাশায় ভুগে সেই ভাইকে জানালাম নিজের বাবার প্রতি আমার রাগ-অভিমানের কথা, বাবার দ্বিতীয় বিয়ের জন্য আমার জিবনের সমস্যাগুলোর কথা। সব শুনে তিনি আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, তোমার বাবা কি তোমাদের আর তোমার মায়ের দেখাশোনা করেন না? তোমাদের যাবতীয় খরচ বহন করেন না? তোমাদের কাছে আসেন না? আমি বললাম, হ্যাঁ তিনি আমাদের দেখাশোনা করেন, আমাদের যাবতীয় খরচ বহন করেন, আমাদের কাছে আসেন, আমাদের প্রতি সব দায়িত্ব পালন করেন।
তখন তিনি বললেন, তাহলে তুমিই বলো তোমার বাবা যদি তার দুই পরিবারেই সমান দায়িত্ব পালন করেন তবে তিনি কি করে অন্যায় করছেন? তোমার তো বরং তোমার বাবাকে নিয়ে গর্ব করা উচিত যে তিনি একসাথে দুইজন স্ত্রীর দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করছেন। তোমার বাবা তো কোন পরনারীর কাছে গিয়ে ব্যভিচার করছেন না, বরং বিয়ে করে, তাদের দায়িত্ব পালন করে তিনি নবী (সা.) এর সুন্নত অনুসরণ করছেন। দেখো বোন ইসলাম তো শুধু তা নয় যা তোমার মনমত তা তুমি গ্রহণ করবে আর যা মনমত নয় তুমি তা ছুঁড়ে ফেলবে। এইযে আমাদের নবীজি (সা.) ১১ টা বিয়ে করেছেন, একমাত্র আয়েশা (রা.) ব্যতীত সকল স্ত্রী ছিলেন বিধবা নবীজি (সা.) তাদের বিয়ে করে আশ্রয় দিয়ে দায়িত্ব পালন করা কি তুমি অপরাধ মনে করো?(নাউযুবিল্লাহ)
আমি বললাম, আস্তগফিরুল্লাহ এ কথা ভাবাও তো আমার জন্য পাপ। তিনি বললেন, তাহলে তোমার বাবার ব্যাপারে খারাপ ভাবা টাও তোমার পাপ। তিনি কোন অন্যায় করেননি। ইসলামে ৪ টি বিয়ে জায়েজ আছে৷ আর তোমার থেকেই শুনলাম তোমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী একজন ডিভোর্সী মহিলা ছিলেন। তাহলে তুমিই বলো উনার দায়িত্ব যদি তোমার বাবা না নিতেন উনি কিভাবে চলতেন? আল্লাহ প্রত্যেকের রিজিক নির্দিষ্ট করে দেন আর উনার রিজিক তোমার বাবার সম্পদে ছিল বলেই আল্লাহ তোমার বাবাকে তার স্বামী হিসেবে মনোনীত করেছেন৷ দ্বিতীয় বিয়ে কোন অসম্মান নয় বরং সম্মানের কাজ, যা এই সমাজের মূর্খরা বুঝতে পারেনা। কারণ তাদের দ্বীনি জ্ঞান নাই যার ফলে এটাকে খারাপ মনে করে। অথচ এটাও নবীর অন্যতম সুন্নত এটাকে সম্মান করা উচিত যা লোকে ভুলে গেছে।
তুমি নিশ্চয়ই এমন পরিবারে বিয়ে করতে চাও না যাদের দ্বীনি জ্ঞান নাই যাদের সাথে জান্নাতের পথে চলতে পারবে না? ধৈর্যধারণ করে দোয়া করো, আল্লাহ তোমায় তার উত্তম প্রতিদান দান করবেন। সেদিন আমার সমস্ত ভুল ভেঙে গেলো, আর সেদিন থেকে আমি আমার বাবার জন্য গর্বিত।”
অতঃপর চোখের পানি মুছে নিঃশব্দে হাঁটা দিলো রেহানা। মেয়েগুলো মাথা নিঁচু করে নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলো আর অনুশোচনা করতে লাগলো নিজেদের ব্যবহারের জন্য। তারা নিজেদের আচরণের জন্য তাওবাহ করার সিদ্ধান্ত নিলো। রেহানার ব্যবহার এবং তার বলা বাক্যগুলো হৃদয় ছুঁয়ে গেলো তাদের। তারা আজ নতুন করে জানলো ইসলাম আসলে নামমাত্র একটি ধর্ম নয় যে, যা ইচ্ছা মানবো যা ইচ্ছে ইগনোর করবো। ইসলাম হলো একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। তাহলে আপনি কবে বুঝবেন?
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত