চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাচ্ছি, বাসের মধ্যে উঠে দেখি আমার সাবেক স্ত্রী ও তার বর্তমান স্বামী বাসের মধ্যে বসে আছে। তাদের সাথে আমার মেয়ে স্নিগ্ধা যার জন্মদাতা আমি কিন্তু সে এখন ওদের সাথে থাকে। আমাদের যখন ডিভোর্স হয়েছে তখন আমাদের মেয়ে স্নিগ্ধার বয়স ছিল নয় মাস। আমার স্ত্রী নাজমা আক্তার বৃষ্টি ডিভোর্সের সময় বললো যে মেয়ে তার কাছে রাখতে চায়।
আমি যদিও কোন প্রতিবাদ করিনি কিন্তু তার বিরুদ্ধে কথা বলেছিল আমার মা-বাবা। তাদের কথা ছিল যে আমাদের নাতনী আমাদের কাছে থাকবে। কিন্তু আমার জন্য তারা বেশি কিছু বলতে পারে নাই, তবে আমার প্রতি আমার মা-বাবা অনেক রাগ করেছিল। আমার ডিভোর্স হবার এক বছরের মধ্যে কাকতালীয় ভাবে মা-বাবা দুজনই মারা গেল। মা অসুস্থ হয়ে বিছানায় ছিল কিন্তু সেই অবস্থায় হঠাৎ করে বাবা স্ট্রোক করে মারা গেল। বাবার মৃত্যুর ২৩ দিন পরে মা চলে গেল। যখন আমার মা-বাবা তাদের নাতনী নেবার জন্য চাপ দিচ্ছিল তখন বৃষ্টি অসহায় হয়ে যায়। সে ভালো করে জানতো যে নিয়মানুযায়ী মেয়ে আমাদের দিয়ে দিতে হবে। তাই সকল পথ বন্ধ দেখে বৃষ্টি একদিন কল দিয়ে বললোঃ-
– আমি জানি ডিভোর্স হয়ে গেছে তবু তুমি আমাকে ভালবাসো, আজও তুমি চাইবে না যে আমার কোন কষ্ট হোক। তাই না?
– আমি বললাম, যদি সেই বিশ্বাস থাকে তাহলে তো ছেড়ে চলে যেতে না।
– তোমার কাছে একটা অনুরোধ ছিল।
– বলো।
– আমি আমার মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে চাই, ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।
– আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে?
– (চুপচাপ)
– আচ্ছা ঠিক আছে বাদ দাও এসব, স্নিগ্ধা তোমার কাছে থাকুক সমস্যা নেই। কিন্তু আমার একটা শর্ত থাকবে, সেই শর্ত পালন করতে হবে।
– কি শর্ত?
– ওকে ওর বাবার আসল পরিচয় জানাবে, ও যেন ওর বাবা হিসেবে আমার নামটাই জানে। বহুকাল পরেও তার সাথে দেখা হলে সে যেন আমাকে তার বাবা বলে চিনতে পারে।
– ঠিক আছে তাই হবে, ওর বাবার নাম সজীব তাই সেটাই ও জানবে। আচ্ছা তোমার মা-বাবা কিছু বলে আবার প্রতিবাদ করবে না তো?
– না করবে না, মা-বাবা আর কতদিন বাঁচবে? তারা মারা গেলে তো আর কেউ থাকবে না। আর আমি তো আর আমাদের মেয়ে পালতে পারবো না, কারণ জীবন তো থেমে গেছে। বৃষ্টি আমাকে বাসের মধ্যে দেখে অবাক হয়ে গেল, তার চোখের চাহনি প্রকাশ করে দিচ্ছে তার হতবাক। আমি মুখের মধ্যে মাস্ক ভালো করে লাগিয়ে নিলাম, তারপর আরো দুই সিট পিছনে গিয়ে আমার বরাদ্দ রাখা সিটে বসলাম। আমার সিট জানালার পাশে, কিন্তু সেখানে এক বয়স্ক ভদ্রলোক বসে আছে। তার হাতে দৈনিক “বাংলাদেশ প্রতিদিন” পত্রিকা দেখতে পাচ্ছি, মনে হয় সময় পার করার জন্য নিয়েছেন। বাম হাতে একটা বহু প্রাচীন ঘড়ি।
– আমাকে দেখে বললেন, এটা তোমার সিট?
– জ্বি আঙ্কেল।
– আচ্ছা ঠিক আছে বসো তাহলে।
– আমি আমার সিটে গিয়ে জানালার পাশে বসলাম আর ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম।
– লোকটা বললো, ঢাকা যাচ্ছ?
– জ্বি আপনি?
– আমিও, ঢাকা কি তোমার বাসা নাকি অন্য কোন কাজ বা বেড়াতে?
– আমার বন্ধু হাসপাতালে ভর্তি আছে, আগামীকাল সকালে তার অপারেশন। তার বিশ্বাস সে অপারেশন হবার পর আর বাঁচবে না তাই আমাকে তার জীবনের শেষ মুহূর্তে দেখতে চায়।
– তাহলে আরো আগে গেলে না কেন?
– আমি তাকে এড়িয়ে চলতে চাই আঙ্কেল তাই আমি ওর সামনে যেতে চাই না। ওর নাম পাখি, পাখির সাথে আমার পরিচয় ফেসবুকের মধ্যে। এরপর তার সাথে আস্তে আস্তে বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয়েছে এবং আমরা একবার দেখা করেছি ঢাকা শহরে। গত বইমেলায় আমি ঢাকা গেছিলাম পাখির সাথে দেখা করতে, আর সেদিন পাখি আমাকে প্রপোজ করে।
– বলো কি? ভেরি ইন্টারেস্টিং, পত্রিকা কিনেছিলাম সময় পার করার জন্য কিন্তু মনে হচ্ছে তোমার সাথে কথা বলে শুধু ঢাকা শহর নয় বরং লন্ডন যাওয়া যাবে।
– হাহাহা, কিন্তু আঙ্কেল আমি তো একটু পরেই ঘুমের রাজ্যে চলে যাবো। বাসের মধ্যে আমার খুব বেশি ঘুম ধরে যেটা কন্ট্রোল করতে পারি না।
– তাহলে চটপট কাহিনিটা বলো, মেয়ে যখন প্রপোজ করে তখন তুমি কি করলে? আর এখন তুমি তাকে এড়িয়ে চলো কেন?
– আমি আমার জীবনে শুধু একজনকে ভালবাসি তাই তাকে ছাড়া কাউকে কল্পনা করতে পারি না। সে জন্য সেদিন পাখির ভালবাসা ফিরিয়ে দিলাম, আর তাকে বলেছিলাম বন্ধু হয়ে সারাজীবন পাশে রবো।
– তুমি যাকে ভালবাস সে কোথায়? তার কি অন্য কোন যায়গা বিয়ে হয়েছে? নাকি অবিবাহিতা?
– অন্য স্থানে বিয়ে হয়ে গেছে তবে সেটা আমার সঙ্গে ডিভোর্স হবার পরে।
– মানে কি? এত প্যাঁচ কেন? সবকিছু কেমন রহস্য রহস্য মনে হচ্ছে।
– আমরা দুজন পছন্দ করে বিয়ে করেছিলাম, বিয়ের দেড় বছর পরে আমাদের প্রথম সন্তান জন্ম নেয়। কিন্তু সেই সন্তানের বয়স যখন ৯ মাস তখন আবার আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। সে এখন তার দ্বিতীয় স্বামীর সাথে আছে আর আমাদের মেয়ে তার কাছে থাকে।
– পাখির কি হলো তারপর?
– তারপর থেকে আমি যদিও ওর সাথে বন্ধুত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করি কিন্তু মনে মনে চাচ্ছিলাম আমরা যোগাযোগ বন্ধ করবো।
কারণ দিনের পর দিন পাখি আমার প্রতি বেশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। আমি মনে করি এতে পাখির কোন দোষ নেই কারণ হুমায়ুন আহমেদ বলেছিলেন, “একটা ছেলে ও একটা মেয়ে বন্ধু হতে পারে কিন্তু তারা অবশ্যই প্রেমে পরবে। হয় কিছু সময়ের জন্য অথবা সারাজীবনের জন্য, কিন্তু প্রেমে তারা পরবে-ই। “
– তোমার কি মনে হয় যে পাখি তোমাকে সত্যি সত্যি ভালবাসে? নাকি ক্ষনিকের মোহ?
– মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি ভালবাসে কিন্তু আমি তো এ জীবনে কাউকে বিশ্বাস করতে চাই না।
– কেন?
– আমার সাবেক স্ত্রী আমাকে পাখির চেয়ে বেশি ভালবাসতো একসময়।
কিন্তু তবুও তার সেই প্রেমের মৃত্যু হয়ে গেল, একটা সন্তান হবার পরও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। ভালবাসা সত্যি সত্যি রঙ বদলে যায় আঙ্কেল, বিশিষ্ট অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদি তার স্ত্রী সুবর্না মোস্তাফাকে কত ভালবাসত কিন্তু তবুও তাদের বিচ্ছেদ হয়ে গেল। বর্তমান যুগের তাহসান মিথিলা ছিল সবচেয়ে আলোচিত কিন্তু তাদের একটা কন্যা সন্তান অবস্থায় ডিভোর্স হয়ে গেল।
– তাই বলে কি ভালবাসা অবিশ্বাস করবে? আমরা সবাই রাতে ঘুমানোর সময় জানি যে সকাল বেলা বেঁচে নাও থাকতে পারি কিন্তু প্রতিদিন ঘুমানোর আগে এলার্ম দিয়ে রাখি। এটা হচ্ছে বিশ্বাস।
– তা ঠিক বলছেন আঙ্কেল। মোবাইল বের করে পাখির নাম্বারে কল দিলাম, সে বারবার বলে দিয়েছে বাসে উঠে যেন কল করি, তাই কল দিলাম।
– হ্যালো বাবুই? বাসে উঠছো তুমি? (পাখি আমাকে বাবুই বলে ডাকে, ভারচুয়ালে বেশিরভাগ দেখা যায় বাবু বেবি ইত্যাদি। কিন্তু পাখি আমাকে বাবুই বলে ডাকে যদিও আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর।)
– হ্যাঁ পাখি গাড়ি ছুটে চলছে, মনে হয় রাত বারোটার আগেই পৌঁছে যাবো।
– কিছু খেয়েছ? নাকি না খেয়ে তারপর আসছো?
– তুমি তো জানো আমি গাড়িতে চড়লে কিছু খেতে পারি না তাহলে পেটে গ্যাসের সমস্যা করে।
– একটু তাড়াতাড়ি আসো, তোমাকে দেখার জন্য মনটা ছটফট করছে। আমার আত্মীয়স্বজনরা সবাই এসেছে, বিদেশে যারা থাকে তারাও চলে এসেছে। আমি সত্যি সত্যি মরে যাবো গো, মৃত্যুর আগে শুধু তোমার সাথে দেখা হবার অপেক্ষা।
– এমন কথা বলতে তোমাকে বারবার নিষেধ করেছি পাখি, তুমি আমাকে কথা দিয়েছ যে এমন ভাবে আর কখনো বলবে না। আমর বিশ্বাস তুমি অনেক বছর বাঁচবে, না এই করোনা ভাইরাসের মধ্যে না এই শীত আসার শুরুতে। তাই শুধু শুধু এসব বলে আমার রাগ বাড়িয়ে দিও না বলে দিচ্ছি।
– তুমিও আমাকে কথা দিয়েছিলে যে আমার বিষয় একটু ভেবে দেখবে। দেখ বাবুই, আমি যদি সত্যি সত্যি মারা যাই তাহলে তো আর তোমাকে বিরক্ত করার সুযোগ পাবো না। বাবুই বলে তোমাকে আর কেউ বিরক্ত করবে না, ভালবাসা চাইতে চাইতে কেউ তোমার সাথে আড়ি দেবে না। তুমি ভালবাসবে না জেনেও বারবার তোমার জন্য চোখের পানি দিয়ে বুক ভাসাবে কেউ। মরার পরে দুর আকাশের তারা হয়ে নীরবে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবো তোমাকে। তুমি হয়তো তোমার স্ত্রীর কষ্টে বিষন্ন ভগ্নহৃদয়ে রাতের আধারে আকাশের দিকে তাকাবে। তখন কিন্তু আমি তোমাকে মন ভরে দেখবো কিন্তু কিছু বলে বিরক্ত করতে পারবো না বাবুই।
– পাখির কথা শুনে আজ প্রথম তার জন্য আমার চোখে পানি টলমল করছে। এর আগে বহুবার পাখি এমন করে কথা বলেছে কিন্তু তখন শুধু বিরক্ত ছাড়া কিছু অনুভব করিনি। কিন্তু আজকে আর নিজের চোখ দুটো ধরে রাখতে পারি নাই তাই আমার নিজের অজান্তে কান্না করলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে আমি বললাম, পাখি একটা কথা বলবো?
– বলো..!
– তোমাকে নিয়ে যদি আমি আমার বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে চাই তাহলে তুমি বাঁচার চেষ্টা করবে?
– কিন্তু তুমি তো আমাকে চাও না।
– যদি চাই? যদি ভালবাসতে চাই, তাহলে এসব মৃত্যু নিয়ে আর চিন্তা করবে না তো?
– না করবো না, কথা দাও যদি বেঁচে থাকি তাহলে আমাকে নিয়ে বাঁচবে তুমি।
– কথা দিচ্ছি, তুমি বাঁচলেও তোমাকে ভালবাসবো আর যদি সত্যি সত্যি মারা যাও তাহলেও তোমাকে ভালবাসবো।
– খুব ভালো লাগছে এখন, আগামীকাল সকালে অপারেশনে যদি মারা যাই তবুও কষ্ট থাকবে না। কারণ এই মুহূর্তে আমি তোমার ভালবাসা পেয়েছি, আমার মা-বাবা আত্মীয় স্বজন সকলের চোখে আমি আমার জন্য অজস্র ভালবাসা দেখতে পাচ্ছি।
– তুমি বেশি টেনশন না করে ঘুমানোর চেষ্টা করো, আগামীকাল সকালে ফ্রেশ একটা মন নিয়ে তুমি অপারেশন থিয়েটারে যাবে। মনের মধ্যে বিশ্বাস রাখবে যে তোমাকে বাচতে হবে, তোমার মা-বাবার চোখের পানি মোছার জন্য তোমাকে বাঁচতে হবে।
– বাবুই?
– বলো।
– আগামীকাল সকালে সূর্য ওঠার আগেই আমি তোমাকে দেখতে চাই, তুমি আসবে তো?
– হ্যাঁ আসবো, সূর্য ওঠার আগেই আমি তোমাকে সামনে থাকবো কথা দিচ্ছি।
– আচ্ছা ঠিক আছে, সাবধানে এসো। মোবাইল কেটে দিয়ে চোখের পানি মুছে দেখি পাশে আঙ্কেল তাকিয়ে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে সে বললোঃ-
– একটু আগেই বলেছিলে তুমি তোমার স্ত্রী ছাড়া কাউকে কল্পনা করতে পারো না। কিন্তু দেখলে তো ভালবাসা কখন কার জন্য সৃষ্টি হয়ে যায়?
– না আঙ্কেল, পাখির কথা শুনে খুব খারাপ লাগছে আজকে তাই এগুলো বললাম। আল্লাহ না করুন, সত্যি সত্যি যদি সে মারা যায় তাহলে একরাশ যন্ত্রণা থাকবে তার মনের মধ্যে। তাই আজকের রাতের জন্য তাকে শান্ত করলাম, এখন কিন্তু সে আফসোস করবে না। বরং মনের মধ্যে কিছু স্বপ্ন সাজাতে গিয়ে ঘুমিয়ে যাবে, বড় অদ্ভুত তাই না?
– হ্যাঁ সত্যি সত্যি অদ্ভুত পৃথিবী।
ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাস দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পাচ্ছি, মনে করলাম যে কুমিল্লা হোটেলে যাত্রা বিরতি মনে হয়। কিন্তু না, জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখি সাইনবোর্ডে লেখা আছে “উত্তর বাড্ডা”। চমকে উঠলাম কারণ বাস এতটা পথ চলে এসেছে? পাশের সিটে আঙ্কেল মনে হয় নেমে গেছে অনেক আগেই। বাস প্রায় ফাঁকা, আমি দাঁড়িয়ে গিয়ে একটু সামনে তাকিয়ে দেখি বৃষ্টি বৃষ্টির স্বামী ও স্নিগ্ধা যে সিটে বসে ছিল সেটা খালি। তারমানে ওরাও নেমে গেছে। আমার গন্তব্য যেহেতু কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল তাই আমি নামবো কুড়িল বিশ্বরোড। সেখান থেকে আবার হাসপাতালে যাবো তাই সোজা হয়ে বসলাম। মোবাইল বের করে দেখি পাখি তিনবার কল দিয়ে তারপর আরেকটা মেসেজ করে রেখেছে। মেসেজে লেখা আছেঃ- “কোথায় তুমি? রাত তিনটা বেজে গেছে এখনো তো আসলে না, তুমি তো বললে বারোটার মধ্যে আসবে। কোন বিপদ হলো নাকি? নাকি ঘুমিয়ে গেছো? ঘুম থেকে উঠে কল দিও নাহলে চিন্তা হবে।”
– পাখির নাম্বারে কল দিলাম কিন্তু রিসিভ করলো তার বড় বোন শারমিন আপু। আপু বললো, পাখি একটু আগেই ঘুমিয়ে গেছে সজীব, তুমি এখন কোন যায়গা?
– আপু আমি উত্তর বাড্ডা পেরিয়ে এসেছি, বাস মনে হয় জ্যামে আটকা ছিল।
– আচ্ছা সাবধানে আসো তাহলে ভাই।
– ঠিক আছে।
বাস থেকে নেমে কুড়িল বিশ্বরোডের নিচে রেললাইন দিয়ে হাঁটছি, রেললাইন পেরিয়ে সামনে রাস্তায় গিয়ে রিক্সা নেবো ভাবছি। হাঁটতে গিয়ে দেখি পথ অনেক বেশি, মনে হচ্ছে ওখান থেকে একটা সিএনজি নিয়ে গেলে ভালো হতো। হঠাৎ করে দেখলাম দুটো মহিলা দাঁড়িয়ে আছে, তারা আমাকে লক্ষ্য করে আজেবাজে কথা বলে যাচ্ছে। এসব মানুষ সম্পর্কে ধারণা আছে মোটামুটি, তাই দ্রুত পা চালাতে লাগলাম। একটু পরে দেখি তাদের পিছনের দিক থেকে চারজন মানুষ দৌড়ে এদিকে আসছে। আমার সঙ্গে কিছু নেই, খালি হাতে ছিলাম তাই দিলাম দৌড়। ভেবেছিলাম তারা হয়তো ওই মহিলাদের লোকজন হতে পারে।
কিন্তু একটু পরে দেখি তারা কোই যেন ঢুকে গেল, আমি দৌড় বন্ধ করে নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য একটু হাসলাম। কিন্তু সেই হাসি স্থায়ী হলো না কারণ সামনে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ। আশ্চর্য এর মধ্যে পুলিশ কীভাবে আসলো? কিন্তু আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তারা আমার কাছে এসে ৩/৪ মিলে ধরে ফেললো। তারপর একজন বললো, একটা ধরে নিয়ে গেলে বাকি সবগুলোর গুষ্টি শুদ্ধো পাওয়া যাবে। আমি যতই প্রতিবাদ করছি ততই তাদের চড় ঘুষি আর লাঠির আঘাত খাচ্ছি। আমি এখন থানার মধ্যে বন্দী, আমার সামনে অনেক গুলো পুলিশ আর তাদের সাথে চেয়ারে একটা মেয়ে বসে আছে। তাদের প্রশ্ন আর গালাগালির মধ্যে থেকে যতটা বুঝতে পারছি তা হচ্ছে ” ওই মেয়েকে কারা যেন অপহরণ করেছে এবং পুলিশ সেখানে গিয়ে তাকে উদ্ধার করেছে। কিন্তু আসামি সবাই পিছনের দরজা খুলে বেরিয়ে রেললাইনে পালিয়ে যায়। আর সেখান থেকে আমাকে তারা সন্দেহ করে ধরে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমি যতবারই সত্য কথা বলতে চাচ্ছি তারা সেই কথা কেউ আমলে নিতে চাচ্ছে না।
– একটা পুলিশ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো, আপনি কোন চিন্তা করবেন না। সরকার নতুন করা আইন অনুযায়ী ধর্ষন করার বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা এমন করে কেস সাজিয়ে দেবো আর আপনি শুধু সাক্ষী দিবেন তবে দেখবেন একজনের জন্য সমগ্র দেশ শিক্ষা পাবে। আপনাকে এখন বাসায় পৌঁছে দেওয়া হবে, কালকে সকালে এসে মামলা লিখিয়ে যাবেন। ফজরের আজান কিছুক্ষণ আগে দিয়েছে, একটু পরে সূর্য উঠবে। পাখির কথা মনে পরলো, তাকে কথা দিয়েছি সূর্য ওঠার আগেই আমি তার সাথে দেখা করবো। কিন্তু এখন আমি যে বিপদের মধ্যে পরেছি তা থেকে বের হবো কীভাবে? আমার পকেট থেকে মোবাইল অনেক আগেই নিয়ে গেছে তারা। সকাল দশটার দিকে সেই মেয়েটা থানায় আসলো আবার, তার সাথে আরেকটা মহিলা এবং দুটো পুরুষ।
– মহিলাটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, দেখে তো কত শিক্ষিত মনে হয়। তোর ঘরে কি বোন নেই? সে কি মানুষের কাছে নিরাপদ।
– আমি বললাম, আন্টি আপনাদের যা কিছু করার সবকিছু করবেন সমস্যা নেই কিন্তু আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?
– চুপ কর শয়তানের বাচ্চা, আদালতে হাজির করে দিলেই সব অনুরোধ শুনবে সবাই।
– কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে, আসলে আমি গতকাল রাতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এসেছি।
আমার এক বন্ধুর আজকে অপারেশন হবে তাই তাকে দেখতে এসেছি। সে বাঁচবে কি না জানি না তাকে কথা দিছিলাম সূর্য ওঠার আগেই তার সামনে গিয়ে হাজির হবো। কিন্তু মাঝখানে এমন বিপদের মধ্যে পরেছি, আপনারা যা ইচ্ছে করবেন কিন্তু আমার অনুরোধ আমাকে একটু তার সাথে কথা বলতে সুযোগ করে দেন। আর যদি না পারেন তাহলে তার অপারেশনের পর সে বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে শুধু এতটুকু জানার ব্যবস্থা করবেন প্লিজ! থানার পরিবেশ এখন থমথমে অবস্থা, সবাই একটু যেন নড়েচড়ে বসছেন। যে মেয়েটির জন্য আমার এ অবস্থা সেই মেয়েও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আর ভদ্রমহিলা আমার সামনে দাঁড়িয়ে যেন মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করছে।
– আমার মনে হচ্ছে যে আমি সবার মনের মধ্যে সত্য কথাটা গেঁথে দিতে পেরেছি। তাই বললামঃ- বিশ্বাস না হলে আপনি আমার সাথে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে যেতে পারেন। আমি গতকাল অফিসে ডিউটি করে বিকেলে চট্টগ্রাম থেকে রওনা দিয়েছি। আপনারা চাইলে সবকিছু খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন শুধু শুধু আদালতের দিকে নিবেন না।
– মহিলা বললেন, বাসের টিকিট আছে?
– হ্যাঁ আছে, আমি পকেট থেকে টিকিট বের করে তার হাতে দিলাম।
টিকিট বের করার সময় দেখলাম আরেকটা কাগজ আছে সেখানে কিন্তু যতটুকু মনে পরে যে সেই কাগজ আমার না। মহিলা টিকিট চেক করেছেন আর আমি সেই কাগজের দিকে তাকিয়ে পড়ার চেষ্টা করছি। বেশি কিছু লেখা নেই, সেখানে লেখা আছেঃ- “তুমি ঘুমিয়ে ছিলে তাই নেমে যাবার সময় তোমাকে ডেকে বিরক্ত করলাম না। সুপারভাইজারকে বলে দিচ্ছি সে তোমাকে কুড়িল বিশ্বরোড নামিয়ে দেবো। যে পাখিটা তোমাকে বাবুই বলে ডাকে সেই পাখিটা আগামীকাল অপারেশনের পরে কেমন আছে সেটা জানার অপেক্ষায় রইলাম। আমার নাম্বার রেখে দিচ্ছি তুমি কল দিও। ” বুঝতে পারছি এটা গতকাল বাসের মধ্যে পাশের সিটে বসা সেই আঙ্কেলের চিরকুট। আমি সম্মুখে তাকিয়ে দেখি পুলিশ দুজন এগিয়ে এসে তালা খুলে দিচ্ছে, তারমানে আমি মুক্তি পাচ্ছি। একজন পুলিশ আমার দিকে আমার মোবাইল এগিয়ে দিল, আমার মোবাইল বন্ধ করে রেখেছেন তারা। মোবাইল অন করে সাথে সাথে কল দিলাম পাখির নাম্বারে কল রিসিভ করলো ওর বোন।
– হ্যালো সজীব? কোই তুমি? তোমার নাম্বার বন্ধ কেন ভাই?
– আপু আমি থানায় আছি, গতকাল রাতে একটা ছোট্ট ঝামেলা হয়ে গেছে। আমি আর কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবো, অপারেশন কি শুরু হয়ে গেছে?
– নাহহ, ফজরের কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ করে পাখি বমি করা শুরু করে। প্রচুর অসুস্থ হয়ে গেছে তখন, তারপর কর্তব্যরত ডাক্তার যিনি ছিলেন তিনি ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছে। আর একটা স্যালাইন লাগানো হয়েছে, পাখি সেই থেকে এখনো ঘুমাচ্ছে। আর বড় ডাক্তার অপারেশনের সময় পরিবর্তন করে আজকে বিকেলে দিয়েছে।
– ওহহ আলহামদুলিল্লাহ, আমি একটু পরে পৌঁছে যাবো আপু, এর মধ্যে যদি পাখির ঘুম ভেঙ্গে যায় তাহলে বলবেন যে আমি বাইরে আছি। পুলিশের ঝামেলার কারণে সময় মতো পৌঁছাতে পারিনি সেই কথা বলার দরকার নেই।
– আচ্ছা ঠিক আছে তাড়াতাড়ি আসো।
– ঠিক আছে আপু। আমার সাথে একজন পুলিশ, সেই মেয়ে ও মহিলা যাচ্ছে হাসপাতালে। পুলিশের গাড়িতে করে আমরা চলছিলাম তবে সবাই চুপচাপ, নীরব।
পাখির ঘুম ভেঙেছে সাড়ে এগারোটার পরে, আমি তখন ওর কেবিনের মধ্যে ছিলাম। পাখির মা-বাবা বোন দুলাভাই আর তিনটা বান্ধবী আছে এখানে। এরা কেউ আমার পরিচিত নয়, কিন্তু পাখির মায়ের সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম বেশ কয়েকবার। আর ওর বোনের সাথে আগে দুদিন বলেছিলাম আর গত রাতে যেটুকু বললাম সেটুকুই। আমি পাখির সাথে দেখা করে সামান্য কিছু কথা বলে খাবার খাওয়ার কথা বলে উঠে গেলাম। এখন এখানে বেশি কথা বলা ঠিক না, ওর আত্মীয় স্বজন অনেকে আছে। পাখির করা পাগলামি তারা হয়তো প্রশ্রয় দিবে না, আর এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারবে না তাই সরে গেলাম। পেটের মধ্যে সত্যি সত্যি খুব ক্ষুধা পাচ্ছে কিন্তু তেমন কিছু খেতে ইচ্ছে করে না। পৌনে দুটোর দিকে হঠাৎ বৃষ্টি কল দিল, তার সেই পুরনো নাম্বার আজও ব্যবহার করে। এই নাম্বারেই কল দিয়ে আমি মাঝে মাঝে আমার মেয়ের খবর নিতাম। কিন্তু বৃষ্টি একদিন বললো যে সে সময় করে আমাকে কল দিয়ে জানাবে। আমি যেন হুটহাট করে কল দিয়ে না ফেলি তাহলে নাকি ওর সমস্যা হয়।
– রিসিভ করে কিছু না বলে চুপ করে আছি, বৃষ্টি ওপাশ থেকে বললোঃ- কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ তুমি?
– আছি মোটামুটি, হঠাৎ করে ঢাকা কেন?
– আসতে পারি না?
– তা পারো কিন্তু তুমি তো চট্টগ্রাম থেকে কোন কাজ ছাড়া আসার মানুষ নয়।
– হ্যাঁ কাজেই এসেছি।
– অনেক রোগা হয়ে গেছো, ওজন কত?
– ৬১ কেজি।
– আমি যখন ছিলাম তখন ৭৫ এর বেশি ছিল।
– সময়ের সঙ্গে সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যায় বৃষ্টি, স্নিগ্ধা কেমন আছে?
– দেখলে তো গতকাল, খুব ভালো আছে।
– এখন কি করে?
– ওর বাবার সঙ্গে ঘুমাচ্ছে।
– কার সঙ্গে?
– কিছু না বাদ দাও, তুমি কি কাজে এসেছো?
– এক বন্ধুর অপারেশন আজকে তাই তাকে দেখার জন্য এসেছি, তুমি চিনবে না।
– তোমার সব বন্ধুকে আমি চিনতাম কিন্তু এখন চিনবো না মানে? কে সে?
– তার নাম পাখি, তবে আমাকে পছন্দও করে।
– ওহ্হ আচ্ছা, তাহলে এতদিন পরে!
– তেমন কিছু না, সে আমাকে ভালবাসে কিন্তু আমি তো সেই আগের মতো। এরপর বৃষ্টির কাছে পাখির সাথে পরিচয়ের পরের সবকিছু বললাম। বৃষ্টি আসলে এমনই, কৌতূহল খুব বেশি তার, তাই সে যেভাবে প্রশ্ন করেছে আমিও সেই ভাবে জবাব দিলাম।
– সব শুনে বৃষ্টি বললো, মেয়েটা তোমাকে সত্যি সত্যি অনেক ভালবাসে সজীব। তুমি তাকে কষ্ট না দিয়ে আপন করে নাও তাহলে সুখী হবে।
– তুমিও তো আমাকে প্রচুর ভালবাসতে কিন্তু কোই? তোমাকে নিয়ে কি সুখী হতে পেরেছি?
– সবাই তো আমার মত খারাপ নাও হতে পারে।
– তাহলে কি চাও তুমি?
– আমি চাই, ওই মেয়ে সুস্থ হবার পরে তুমি তাকে বিয়ে করে নতুন করে জীবন শুরু করো।
তোমার যে জীবন আমি তছনছ করে দিছি সেটা গোছানোর জন্য তাকে নিয়ে আসো। তোমরা দুজন সত্যি সত্যি অনেক সুখে শান্তিতে থাকবে এটা আমার বিশ্বাস। হয়তো প্রকৃতি তোমার আমার জীবনে সুখ লিখে দেয় নাই নাহলে তখন কেন বা তোমাকে হাঠাৎ করে ডিভোর্স দিলাম বলো?
– তুমি আমার বিয়ের জন্য দোয়া করিও না বৃষ্টি, কারণ সত্যি সত্যি যদি আমি পাখিকে বিয়ে করি তাহলে কিন্তু আমার মেয়ে আমি আমার কাছে নিয়ে আসবো। তখন পাখি হবে তার মা আর আমি তো তার আসল বাবা আছিই। সহ্য করতে পারবে তো সেদিন? বাকি কথা শুনতে পাওয়ার আগেই মোবাইল কান থেকে নামিয়ে নিতে বাধ্য হলাম। কারণ পাখির বোন আমার সামনে দ্রুত হেঁটে এসে দাড়ালেন, তিনি মনে হয় সামান্য হাঁপাচ্ছেন।
– আপু বললো, তুমি একটু তাড়াতাড়ি কেবিনে আসো সজীব। পাখির অপারেশন আরম্ভ হবে কিছুক্ষণ পরে তাই প্রস্তুতি চলছে। একটু পরে ওকে অপারেশন করার জন্য থিয়েটারে নিয়ে যাবে তাই আপু দ্রুত ডাকতে গেছিল। হাসিহাসি মুখ নিয়ে পাখি বসে আছে, আমি কেবিনে গিয়ে দেখি আঙ্কেল আন্টি সবাই বসে আছে।
সবার সাথে পাখি কথা বললো, কেমন যেন মায়া ভরা তার চেহারা থেকে চোখ সরানো যায় না। এমন আগে কখনো মনে হয়নাই, হয়তো এভাবে কখনো চিন্তা করিনি। যে যার মতো করে কথা বলছে আর আমি পাখির দিকে তাকিয়ে আছি অপলক দৃষ্টিতে। মনে মনে ভাবলাম, “এই মেয়েটার এমন হাসি ভরা মুখ সবসময় দেখতে পেলে মন্দ হবে না। আল্লাহর কাছে মনে মনে দোয়া করলাম, আমার জীবনের কষ্ট পরিমাণ যদি শেষ হয়ে থাকে। তাহলে এমন পুরষ্কার যেন আমি পাই। “চিন্তাযুক্ত মন নিয়ে সবাই অপেক্ষা করছি অপারেশন শেষ হবার জন্য। কি হবে কে জানে? সবাই খুব চিন্তা করছে সেটা বোঝা যাচ্ছে, আমি একবার ভাবলাম যে গতকাল রাতে বাসের মধ্যে পরিচিত আঙ্কেলের কাছে কল দেবো। কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তা করছি যে, অপারেশন শেষ হলে তারপর নাহয় কল দিয়ে কথা বলা যাবে।
– চোখ বন্ধ করে বসে আছি তখন পাখির বোন এসে বললো, ক্লান্ত লাগছে?
– চোখ মেলে তাকিয়ে একটু লজ্জিত হলাম, তারপর বললাম না তেমন কিছু না।
– খুব চিন্তা হচ্ছে ওর জন্য?
– তা একটু হচ্ছে আপু,
কতদিন কত কারণে ওকে বকাঝকা করেছি কিন্তু কখনো প্রতিবাদ করে নাই। সবসময় চুপ করে সহ্য করে গেছে, আবার পরে কল দিয়ে ঠিকই কথা বলেছে। আজ যদি পাখির কিছু হয়ে যায় নিজেকে খুব অপরাধী মনে হবে। যদিও সে আমার খুব ভালো বন্ধু কিন্তু তবুও তার অনুপস্থিতি মেনে নিতে পারবো না। চোখ বন্ধ করে কল্পনা করে বুঝলাম, আমার স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ হবার সময় যে কষ্ট পেয়েছি। পাখির জন্য তার চেয়ে একটুও কম কষ্ট হবে না, আল্লাহ যেন বাঁচিয়ে দেয় ওকে।
– একটা প্রশ্ন করবো?
– জ্বি করুন।
– তুমি এমন ভালো একটা ছেলে কিন্তু তবুও তোমার ডিভোর্স কেন হলো?
– তেমন কোনো কারণ নেই আপু, কপালে লেখা ছিল তাই হয়ে গেছে।
কারণ আমাদের মাঝে কখনো কোন বিষয় নিয়ে বড় ধরনের ঝামেলা হয়নাই কিন্তু আমার মেয়ে জন্মের সাথে পরেও শুধু ছোট্ট কিছু কারণে দুরত্ব তৈরি হলো। আমি জব করতাম আর আমার স্ত্রী বৃষ্টি সবসময় সন্তান নিয়ে বাসায় থাকতো। মেয়ে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে থাকতে কাজের প্রতি একটু বেশি অবহেলা করছিল। এই নিয়ে একটু একটু রাগারাগি চেঁচামেচি করতাম, আসলে অফিস শেষে বাসায় ফিরে মাথা সবসময় ঠিক থাকে না। আর আমরা দুজন পছন্দ করে বিয়ে করেছিলাম কিন্তু তার বাবা মা মেনে নেয় নাই। বৃষ্টি রাগ করে মেয়ে নিয়ে ওদের বাড়িতে চলে গেল তারপর ওর মা-বাবা বারবার আমাকে ডিভোর্স দিতে বলে। এভাবে মাস তিনেক পার হবার পরেই হুট করে সে ডিভোর্স দিতে চায়। খুব স্বাভাবিক ভাবে আমরা কথা বলছিলাম, এখনো প্রায় সেভাবেই মাঝে মাঝে কথা হয়। একপ্রকার যেন হাসতে হাসতে ডিভোর্স হয়ে গেল আমাদের কিন্তু সে বেদনা কতটা ভয়ংকর তা কি সবাই জানে?
– আশ্রয়, এমন কারণে বিয়ের মতো একটা পবিত্র সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়? এটা অবিশ্বাস্য।
– আপু প্রতিদিন কিন্তু এই পৃথিবীতে অসংখ্য অসংখ্য অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটে। কারো কারো জীবনে হঠাৎ করে অপ্রত্যাশিত সুসংবাদ আসে। আবার কারো জীবনে হঠাৎ করে এতো বড় কষ্টের ঘটনা ঘটে যে সেই কষ্টের ব্যথা সারাজীবন ভুলতে পারে না।
– তবুও এমনটা সহজে হয় না।
– আমার একটা বন্ধু ছিল সে বিদেশে থাকতো, পাঁচ বছর পরে যখন বাংলাদেশ ফিরছে তখন তার সম্পুর্ণ পরিবার অনেক আনন্দিত ছিল।
বাংলাদেশে বিমান থেকে নামার পরে আমাকে কল দিল, তার মনের মধ্যে তখন অজস্র আনন্দ। এর ঠিক চার ঘন্টা পরে খবর পেলাম সেই বন্ধু বাড়ি পৌঁছানোর আগেই গাড়ি এক্সিডেন্ট করে ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। এক মুহূর্তে তাদের সেই আনন্দ ভরা বাড়িতে সারাজীবনের জন্য কষ্টের মেঘ জমা হলো।
অপারেশন শেষ হয়েছে, ডাক্তার হাসি দিয়ে বললেন যে, আলহামদুলিল্লাহ আপনাদের মেয়ে এখন বিপদ থেকে মুক্ত। সকলের বুকের উপর দিয়ে পাথরের বোঝা সরে গেল, একটু পরে পাখির অজ্ঞান অচেতন দেহটা বের করে কেবিনে নিয়ে গেল। আমি মুচকি হাসির চেষ্টা করে সেখান থেকে স্থানান্তরিত হলাম। বাসে পরিচিত আঙ্কেলের কাছে কল দিলাম কিন্তু কথা বলতে পারি নাই। তিনি মোবাইল বাসায় রেখে বাইরে গেছেন, তাই যিনি কল রিসিভ করেছে তার কাছে খবরটা দিলাম। ১৩ বছর পরে। আজ শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন তাই বেলকনিতে বসে পত্রিকা পড়ছিলাম, পিছনে কারো নিশ্বাসের শব্দ শুনে ফিরে তাকিয়ে দেখি স্নিগ্ধা দাঁড়িয়ে আছে।
– কি করো বাবা?
– তেমন কিছু না, কিছু বলবি মা?
– আমার মনটা খুব খারাপ বাবা।
– কেন কেন কেন? কি হইছে আমার আম্মুর?
– আমি প্রায় প্রতিদিন তোমার ডায়েরি পড়ি কিন্তু রোজ রোজ এক অসমাপ্ত আত্মজীবনী ভালো লাগে না। তুমি আজকেই পাখির আন্টি আর আমার মা’র বাকি কাহিনি শেষ করবা।
– লিখতে ইচ্ছে করে না মা।
– তাহলে মুখে বলো, তবুও জানতে চাই।
– কি লাভ জেনে?
– পাখি আন্টির বিষয় কৌতূহল হচ্ছে, তিনি কেন আমার মা হলেন না? আর আমার মা শুধু শুধু কেন আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিল।
– তোমার মায়ের দ্বিতীয়বার মা হবার পরেই সেখানে তোমার অবহেলা শুরু হয়ে যায়। তারপর বৃষ্টি মানে তোমার মা নিজেই তোমাকে আমার কাছে দিয়ে দেয় কারণ সেই লোকটা নাকি একদিন তোমাকে খুব করে মেরেছিল।
– এই সামান্য কথা গুলো তুমি লিখতে পারো না?
– বাস্তব জিনিস লিখলে কেমন যেন ভালো লাগে না সবার কাছে তাই বন্ধ। কাল্পনিক অস্তিত্ব দিয়ে কিছু লিখতে গেলে সেগুলো পছন্দ করে সবাই।
– পাখি আন্টি কোথায় এখন?
– হাসপাতাল থেকে বাসায় যাবার পর তার সাথে বন্ধু থেকে প্রেম হয়েছিল।
কিন্তু দুই মাস পরেই তোমার মায়ের মতো করে সেও বদলে যায়। ভালবাসা কেমন যেন হারিয়ে যায়, তখন বুঝতে পারলাম যে আমার মাঝে অনেক অপূর্নতা আছে মনে হয়। নাহলে সবাই ভালবেসে খুব কাছে এসে আবার কেন মাঝপথে ফেলে যাবে?
– এবার বুঝতে পারছি।
– কি?
– পরবর্তী জীবনের কাহিনিটা বিষন্নতা দীর্ঘশ্বাসের বেড়াজালে আবদ্ধ তাই লিখতে গিয়ে তুমি থমকে যাও বাবা, তাই না?
– এ প্রসঙ্গ টা বাদ দেওয়া যায় না মা?
– ঠিক আছে বাবা তাই দিলাম, কিন্তু একটা প্রশ্ন করতে পারি? এটাই শেষ।
– কি?
– তুমি ডায়েরিটা “বাবুই পাখির বাসা” বলে লেখা আরম্ভ করলে কেন?
– ভেবেছিলাম বাস্তব আর কল্পনা দিয়ে মিশ্রন করে সাজিয়ে দেবো, কিন্তু হলো না।
– আচ্ছা ঠিক আছে তুমি তাহলে পত্রিকা পড়ো আমি চা নিয়ে আসি।
স্নিগ্ধা চলে গেল ভিতরে, আমি রাস্তার পাশে তালগাছ এর দিকে তাকিয়ে আছি। যেদিন ডায়েরিটা লেখা শুরু করেছিলাম তখন এই গাছে বাবুই পাখির বাসা ছিল অনেক গুলো। এখন আর সেই বাসা নেই, সব পাখিগুলো হারিয়ে গেছে অজানায়।
গল্পের বিষয়:
গল্প