কোনো এক অদৃশ্য কারণে আমার শাশুড়ি ফর্সা রংয়ের মানুষ বেশি পছন্দ করেন। মানে গায়ের রং ফর্সা ব্যক্তির সাত খুনও মাপ। কী আশ্চর্য উনার পাঁচটা ছেলের বউয়ের মধ্যে খুব একটা ফর্সা কেউ নেই! তবে সবচেয়ে বেশি কালো আমি। অথচ তাঁর ছেলে দেখার আগে তিনিই আমাকে প্রথম দেখেছেন, এবং খুশি মনে স্বাচ্ছন্দ্য তাঁর ছোটছেলের বউ করে এনেছেন। যে মহিলা এমন কালার বিদ্বেষী, তিনি আমাকে প্রথম দেখায় পছন্দ করেছেন ছেলের বউ হিসাবে মাঝে মাঝে ব্যাপারটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগে। হয়তো সব সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছেই হয়েছেন।
মেয়েটার জন্মের আগে ছিল শীতের সিজন। কাকের পুরো রং যেন আমি ধারন বরেছি। এমন কালো হয়েছি কী বলব। এটা অবশ্য অামার কথা না তৃতীয় পক্ষের মন্তব্য। আমি নির্বাক হয়ে মাঝেমাঝে সৃষ্টিকর্তার কাছে কিছু চাইতাম। কিন্তু মুখে তো নয়ই, মনে মনেও প্রকাশ করতাম না। সৃষ্টিকর্তা নির্বাক আমার ভাষা বুঝতে পেরেছেন। সেজনই আমি হুমাইরার মতো একটা পুতুল মেয়ের মা হয়েছি।
মানুষ বলে তাদের সন্তান সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেয়। আমি বলব আমার মেয়েটা হীরার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নিয়েছে। এত আদর, এত যত্ন, এত ভালোবাসা সে দাদার বাড়ি নানার বাড়িতে পেয়েছে, যেটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। যাই হোক সে প্রসঙ্গে না যাই । আজ আমার ছেলেকে নিয়ে লিখব। যতটা জৌলসপূর্ণ ছিল আমার মেয়েটার আগমন পৃথিবীতে, ঠিক ততটাই নিষ্প্রাণ ছিল আমার ছেলের আগমন। যখন আমি হুমাইরাকে নিয়ে পাগল প্রায়, আমাদেরকে নিয়ে পরিবারের সবাই দিশেহারা।( হুমারার কিছু ক্রিটিক্যাল শারীরিক সমস্যা ছিল, বুকের দুধ না খাওয়া, সারারাত কান্না করা, সারাক্ষণ বমি করা, রাত জেগে কান্না করা ইত্যাদি)। সেসময় খবর পেলাম আমি দ্বিতীয় সন্তানের মা হবো। পরিবারের সবাই ভীষণভাবে আমাকে অবিবেচক ভাবতে শুরু করল।
এমন খারাপ সময় ছেলেটার জন্ম হলো, যখন ওর বাবা ব্যাবসায় মারাত্মক লস খেয়ে বাড়ি চলে আসলেন। ওর জন্মের একসপ্তাহ পর ওর দাদু অসুস্থ হয়ে বারডেম, ইউনাটেডে হাসপাতালের আইসিইউতে তিনমাস ছিলেন। ও প্রি-ম্যাচিউরড বেবি ছিল। সেজন্য ওজনও কম ছিল। জন্মের পর ওর জন্ডিস, হাঁপানি, পায়খানার সাথে টকটকে লাল রক্ত যাওয়া ইত্যাদি অনেকগুলো শারীরিক সমস্যা ছিল। অথচ তখন ওর দাদু ইউনাইটেডের হাসপাতালের আইসিইউতে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ওর বাবা ফোন দিয়ে ছেলের খোঁজ নেয়ারও পরিস্থিতি নেই। বাড়িতে ওর জেঠুদের ভীষণ মন খারাপ। স্রোতের মতো টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। সে সাথে আম্মার জীবনও অনিশ্চিত। এদিকে আমার অগোচরে অনেকেই আলোচনা করছিল এরকম বাচ্চারা বাঁচে না, অাঁতুড় ঘরেই মরে যায়।
যখন এসব আলোচনা আমার কানে আসছিল, আমার মনে হয়েছিল বুকের খাঁচায় থাকায় প্রাণটা আমার অনবরত লাফাচ্ছে। আমি হঠাৎ করে সুস্থ হয়ে গেলাম। চাকরি ছেড়ে দেয়া, মা হওয়া সঠিকভাবে মেয়েকে লালন-পালন করতে না পারা, বছরের পর বছর গৃহবন্দী হয়ে থাকা আমি যে ডিপ্রেশানে চলে গিয়েছিল। সেটা যেন এক লহমায় ঠিক হয়ে গিয়েছে। আমি দু’হাত তুলে কায়মনোবাক্যে সৃষ্টিকর্তার কাছে কেবল আমার ছেলেটার জীবন ভিক্ষা চেয়েছি। ও একদম জালাতো না, সুন্দর করে খেয়ে সারাক্ষণ ঘুমাতো। কান্না করতো না। একা একা হাত পা নেড়ে খেলতো। একটা সুস্থ, সুন্দর স্বাভাবিক বাচ্চার মতো। অথচ গলার মাঝে বিকট শব্দ করত, পায়খানার সাথে রক্ত যেতে। একদিন সাহস করে ওর জেঠিমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম। আমার প্রথম কথা ছিল
” ডাক্তার আমার ছেলেটা বাঁচবে তো!” আমার কথা শুনে ডাক্তার হাসতে শুরু করলেন।
” আলহামদুলিল্লাহ, আপনার ছেলের কোনো সমস্যা নেই। একটা বাচ্চা যতক্ষণ বুকের দুধ টেনে খায়, ততক্ষণ পর্যন্ত ভয়ের কিছু নেই। ” বুকের খাঁচায় লাফাতে থাকা আত্মাটা যেন একটু স্থির হলো।
একটা বাচ্চা যে আমার রুমে আছে পাড়া -প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজন অনেকেই জানতো না। ও কখনো কাঁদতো না। সপ্তাহখানেক পর পাশেররুমের ওর জেঠিমা জানতে চাইত ” তোমার ছেলেটা কী করে?” হুমাইরাকে নিয়ে সারাক্ষণই আমার রুমে চাঁদের হাট বসতো। অথচ দু’মাসে একই ঘরে থাকা কেউ আমার রুমে উঁকি দিয়ে ছেলেটাকে দেখতোও না। অবশ্য দেখার প্রয়োজনও হতো না। ওদেরকে লালন পালন করা ছাড়া গৃহস্থালির সমস্ত কাজ থেকে আমাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সাথে সার্বক্ষণিক বাচ্চাদের সাথে আমাকে দেখাশোনা করার জন্য একজন কাজের লোকও ছিল। আমি ডাইনিং রুমে গিয়ে খাওয়া ছাড়া আর রুম থেকেও বের হতাম না। প্রায় চারমাস পর আম্মা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। দিনে তিন চারবার আম্মা ওকে দেখতে আসতেন, আদর করে যেতেন। আর কেউ না, আমার কেন যেন মনে হতো ওর বাবাও ওর ব্যাপারে উদাসীন। এটা আমার ভুল ধারনাও হতে পারে, উনি ব্যাবসায় লস খেলেন, আম্মার অসুখ হলো সে কারণেও মন খারাপ থাকতে পারে।
ছেলেটাকে তিনি কখনো কোলে নিতেন না। আমি অনুরোধ করলেও না। বলতেন ” ও একা একা খেলছে তো! অহেতুক কোলে নিয়ে বসে থাকব কেন?” আমার হঠাৎ মনে হতে লাগল। আমার ছেলেটা পারবে তো সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে, ও শুকনো, সাথে গায়ের রং কালো বলে সবাই ওকে অবহেলা করবে না তো। একদিন দেয়াল ধরে ধরে আলতো পায়ে হেঁটে হেঁটে ওর দাদুর রুমের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তখন ওর বয়স এক বছর। এরি মধ্যে ও হাঁটা শিখেছে, টুকটাক কথা বলা শিখছে। সবাই তো ওকে দেখে অবাক! দৌড়ে এসে বুকের সাথে লেপ্টে নিলো। অনেকেই বলে ” পৃথিবীতে নিজের যোগ্যতায় জায়গা করে নিতে হয়। কেউ কাউকে জায়গা করে দেয় না” এ বিষয়টা আমি বুঝতাম না। নিজের যোগ্যতায় আবার জায়গা করে নেয় কীভাবে! পারিওনি কখনো কোথাও জায়গা করে নিতে।
আমার ছেলেকে দেখে বুঝতে শিখলাম, নিজের যোগ্যতায় জায়গা করে নিতে হয় কীভাবে। আস্তে আস্তে ও রুম থেকে বাইরে আসতে শুরু করল। এই প্রথম সবাই বুঝতে পারলো শুকনো পাটখড়ির মতো কৃষ্ণ বর্নের আমার ছেলেটা ঘরের সব বাচ্চার চেয়ে আলাদা। ও কখনো কারো রুমে প্রশ্রাব করে কাউকে বিরক্ত করেনি। কারো কোলে উঠে কাউকে জালাতন করেনি। ও কখনো খাওয়া নিয়ে, ঘুম নিয়ে, খেলনা নিয়ে কারো যন্ত্রণার কারণ হয়নি। আমি যেদিন দুধ বন্ধ করেছি, সেদিনই ও একা একা কোল বালিশ জড়িয়ে ঘুমানোর অভ্যাস করে নিয়েছে। ওকে কখনো একটা বর্ণামালাও হাতে কলমে শিখাইনি। একদিন দেখি ও বোনের পাশে বসে বসে নিজে নিজে সব শিখে নিয়েছে। ও ভীষণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন জেদি বাচ্চা। ওর না না-ই, কখনো হ্যাঁ হবে না। আমি ওকে ভীষণ সমীহ করি। সহীহ করার একটা দুটো কারণ বলছি।
১। একদিন ওর ফুড পয়জনিং হয়েছে। সারারাত বমি এবং পাতলা পায়খানা ছিল। শীতের সময় কম্বল জড়ানো খাটে ও বমি করতে চেয়েছে। আমি বালতি হাতের কাছে না পেয়ে তাড়াহুড়ো করে ওর আব্বুর বালিশের উপর দেয়া টাওয়েল সামনে ধরেছি। ও নিজের বমি গিলে ফেলেছে। তারপরও খাটে, কম্বলে, টাওয়েলে বমি করেনি।
২। ও কখনো আজ পর্যন্ত, বাথরুমের সেন্ডেল ঘরের সেন্ডেল ঘুলিয়ে ফেলেনি। রাতের তিনটা কারেন্ট বিহীন অন্ধকার রুমেও ও আগে সেন্ডেল চেঞ্জ করবে তারপর বাথরুমে যাবে। ও কখনো গামছা বা টাওয়েল ছাড়া, অন্য কোনো কাপড়ে হাত মুছবে না।
আরো আছে, একদিন ওকে রাগ করে তুই বলেছিলাম। ও ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল। প্রায় দুই ঘণ্টা মন খারাপ করে একা একা রুমে বসেছিল। সবাই জিজ্ঞাসা করেছে কী সমস্যা, অথচ সে শুধু কেঁদেছে কাউকে কিছু বলেনি। দুই দিন পর আমার কানে কানে বলেছে। ” সেদিন যে তুমি আমাকে তুই বলেছিলে আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। ছোট বাচ্চাদের কেউ তুই বলে?” আমি ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলাম। মুখ থেকে যেনে শব্দ বেরুচ্ছিল না। একদিন বাসায় মেহমান এসেছিল, তারা অন্যসব বাচ্চাদের সাথে আমার বাচ্চাকেও দেখতে চেয়েছিলেন। কালো, শুকনো সাথে ন্যাড়া মাথা থাকায় মাঝপথ থেকে মেহমানের সাথে দেখা না করিয়ে আমার ছেলেটাকে রুমে ফিরে যেতে হয়েছিল। বিষয়টা আমি বুঝতে পারার পর মনে হয়েছিল, কেউ যেন বিষাক্ত তীরের ফলা দিয়ে আমার কলিজাটাকে অনবরত এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে।
আমি সেই দিন দুহাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম ” হে আল্লাহ তুমি আমার সন্তানকে, শিক্ষা -দীক্ষা, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে এত বড় বানিও যেন সে পৃথিবীর সব সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠতে পারে।” নিজের যোগ্যতায় এখন সে ঘরের সবার চোখের মণি। ওর বাবার কলিজার টুকরো। কোনো এক বিশেষ কারণে কোনোদিন ছেলেটার জন্মদিন পালন করিনি। শুধু ওর জন্মদিনে আমি ওর সুস্থতার জন্য একটা রোজা রাখতাম। এবার পুরো পৃথিবীতে মহাপ্রলয় হয়ে গেলেও আমি ছেলেটাকে নিয়ে ওর জন্মদিনে বাইরে ঘুরতে যাব। ওর পছন্দের সবকিছু করব। আমার মিষ্টি সোনা বাচ্চার আগামী ১৬ তারিখ জন্মদিন। সব্বাই আমার ছেলেটার জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন তাকে সুস্থতার সহিত নেক হায়ত দান করেন।
গল্পের বিষয়:
গল্প