আমার বন্ধু রবি মেয়েদের ফোন নাম্বার বিক্রি করে একশত টাকা করে। আগেই বলে রাখে, “মেয়ে তোর সাথে প্রেম করবে কি-না সেটা আমি জানি না। পটাতে পারলে প্রেম করবি, না পারলে নাই। কিন্তু এটি যে মেয়ের নাম্বার তাতে সন্দেহ নাই।” উত্তর পাড়ার ফজলু একসাথে তিন চারটা প্রেম করে। সবগুলো ফোন নাম্বার রবি থেকেই কিনে নিয়েছে। দূরের এলাকা থেকেও অনেকে এই নাম্বারের খুঁজে আসে।
রবি প্রতিটি নাম্বার বিক্রি করে একশত টাকা করে। আমি এতো কিছু জানতাম না। একদিন কড়ইতলা মোড়ে রবি আর আমজাদ কঠিন মারামারি করছে। দুই তিনজন ফিরিয়ে রাখতে পারে না তাদের। আমি তখন বাজারে যাচ্ছিলাম। ওদের মারামারি দেখে থমকে দাঁড়িয়েছি। রবি বলছে, “আমার তিনশত পঞ্চাশ টাকা এখন দিবি তুই, নয়তো তোর বাড়িতে বিচার নিয়ে যাব।” আমজাদ বলছে, “টাকা পাবি দুইশো, সবগুলা বুইড়া।” রবি বলছে, “বুড়া না কড়া সেটা তো ভাই আমি জানি না। আমার প্রতি পিছ একশো টাকা করে লাগবে। আমি আরো পঞ্চাশ টাকা ছাড় দিচ্ছি।” অবশেষে ওদের ঝগড়া মীমাংসা হলো তিনশত টাকায়। তখন জানতে পারলাম আমজাদ চারটা ফোন নাম্বার কিনেছে। ফোন দিলে নাকি সবগুলোই বুড়া মহিলা কথা বলে। আমি রবির কাছে জানতে চাইলাম, “তুই এতো ফোন নাম্বার পাস কোথায়?”
রবি উত্তর দিলো, “আমি উল্টা পাল্টা নাম্বার বানিয়ে বানিয়ে ফোন দেই। যে নাম্বার থেকে মেয়ে কন্ঠ আসে, সে নাম্বারটা খাতায় লিখে রাখি। আর সেগুলোই বিক্রি করি। তোর লাগলে নিতে পারিস। মহিলা না, সুন্দর কন্ঠের মেয়ের নাম্বার নিতে পারিস।” আমি রবিকে ধমক দিয়ে চলে আসলাম। বুঝাতে চাইলাম, আমি এর আগেও নাই, পাছেও নাই। শুক্কুর আলী নামে এক চাচা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে। একটু পর পর ডানে বামে তাকিয়ে মোবাইলে চুমু খাচ্ছে। আমি দূর থেকে দেখতে পেলাম। আমার মনের ভিতর কৌতূহল সৃষ্টি হলো। চাচা এই বয়সে মোবাইলে চুমু দেয় কাকে? আমি গাছকে আড়াল করেই এগিয়ে যাচ্ছি। গাছের কাছাকাছি যেতে শুনি চাচা ফিসফিস করে বলছে, “সোনা বিশ্বাস করো, বাবার কাছে বলেছি আমার মার্কেট করার টাকা লাগবে। বাবা বলছে মাস শেষ হলে দিবে। তখন আমি তোমাকে পরী জামা কেনার টাকা দেব। উমমমা, রাগ করো না।”
আমি আর সামনে এগিয়ে যেতে পারিনি। ফিরে আসার সময় ভাবছি, আমি ছোটো থাকতে শুক্কুর আলী চাচার বাবা মারা গেছে। তিনি এখন তাঁর বাবার কাছে টাকা চাইতে হলে কবরস্থানে গিয়ে আগে কবর খুঁজে বের করতে হবে। তাছাড়া কবরের ভিতর টাকা থাকে কি-না আমার জানা নেই। রবিকে আমি ফোন দিয়েও চক্ষু লজ্জায় বলতে পারিনি যে, আমারও একটা ফোন নাম্বার দরকার। চারদিকে সবাই কেমন প্রেম করে বেড়াচ্ছে। বুড়া চাচা থেকে শুরু করে প্রাইমারী স্কুলের পিচ্ছিটা তিনটা চারটা করে প্রেম করে। আমারো তো একটা মন বলে কিছু আছে। রবিকে ফোন দিয়ে বললাম, “এমনি একটা কথা জানতে ফোন দিলাম। তুই যে এতো মানুষের কাছে নাম্বার বিক্রি করিস, তা তুই কখনো প্রেম করেছিস?”
রবির খিলখিল শব্দে মোবাইল কান থেকে একটু দূরে সরিয়ে রাখলাম। তখন সে বলল, “দোস্ত আমার প্রেম সকাল-বিকাল। সকালে একটা তো বিকালে আরেকটা। আমার হলো টাইমপাস করার কথা। তোদের দোয়ায় ইনকাম তো খারাপ না। বাকি অবসর সময়টা ফোনে টাইম পাস করি মেয়েদের সাথে। আরে তুই-ও একটা নাম্বার নিয়ে নে। প্রেম-ট্রেম কর, সময় ভালো কাটবে।” আমি তবুও রবিকে বলতে পারিনি, যে দে আমাকে একটা নাম্বার। শুধু বলেছি, “আচ্ছা তোকে জানাবো যদি লাগে।” কুসুমদের বাড়ি আমাদের দুইটা বাড়ি পড়ে। দেখতে কালো পেত্নির মতো। ঠোঁট ফাঁক করে হাসতে হয় না, দাঁত উঁচু থাকায় সবসময় ঠোঁটে হাসিই থাকে। তবুও চেহারায় একটা মায়া মায়া ভাব আছে। তবে আমার তাকে তেমন পছন্দ না। তবে আমি জানি, কুসুম আমাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে।
সে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো অজুহাতে আমাদের বাড়ি আসে। আমার মায়ের সাথে বসে গল্প গুজব করে। কখনো গাছ থেকে মেহেদী তুলে নিয়ে যায়।। ওদের বাড়িতে আবার বকুল ফুলের গাছ আছে। সকালে ফুল কুড়িয়ে মেয়েটা মালা গাঁথে। তারপর মাথায় দেয়, গলায় আর হাতে দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মধ্যে আমাকে দিয়ে বলে, “শাওন ভাই, দেখো তো মালাটা সুন্দর না? তোমার জন্য বানাইছি।” আমি কুসুমের হাত থেকে মালা নিয়ে বিছানায় বা টেবিলের উপর ফেলে রাখি। আমার নিশ্চয় গলায় মালা পরে ঘুরে বেড়ানো ঠিক হবে না। স্নোর কৌঠা প্রায় শেষ হবার পথে। মাঝে মধ্যে বলতে ইচ্ছে করে, “তোমরা যদি সত্যিকারের মিথ্যেবাদী দেখতে চাও, তাহলে স্নোর কোম্পানীগুলোর বিজ্ঞাপন দেখো।”
বছরের পর বছর স্নো মেখেও একটু সুন্দর হতে পারলাম না। আজ একটু বেশি করেই মাখলাম। মুখে কেমন সাদা সাদা একটা ভাব আসছে। গতকাল একশত পঞ্চাশ টাকা করে কয়েকটা গেঞ্জি কিনে এনেছি। একটু ঘুরাফিরা করলে মেয়ে পটানো কোনো ব্যাপারই না। এই বয়সে যদি একটা প্রেমই করতে না পারি, তাহলে আর কী পারবো?
রাস্তায় বের হবার পরই দক্ষিণপাড়ার আয়েশার সাথে দেখা। মেয়েটা কত দ্রুত বড় হয়ে গেল। হাসলে বাম গালে গর্ত হয়ে টোল পড়ে। আর যখন চোখের সামনে আসা অবাধ্য চুলে আঙ্গুল ঘুরাতে থাকে, উফপ তখনই যে কেউ প্রেমে পড়ে যাবে। আমি নিজেকে একটু ভাবে রেখে সুন্দর করে জানতে চাইলাম, “কোথায় যাচ্ছ আয়েশা? অনেকদিন পর দেখলাম তোমাকে।” আয়েশা মাথা নিচু করে জবাব দিলো, “কাকা, কুসুমের কাছে যাব একটু। বকুল ফুল আনতে।” আমার চেহারাটা মলিন হয়ে গেল। আমি জানতে চাইলাম, “কী ব্যাপার আয়েশা, তুমি আমাকে কাকা ডাকলে কেন?”
সে জবাব দিলো, “কেন কাকা? আপনি তো আমার বাবাকে ভাই বলে ডাকেন। তাহলে আমার তো কাকা’ই হবেন।”
আমি মাথা চুলকিয়ে ভাবতে লাগলাম, সত্যিই তো। আগে জানলে তো ভাই ডাকা বাদ দিয়ে আয়েশার বাবাকে আমি নিজেই মামা কাকা বলে ডাকতাম।
চক্ষু লজ্জা রেখে আর লাভ নেই। একশত টাকা রবির পকেটে গুঁজে দিয়ে বললাম, “ভাই কোনো মহিলার নাম্বার দিস না, মেয়ের নাম্বার দিস।” রবি আমার মোবাইলে নাম্বার তুলে দিয়ে বলল, “কন্ঠ শুনেই তো ব্যাটা অজ্ঞান হয়ে যাবি। আর কেউ ফোন দেয় নাই এই মেয়েকে। তোর কাছেই প্রথম বিক্রি করলাম” আমি ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চাইলাম, “আমার কাছে প্রথম মানে? তুই এক নাম্বার কয়জনের কাছে বিক্রি করোস?” রবি বলল, “রেগে যাচ্ছিস কেন? ধর তুই নাম্বারটা নিলি, কিন্তু মেয়েটাকে পটাতে পারিসনি। মেয়ে তোকে পাত্তা দিচ্ছে না। তখন নাম্বারটা অন্য কারো কাছে বিক্রি করবো। একজন পটাতে না পারলে আরেকজন।” আমি পুকুরপাড়ে এসে ফোন দিলাম সেই নাম্বারে। রবি সত্যি কথাই বলেছে, মেয়েটির কন্ঠ অনেক সুন্দর। না জানি মেয়েটা কত সুন্দর। মেয়েটি রিসিভ করে জানতে চাইলো, “হ্যালো কে বলছেন?কাকে চান?”
আমি উত্তর দিলাম, “আমি শাওন। ফোন করেছি ফায়ার সার্ভিসে। দ্রুত চলে আসুন, আমার মনে আগুন লেগেছে।”
মেয়েটি আমার কথা শুনে খিলখিল করে হেসে দিলো। বাহ, মেয়ে পটানো কোনো ব্যাপার হলো? শুরু হয়ে গেল আমাদের পরিচয় পর্ব, পরিচয় থেকে প্রেম। মেয়েটার বাড়ি আবার পাশের গ্রামেই। মাথার ক্যাপ ডানদিকে ঘুরিয়ে হাতে লাল একটা রুমাল বেঁধে আলাদা একটা ভাব নিলাম। আজ আমার প্রেমিকার সাথে দেখা করতে যাব। রবিকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব, তাঁর জন্যই আজ প্রেম করতে পেরেছি। ঘর থেকে বের হয়েই দেখি কুসুম সামনে দাঁড়িয়ে। যাত্রা শুভ না অশুভ বুঝতে পারছি না। খলসে মাছের মতো একটা ভেটকি মেরে কুসুম বলল, “শাওন ভাই, এমন নায়ক সেজে কোথায় যান?” আমি পাশ কেটে আসার সময় বললাম, “নায়িকার সাথে দেখা করতে।”
মনে মনে অবশ্য একটু খুশি। কুসুম অন্তত নায়কের মতো ভেবেছে আমাকে। পাশের এলাকায় গিয়ে কিন্টারগার্ডেন স্কুল খুঁজে পাচ্ছি না। ফোনে যে মেয়েটির সাথে প্রেম হলো তার নাম বিলকিস। সে আমাকে বলেছে কিন্টারগার্ডেনের সামনে দাঁড়ানো থাকবে। পথে এক আন্টির সাথে দেখা। কোন গুদামের চাল খায় কে জানে। আমার মতো চারজন জোড়া দিলে উনার সমান হবে। আমি জানতে চাইলাম, “আচ্ছা আন্টি, এখানে কিন্টারগার্ডেন স্কুল কোথায়?”
মহিলা তো রেগে মেগে উত্তর দিলো, “এই ছেলে, আমাকে আন্টি ডাকলে কেন? আমার এখনো বিয়েই হয়নি।”
আমি কী জবাব দেব বুঝে উঠতে না পেরে সরি বললাম। আমাকে ধরে আছাড় দিলে আমার অস্তিত্ব থাকবে না। একটু সামনে গিয়ে বিলকিসকে ফোন দিলাম। সে রিসিভ করে বলল, “কোথায় তুমি? মন মেজাজ ভালো না, তাড়াতাড়ি আসো। এক ছেলে আমাকে আন্টি ডেকেছে।”
আমি পেছন ফিরে দেখি ঐ আন্টির কানে মোবাইল, মানে এটাই বিলকিস। আমি পা দুটো ঈষৎ ফাঁক করে হাঁটার মতো করেই এক প্রকার দৌড়ে পালিয়েছি। মন খারাপ করে বাসায় ফিরছি। বিলকিস আমার মনটা ভেঙ্গে দিলো। এতো সুন্দর কন্ঠ, অথচ। সামনে চোখে পড়ল দুটি মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। দু’টি মেয়েরই চুলে বেণী করা। সেলোয়ার কামিজ পরনে হেঁটে যাচ্ছি। দুই বান্ধবী হতে পারে। দুইটা থেকে একজন তো পছন্দ হবে আমি সিউর। চাঁদ মুখ দুটো দেখতে হলে আমাকে একটু দ্রুত হেঁটে যেতে হবে। আমি জোরে হেঁটে প্রায় ওদের কাছাকাছি এসে গেছি। এমন সময় একজন আমার দিকে তাকিয়ে হাতে দুই তিনটা তালি মেরে বলছে, ছাইয়া, দেখরে একটা শুটকি পোলা যায়। এই শুটকি, প্রেম করবি আমার সাথে?”
আমি বুকে থুথু দিয়ে দৌড়াতে লাগলাম। হিজরা দুটোর হাসির শব্দ তখনো শোনা যাচ্ছিলো। বাড়ি ফিরে এলাম ক্লান্ত শরীরে। কুসুম তখন আমার মায়ের সাথে বসে ফুল পিঠা বানাচ্ছে। খেঁজুর কাটা দিয়ে নকশী এঁকে বানাচ্ছে পিঠা। তার অবাধ্য চুল বারবার চোখের সামনে এসে যাচ্ছে। সে আঙ্গুল দিয়ে বারবার কানের পাশে গুঁজে দিচ্ছে। কতো সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে। সে আমাকে ভালোবাসে। সারা দুনিয়া আমি প্রেমের জন্য ঘুরে বেড়াই, অথচ বাড়ির পাশে কুসুম আমাকে ভালোবাসে। আমি ইশারায় ডাকলাম কুসুমকে। সে উঠে এলো। আমি আম গাছকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছি। কুসুম এসে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। কয়েকটা চুল চোখের একপাশে। আমি আমার হাতের আঙ্গুল দিয়ে চুলগুলো তার কানের পাশে গুঁজে দিচ্ছি। কুসুম অনেক লজ্জা পাচ্ছে। আমি বললাম, “আজ আমার জন্য বকুল ফুলের মালা গাঁথিসনি?” কুসুম অপরাধীর মতো বলছে, “আয়েশা এসে সব নিয়ে গেছে। আপনি দাঁড়ান, আমি এখনি বকুল ফুল কুড়িয়ে আনছি।”
কুসুম ছুটে গেল, আমি যাচ্ছি তার পেছনে। এই বিকালে বকুল ফুল পাবে তো? এলাকার সব বাচ্চারা নিয়ে গেছে হয়তো ফুল কুড়িয়ে। আমি গিয়ে দেখি কুসুম বকুল ফুলের গাছ ধরে ঝাঁকি দিচ্ছে। আমি তার কাছে ফুলের মালা চেয়েছি বলে তার কতো চেষ্টা কিছু ফুল কুড়ানোর জন্য। আমি এগিয়ে গেলাম কুসুমের কাছে। আমিও কুসুমের সাথে হাত একত্র করে গাছে ঝাঁকি দিচ্ছি, যেন কিছু ফুল ঝরে পড়ে। অন্তত একটা মালা যেন কুসুম গেঁথে ফেলতে পারে। সেই মালা পরিয়ে তেব তাঁরই গলায়।
গল্পের বিষয়:
গল্প