স্যার সবজি কি আর নিবেন? রফিকের প্রশ্নে মধ্যম কাশিতে আলতাফ মাস্টারের উত্তর- না। বেশী নিলে ঝামেলা। মাইয়া মানুষ ফ্রিজে ঢুকাবে। সবজি খাইতে হয় তরতাজা। রফিক ব্যাগ হাতে বাড়ির দিকে রওনা হয়।
আলতাফ মাস্টারের বয়স ৮০ কিংবা তার চেয়ে একটু বেশী। বয়স জিজ্ঞাসা করলে শুধু বলে ‘আম্মা কইছিলো মাঘ মাসের ২০ তারিখে হইছি, কোন সনের মাঘ মাস তা আর জানিনা’ বয়সের ছাপ হাটা চলায় স্পষ্ট হলেও এ বয়সে কিছু জিনিস আলতাফ সাহেব খুব কঠোর ভাবে মেনে চলে। বাশি কিছু খায়না। ফ্রিজ নামের বস্তুটা তার খুব অপছন্দের। হেটে হেটে প্রতিদিনের বাজার প্রতিদিন কিনে আনে। বাজারে যাওয়াটা তার জন্য কষ্টকর। গ্রাম থেকে বাজারের অতোটুকু রাস্তায় যোগাযোগের ব্যবস্থা না থাকায় হেটেই বাজারে যেতে হয়। বেশ কয়েকবার খবর এসেছিলো মাস্টার সাহেব রাস্তায় পড়ে আছে, হাটতে পারছেনা। এরপর থেকে রফিক সাথে যায়। অনেকবার অনুরোধ করার পরেও উনি ঘরে থাকতে রাজিনা। বাজার সে নিজেই করবে। অগত্যা রফিক সঙ্গ দেয়, মাস্টার সাহেবকে ধরে ধরে নিয়ে যায় আবার নিয়ে আসে।
জীবনের হিসাব হইলো শরীরের শক্তি অপচয় না করা। অপচয় করা মানুষ অলস হয়। বাঁচবো আর কয়দিন রফিক? হাটতে যেহেতু পারি, একটু হাটি। বিছানায় পড়ে গেলে তো তা আর সম্ভব না তাইনা? প্রশ্ন করে রফিকের দিকে তাকিয়েই রাস্তায় বসে পড়ে আলতাফ সাহেব। বড়বড় শ্বাস নিচ্ছে। বুঝা যাচ্ছে উনি আর হাটতে পারবেন না।
রফিক কাছে গিয়ে মাথায় হাত রেখে বলে স্যার জীবনের শক্তি অপচয় করা ঠিক না। তবে জীবন হুমকিতে পড়ে যাবে অতোটা শক্তি ব্যয় করাও ঠিক না। আপনি বাড়ি থাকবেন। এখন থেকে বাজারটা প্রতিদিন সকালে আমিই করবো। আলতাফ সাহেব রফিকের দিকে তাকালো। ‘তোমারে আমার ভালো লাগে রফিক। জীবনে অনেক বড় হবা। সূরা ফাতেহা তিনবার পড়ে আমার বুকে একটু ফু দাও। সূরা ফাতেহার বড় ফজিলত। পূন্য ব্যক্তি এই সূরা পড়ে ফু দিলে যেকোন সমস্যাই দূর হয়’ রফিক সূরা ফাতেহা পড়ে বুকে ফু দিলো। কিছুক্ষণ পর আলতাফ সাহেব উঠে দাড়ালো। বললো বুকে বল পাইতেছি রফিক, চলো হাটি। রফিক বুঝতে পারলো আলতাফ সাহেব এখনো ঠিক নেই। রফিককে খুশী করতে উনি উঠে দাঁড়িয়েছে।
সাফা পড়ার টেবিলে বসে আছে। মাস্টার সাহেব আসবে। মূলত সকাল সকাল প্রাইভেট পড়ার কারন হচ্ছে এই সময়ে ব্রেইন সরস থাকে। সহজে পড়া মাথায় ঢুকে। বিকাল সন্ধ্যায় ব্রেইনে সারা দিনের নানান রকমের ঘটনা ঘুরে, পড়ায় অতো মন বসেনা। এইজন্য পড়ার মতো সিরিয়াস কাজ গুলো সকাল সকাল সাড়তে হয়। ইদানীং সাফা চিরতার রস খায়। বিশ্রী খাইতে। তবে চিরতার রস পাকস্থলীর জন্য যেমন ভালো তেমন ত্বকের জন্যেও ভালো। যুবতী মেয়েরা ত্বকের যত্নে বিশ্ব যুদ্ধ করতে রাজী হবে তবুও একটুখানি ছাড় দিবেনা। রফিক ঘরে ঢুকতেই সাফা এক গ্লাস চিরতার রস দিলো। ‘চিরতার রস তো আমি খাইনা সাফা’ ‘খান না, তবে আজকে খাবেন। শরীরের জন্য ভালো। তবে আপনি উপকারের জন্য খাবেন না। এটা আপনার শাস্তি’ ‘শাস্তি? কিসের শাস্তি?’
‘গত তিন দিন যাবৎ আপনার জন্য বইয়ের মাঝে চিরকুট রেখে যাচ্ছি সকালে বাজার থেকে আমার জন্য নীল চুড়ি আনবেন। আপনি সেটা চোখেই দেখেন না। সব কথা মুখে বলা যায়না। কিন্তু এখন থেকে ভাবছি মুখেই বলবো। ছাগল দিয়ে হালচাষ হয়না। আপনি হচ্ছেন সেই ছাগল। এক্ষুনি এই রস খাবেন’ রফিক চিরতার রস খায়। তবে আর পড়ায় না। ঘর থেকে বের হয়ে যায়। রফিক এই মুহূর্তে সাফাদের বাড়িতেই থাকছে। গরীব ঘরের ছেলে সে। কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে। স্কুল কলেজে যাওয়ার জন্য যখন দুইবেলা খাবার জুটতোনা কপালে তখন আজহার সাহেব রফিককে পড়াশোনার খরচ দিয়েছে। কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলে যখন অন্যান্য ছেলে মেয়েরা শহরে গিয়ে কোচিং-এ ভর্তি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার স্বপ্ন দেখে তখন রফিক চুক্তিতে ধান কাটতো, হাল চাষ করতো। আজহার সাহেবই পড়ে রফিককে শহরে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। রফিক দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিকাল সাইন্সে গ্রাজুয়েশন শেষ করে।
পরিশ্রমী ছেলেদের মানুষ সম্মান করে, স্নেহ করে। রফিক গ্রামের সেই পরিশ্রমী ছেলে। অত্র এলাকায় তার নাম ছড়িয়েছে শুধু পড়াশোনা দিয়ে। আর ঠিক এ ব্যাপারটাকেই আপাতত কাজে লাগাচ্ছে আজহার সাহেব। সামনে জাতীয় নির্বাচন। বেশ কয়েক বছর যাবৎ উপজেলা চেয়ারম্যান হয়ে নাম কুড়িয়ে এখন উনি এমপি নির্বাচনের কথা ভাবছেন। প্রচুর জন সমর্থন দরকার। রফিককে আপাতত পাশে রেখেছে। মেয়েকে পড়াবে আর সামনের কয়েকমাস তার সাথে নির্বাচনি প্রচারণায় থাকবে। চিরতার রস খেয়ে আপাতত রফিক চিনি মুখে বসে আছে। অগ্রহায়ণের সকালের রোদ কম্বলের মতো ওম দেয় শরীরে। ওম দেওয়া রোদে আলতাফ মাস্টারের সাথে কথা বলছে আজহার সাহেব। দেখে মনে হচ্ছে সিরিয়াস কিছু। সিরিয়াস কিছুতে আলতাফ মাস্টার চোখ মুখ শক্ত করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ছেলে চলে যাওয়ার পরেও মাটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে আছে আলতাফ মাস্টার। রফিক কাছে যায়। ইশারায় আলতাফ মাস্টার তাকে বসতে বলে।
‘জীবনের কয়েকটা ধাপ আছে রফিক। এইগুলা মাথায় রাখবা। একটা সময় থাকবে তোমার কথায় সব হবে। একটা সময় আসবে তোমার কথায় কিছুই হবেনা, তবে যা হবে সেই ব্যাপারে তোমাকে জানানো হবে। আরেকটা সময় আসবে তোমার কথায় কিছুই হবেনা, যা হবে সেই ব্যাপারে জানানোও হবেনা। শেষ ধাপের নাম অবহেলা। এটা শেষ বয়সে আসে। তখন কষ্ট পাইয়ো না’ রফিক মাথা তুলে আলতাফ মাস্টারের দিকে তাকালো। চেহারাটা পাথরের মতো হয়ে আছে। পাথর ভাঙার মতো শব্দ করে উনি বলছেন- ‘জীবনটাকে ধরতে পারো রাস্তার মতন। রাস্তা পার হওয়ার নিয়ম সামনে এগিয়ে যাওয়া। শুধু মসৃন রাস্তায় চলতে শিখে গেলে ভাঙাচুরায় তুমি টিকবেনা। গাড়ির মতন উল্টাইয়া যাইবা। বরং ভাঙাচুরায় চলতে শিখো, চলতে চলতে শক্ত হতে শিখবা। মনের মধ্যে রাস্তা সংস্কারের একটা তীব্র আন্দোলন তৈরী হবে। এর উদাহরণ হইলো গলায় দড়ি দেওয়া ঝুলন্ত মানুষ গুলা বেশীর ভাগ ৮-১০ তলায় থাকে। টিনের ঘরে না। টিনের ঘরের মানুষ গুলা এক বেলা ডাল ভাত কাঁচা মরিচ দিয়া ডইলা খায়, খাইয়া কয় আলহামদুলিল্লাহ ভালা আছি!’
রফিক উঠে আসে। এই মানুষটাকে তার একটা আস্ত উপন্যাস মনে হয়। যে উপন্যাসে বুদ হয়ে থাকা যায়, মোহ থেকে যায়। শেষ হয়েও শেষ হয়না। পাকিস্তান আমলের Bsc পাশ আলতাফ সাহেব উপজেলার সরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন ৩৫ বছর। একমাত্র ছেলে আজহারকে উনি শিক্ষিত করতে পারেন নি। ছেলে রাজনীতি করতো। মানুষ খারাপ না। দুস্থদের পাশে দাঁড়াতো। জনসেবা মূলক কাজ করতো। আলতাফ মাস্টারের ছেলে হিসেবে ভালো সুনাম কুড়িয়ে একবার উপজেলা চেয়ারম্যান পদে দাঁড়িয়ে গেলো। বিপুল ভোটে জয়ী হলো। কিন্তু উনি এখানেই ক্ষান্ত থাকতে চাননা। জনপ্রিয় হলে জনপ্রিয়তা ব্যবহার করতে হয়। জনগনের হাত ধরেই উপরে উঠতে হয়। এবার সামনে এমপি নির্বাচন করবেন।
দলীয় মনোনয়নে উনি যাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছেন সে খুব পয়সাওয়ালা। উপরের মন্ত্রীদের সাথে তার ভালো হাত। কিন্তু এলাকায় তার সমর্থন নাই। বর্তমান নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নটাই আসল। এটা ফসকে গেলে জনপ্রিয়তা দিয়েও কিছু হবেনা। সেই লোক সাফাকে তার ছেলের বউ হিসেবে পছন্দ করেছে। এখন মনোনয়ন কব্জা করতে এই সুযোগটা লুফে নিতে চায় আজহার সাহেব। ছেলের ঠিক এই ব্যাপারটাই ভালো লাগেনি আলতাফ মাস্টারের। কুৎসিত মনোভাব। ‘মনে মনে কি ভাবেন মাস্টার’? পিছনে তাকিয়েই দেখে সাফা নীল শাড়ী, নীল চুড়ি আর কপালে ছোট্ট একটি কালো টিপ পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার রুচি ভালো। কপালের টিপটা নীল হলে কার্টুন দেখাতো। কিন্তু সে কালো টিপ পড়ে ব্যাপারটায় ভিন্নতা এনেছে, আলাদা করে দৃষ্টি পড়ছে ওখানে। কালো চোখের কালো কাজলের পাড় ঘেঁষে ছোট্ট একটা কালো সূর্য, মায়াবী অবয়ব। কবি হলে এতোক্ষণে অনেক কিছু বলা যেতো। তবে সে যেহেতু কবি না, আবার প্রেমিক পুরুষও না তাই ছোট্ট করে উত্তর দিলো কিছুনা!
– ‘সকালের ঘটনার জন্য দুঃখিত মাস্টার সাহেব। আসলে আমার নীল চুড়ি আছে। আপনাকে শুধু শুধু চিরকুট দিতাম। কেনো দিতাম নিজেও জানিনা। বলেন আমি বোকা না?’
– ‘তুমি কেনো বোকা হবা? বোকা মেয়ে হলে কপালে নীল টিপ থাকতো। যেহেতু টিপটা কালো, তারমানে তুমি স্মার্ট’
– ‘নাহ মাস্টার মশাই, আমি বোকা। সারাজীবন ভেবে আসছি বাবা আমাকে খুব ভালোবাসে। আমার জন্য সবকিছু করে ফেলতে পারবে চোখ বন্ধ করে। এখন দেখছি আমার ভাবনা ভুল। আসলে বাবা ভালোবেসেছে যেন আমি তার জন্য যেকোন সময় যা ইচ্ছে তা করে ফেলতে পারি। বিশ্বাস জুগিয়েছে, যেন তার অবিশ্বাস্য কাজেও আমি হ্যাঁ বলে দিতে পারি। যেমন বাবা কালকে বললো ছেলে পক্ষ আমাকে দেখতে আসবে। পছন্দ করা আছে। এ সপ্তাহের মধ্যেই বিয়ে। আমি বলে ফেললাম আচ্ছা। আশ্চর্য বিয়ের মতো একটা সারাজীবনের ব্যাপারকেও আমি কেমন নির্দ্বিধায় আচ্ছা বলে মত দিয়ে দিলাম কোন কিছু না ভেবে! বলেন আমি বোকা না?’
– ‘সব বাবারাই চায় তার মেয়ে ভালো থাকুক। উনি নিঃসন্দেহে তোমার ভালোটা ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে’
– ‘আপনারে দেইখা মনে হইতেছে আপনি আসলে দর্শন বিদ্যার ছাত্র, পলিটিক্সের না।
আমারতো ওরকম তথাকথিত এস্টাব্লিশড ছেলের দরকার নাই। আমার দরকার আমি কোথায় ভালো থাকবো, কোথায় আমার ভালো লাগা গুলো কাজ করে সেরকম কিছু। যে মানুষটারে চেয়েছি সেই মানুষটাকেই পেয়েছি, এমন সুখানুভূতি নিয়ে আমি কুঁড়ের ঘরেও থাকতে পারবো’ রফিক সাফার দিকে তাকালো। এই মুহূর্তে কপালের কালো টিপটাকে তার কুঁড়ের ঘর মনে হচ্ছে। এই ঘরে থাকা যায়, একটা ছোট্ট সুখের সংসার পাতা যায়, দুইবেলা কাঁচামরিচ দিয়ে ডলে পান্তাভাত খেয়েও তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে আলহামদুলিল্লাহ বলা যায়। ভালো লাগার ব্যাপারটা একপাশে রেখে রফিক উত্তর দিলো- ‘আমি এমন অনেক মেয়েকে জানি যারা একটা সুন্দর সম্পর্কে থেকেও ভবিষৎ ভেবে শেষমেশ এস্টাব্লিশড ছেলের হাত ধরেছে। কিন্তু তুমি ব্যতিক্রম।
তোমার আত্মউপলব্ধী সুন্দর। আমি এটাকে সম্মান করি’ ‘এমন আত্মউপলব্ধী করা মেয়েদের কি আপনার পছন্দ মাস্টার মশাই?’ রফিক দ্বিধায় পড়ে যায়। রফিককে দ্বিধায় রেখে সাফা বলে যায়- আজকে সন্ধ্যা অব্দি আপনার সময়। ভাবতে থাকেন। এসব নাটক ফাটক আমার ভালো লাগেনা। সন্ধ্যার পর আপনার সাথে আবার দেখা হবে। রফিক আর সাফা আলতাফ মাস্টারের ঘরে বসে আছে। হবু জামাইর পাশে মেয়েদের খানিকটা লজ্জাবতী দেখায়। নাতনীর লজ্জামাখা গালে হাত রেখে আলতাফ মাস্টার বললো- জীবনকে নিজের কাছে রাখা উচিৎ। অন্যের কাছে সোপর্দ করা জীবন দাসত্বের মতো। তুই নিজের সিদ্ধান্তে আছস, এটা ভেবে আমি শান্তি পাচ্ছি। সবকিছু প্ল্যান মাফিক হয়না। এ নিয়ে মন খারাপ করিস না। এতে একটু দুর্নাম হবে। সব দুর্নাম খারাপ না। কিছু দুর্নাম পথভ্রষ্ট মানুষের জন্য শিক্ষা। আশাকরি তোর বাবা শিক্ষা পাবে। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় হঠাৎ রফিক থমকে গেলো। আবার আলতাফ মাস্টারের কাছে এসে বসলো।
– ‘ স্যার আমাদের সূরা ফাতেহা পড়ে একবার ফু দিয়ে দিবেন?’ আলতাফ মাস্টার দুজনকে সূরা ফাতেহা পড়ে ফু দেয়। রফিক সত্যিই অনুভব করে তার বুকে বল ফিরে এসেছে। অদ্ভুত এক শক্তি কাজ করছে। যে শক্তি আর বল দিয়ে সাফাকে নিয়ে কুঁড়ে ঘরেও থাকা যাবে। দুইবেলা মরিচ ডলে ভাত খেয়েও বলা যাবে- আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি!
গল্পের বিষয়:
গল্প