আমার বউ ঘুমের মধ্যে কথা বলে ৷ আজ রাতে সে ঘুমের মধ্যে এমন একটা কথা বললো যা আমি প্রত্যাশা করিনি ৷ চেতন অবস্থায় সে এরকম কথা কখনোই বলবেনা ৷ অথচ ঘুমের মধ্যে ঠিকই সে অকথ্য ভাষায় অপ্রত্যাশিত কথাটি বলে ফেললো ৷
অধিকাংশ দিন আমি বাজার থেকে ছোট ছোট পুঁটিমাছ কিনে আনি, এটা যে বউয়ের অপছন্দ সেটা আমার জানা ছিলোনা ৷ আজকে ঘুমের মধ্যে বউ সেই অপছন্দের কথাটি ব্যক্ত করলো ৷ বউ বললো, “শালার জামাই, আর যদি কোনোদিন পুঁটিমাছ কিনে এনোছো, তবে তোমার একদিন কি আমার একদিন ৷ কিছু বলিনা বলে মাথায় উঠে গেছো! বউকে চাকরাণী ভেবে যা ইচ্ছা তাই করতে মন চাই, তাইনা? ৷ এক কেজি পুঁটি মাছ কাটতে কত সময় লাগে সেদিকে কি তোমার খেয়াল আছে? আরেকদিন বালের ঐ পুঁটিমাছ কিনে এনো, সেদিন দেখাবো মজা! ঐ বালের মাছ আমি রান্না না করেই তোমার গলার ভেতর ঢুকিয়ে দেবো! ঝাঁঝালো কন্ঠের এরকম হুঁশিয়ারী কথা গড়গড়িয়ে বলে ফেললো আমার সুন্দরী বউটা ৷ তার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম ৷ কিছুক্ষণ থম মেরে থাকার পর হাত থেকে ফোনটা সরিয়ে বউয়ের পিঠে হাত রেখে মৃদ্যুভাবে ঠ্যালা মেরে নিচুস্বরে বললাম,
-দোলা, তুমি কি জেগে আছো?
কোনো উত্তর এলোনা ৷ সে এতোটুকু পরিমাণে নড়লোও না ৷ বুঝলাম সে সত্যি ঘুমে বিভোর! দোলাকে আর ডাকলাম না ৷ ঘুমোচ্ছে ঘুমাক! ঘুমের মধ্যে সে নিজের অপছন্দের বিষয়টি তুলে ধরেছে এটা জানতে পেরে সাবধান হয়ে গেলাম ৷ মাথায় একটা বিষয় গেঁথে রাখলাম যে দ্বিতীয়বার আর পুঁটি মাছ বাজার থেকে কিনে আনা যাবেনা! কিনলেই বউ হয়তো ফের ঘুমের মধ্যেই কথার মাধ্যমে ধোলায় করতে পারে! সকালে খাবার টেবিলে বসার পর মুখে রুটি তুলতে গিয়ে বউকে বললাম,
-দোলা, তুমি যে কাল রাতেও ঘুমের মধ্যে কথা বলেছো সেটা কি জানো? দোলা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে কিঞ্চিত বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো,
-কই, আমি কখন ঘুমের মধ্যে কথা বললাম? আমার তো কিছু মনে পরছেনা!
-তোমার মনে না পরারই কথা ৷ ঘুমের মধ্যে কেউ কিছু বললে সে সত্যিই কিছু মনে করতে পারেনা!
-তো, আমি ঘুমের ঘোরে কি বলেছিলাম? দোলার দিকে নরম দৃষ্টি দিলাম, এবং স্মিত হেসে বললাম,
-তুমি বলেছো যে আর কখনো যেনো আমি বড় মাছ কিনে না আনি ৷ তোমার নিকট ছোট মাছ খুব প্রিয়! বড় মাছ তুমি অপছন্দ করো ৷ বিশেষ করে চিতল মাছ! অথচ সেই চিতল মাছ সপ্তাহে দু দিন কিনে আনি! সো, আর চিতল মাছ কিনে আনবোনা! দোলার চেহারার রং পাল্টে গেলো ৷ খানিকটা ঘাবড়ে গেছে বুঝতে পারলাম ৷ সে ভারি গলায় বললো,
-আমি এমন কিছু বলতে যাবো কিসের জন্য? আর আমি চিতল মাছতো ভালোবাসি!
-সেটা আমি বলবো কি করে? তুমি এতে ঘাবড়ে যাচ্ছো কেন? ঘুমের মধ্যে অনেকে অনেক কিছু বলে, তুমি তো খারাপ কিছু বলোনি বরং নিজের মত প্রকাশ করেছো! দোলা চুপ হয়ে গেলো ৷ কোনো প্রতিত্তর করলোনা ৷ তবে তার চেহারায় কিঞ্চিৎ বিরক্তির ছাঁপ লক্ষ্য করলাম ৷ যদি আসল কথাগুলো শোনাতাম তখন তার চেহারার অবস্থা কেমন হতো কে জানে!
শ্বশুরবাড়ি এসেছি তিনদিন হলো ৷ কাল দুপুরেই বাসায় চলে যাবো৷ এসেছিলাম শ্বশুরের থেকে ৫০ হাজার টাকা ধার নিতে ৷ জানি চাইলেই শ্বশুর আব্বা টাকাগুলো দিয়ে দিবে কিন্তু এখনো তার নিকট টাকার কথা বলতে পারছিনা ৷ ভাবছি সকালে শ্বশুরের নিকট টাকার কথা উপস্থাপন করবো ৷ আজ বিকেলে দোলাকে টাকার ব্যাপারে বলেছি, সে টাকা নিতে নিষেধ করেনি, বরং টাকা নিতে উৎসাহ দিয়েছে ৷ যদিও গতবছর ৬০ হাজার টাকা নিয়ে শ্বশুরকে আর ফেরত দিইনি ৷ এসত্বেও বউ এ ব্যাপারটা নিয়ে একটা টু শব্দও করেনি ৷ শ্বশুরআব্বা আমার থেকে সেই ধারের টাকাগুলো না চাওয়াই আমিও টাকা ফিরিয়ে দেবার এতোটুকুও ইচ্ছাপোষণ করিনি ৷ রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় গিয়ে ইউটিউবে চলে গেলাম একটু বিনোদন নেবার আশায় ৷ আমার বউ একটু পরই বেডে আসবে, এবং সে ঘন্টাখানেকের আগেই ঘুমের জগতে হারিয়ে যাবে ৷ সে ঘুমকাতর হওয়ায় মনোযোগ দিয়ে মুভি নাটক উপভোগ করতে পারি! আজও তার ব্যতিক্রম হচ্ছেনা ৷ দেখতে দেখতে রাত ১১টা বেজে গেলো ৷ দোলার নিকট এখন গভীর রাত, তাই সে ঘুমের চাদরে মিশে আছে, আর আমি ফোনের স্কিনে! আচমকা, দোলার জোরালো আওয়াজ ভেসে আসলো ৷ সে ভয়ংকর রকমের রাগান্বিত স্বরে বললো,
-রেহাইনন্যা, খবরদার ভুলেও আমার আব্বার থেকে ১টাকাও নিবেনা, নিলেই তোমার বারোটা আমি বাজিয়ে ফেলবো৷ এতোটুকু বললাম, এর বেশিকিছু বলার দরকার নেই! এতোটুকু বলেই বউ চুপ হয়ে গেলো ৷ দোলাকে সজোরে ঠ্যালা মেরে জাগিয়ে দিলাম ৷ সে জেগে উঠে ঘুমজরানো কন্ঠে বললো,
-কি হয়েছে? জাগালে কেন? ওহ বুঝতে পেরেছি ৷ কিন্তু আজকে আমি তোমার সাথে রোমান্স করার মুডে নাই ৷ প্রচুর ঘুম পেয়েছে,আমি ঘুমাবো ৷ যদি চাও তবে শেষরাতের অপেক্ষায় থাকো! কিঞ্চিৎ চেঁচানো গলায় বললাম,
-আরে না, আমি তো তোমাকে জাগিয়েছি অন্য একটি কারণে!
-কি কারণ?
-তুমি এই মাত্র ঘুমের ঘোরে কথা বলছিলে! তোমার কি কিছু মনে নেই?
-আমি কথা বলেছি? সত্যি?
-আরে আমি মিথ্যা বলবো কেন?
-তো আজকে আমি কি বলেছি?
-থাক বলতে চাইনা, যেহেতু তোমার কিছুই মনে নেই ৷ শুধু শুধু বলে কি লাভ?
-খুব কি খারাপ কিছু বলেছি?
-না ৷ তবে একটা কাজ করতে নিষেধ করেছো!
-ওহ, তাহলে ঐ কাজটা করোনা ৷ একবার আম্মুকে ঘুমের মধ্যে বলেছিলাম সে যেনো অমুক কাজটা না করে ৷ কিন্তু সে আমার কথা মানেনি! না মানার কারণে আম্মুর অনেক ক্ষতি হয়েছিলো ৷
-ওহ ৷ তাই নাকি! তাহলে আমিও কি নিষেধ করা কাজটা করবো না?
-আমার তো অনুরোধ থাকবে ভুলেও করোনা ৷ কিন্তু ঘুমের মধ্যে তোমাকে কি করতে নিষেধ করেছি সেটা তো বলবে?
-থাক বলতে চাইনা!
-ওকে, ঘুমাও ৷ আর যদি চাও তবে চলো পুকুর পাড়ে যাই, দুজনে বসে পূর্নিমা দেখি!
-না দরকার নেই ৷ ঘুমিয়ে পরি বরং!
শেষপর্যন্ত শ্বশুরের থেকে টাকা নেবার সাহস হলোনা ৷ টাকা নিলে হয়তো কোনো ক্ষতি হতে পারে! এই ভয়ে পিছিয়ে গেলাম! ২মাস পেরিয়ে গেলো ৷ কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো এই ২মাসে একদিনও আমার বউ ঘুমের মধ্যে কথা বলেনি ৷ এরমানে তার সমস্যাটা আর নেই? কিছুক্ষণ গভীরভাবে ভাবার পর একটা বিষয় আমার মাথায় এলো, তবে তেমনভাবে সেটা গুরুত্বে নিলাম না! তিন মাস পরের ঘটনা, আমার বউয়ের মাথায় কুটচিন্তা বাসা বেঁধেছে ৷ সে জঘন্য চিন্তাভাবনা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে ৷ সে এমন আচরণ করবে ভাবিনি ৷
আমাকে বলছে বাবা, মায়ের থেকে আলাদা হয়ে সংসার চালাতে হবে ৷ কতবড় দুঃসাহসিক দাবি জানিয়েছে আমার নিকট! আমার দু ভাই আলাদাভাবে সংসার করছে এসত্বেও, আমি কেন বাবা, মায়ের সঙ্গে সংসার করছি এটা আমার বউ মেনে নিতে পারছেনা! দোলাকে আমি প্রতিত্তরে হ্যাঁ না কিছুই বলিনি এখনো ৷ তবে চোখের ভাষায় বুঝিয়েছে সে অপরাধযোগ্য দাবি পেশ করেছে! আমার শ্বাশুরি দোলার মাথা খেয়েছে এটা সহজে অনুমেয় হচ্ছে ৷ সর্বোপরি আমি চুপচাপ রইলাম! ৩দিন পর, আমার বউ ভোরবেলা কান্না জুরে দিয়েছে ৷ সে কাঁদতে কাঁদতে বেলকণিতে দাঁড়িয়ে ফোনে কার সঙ্গে যেনো কথা বলছিলো ৷ আমি রুমে শুয়ে থেকে অস্পষ্টভাবে সেসব শুনছিলাম ৷ কৌতূহলবশত বেলকণির নিকটে গেলাম এবং স্পষ্টভাবে শুনতে পেলাম তার কান্নামিশ্রিত আতঙ্কের স্বরের কথামালা,
-মা, রেহানের মাথা বোধহয় নষ্ট হয়ে গেছে ৷ সে রাতে ঘুমের ঘোরে যা ইচ্ছা তাই বলেছে ৷ আমাকে গালিগালাজ করছিলো আর হুমকি দিচ্ছিলো ৷ হুমকিটা আসলে ঐ ব্যাপারটা নিয়ে! সে আলাদাভাবে সংসার করবেনা, এমনকি এই ব্যপারটা নিয়ে কোনো কথা বললে সে ঘুমের ঘোরে না কি গলা টিপে আমাকে মেরে ফেলবে! মা, আমি চাইনা আমাদের সুখের সংসার ভেঙ্গে যাক ৷ যেমনে আছি তেমনেই চলি ৷ আর শ্বশুর শ্বাশুরি তো আমাকে খুব ভালোবাসে, একদম তার মেয়ের মত করে! মা তুমি রাগ করোনা! আমি সত্যি চাইনা আলাদা হই ৷ আসলে মা, আমার ভয় হচ্ছে রেহানকে নিয়ে ৷ তারও কি সেই সমস্যা সৃষ্টি হলো যে সমস্যা আমি ১০ বছর ধরে বয়ে বেরিয়েছি এমনকি ৪ মাস আগেও ছিলো ৷ ঘুমের মধ্যে কথা বলা হুমকি ধামকি দেওয়া ভালো কিছু না ৷ জানোই তো, রেহানকে শায়েস্তা করতে ১মাস ধরে ঘুমের মধ্যে কথা বলার নাটক করেছিলাম ৷ আর নাটকটা কাজেও লেগেছিলো ৷ কিন্তু এবার দেখছি আমার ব্যারাম রেহানের মধ্যে ঢুকেছে! না মা, তুমি যেটা ভাবছো তেমনটা হবার চান্স নেই ৷ রেহান কি করে জানবে যে আমি ঘুমের মধ্যে কথা বলার নাটক করেছিলাম? সে তো জানতোই না যে আমি রোগটা থেকে অনেক আগেই মুক্তি পেয়েছি!
দোলা ভুল জানে ৷ সে যে ঘুমের মধ্যে কথা বলার নামে অভিনয় করতো সেটা আমি ১ সপ্তাহ আগে জেনে গিয়েছিলাম ৷ দোলা তার মায়ের সঙ্গে আজকের আগেও ঘুমের মধ্যে কথা বলার বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেছিলে আর আমি সেটা শুনে ফেলেছিলাম ৷ আলোচনা শুনে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম৷ এরফলে বউয়ের উপর ট্রিকসটা কাজে লাগানোর সুযোগ খুঁজছিলাম ৷ যখন দেখলাম বউ তার মায়ের কথা শুনে বখে গেছে তখন ঘুমের মধ্যে কথা বলার অভিনয়টা শৈল্পিক কায়দায় করতে হলো! আমার মনে হচ্ছে ট্রিকসটা কাজে লেগেছে ৷ যাই, আরো একবার ঘুম দেই ৷ ছুটির দিন আজ, ঘুমালে দোষ নাই! আমার বউটা আপাতত টেনশনে থাকুক!
গল্পের বিষয়:
গল্প