মিহিন এবং শিউলি ফুল

মিহিন এবং শিউলি ফুল
“তুমি চলে যাও এখান থেকে৷ দ্রুত চলে যাও। তোমাকে আমার অসহ্য লাগছে।” মিহিন রাগ করেছে৷ এতো বেশি রাগ করেছে যে আজ তিন দিন হয়ে গেল তার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই৷ কথা নেই৷ আমি ফোন দেই সে ফোন ধরে না৷ মেসেজের রিপ্লাই দেয় না৷ কেমন অচেনা অচেনা আচরণ করে৷ এটা নতুন কিছু নয়৷ সে যখন আমার উপর প্রচণ্ডরকম রেগে থাকে তখন এমন করে। কেবল আমার সাথেই করে। কেন করে জানতে চাইলে সে বলে এটা তার অধিকার। সে আমার উপর রাগ করবে না তো কার উপর করবে? সে রাগ করে। আর অপেক্ষা করে আমি কখন রাগ ভাঙ্গাবো। তার সখ আমি নানান ভঙ্গিমায় তার রাগ ভাঙ্গাই৷ রাগ ভাঙ্গানোর প্রক্রিয়া যতো ইউনিক হবে ততো দ্রুতই সে রাগ ভাঙ্গবে৷ মিহিনের ধারণা ছিল আমি বেশ রোমান্টিক ধরনের৷ আমার গল্প গুলো পড়ে পড়ে তার এমন ধরনের ধারণা জন্ম হয়েছে৷ অথচ তার ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল।
প্রথম প্রথম আমি ভাবতাম আসলেই সব সম্ভব। যা ভাবি তা-ই করা যায়৷ অথচ বাস্তবতা ভিন্ন৷ বাস্তব মানুষ ভিন্ন। আমি গল্পে নানান উপায়ে আমার গল্পকন্যার রাগ ভাঙ্গাই৷ অথচ বাস্তবে তেমন কিছুই করতে পারি না৷ আয়োজন করতে ইচ্ছে জাগে বটে, করা হয় না৷ আমি বেশ আলসে ধরনের। আবার নিজেকে সবার সামনে তুলে ধরতে জানি না৷ অপূর্ণতায় ভরপুর একজন মানুষ। তাও কেন এই মেয়ে আমাকে এতো ভালোবাসলো তা বোঝা মুশকিল। সে রাগ করলে আমি তাকে নিয়ম করে ফোন দেই। কথা বলার চেষ্টা করি। নানান ইমোশনাল মেসেজ দেই। কিন্তু কখনই বিস্তর আয়োজন করে রাগ ভাঙ্গানো হয় না। মেয়েটার এসব নিয়ে তেমন কোনো মাথা ব্যাথা নেই৷ কোনো অভিযোগ নেই৷ আমার প্রতি অদ্ভুত টান তার। পারিপাশ্বিক কোনো কারণে সে আমাকে চায় না৷ সে আমাকে মন থেকে চায়৷ একদম মন থেকে।
সে আশ্চর্য রকম একটা মেয়ে৷ তার মতো মেয়ে আমি আর কোথাও দেখিনি। সে মায়া জানে না। তবে তার মায়াবী চেহারা দিয়ে কেমন ঘোর ধরাতে জানে৷ সে হাসলেই আমার বুকের ভেতর আশ্চর্যরকম একটা প্রশান্তি বিরাজ করে। এটা অদ্ভুত। একদমই অদ্ভুত। একটা মানুষ একটু হেসে কীভাবে বিপরীত মানুষটার মনের মাঝে প্রভাব ফেলতে পারে? আমি জানি না৷ তাকে আমার রহস্যময়ী লাগে। সে মাঝে মাঝে অনেক কিছু বলতে চায়৷ কিন্তু বলে না৷ একটু বলে থেমে যায়৷
‘মিস্টার লেখক, একটা কথা বলবো?’
‘বলো।’ সে চুপ থাকে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। বলে,
‘আমি যখন আকাশ দেখি তখন আমার একজনকে খুব পাশে পেতে ইচ্ছে হয়৷ কেন হয়?’ এই কথাটা শোনার পর আমি চিন্তায় পড়ে যাই৷ আশ্চর্য ব্যাপার! আকাশ দেখার সময় ওর কার কথা মনে পড়ে? কে সে? কে সেই সুপুরুষ? আমার ঈর্ষা হয়। আমি বলি,
‘কার কথা মনে পড়ে?’ সে হাসে। কথা বলে না। আমি আবারও বলি,
‘বলো, কার কথা মনে পড়ে?’
সে যেন চুপ করে থাকার পন করেছে। কথাই বলে না আর৷ আমি চিন্তায় অস্থির হয়ে বলি, ‘বলো না?’ সে মৃদু হেসে বলে, ‘বাসায় ফিরবো। যাবে আমার সাথে?’ আমি উঠে দাঁড়াই৷ সেও দাঁড়ায়৷ হেঁটে যায়৷ আমি বার বার জিজ্ঞেস করি, ‘বলো না কার কথা মনে পড়ে?’ তার জবাব নেই৷ যখন আমি তার কথাটা সম্পূর্ণ রূপে বুঝতে পারি তখন বেশ দেরি হয়ে যায়৷ সে তখন বাসায়৷ আমি পথে। আমি তাকে ফোন দেই,
‘তুমি যখন আকাশ দেখ তখন তুমি আমাকে তোমার পাশে চাও তাই না?’ সে অবাক হয়,
‘না তো! তোমাকে কেন চাইবো?’
‘আমি জানি। তুমি আমাকেই চাও।’
‘তুমি ভুল জানো।’
‘আমার জানার প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে আমার।’
‘তোমার বিশ্বাস আর আমার মনে কথা দুটোই ভিন্ন ব্যাপার।’
‘মোটেও ভিন্ন নয়৷ তোমার মন এবং আমার বিশ্বাস দুটি একই। আমরা দু’জনই একই। একই না?’
‘উহু। না।’
‘আমি জানি। একই।’
‘ভুল জানো তুমি।’
তাকে ঠিক বুঝা মুশকিল। যখনই মনে হয় তাকে আমি একটু বুঝেছি তখনই মনে হয় তাকে আসলে একটুও বুঝা হয়নি৷ তাকে বুঝা মুশকিল। কঠিন থেকে কঠিন৷ তাও, আমার মনে হয়, আমি তাকে কিছুটা বুঝতে পারি। নিয়ন্ত্রণ করে জানি। অথচ এই মেয়েটাকে আমি জানতামও না৷ চিনতামও না৷ আচমকা সে এলো৷ এসেই এমন ভাবে গেঁথে গেল যে এখন তাকে ছাড়া চলাটাই মুশকিল। হঠাৎই একদিন পেছন থেকে কেউ ডাক দেয়,
‘লেখক সাহেব?’
আমি লিখি৷ তবে নিজেকে লেখক বলতে ভীষণ লজ্জা লাগে৷ কারণ একজন লেখকের যে ধরনের গুণ থাকার কথা, আমার আসলে তেমন নেই৷ এজন্যে কেউ লেখক বললে লজ্জা পাই, তবে লেখক সাহেব বলে ডাকলে পেছন ফিরে তাকিয়ে ফেলি৷ এমন ভাব যেন মস্তবড় লেখক! ‘লেখক সাহেব’ ডাক শুনে আমি পেছন ফিরে তাকাই৷ তাকাতেই আমি তাকে দেখি। সর্ব প্রথম আমি তার চোখ দেখি৷ চোখের পাড়ের কাজল দেখি। এরপর চোখ নামিয়ে নেই৷ আমার বুকের ভেতর কেঁপে উঠে। আশ্চর্যরকম সুন্দর তার চোখ। তার চোখের ভেতর অদ্ভুত কিছু ছিল৷ অদ্ভুত রকম ঘোর৷ হৃদয় নাড়িয়ে দেয়ার মতো৷ আমি তার কাছে গিয়ে বলি,
‘আমাকে ডেকেছেন?’
‘জি।’
‘বলুন কেন ডেকেছেন?’
‘কেন ডেকেছি সেটা শুনলে আপনি রেগে যাবেন৷’
আমি অবাক হই৷ বলি,
‘কী বলেন! রাগবো কেন?’
‘আসলে রেগে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।’
আমি তখন চিন্তায় পড়ে যাই৷ মেয়েটা কী এমন বলবে যেটা শুনে আমি রেগে যাবো? মেয়েটা বলে উঠে,
‘আপনি আমার সাথে এক কাপ কফি খাবেন? আপনাকে কিছু কথা বলবো আমি৷ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা।’
আমি হাসলাম। ভাবলাম কফির সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা শুনেই যাই৷ আমি বেকার মানুষ! সারাদিন হেঁটেহেঁটে কাটিয়ে দেই। এরচে ভালো কিছু সময় কারো গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা শোনা যাক। সেই শুনতে যাওয়াটাই কাল হয়েছে। একবার এক সাথে কফি খাওয়া মানে দ্বিতীয়বার দেখা হলে কফি অফার করাটা সহজ করে দেয়া। মিহিনের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে৷ যদিও প্রথম দিন সাক্ষাৎকারের পর আমি খুব করে চেয়েছি তাকে এড়িয়ে যেতে। কিন্তু তা আসলে পেরে উঠা যায়নি। এমন চমৎকার একটা মেয়েকে কীভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায়? এড়িয়ে যাওয়ার কারণটা বলা যাক। কফি শপে ঢুকলাম কফি খেতে। মেয়েটা কফি অর্ডার করে চুপচাপ বসে থাকে। আমি বলি,
‘কই? কী বলবেন বলুন।’ মেয়েটা হাসে। অমায়িক হাসি। বলে,
‘অল্প কিছু কথা৷ কফিটা শেষ করার পর সেটা বলবো।’
‘তা কেন? এখন বললে কী প্রব্লেম?’
‘প্রব্লেম আছে বলেই বলছি না৷ বললে দেখা যাবে আপনি কফি না খেয়ে চলে যাবেন। আমি তা চাই না।’ আমি কী বলবো ভেবে পেলাম না৷ বড় আশ্চর্যরকম মেয়ে! একে বোঝা মুশকিল। কফি এলে সে বলে, ‘অর্না আপুকে চিনেন?’ ‘কোন অর্না?’  ‘আপনার স্টুডেন্টের বোন।’ ‘ও হ্যাঁ৷ মনে পড়েছে। রোহানের বড় আপু৷ আপনি তাকে কী করে চিনেন?’ ‘তিনি আমার চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী।’ ‘বাহ! বেশ তো!’ মেয়েটা হাসলো এবং কফিতে চুমুক দিলো। আমি সেটা দেখলাম এবং মাথা নিচু করে নিলাম। এই মেয়ের দিকে সরাসরি তাকানোই মুশকিল হয়ে গেল! সে যা-ই করছে সব কিছুই যেন আমাকে মুগ্ধ করছে৷ কফিতে চুমুক দেওয়ার দৃশ্যে ভালো লাগার মতো কিছু নেই৷ অথচ আমার সেটাও ভালো লেগে গেল! কেবল ভালো না৷ মারাত্মক রকমের ভালো৷ মেয়েটি নিচু স্বরে বলল,
‘উনাদের বিয়েতেই আমি আপনাকে প্রথম দেখি।’ আমি যারপরনাই নাই অবাক হই। বলি,
‘তার মানে আপনি আমাকে আগ থেকেই চিনতেন?’
‘জি।’
আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না। চুপ করে থাকলাম। মেয়েটা আবার বলল, ‘সেদিন থেকেই আমি আপনার ব্যাপারে খোঁজ চালাই।’ আমি হঠাৎ থমকে যাই৷ ভ্রু কুচকে তাকাই। অবাক হই৷ আমার খোঁজ কেন করবে সে? আমি বলি, ‘কেন?’ সে মুচকি হাসে। বলে, ‘কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা হলে রিয়েল টেস্টটা পাবেন না৷ খেয়ে নিন।’ আমি চুপচাপ কফি খাই৷ কোনো কথা বলি না। মাথার ভেতর এই মেয়েকে নিয়ে নানান চিন্তা ঘুরে৷ নানান চিন্তা। কফি খাওয়া শেষে মেয়েটা বিলটা পে করে দেয়৷ আমিই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে দিতে দিলো না৷ সব শেষে মেয়েটা একটা কথা বলে। মুখটা আমার দিকে বাড়িয়ে মৃদু স্বরে বলে, ‘সেদিন বিয়েতে আপনাকে দেখার পর আমার সমস্ত পৃথিবী পাল্টে গিয়েছিল। আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। আপনাকে দেখে আমার মনে হয়েছে আমি আপনাকেই এতোদিন খুঁজছি৷
আপনাকেই খুঁজছি। শোনেন মিস্টার, সেদিন প্রথম দেখায় আপনাকে আমার ভালো লেগে গিয়েছিলো৷ এমন ভাবে ভালো লেগেছে যে আজ তিন মাস ঘনিয়েছে, আপনি আমার মন ও মস্তিষ্ক থেকে এক মূহুর্তের জন্যে বিরতি নেননি৷ খুব অন্যায় করেছেন। আপনাকে শাস্তি পেতে হবে। শাস্তি পাওয়ার জন্যে আমাদের দ্বিতীয় সাক্ষাৎকারের অপেক্ষা করুন৷’ এতটুকু বলার পর সে আরেকটু নিচু স্বরে বলে, ‘আপনি অদ্ভুত, অনিন্দ্য এবং আকর্ষণীয়। আমার আপনাকে চাই৷ সারাজীবনের জন্যে চাই৷’ আমি রোবটের মতো বসে থাকি। স্তম্ভিত হয়ে তার কথা গুলো শুনি কেবল। আমি কী বলব ভেবে পাই না৷ নিশ্চুপ থাকি। সে উঠে দাঁড়ায়। তারপর ধীরে ধীরে হেঁটে যায়। তার হিলের ঠক ঠক শব্দ কেবল আমার কানে বাজে। আর কোনো শব্দই যেন আমি শুনি না। কোনো শব্দই না।
মিহিন আমাকে চেয়েছে৷ এমন ভাবে চেয়েছে যে আমি তাকে ফিরিয়ে দিতে পারিনি৷ আমার দ্বারা সম্ভব হয়নি আসলে। প্রথম প্রথম এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শেষমেশ আমার দ্বারা তাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। মিহিন এমন একটি মেয়ে যাকে আসলে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না। মহা অসম্ভব। মিহিন রাগ করেছে। রাগ করে তিন দিন কথা বলেনি৷ আমার চিন্তার শেষ নেই৷ কাছের মানুষটা হঠাৎ এমন করলে খারাপ লাগে৷ ভীষণ খারাপ লাগে৷ অস্থির-হাসফাস লাগে। আমি পাগলে মতো হয়ে যাই৷ তার সাথে একটু কথা বলার জন্যে মন কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠে। কেমন দিশেহারা হয়ে যায়৷ তার রাগ করাটা অযৌক্তিক না৷ অযৌক্তিক কোনো কারণে মিহিন রাগ করে না৷ তার এই স্বভাবটা আমার বেশ লাগে। রোহানকে যখন পড়াতে যাই, তখন একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হয় আমার। সে রোহানদের অপজিট বিল্ডিংয়ে থাকে। নাম চিত্রা। চিত্রা মেয়েটি বেশ চঞ্চল প্রকৃতির।
এ জন্যে তাকে আমার বিশেষ পছন্দ না। চাঞ্চল্যতার একটা সীমা থাকে। কিন্তু চিত্রার সে সীমা নেই। আচমকা একদিন মেয়েটি আমায় প্রপোজ করে বসলো। আমার জীবনের দ্বিতীয় এবং শেষ প্রপোজ। আমি একদম বোকা বনে যাই। ইন্টার পড়া মেয়েটি কীভাবে আমাকে প্রপোজ করতে পারে তা ভেবে আমার মাথা ভার হয়৷ আমি অবাক হই৷ তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিদায় করে দেই৷ টিউশনিতে এসে এভাবে কোনো মেয়ের সাথে দেখা করা কিংবা কথা বলা লজ্জাজনক এবং মানসম্মান হানিকারক। আশপাশের লোকজন নানান ভ্রান্ত চিন্তা নিয়ে তাকায়৷ এসব আমার জন্যে বিরক্তিকর। গা গুলিয়ে আসা টাইপ। আমি তাকে স্পষ্টই নিষেধ করি সে যেন এভাবে আর না আসে৷ কিন্তু কে শুনে কার কথা৷ আমি যখন রোহানদের বাসা থেকে বের হই সে তখন তাদের বাসার গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে৷ আমাকে বের হতে দেখলেই বলে, ‘স্যার, কেমন আছেন?’ কী যে অপ্রস্তুতকর মোমেন্ট বলার মতো না৷ লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে যায়৷ আমি তার দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফিরে আসি৷
চিত্রা মেয়েটিকে কোনো কিছুই ধরে না৷ আমি নানান ভাবে কৌশল করেও তাকে ফেরাতে পারিনি৷ শেষমেশ আমাকে টিউশনিটা ছাড়তে হয়। ছাড়ার আগে আমি চিত্রাকে বেশ কিছু কঠিন কথা বলি। তাকে রাগ দেখাই। সে বড় নির্লিপ্ত এবং ভাবলেশহীন ভাবে আমার কথা গুলো শুনে৷ আমি তাকে আমার সম্পর্কের কথা বলি। মিহিন নামক একটি রাজকন্যার গল্প শোনাই। তার সবই চিত্রার কাছে মিথ্যা লাগে৷ তার মনে হয় আমি তাকে পিছু ছাড়ানোর জন্যে এসব বলছি। একটা সময় আমার কিছুই করার থাকে না৷ আমি লেজ গুটিয়ে পালিয়ে আসি৷ ওই এলাকায় যাওয়াটা বন্ধ করে দেই৷ এসবের কিছুই মিহিন জানতো না৷ আমিই তাকে জানাইনি। খামখা ভেজাল বাড়াতে চাইনি৷ মিহিন জানলে হুলুস্থুল কান্ড বেধে যাবে৷ একটা ঘটনা বলি৷ তাহলে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে৷ এই ধরনের ঘটনা আসলে প্রেমিক প্রেমিকাদের ক্ষেত্রে হারহামেশাই ঘটে। তাই সবার কাছে নতুন কিংবা ভালো না’ও লাগতে পারে।
রেস্টুরেন্টে বসেছিলাম সেদিন৷ আমাদের প্রথম মিট হওয়া রেস্টুরেন্টটায়৷ আমরা সামান্য নাস্তা করছিলাম তখন। হঠাৎ আমার দৃষ্টি মিহিনের পেছনে যায়৷ পেছন থেকে একটা মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ কেবল তাকিয়েই আছে৷ আমি ভাবলাম সে হয়তো আমাকে দেখছে না৷ আমার পেছনের কাউকে দেখছে। আমি দৃষ্টি নামিয়ে নেই। মেয়েটাও তাই করে৷ কিছু সময় পর সেইম ব্যাপারটা আবার ঘটে৷ মেয়েটা আবার আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি এবার অস্বস্তিতে পড়ে যাই৷ আমার মনে হয় মেয়েটা আমাকেই দেখছে৷ আমি মাথা নিচু করি। মিহিনের সাথে কথা বলি। হাসি। তবে মনের কোনো কেমন অস্বস্তিবোধটা থেকেই যায়৷ মিহিন ব্যাপারটা কীভাবে যেন বুঝে যায়৷ হঠাৎ সে পেছন ফিরে তাকায়৷ মেয়েটার সাথে চোখাচোখি মেয়ে৷ মেয়েটা দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয়৷ মিহিন প্রথমে কিছু বলেনি৷ কিছু সময় গেলে সে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
‘মেয়েটা তোমায় দেখছিল?’ আমি ভান করি,
‘কোন মেয়ে?’
‘ঢং করো না। বলো দেখছিল কি না?’
‘শান্ত হও। তেমন কিছু না। এমনিই তাকিয়েছে হয়তো!’ মিহিন মিনমিন করে বলে,
‘এমনি এমনি তাকাবে কেন? ও তোমার দিকে তাকাবে কেন?’
আমি চুপ করে থাকি৷ ঘটনা এখান পর্যন্ত স্বাভাবিকই ছিল। অস্বাভাবিক হয়ে যায় তখন, যখন মেয়েটি দ্বিতীয়বার ধরা খায় মিহিনের চোখে। আমি মনে মনে বলি,
‘যাক, কাজ সেরেছে।’
মিহিন দ্রুত উঠে যায়৷ মেয়েটার কাছে গিয়ে কি জানি জিজ্ঞেস করে। এরপর মেয়েটার কানের কাছে মুখ নিয়ে কি জানি বলে। যা শুনে মেয়েটা রেগে যায়৷ আর দুটো মেয়ে এক সাথে রেগে গেল কী হয় সেটা হয়তো সকলেরই কম-বেশি জানা আছে৷ তা আর বললাম না৷ তবে সেদিন মিহিনকে থামাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে আমার৷ এই ধরনের সিনক্রিয়েট আবার যাতে না হয় সে জন্যেই আমি ব্যাপারটা মিহিনকে জানাইনি। জানালে যে কী হতো তা আল্লাহই ভালো জানেন।
দু’দিন সব কিছু ঠিক মতোই ছিল। চিত্রার ব্যাপার চাপা পড়েছে ভেবে মনের মাঝে মৃদুমন্দ আনন্দের ঢেউ বইছিলো। সেই ঢেউ তৃতীয় দিন আর বইলো না৷ চিত্রা মেয়েটা আমার বাসা পর্যন্ত চলে এলো। বারান্দার কাছে যেতেই দেখি সে তার বান্ধুবিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ কী অবাক করা ব্যাপার! এই মেয়েটির মাঝে কি ডর-ভয় নেই? একটু লাজলজ্জাও নেই? বয়সের দোষটা কি এতো তীব্রভাবে ঝেঁকে বসে? আমি চিন্তায় পড়ে যাই৷ বাবা মা জানলে ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাবে। তাছাড়া এলাকার মানুষ কী বলবে? চরিত্রে আমার দাগ নেই৷ আশপাশের প্রত্যেকেই আমাকে আদর-স্নেহ করেন। তারা কী ভাববেন? চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠি আমি। অনেক ভেবে আমি তার সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেই৷ আমি তাকে রেস্টুরেন্টে ডেকে পাঠাই৷ দু’জনে সামনাসামনি বসি।
‘চিত্রা, তোমার সমস্যা কী?’
‘আমার কোনো সমস্যা নেই।’
‘তাহলে এমন করছো কেন?’
‘আপনিই বলেন আমি কি খারাপ কিছু করছি?’
‘কারো বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকাকে তুমি ভালো বলছো? কিংবা একজন এঙ্গেজড ছেলেকে বিরক্ত করাকে তুমি ভালো বলছো?’
‘ভালোবাসা প্রকাশ কি কোনো অপরাধ?’
‘তা নয়৷ তবে সব কিছুরই একটা সীমা থাকে।’
‘আমি সীমা টিমা মানি না। আমার আপনাকে ভালো লেগেছে৷ আপনাকেই আমার চাই।’
‘ভালো লাগা আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য বুঝো তুমি?’
‘সব বুঝি। আপনাকে যখন আমার ভালো লেগেছে তখন ভালোবাসা আপনা আপনিই চলে আসবে।’
‘তুমি বুঝতে পারছো না চিত্রা৷ এসব কিছুই তোমার না৷ এসব জাস্ট এট্রাকশন। নাথিং মোর।’
‘আমি কিচ্ছু বুঝতে চাই না৷ আমি স্পষ্টই বলছি, আমার আপনাকে চাই৷ ব্যস!’
ঠিক ওই সময়টায় মিহিনের কল আসে৷ আমি কল ধরি না৷ ফোনটা টেবিলের উপর রাখি৷ চিত্রাকে বোঝানোর চেষ্টা করি। মিহিনের ফোন আসে আবার। আবার আসে৷ আমি ধরি না৷ চিত্রা বিরক্ত হয়৷ সে খপ করে টেবিল থেকে ফোনটা তুলে নেয়৷ রিসিভ করে বলে,
‘কী সমস্যা আপনার? এতো ফোন দেন কেন? দেখছে সে ফোন ধরছে না৷ তাও ফোন কেন দিচ্ছেন?’
আকস্মিক তার এমন আচরণে আমি একদম বোকা বনে যাই৷ হতভম্ব হয়ে চিত্রার দিকে তাকিয়ে থাকি৷ উঠে দাঁড়িয়ে ওর হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নেই৷ ঠিক সে সময়ে কোত্থেকে জানি মিহিন আমার সামনে চলে আসে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসে৷ তার হাসির মানে আমি বেশ বুঝি৷ সে বলে, ‘এখানে না এলে এই দৃশ্য দেখতেই পেতাম না৷ দৃশ্যটা বেশ চমৎকার। এই মেয়েটি কে? কী করছো ওর সাথে? ও তোমার ফোন নিয়ে আমার কল রিসিভ করে আমাকে ঝাড়ি মারে কীভাবে? তাকে এতো বড় স্পর্ধা দিলো কে?’ চিত্রা দাঁড়িয়ে যায়। বলে, ‘আপনি মিহিন?’ মিহিন কষে একটা চড় মারে চিত্রার গালে। চিত্রা স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। আমি আর অপেক্ষা করি না৷ সিরিয়াস কোনো সিনক্রিয়েট করার আগে আমি মিহিনকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে আসি। ও আসতে চায় না৷ আমি তাকে জোর করে টেনে আনি৷
‘হাত ছাড়ো। ব্যাথা লাগছে।’
আমি তার হাত ছেড়ে দেই৷ আবার চট করে ধরে কাছে আনি। হাতটায় চাপ পড়েছে অনেক৷ মেয়েটি ব্যাথা পেয়েছে। আমি তার হাতটায় চুমু খেতে চাই৷ সে হাত সরিয়ে নেয়৷ কষে একটা চড় মারে আমার গালে। আমি গালে হাত দিয়ে
‘সরি’ বলি। সে বলে,
‘তোর সরি তোর কাছেই থাক। আমাকে বলার দরকার নেই৷’ আমার তখন গাল জ্বলছিল। আমি গালে হাত রেখে বলি,
‘প্লীজ একটু শুনো।’
‘তোর কোনো কথা শুনতে চাই না আমি।’ কথাটা বলে মিহিন এগিয়ে যায়৷ আমি তার পেছন পেছন যাই৷ বলি,
‘প্লীজ মিহিন। একটু শুনো।’ মিহিন কঠিন স্বরে বলে,
‘খবরদার পিছু পিছু আসবি না বলে দিলাম।’
‘মিহিন, তুমি তো আমাকে বুঝো৷ খুব বুঝো। তাহলে আজ কেন বুঝছো না৷’
‘আমি তোকে কোনো কালেই বুঝিনি। আর একবার আমার নাম ধরে ডাকলে লোক ডেকে জড়ো করবো বলে দিলাম।’
মিহিন চলে যায়৷ আমি গালে হাত দিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকি৷ অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকি৷ আমার সেখান থেকে নড়তে ইচ্ছে হয় না৷ আজীবন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়৷ আমি বেশ কিছু সময় ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকি। তারপর বাসায় চলে আসি৷ আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না কিছুই৷ সব কিছু দ্রুতই ঘটে যায়৷ এতো দ্রুত যে আমি ঠিক সব কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। আমার বারবার মনে হচ্ছে আমি মিহিনকে হারিয়ে ফেলেছি। আসলেই কি হারিয়ে ফেলেছি?
আমার জীবনে মিহিন এমন একটি অধ্যায় যে অধ্যায় হারিয়ে গেলেও সেটা হারিয়ে যাবে না৷ স্মৃতির একটা বৃহৎ অংশ হয়ে আজীবন থেকে যাবে৷ আমি চাইলেই সে স্মৃতি ভুলতে পারবো না৷ কোনো ভাবেই তাকে আমার মন থেকে মুছে ফেলা সম্ভব না৷ কোনো ভাবেই না৷ কাউকে আসলে এতো তীব্র ভাবে ভালোবেসে ফেলা ঠিক না৷ ভালোবাসাটা যতো গভীর হয়, প্রতিদানে ব্যাথাটাও ততোটা গভীর হয়৷ ক্ষতটাও অনেকটা জুড়ে হয়৷ শূন্যতার অনুভূতিটাও ততো গাঢ় হয়। যা সয়ে যাওয়া মুশকিল। মহা মুশকিল।
সেদিন যখন বাসায় আসি, অনেকটা সময় ভীষণ ঘোরে সময় কাটে আমার। গালে পাঁচ আঙ্গুলের একটা ছাপ এঁকে যায়৷ আম্মা সেটা দেখে ভীষণ রেগে যান৷ আমাকে অনেকক্ষন বকেন৷ এরপর তিনি কীভাবে যেন বুঝে যান এটা মিহিনের প্রতিদান৷ কারণ তিনি জানতেন মিহিনকে। সারাটা সময় তিনি মিহিনকে বকে গেলেন৷ যেন সামনে পেলে আস্ত গিলে খেতো মেয়েটাকে৷ মেয়ে জাতিটাই আসলে রহস্যময়ী৷ বয়স বাড়ে বটে এদের রহস্যের ধার কমে না৷
তিনটা দিন আমি তাকে কতো গুলো মেসেজ করলাম, কল দিলাম, তার অন্ত নেই। আমি বারবার তাকে বোঝাতে চেয়েছি, আমি ভালো নেই৷ একদমই ভালো নেই। অথচ সে আমার কথা শুনেনি৷ সে বুঝতেই চায়নি আমাকে৷ সময়টা আমার কেমন কঠিন হয়ে যেতে থাকলো। মস্তিষ্ক একটু ফাঁকা সময় পেলেই এই মেয়েটাকে নিয়ে ভাবনা শুরু করে৷ ভাবনাটা এতো তীব্র হয় যে আমার মনে হয় আমার পাশেই মিহিন বসে আছে৷ আমি তাকে দেখছে৷ খুব কাছ থেকে দেখছি৷ ছুঁয়ে দিচ্ছি৷ অথচ ঘোর ভাঙ্গলেই চারদিক অন্ধকার আর বিষাদে ভরপুর। কোথাও মিহিন নেই। কোথাও নেই৷
এক রাত আমি নির্ঘুম কাটাই৷ চোখ বুঁজলেই মনে হয় মিহিন এসেছে৷ আমি আবার দ্রুত চোখ খুলি৷ চোখ খুললেই অন্ধকার দেখি৷ বুকের ভেতর কেমন জানি একটা ব্যাথা হয়৷ অসহ্যকর রকম যন্ত্রণা। বোঝানো মুশকিল৷
হাসফাস এবং দমবন্ধকর অবস্থা যখন আমাকে গ্রাস করে নিচ্ছিল তখন আমি সিদ্ধান্ত নেই আমি মিহিনদের বাসায় যাবো৷ এছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পাইনি৷ ভোরের আলো ফোটার আগেই আমি বাসা থেকে বের হই৷ বাবা মা তখনও ঘুমোচ্ছেন৷ গেট খুলে বেরিয়ে আসি রাস্তায়৷ বাইরে ভীষণ কুয়াশা। সামনের দিকটা কেমন ঘোলাটে লাগে৷ আমি জ্যাকেটের হুডি উঠিয়ে দেই৷ তারপর দ্রুত পাঁয়ে হেঁটে যাই৷
আমি যখন মিহিনদের বাসার কাছে পৌঁছালাম তখন ভোরের আলো ফুটে গিয়েছে। ভোরের পাখি কাকের হাঁক আমি স্পষ্ট শুনি৷ মিহিনদের বাসার পেছনে জায়গাটা ভীষণ সুন্দর। সেখানে একটি শিউলি গাছ আছে। শিউলি গাছটার ঠিক নিচে একটা বেঞ্চি আছে। সাদা রঙের বেঞ্চি। আমি কখনই এই জায়গাটা দেখিনি৷ সেটা সুন্দর বলেছি কারণ জায়গাটা ‘ভীষণ সুন্দর’ এমনটা মিহিন বলেছে। ছবি পাঠিয়েছে। তাতে আমি তেষ্ট ছিলাম। কিন্তু আজ জায়গাটা কাছ থেকে দেখে আমার মনে হলো এতোদিন কেন এখানে আসিনি। কেন এই বেঞ্চিটাতে কিছু সময় বসিনি৷ কী সুন্দর মায়াময় একটি জায়গা। গাছে নবফুটন্ত শিউলি। সেই শিউলি ঝরে পড়ে কুয়াশায় ভেজা সবুজ ঘাসের গায়ে৷ কিছু ফুল বেঞ্চিটা স্পর্শ করে পড়ে যায়৷ কিছু ফুল বেঞ্চিতে একরাস মুগ্ধতা নিয়ে বসে থাকে৷ আমি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে শিউলি গাছ দেখি৷ শিউলির ঝরা দেখি। সদ্য ফুটন্ত ভোরে ঝরে যাওয়া শিউলি কী অনিন্দ্য এক সৌন্দর্যতা সৃষ্টি করেছে তা বলার মতো না।
আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি৷ ভোরে কুয়াশায় এই শিউলি আমাকে অদ্ভুত আনন্দ দেয়৷ আমার মন ভালো হয়৷ আমি বুঝতে পারি, মিহিনের মন খারাপ থাকলে সে কেন এখানে এসে বসে থাকে৷ কীভাবে এই জায়গাটা মেয়েটির মন প্রশান্তি জাগায়। আমি জানি মিহিনের মন খারাপ। তার মন খারাপ থাকলে সে শিউলি তলায় আসে৷ এই বেঞ্চিটায় বসে থাকে৷ আমার ধারণা সে আজও আসবে৷ আসতে বাধ্য৷ আমি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকি। অপেক্ষা করি৷ এমন সময়, হঠাৎই আমি অনুভব করি, আমার বুকের ভেতর কাঁপছে৷ ধপ ধপ শব্দের মাত্রাটা বেড়ে যাচ্ছে। মিহিনের সাথে দেখা হওয়ার পূর্বে ঠিক এমনটা হয়৷ কেন হয় কে জানে!
আমি ভালো করে সামনের দিকে তাকাই৷ কুয়াশায় তেমন কিছু দেখা যায় না৷ ঘোলাটে ঘোলাটে লাগে৷ আমি ভালো করে দেখি৷ দূরে কার যেন অবয়ব দেখা যায়৷ সাদা সেলোয়ার-কামিজ পরা কেউ একজন ধীর পাঁয়ে এগিয়ে আসে৷ আমার বুকের ভেতর কাঁপন বাড়ে ভীষণ৷ মেয়েটি আরেকটু কাছে আসে৷ ক্রমশ সে স্পষ্ট হয়৷ সাদা জামা পরিহিতা মেয়েটির গলার কাছে ওরেঞ্জ কালারের ওড়না দেখি আমি। যেন জীবন্ত শিউলি ফুল। চোখে যার গাঢ় কাজল। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। খালি পাঁয়ে ভেজা ঘাস মাড়িয়ে মেয়েটা এগিয়ে আসছে। যেন জগতের সকল সৌন্দর্যতাকে নিজের সাথে করে নিয়ে আসছে সে। তার ফর্সা পা’টি কী কোমল ভাবে ঘাস মাড়িয়ে আসছে৷ ঘাসেরাও যেন ধন্য বোধ করে।
আচ্ছা, মেয়েটি কি জানতো আজ আমি আসবো? জানতো? না জানলে সে এতো সাজবে কেন? কেন চোখে কাজল কিংবা ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে আসবে? আমার অবাক হওয়ার সীমা থাকে না৷
মিহিন বেঞ্চিতে এসে বসে। কিছু শিউলি কুড়িয়ে হাতে নেয়৷ কপালের কাছের অবাধ্য চুল গুলো কানের পাশে গুঁজে দেয়। কানের পাশে সে একটা শিউলি রাখে। পৃথিবীর সকল মায়া একত্র করে সেই ছোট্ট শিউলিটি মিহিনের কানের পাশে বসে থাকে। তাকে অদ্ভুত মায়াবী লাগে। আমার মনে হয় কুয়াশাচ্ছন্ন এই ভোরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী রমনী একটি সাদা বেঞ্চ আলোকিত করে বসে আছে৷ এই দৃশ্য কতোটা অসাধারণ সেটা কেউ সামনাসামনি না দেখলে বুঝবে না৷ হঠাৎ এক ঝাক হিমশীতল বাতাস এসে আমাকে ছুঁয়ে যায়৷ সমস্ত শরীরে অদ্ভুত এক শিতল শিহরণ বিরাজ করে৷ আমি ভালো করে মিহিনকে দেখি। তার চেহারায় কিছু একটা নেই৷ কিছু একটাকে আমি ভীষণ মিস করি৷ তার চেহারা ফ্যাকাসে। চোখ ভর্তি কেমন বেদনা। সে যেন পৃথিবীর সেরা দুঃখি প্রেমিকা। আমি ধীর পাঁয়ে এগিয়ে যাই। আমার হার্টবিট তখন বেশ বেড়ে যায়৷ কেমন যেন লাগতে থাকে আমার৷ আমি এগিয়ে যাই৷ হঠাৎ মিহিন লক্ষ্য করে আমায়৷ আমি ভাবলাম আমায় দেখে সে প্রসন্ন বোধ করবে৷ অথচ সে চেহারা কালো করে ভ্রু কুচকে তাকায়। আমি হঠাৎ থমকে যাই। এই মিহিনকে যেন আমি একদমই চিনি না৷ ভীষণ অচেনা লাগে। সে ভ্রু কুচকে বলে,
‘তুমি? তুমি এখানে কী করছো?’ আমি আরেকটু এগিয়ে যাই৷ বলি,
‘মিহিন, তোমার সাথে কথা আছে আমার।’
‘তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই৷ ভালো হয় তুমি এখান থেকে চলে যাও।’
‘প্লীজ মিহিন৷ এমনটা বলো না৷ এতোটা পথ হেঁটে এসেছি, অন্তত এমন কোনো কথা শুনতে নয়।’
‘তাহলে কেমন কথা তুমি শুনতে চাও বলো? কীভাবে বললে তুমি এখান থেকে চলে যাবে?’
‘প্লীজ! ডোন্ট হার্ট মি মোর।’
‘হার্ট! হার্টের কি বোঝো তুমি?’
‘মিহিন, আমাকে অন্তত কিছুটা সময় দাও প্লীজ৷ আমি তোমাকে সবটা বলবো।’
‘সবটা বলা লাগবে না৷ তুমি চলে যাও এখান থেকে৷ দ্রুত চলে যাও। তোমাকে আমার অসহ্য লাগছে।’
‘অসহ্য লাগুক, আর যা-ই লাগুক, আমি তোমাকে বলেই যাবো।’
‘দেখো, সিনক্রিয়েট করো না৷ আমাকে একা থাকতে দাও।’
‘একা থাকতে দিলে তুমি ভালো থাকবে?’
‘অবশ্যই থাকবো। অন্তত আঘাত দেওয়ার মতো কেউ থাকবে না।’ ‘আমি তোমাকে আঘাত দেইনি মিহিন।’ ‘যেটা করেছো সেটা আসলেই আঘাত ছিল না৷ তুমি আমায় আঘাত করোনি। স্পষ্ট খুন করেছো।’ আমি তার দিকে এগিয়ে যাই। বলি, ‘আমি তোমাকে ভালো রাখতে চেয়েছি।’ ‘তার নমুনা আমি বেশ পেয়েছি।’ ‘বোঝার চেষ্টা করো মিহিন। চিত্রার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’ ‘ওই কু**বাচ্চার নাম নিবি না তুই।’ মিহিন চেহারা লাল করে আমার দিকে তাকায়৷ হঠাৎ তার এমন রেগে যাওয়ায় আতঙ্কিত হই আমি৷ আমি বেঞ্চিতে বসি৷ সে দ্রুত বলে, ‘উঠ! উঠে যা এখান থেকে। তা না হলে চিল্লাবো আমি।’ আমি সেখানে বসে থাকি৷ মিহিনের দিকে তাকিয়ে থাকি কেবল। তার চেহারা কেমন লালচে হয়ে উঠে। হঠাৎ তাকে কেমন মায়াবী লাগে আমার কাছে৷ ওই মূহুর্তে আমি যেন দ্বিতীয়বার আমার রাজকন্যার মায়ায় পড়ি। প্রেমে পড়ি। আমি বলি,
‘মিহিন, শান্ত হও। আমি চলে যাবো।’
‘বেশ তো! যাও। দ্রুত যাও।’
‘পাঁচ মিনিট৷ জাস্ট পাঁচ মিনিট দাঁতে দাঁত চেপে আমার কথা গুলো শোনো। পাঁচ মিনিটের পর এক সেকেন্ডের জন্যে তুমি আমাকে এখানে পাবা না৷ কথা দিলাম।’ মিহিন হঠাৎ শান্ত হয়৷ আমার থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে বসে। বলে, ‘বলো।’ আমি মৃদু হাসি৷ হঠাৎই আমার মনটা কেমন ফুরফুরে হয়ে যায়৷ ওই মূহুর্ত, মিহিনের ওই রাগান্বিত চেহারা আমায় কেমন আনন্দিত করে। আমি বলি, ‘তোমাকে এই অবস্থায় অসাধারণ লাগছে মিহিন। অসাধারণ লাগছে।’ মিহিন ভ্রু কুচকে কিছু বলতে চায়। আমি তাকে থামিয়ে বলি, ‘তোমাকে কিছু বলতে হবে না৷ আমি জানি আমার সময় পাঁচ মিনিট। এই সময়টা কেবল আমার। তাই আমি যা বলবো তুমি তা’ই শুনবে৷’ মিহিন চুপচাপ থাকে। আমি আবারও বলি,
‘পাঁচ মিনিট অনেক সময়৷ ৩০০ সেকেন্ড। ৩০০ সেকেন্ডে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে।’ মিহিন কেমন জানি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়৷ তার দৃষ্টি কেমন শূন্য শূন্য লাগে।আমি বলি, ‘তুমি জানতে আমি আসবো৷ অবশ্যই জানতে। সে জন্যেই তুমি এমন সেজেছো। সাদ-ওরেঞ্জ মিলিয়ে তুমি জীবন্ত একটা শিউলি হয়ে এখানে এসেছো৷ তোমাকে আমি একবার একটা ভোরের গল্প বলেছিলাম। সেই গল্প ভোর থাকবে, ভোরের শিউলি থাকবে, শিউলির মতো করে তুমি সাজবে। আমি তোমাকে দেখে মুগ্ধ হবো। তুমি আমার চাওয়া পূর্ণ করেছো। সত্যিই মিহিন, তুমি আমায় ভালোবাসো না, আমাকে নিয়ে ভাবো না৷ তাও আমার জন্যে কতো করলে!’ মিহিন কেমন করে যেন তাকায়৷ তার দৃষ্টি সরল হয় ক্রমশ। সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি মৃদু হাসি। বলি, ‘এই যে চমৎকার একটা ভোর উপহার দিলে, কুয়াশা, শিউলি, তুমি, হিমশীতল বাতাস এসব আমার জন্যে কম কিছু না৷ অনেক অনেক।’
মিহিন একবার চোখ নামিয়ে নেয়৷ আবার মাথা তুলে তাকায়৷ আমি বলি, ‘চিত্রা আমার কেউ না৷ সে অচেনা। আমার ভাবনার বাহিরে৷ মিহিন আমার কাছের, জানা কেউ। যার অবর্তমান আমাকে ভীষণ ভোগায়। যে আমাকে খুব বোঝে৷ জানে। ভালোবাসে৷ অথচ আমি যেই মিহিনটাকে জানি, তুমি সেই মিহিন নও। তুমি অন্য রকম মিহিন। তোমাকে আমার চাই না। পাঁচ মিনিট ঘনিয়ে এসেছে। মিহিন, আমি চাই তুমি বাকি সময়টা চোখ বন্ধ করে রাখো৷ এতোক্ষন আমি যা বলেছি তা একটু ভাবো। অবশ্য সেটা করা না করা একান্তই তোমার ব্যাপার।’ আমি চুপচাপ মিহিনের পাশে বসে থাকি। পাঁচ মিনিট শেষ হওয়ার অপেক্ষা করি৷ মিহিন আমার দিকে তাকিয়ে থাকে৷ তার চেহারা মলিন হয়ে আসে৷ চেহারার কাঠিন্যতা যেন কুয়াশায় মিলিয়ে যায়৷ সে চট করেই বলে উঠে, ‘আমারও পাঁচ মিনিট চাই। আমি চাই আমি যা বলবো তুমি সবটা মন দিয়ে শুনবে। যা বলবো তুমি তা করবে৷’ আমি কিছু বলি না। মিহিনের দিকে তাকিয়ে থাকি কেবল। মিহিন বলে, ‘শোনো, আমার একজন গুপ্তচর আছে। যে লেখক সাহেবের নানান তথ্য আমাকে দেয়৷ এটা খুবই অন্যায়৷ লেখকের জন্যে গুপ্তচর রাখাটা৷ তবে আগ থেকেই নিরাপদ থাকাটা বিশেষ প্রয়োজন৷ আমি আমার মানুষটাকে আগলে রাখতে চাই৷ সে জন্যেই এই গুপ্তচর রাখা।’
আমি ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকাই। কিছু বলি না৷ সে বলে, ‘গুপ্তচর আমাকে মাঝে মাঝে খবর পাঠায়৷ লেখক কী করছে না করছে এসব৷ একদিন খবর আসে, লেখক একটা মেয়ের সাথে বেশ ঝগড়া করেছে৷ কিছু কঠিন কথা বলেছে৷ এমন তথ্য পেয়ে আমি হাসি। আমার লেখক ঝগড়া করতেও জানে!’ মিহিন মৃদু হাসে। বলে, ‘যখন জানতে পারি চিত্রা মেয়েটি আমার মানুষটাকে প্রপোজ করেছে, তাকে বেশ জ্বলাচ্ছে, তখন আমি আসলেই রেগে যাই৷ এখানে যে কোনো মেয়ে-ই রেগে যাবে৷ সেটা নিতান্তই স্বাভাবিক।’ ‘আমার খুব মন খারাপ হয়। লেখক আমাকে অন্তত চিত্রার ব্যাপারটা বলতো৷ আমি তাকে বোঝাতাম মিহিন কি জিনিস৷ অথচ সে আমাকে বলেনি। এতো বড় ব্যাপারটা আমার কাছে গোপন রেখেছে। আমার মন খারাপ হয়৷ কান্না পায়৷ আশ্চর্য! মানুষটা কীভাবে না বলে থাকতে পারলো?’
মিহিন থামে। তার চেহারা মলিন হয়ে আসে৷ আমি মনে মনে হাসি। বলি, ‘পাঁচ মিনিট প্রায় শেষ!’ মিহিন হঠাৎ রেগে যায়৷ কঠিন দৃষ্টি আমার দিকে তাকায়৷ তীক্ষ্ণ স্বরে বলে, ‘এতো তাড়া কিসের তোমার হু? চিত্রার কাছে যাবা তাই না? পাঁ ভেঙ্গে ফেলবো একদম। পাঁচ মিনিট কেন? যদি তোমাকে আমি এখানে সারাজীবনও বসে থাকতে হয় তুমি এখানে থাকবে৷ থাকতেই হবে।’ আমি মৃদু হাসি। সে অবাক হয়, ‘হাসছো কেন? হাসির কী বলেছি আমি?’ আমি কিছু বলি না চুপ থাকি। সে বলে, ‘চুপচাপ বসে থাকো। যা বলছি শোনো৷’ আমি তার কথা শুনি, ‘আমার গুপ্তচরের কাজ কর্ম এতো দ্রুত নয়। সে সব তথ্য দেরিতে হয়৷ মূলত তথ্য জোগারে তার দেরি হয়ে যায়৷ সেদিন সে হঠাৎ জানালো আমার লেখক চিত্রাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়েছে৷ আমার মাথায় বাড়ি পড়ে যেন৷ আচমকা আমি পাগলের মতো হয়ে যাই৷ মেয়েটা সেদিনই তো প্রপোজ করলো৷ এতো দ্রুত তাদের রেস্টুরেন্টে যাওয়ার কী ঘটলো? আর লেখক কীভাবে গেল তার সাথে? ওই মূহুর্তে আমি একদম দিশেহারা হয়ে যাই৷ হন্তদন্ত হয়ে বাসা থেকে বের হই৷ লেখককে বার বার ফোন দেই৷
সে ফোন ধরে ন৷ হঠাৎ ফোন রিসিভ হয়৷ আমি কিছু বলার আগে ওপাশ থেকে চিত্রার স্বর শোনা যায়৷ আমি এতো রেগে যাই যে রাস্তার মাঝে আমার চিৎকার দিতে ইচ্ছে হয়৷ ইচ্ছে হয় কাউকে খুন করে ফেলি। রাগে গা’টা জ্বলে যায়৷ রেস্টুরেন্টে তাদের দু’জনকে এক সাথে দেখে আমি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারাই নিজের উপর। ফল স্বরূপ লেখকের সাথে আমার সাময়িক বিচ্ছেদ হয়৷ আমার তীব্র রাগ আমাকে পাগল করে দিয়েছিল। যার দরুণ আমি লেখককে চড়ও মারি। সেই অপরাধবোধ আজ আমায় ভীষণ ভোগায়৷ কান্না পায়৷ দুটো দিন আমার উন্মাদের মতো কাটে। পাগল পাগল লাগে৷ তৃতীয় দিন গুপ্তচর খবর পাঠায়, চিত্রার সাথে আসলে লেখকের কোনো সম্পর্ক নেই৷ লেখক তাকে কেবল বোঝানোর জন্যেই রেস্টুরেন্টে ডেকে নেয়৷ কথা বলে সব মিটমাট করতে চায়৷ এই খবরটা পাওয়ার পর আমি সম্পূর্ণরূপে হতাশ হই৷ আমার লেখকের উপর আমি কীভাবে এমন অন্যায় করতে পারি তা ভেবে কান্না পায় আমার।
নিজের বোকামির জন্যে রাতভর কাঁদি৷ অদ্ভুত এক কষ্ট আমায় পাগল করে তোলে। অপরাধবোধ আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়৷ এই যে আমাকে দেখছো না, আজ পুরো রাত ঘুমাইনি আমি। ঘুম আসে না। চোখ বুঁজে ঘুম আনতে যেন ভুলে গিয়েছি লেখক। ভোর হওয়ার আগেই ইচ্ছে হলো সাজবো। লেখকের কথা অনুযায়ী সাজবো৷ শিউলি তলায় গিয়ে চুপচাপ বসে থাকবো৷ তারপর পুরোটা সময় জুড়ে প্ল্যান করবো কীভাবে লেখকের কাছে ক্ষমা চাওয়া যায়৷ কিন্তু এখানে আসার সময়ই মনে হলো তুমি আশেপাশেই আছো৷ একটু পর কাছে আসবে। এমনটা কেন মনে হলো জানি না৷ তবে মনে হলো। আমি এখানে এসে বসতেই তুমি এলে। আমি অবাক হই৷ কী করবো ভেবে পাই না৷ হঠাৎ ইচ্ছে করে রাগ দেখাই। ভাবি তোমাকে এখন কোনো ভাবে তাড়িয়ে দেবো৷ তারপর আয়োজন করে ক্ষমা চাইবো।
অথচ তা হলো কই? তুমি তো নাছোড়বান্দা। লেগেই থাকলে। শেষে এমন ভাবে আমার দিকে তাকালে, এমন ভাবে কথা বলতে থাকলে যে আমার এক মূহুর্তের জন্যে মনে হলো তুমি আজ এখান থেকে চলে গেলে তোমাকে আর পাবো না আমি। একদম হারিয়ে ফেলবো৷ আমি ভয় পেয়ে যাই। বুকের ভেতর ধক করে উঠে। এক দলা কষ্ট এসে জমাট বাঁধে বুকের কাছে৷ কী করবো ভেবে পাই না৷ দ্রুত মন খারাপ হয় আমার। কিছু না ভেবেই শেষমেশ আমি তার কাছে পাঁচ মিনিট চাই৷ এবং পাঁচ মিনিটের কথা বলে দশ মিনিট কথা বলি।’ এতটুকু কথা বল্ব মিহিন থামে। নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে একমনে। আমি অবাক ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকি৷ কী অদ্ভুত মেয়ে। মনের ভেতর তার কতো কথা, কতো টান। অথচ প্রথমে এমন রাগ দেখালো যে আমি নিজেও বেশ ঘাবড়ে যাই৷
মিহিন চুপচাপ থাকে। মাথা তুলে তাকায় না৷ আমি এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকি৷ কিছু সময় পর সে ধীরে ধীরে মাথা উঠায়৷ একটু তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়৷ লজ্জাময় হাসি হাসে৷ কেমন কোমল স্বরে বলে, ‘এভাবে তাকিয়ে থেকো না। আমার লজ্জা লাগে৷’ সে হাসে৷ আমি তাকিয়ে থাকি তার দিকে। সে আমার একটু কাছে সরে আসে। আমাদের দূরত্ব কমে যায়৷ সে বলে, ‘আমাকে তো তাকাতে দাও৷ তুমি এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমি তাকাতে পারি না।’ আমি চুপচাপ থাকি। তার পাশে আরেকটু সরে বসে। সে আরেকটু কাছে এসে আমার সাথে মিশে যায়৷ অনেকক্ষন পর আমার চোখে চোখ রাখে৷ আমি খুব কাছ থেকে, খুব কাছ থেকে তার কাজল দেখি৷ কাজল কালো চোখ দেখি। কী মায়া! কী ভীষন মায়া এই চোখ দুটিতে৷ আমি মুগ্ধ হই৷ ভীষণ মুগ্ধ হই। সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার চোখে মায়া করে৷ ঘোর ধরায়৷ আমি ঘোর ধরা দৃষ্টিতে তাকে দেখি। সে কাছে আসে৷ আমাকে টেনে নেয়৷ তার নিশ্বাসের উত্তপ্ততা অনুভব করি আমি৷ সে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে, ‘কোন গালটায় চড় মেরেছিলাম হু?’
আমি অবাক হয়ে তাকে দেখি। কী বলব ভেবে পাই না৷ কেবল তাকে ডান গালটা দেখিয়ে দেই৷ সে তার মুখটা আমার গালের কাছে নিয়ে আসে। ডান হাত দিয়ে আমার গাল স্পর্শ করে প্রথমে। তার হাতের শীতল স্পর্শে কেঁপে উঠি আমি। আমার চোখ যেন আপনা আপনি বন্ধ হয়ে আসে৷ সে আলতো করে আমার গালে চুমু খায়৷ তারপর তার ঠোঁট সেখান থেকে টেনে এসে আমার ঠোঁটের ভাঁজে রাখে। আমি শিউরে উঠি। গা কেঁপে উঠে আমার। অদ্ভুত, অদ্ভুত আনন্দঘন এক অনুভূতি! মিহিন চট করেই আমায় জড়িয়ে ধরে। আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
‘সরি৷ এক্সট্রিমলি সরি লেখক।’ আমি মৃদু হাসি৷ কিছু বলি না৷ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখি কেবল। সেদিন পর, সেদিন ঝগড়ার পর, আজ আমি অনেকটা নিশ্চিত এবং প্রান্তবন্ত অনুভব করি৷ প্রশান্তি অনুভব করি৷ এমন প্রশান্তি হয়তো আর কোথাও নেই৷ কোথাও নেই৷
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত